শ্লোকঃ ৭

রজো রাগাত্মকং বিদ্ধি তৃষ্ণাসঙ্গসমুদ্ভবম্ ।

তন্নিবধ্নাতি কৌন্তেয় কর্মসঙ্গেন দেহিনম্ ॥ ৭ ॥

রজঃ—রজোগুণ; রাগাত্মকম্—বাসনা অথবা অনুরাগাত্মক; বিদ্ধি—জানবে; তৃষ্ণা- আকাঙ্ক্ষা, সঙ্গ আসক্তি জনিত; সমুদ্ভবম্ — উৎপন্ন; তৎ-তা, নিম্নাতি — আবদ্ধ করে; কৌন্তেয়—হে কুন্তীপুত্র: কর্মসঙ্গেন—সকাম কর্মের আসক্তির দ্বারা দেহিনম্—জীবকে।

গীতার গান

রজোগুণ তৃষ্ণাময় শুধু ভোগ চায় ৷

আজীবন কর্ম করি করে হায় হায় ।।

কর্ম করে যত পারে বদ্ধ তাতে হয় ।

অসম্ভব কর্ম চেষ্টা সুখে দুঃখে রয় ।।

অনুবাদঃ হে কৌন্তেয় ! রজোগুণ অনুরাগাত্মক এবং তা তৃষ্ণা ও আসক্তি থেকে উৎপন্ন বলে জানবে এবং সেই রজোগুণই জীবকে সকাম কর্মের আসক্তির দ্বারা আবদ্ধ করে।

তাৎপর্যঃ রজোগুণের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ। পুরুষের প্রতি স্ত্রী আকৃষ্ট হয় এবং স্ত্রীর প্রতি পুরুষ আকৃষ্ট হয়। তাকে বলা হয় রজোগুণ। মানুষের মধ্যে যখন রজোগুণ বর্ধিত হয়, তখন তার জাগতিক সুখভোগের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। সে তখন ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করতে চায়। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার জন্য রজোগুণে অধিষ্ঠিত মানুষ সমাজে অথবা জাতিতে প্রতিষ্ঠা কামনা করে এবং স্ত্রী- পুত্র-গৃহ সমন্বিত একটি সুখী পরিবার কামনা করে। এগুলি হচ্ছে রজোগুণের প্রভাব। মানুষ যখন এই সব আকাঙ্ক্ষা করে, তখন তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। তাই এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, মানুষ তার কর্মফলের প্রতি আসত হয়ে পড়ে এবং তার ফলে এই ধরনের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তার স্ত্রী, পুত্র ও সমাজকে সন্তুষ্ট করার জন্য এবং তার সম্মান বজায় রাখার জন্য তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। সুতরাং, সমস্ত জড় জগৎটিই প্রায় রজোগুণে অধিষ্ঠিত। আধুনিক সভ্যতাকে রজোগুণের পরিপ্রেক্ষিতেই উন্নত বলে গণ্য করা হয়। পুরাকালে সত্ত্বগুণের পরিপ্রেক্ষিতে উন্নতির মান নির্ণয় করা হত। যাঁরা সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত, তাঁরাই যদি মুক্তি লাভ করতে না পারেন, তা হলে যারা রজোগুণের বন্ধনে আবন্ধ, তাদের কি অবস্থা?

শ্লোকঃ ৮

তমস্ত্বজ্ঞানজং বিদ্ধি মোহনং সর্বদেহিনাম্ ।

প্রমাদালস্যনিদ্রাভিস্তন্নিবধ্নাতি ভারত ।। ৮ ।।

তমঃ— তমোগুণ, তু— কিন্তু; অজ্ঞানজম্—অজ্ঞানজাত; বিদ্ধি — জানবে; মোহনম্ মোহনকারী; সর্বদেহিনাম্ — সমস্ত জীবের; প্রমাদ — প্রমাদ; আলস্য – আলস্য; নিদ্রাভিঃ— নিদ্রার দ্বারা, তৎ–তা, নিবধ্নাতি —আবদ্ধ করে; ভারত – হে ভারত।

