শ্লোকঃ ১০

রজস্তমশ্চাভিভূয় সত্ত্বং ভবতি ভারত ৷

রজঃ সত্ত্বং তমশ্চৈব তমঃ সত্ত্বং রজস্তথা ॥ ১০॥

রজঃ—রজোগুণ; তমঃ— তমোগুণকে, চ—ও; অভিভূয়-পরাভূত করে; সত্বম্— সত্ত্বগুণ; ভবতি— —প্রবল হয়; ভারত – হে ভারত; রজঃ রজোগুণ, সত্ত্বম্—সত্ত্বগুণ। তমঃ— তমোগুণকে, চ—ও; এব—এভাবেই; তমঃ— তমোগুণ: সত্ত্বম্–সত্ত্বগুণ; রজঃ—রজোগুণকে, তথা — সেভাবেই।

গীতার গান

রজোগুণ পরাজয়ে সত্ত্বের প্রাধান্য।

সত্ত্বতম পরাজয়ে রজ হয় গণ্য ৷৷

রজো সত্ত্ব পরাজয়ে তমের প্রাধান্য।

সেই সে পর্যায় হয় গুণের সামান্য ॥

অনুবাদঃ হে ভারত ! রজ ও তমোগুণকে পরাভূত করে সত্ত্বগুণ প্রবল হয়, সত্ত্ব ও তমোগুণকে পরাভূত করে রজোগুণ প্রবল হয় এবং সেভাবেই সত্ত্ব ও রজোগুণকে পরাভূত করে তমোগুণ প্রবল হয়।

তাৎপর্যঃ যখন রজোগুণের প্রাধান্য হয়, তখন সত্ত্ব ও তমোগুণ পরাভূত হয়। সত্ত্বগুণের যখন প্রাধান্য হয়, তখন তম ও রজোগুণ পরাভূত হয়। আর যখন তমোগুণের প্রাধান্য হয়, তখন রজ ও সত্ত্বগুণ পরাভূত হয়। এই প্রতিযোগিতা সব সময়ে চলছে। তাই, যিনি কৃষ্ণভাবনার পথে উন্নতি সাধন করতে সংকল্পবদ্ধ, তাঁকে এই তিনটি গুণই অতিক্রম করতে হবে। মানুষের আচরণে, তার কার্যকলাপে, আহার- বিহার আদিতে কোন না কোন গুণের প্রাধান্য লক্ষিত হয়। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে সেই সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করা হবে। কিন্তু কেউ যদি ইচ্ছা করেন, তা হলে তিনি অনুশীলনের মাধ্যমে সত্ত্বগুণকে বিকশিত করে রক্ত ও তমোগুণকে পরাভূত করতে পারেন। তেমনই, আবার রজোগুণ বিকশিত করে সত্ত্ব ও তমোগুণকে পরাভূত করা যায় অথবা তমোগুণকে বিকশিত করে সত্ত্ব ও রজোগুণকে পরাভূত করা যায়। যদিও প্রকৃতিতে এই তিনটি গুণ রয়েছে, তবুও কেউ যদি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হন, তা হলে তিনি সত্ত্বগুণের দ্বারা আশীর্বাদপুষ্ট হতে পারেন এবং সেই সত্ত্বগুণকে অতিক্রম করে শুদ্ধ সত্ত্বে অধিষ্ঠিত হতে পারেন, যাকে বলা হয় বাসুদেব স্থিতি, অর্থাৎ যে অবস্থায় ভগবৎ-তত্ত্ব উপলব্ধি করা যায়। বিশেষ বিশেষ আচরণ প্রকাশের মাধ্যমে বুঝতে পারা যায় কোন মানুষ কোন্ গুণে অধিষ্ঠিত।

শ্লোকঃ ১১

সর্বদ্বারেষু দেহেঽস্মিন্ প্রকাশ উপজায়তে ৷

জ্ঞানং যদা তদা বিদ্যাদ বিবৃদ্ধং সত্ত্বমিত্যুত ॥ ১১॥

সর্বদ্বারেষু — সব কয়টি দ্বারে; দেহে অস্মিন্ — এই দেহে প্রকাশঃ— প্রকাশ, উপজায়তে—উৎপন্ন হয়; জ্ঞানম্—জ্ঞান; যদা—যখন, তদা—তখন; বিদ্যাৎ- জানবে; বিবৃদ্ধম্—বর্ণিত হয়েছে; সত্ত্বম্—সত্ত্বগুণ, ইতি – এভাবে, উত—বলা হয়।

গীতার গান

জ্ঞানের প্রভাবে যদা শরীরে প্রকাশ ৷

সকল ইন্দ্রিয়দ্বারে সত্ত্বগুণের বিকাশ ॥

অনুবাদঃ যখন এই দেহের সব কয়টি দ্বারে জ্ঞানের প্রকাশ হয়, তখন সত্ত্বগুণ বর্ধিত হয়েছে বলে জানবে।

তাৎপর্যঃ দেহে নয়টি দ্বার রয়েছে—দুটি চক্ষু, দুটি কর্ণ, দুটি নাসারন্ধ্র, মুখ, উপস্থ ও পায়ু। যখন প্রতিটি দ্বারে সত্ত্বগুণের বিকাশ হয়, তখন বুঝতে হবে যে, সেই মানুষ সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হলে যথাযথভাবে দর্শন করা যায়, যথাযথভাবে শ্রবণ করা যায় এবং যথাযথভাবে স্বাদ গ্রহণ করা যায়। মানুষ তখন অন্তরে ও বাইরে নির্মল হন। প্রতিটি দ্বারেই তখন সুখের লক্ষণ প্রকাশিত হয় এবং সেটিই হচ্ছে সাত্ত্বিক অবস্থা।

শ্লোকঃ ১২

লোভঃ প্রবৃত্তিরারম্ভঃ কর্মণামশমঃ স্পৃহা ৷

রজস্যেতানি জায়ন্তে বিবৃদ্ধে ভরতর্ষভ || ১২ ||

লোভঃ—লোভ; প্রবৃত্তিঃ – প্রবৃত্তি; আরম্ভঃ — উদ্যম, কর্মণাম্ — কর্মসমূহে অশমঃ—দুর্দমনীয়; স্পৃহা — বাসনা; রজসি — রজোগুণ, এতানি—এই সমস্ত, জায়ন্তে—উৎপন্ন হয়; বিবৃদ্ধে—বর্ধিত হলে; ভরত ভ— হে ভরত বংশশ্রেষ্ঠ।

গীতার গান

লোকপূজা প্রতিষ্ঠাদি কর্মের আকাঙ্ক্ষা ৷

রজোগুণে বৃদ্ধি হয় নাহি অন্যাপেক্ষা ॥

অনুবাদঃ হে ভরতশ্রেষ্ঠ ! রজোগুণ বর্ধিত হলে লোভ, প্রবৃত্তি, কর্মে উদ্যম ও দুর্দমনীয় স্পৃহা বৃদ্ধি পায়।

তাৎপর্যঃ রজোগুণ-সম্পন্ন মানুষ যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, তিনি কখনই সন্তুষ্ট হতে পারেন না। তিনি সর্বদাই তাঁর অবস্থার উন্নতি সাধন করবার আকাঙ্ক্ষা করেন। যখন তিনি কোন গৃহ নির্মাণ করেন, তখন তিনি একটি প্রাসাদোপম গৃহ নির্মাণ করার চেষ্টা করেন, যেন তিনি চিরকাল সেই বাড়িতেই থাকতে পারবেন। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের ব্যাপারে তাঁর প্রচণ্ড আসক্তি জাগে। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের কোন শেষ নেই। তিনি সর্বদাই তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকতে, তাঁর বাড়িতে বাস করতে এবং চিরকাল ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করতে চান। তাঁর এই কামনা-বাসনার কখনই নিবৃত্তি হয় না। এই সমস্ত লক্ষণগুলি রজোগুণের বৈশিষ্ট্য বলে বুঝতে হবে।

error: Content is protected !!