গীতার গান

তমো সে অজ্ঞানরূপ নিগূঢ় বন্ধন ।

প্রমাদ আলস্য নিদ্রা তাহার মোহন ।।

অনুবাদঃ হে ভারত ! অজ্ঞানজাত তমোগুণকে সমস্ত জীবের মোহনকারী বলে জানবে সেই তমোগুণ প্রমাদ, আলস্য ও নিদ্রার দ্বারা জীবকে আবদ্ধ করে।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে সংস্কৃত তু শব্দটির প্রয়োগ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর অর্থ হচ্ছে যে, তমোগুণ দেহধারী আত্মার অতি অদ্ভুত একটি গুণ। এই তমোগুণ হচ্ছে সত্ত্বগুণের সম্পূর্ণ বিপরীত। সত্ত্বগুণে জ্ঞান অনুশীলনের ফলে জানতে পারা যায় কোটি কি, কিন্তু তমোগুণ হচ্ছে ঠিক তার বিপরীত। তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন সকলেই উন্মাদ এবং যে উন্মাদ সে বুঝতে পারে না কোনটি কি। উন্নতি সাধন করার পরিবর্তে সে অধঃপতিত হয়। বৈদিক শাস্ত্রে তমোগুণের বর্ণনা করে বলা হয়েছে, বস্তুযথাত্মাজ্ঞানাবরকং বিপর্যয়জ্ঞানজনকং তমঃ তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে বস্তুর স্বরূপ নির্ধারণ করতে পারা যায় না। যেমন সকলেই জানে যে, তার পিতামহ মারা গেছেন এবং তাই সেও একদিন মারা যাবে, কারণ মানুষ মরণশীল। তার গর্ভজাত সন্তান-সন্ততিরাও একদিন মারা যাবে। সুতরাং সকলেরই মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু তবুও মানুষ তার সনাতন আত্মাকে উপেক্ষা করে উন্মাদের মতো দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে ধন-সম্পদ সঞ্চয় করে চলেছে। এটিই হচ্ছে উন্মত্ততা। তাদের এই উন্মত্ততার ফলে তারা পারমার্থিক উন্নতি সাধনের প্রতি অত্যন্ত নিস্পৃহ। এই ধরনের মানুষ অত্যন্ত অলস। পারমার্থিক জ্ঞান লাভের জন্য যখন তাদের সাধুসঙ্গ করতে আহ্বান করা হয়, তখন তারা ভাতে খুব একটা উৎসাহী হয় না। তারা এমন কি রজোগুণের দ্বারা পরিচালিত মানুষদের মতোও ততটা সক্রিয় নয়। এভাবেই তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন মানুষদের আর একটি লক্ষণ হচ্ছে যে, তারা যতটা প্রয়োজন তার থেকে বেশি ঘুমায়। ছয় ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট, কিন্তু তমোগুণে আচ্ছন্ন যে মানুষ, সে কম করে দশ থেকে বারো ঘণ্টা ঘুমায়।

এই ধরনের মানুষ সর্বদাই বিষাদগ্রস্ত হয়ে থাকে এবং তারা মাদকদ্রব্য ও নিদ্রার প্রতি অত্যন্ত আসক্ত। এগুলি হচ্ছে তমোগুণের দ্বারা আবদ্ধ মানুষের লক্ষণ।

শ্লোকঃ ৯

সত্ত্বং সুখে সঞ্জয়তি রজঃ কর্মণি ভারত ৷

জ্ঞানমাবৃত্য তু তমঃ প্রমাদে সঞ্জয়ত্যুত ॥ ৯॥

সত্ত্বম্—সত্ত্বগুণ; সুখে— সুখে, সঞ্জয়তি – আবদ্ধ করে; রজঃ— রজোগুণ: কর্মণি— সকাম কর্মে; ভারত—হে ভারত; জ্ঞানম্ — জ্ঞান; আবৃতা – আবৃত করে; তু—কিন্তু তমঃ—তমোগুণ: প্রমাদে — প্রমাদে; সঞ্জয়তি — আবদ্ধ করে; উত্ত—বলা হয়।

গীতার গান

সত্ত্বগুণ সুখে বাঁধে রজোগুণ কাজে।

তমোগুণ প্রমাদেতে বন্ধনে বিরাজে ॥

অনুবাদঃ হে ভারত ! সত্ত্বগুণ জীবকে সুখে আবদ্ধ করে, রজোগুণ জীবকে সকাম কর্মে আবদ্ধ করে এবং তমোগুণ প্রমাদে আবদ্ধ করে।

তাৎপর্যঃ যে মানুষ সাত্ত্বিক, তিনি দার্শনিক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক আদিরূপে কর্ম বা জ্ঞানের কোন বিশেষ শাখায় নিযুক্ত থেকে, তাঁর বুদ্ধিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সন্তুষ্টি লাভ করেন। রজোগুণের দ্বারা প্রভাবিত সকাম কর্মে লিপ্ত মানুষ যতটা সম্ভব সম্পদ আহরণ করেন এবং সৎকার্যে অর্থ ব্যয় করেন। তিনি কখনও কখনও হাসপাতাল খোলবার চেষ্টা করেন এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান আদিতে দান করেন। এগুলি হচ্ছে রজোগুণের লক্ষণ। আর তমোগুণ জ্ঞানকে আচ্ছাদিত করে রাখে। তমোগুণে যাই করা হোক না কেন, তাতে মানুষের নিজের মঙ্গল হয় না এবং অন্যদেরও মঙ্গল হয় না।

error: Content is protected !!