শ্লোকঃ ৪
সর্বযোনিষু কৌন্তেয় মূর্তয় সম্ভবস্তিযাঃ।
তাসাং ব্রহ্ম মহদযোনিরহং বীজপ্রদঃ পিতা ॥ ৪ ॥
সর্বযোনিষু—সকল যোনিতে; কৌন্তেয়—হে কুত্তীপুত্র; মূর্তয়ঃ—মূর্তিসমূহ; সম্ভবন্তি—উৎপন্ন হয়; যাঃ— যে সমস্ত, তাসাম – তাদের সকলের; ব্রহ্ম — ব্রহ্মা ; মহৎ যোনিঃ — মহৎ-তত্বরূপী যোনি, অহম্ — আমি; বীজপ্রদঃ — বীজ প্রদানকারী; পিতা—পিতা।
গীতার গান
অতএব সর্বযোনি যত মূর্তি ধরে ৷
হে কৌন্তেয় জান তাহা আমার আধারে ।।
ব্রহ্ম মহত্তত্ত্ব হয় সবার জননী ।
আমি বীজপ্রদ পিতা জগৎ সরণী ।।
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়! সকল যোনিতে যে সমস্ত মূর্তি প্রকাশিত হয়, , ব্রহ্মরূপী যোনিই তাদের জননী স্বরূপা এবং আমি তাদের বীজ প্রদানকারী পিতা।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সমস্ত জীবের পরম পিতা। জীব হচ্ছে জড়া প্রকৃতি ও পরা প্রকৃতির সমন্বয়। এই ধরনের জীব কেবল এই গ্রহেই দৃষ্ট হয় না, অন্যান্য গ্রহে, এমন কি সর্বোচ্চ ব্রহ্মলোকেও জীব আছে। জীবাত্মা সর্বত্রই রয়েছে। মাটির নীচেও জীব রয়েছে, এমন কি জলে এবং আগুনেও জীব রয়েছে। এই সমস্ত প্রকাশ সম্ভব হয়েছে, তার কারণ হচ্ছে যে, মাতৃরূপী জড়া প্রকৃতিতে শ্রীকৃষ্ণ বীজ প্রদান করেছেন। এর সারমর্ম হচ্ছে যে, পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে জীবাত্মাকে জড় জগতের গর্ভে সঞ্চারিত করা হয় এবং সৃষ্টির সময়ে তারা বিভিন্ন মূর্তিতে প্রকাশিত হয়।
শ্লোকঃ ৫
সত্ত্বং রজস্তম ইতি গুণাঃ প্রকৃতিসম্ভবাঃ ।
নিবধ্নন্তি মহাবাহো দেহে দেহিনমব্যয়ম্ ॥ ৫ ॥
সত্ত্বম্—সত্ত্ব; রজঃ—রজ; তমঃ – তম, ইডি–এই, গুণাঃ— গুণসমূহঃ প্রকৃতি— জড়া প্রকৃতি, সম্ভবাঃ— জাত, নিবন্ধন্তি — আবদ্ধ করে; মহাবাহো – হে মহাবীর; দেহে—এই শরীরে; দেহিনম্—জীবকে, অব্যয়ম্ — নিত্য।
গীতার গান
সত্ত্ব, রজো, তম, গুণ প্রকৃতিসম্ভব ৷
ত্রিগুণেতে বদ্ধ জীব হয়ে যায় সব ৷৷
এই দেহ সে বন্ধন নিগূঢ় আকার ।
জীব অব্যয় সে বন্ধ যে প্রকার ॥
অনুবাদঃ হে মহাবাহো। জড়া প্রকৃতি থেকে জাত সত্ত্ব, রজ ও তম—এই তিনটি গুণ এই দেহের মধ্যে অবস্থিত অব্যয় জীবকে আবদ্ধ করে।
তাৎপর্যঃ জীবাত্মা যেহেতু চিন্ময়, তাই জড়া প্রকৃতির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তবুও জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ার ফলে সে জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা কবলিত হয়ে কর্ম করছে। জীব যেহেতু তাদের বিভিন্ন প্রকৃতি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন দেহ প্রাপ্ত হয়, তাই তাদের সেই প্রকৃতি অনুসারে তারা সেই কর্ম করতে বাধ্য হয়। নানা রকম সুখ ও দুঃখের সেটিই হচ্ছে কারণ।
শ্লোকঃ ৬
তত্র সত্ত্বং নির্মলত্বাৎ প্রকাশকমনাময়ম্ ।
সুখসঙ্গেন বধ্নাতি জ্ঞানসঙ্গেন চানঘ ॥ ৬ ॥
তত্ত্ব—সেই গুণসমূহের মধ্যে সত্ত্বম্—সত্ত্বগুণ, নির্মলত্বাৎ— জড় জগতে সবচেয়ে নির্মল হওয়ার ফলে; প্রকাশকম্ — প্রকাশকারী; অনাময়ম্ — পাপশূন্য; সুখ-সুখ ; সঙ্গেন সঙ্গের দ্বারা; বধ্নাতি আবদ্ধ করে; জ্ঞান—জ্ঞান; সঙ্গেন—সঙ্গের দ্বারা; ঢ— ও; অনঘ – হে নিষ্পাপ ।
গীতার গান
তার মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল আধার ৷
পাপশূন্য প্রকাশক তত্ত্ব সে আত্মার ॥
জ্ঞানচর্চা করি সত্ত্বে বন্ধন তাহার ।
সেই শুদ্ধ সঙ্গ মানে শ্রেষ্ঠ চমৎকার ॥
অনুবাদঃ হে নিষ্পাপ। এই তিনটি গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল হওয়ার ফলে প্রকাশকারী ও পাপশূন্য এবং সুখ ও ভ্রানের সঙ্গের দ্বারা জীবকে আবদ্ধ করে।
তাৎপর্যঃ জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ জীব নানা রকমের। তার মধ্যে কেউ সুখী, কেউ আবার খুব কর্মচঞ্চল এবং কেউ আবার অসহায়। প্রকৃতিতে জীবদের বক্ষনদশার কারণ হচ্ছে এই সমস্ত মানসিক অভিপ্রকাশ। তারা যে কিভাবে ভিন্ন ভিন্নভাবে আবদ্ধ হয়, তা ভগবদ্গীতার এই অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমেই হচ্ছে সত্ত্বগুণ। জড় জগতে সত্ত্বগুণের বিকাশ সাধনের পরিণতি হচ্ছে যে, তিনি অন্য গুণের দ্বারা প্রভাবিত জীবদের থেকে অধিক জ্ঞানসম্পন্ন হন। যে মানুষ সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত, তিনি জড় জগতের দুঃখকষ্ট দ্বারা ততটা প্রভাবিত হন না এবং তিনি জড়-জাগতিক জ্ঞান আহরণ করতে উৎসুক। এই ধরনের মানুষ হচ্ছেন ‘ব্রাহ্মণ’, যাঁর সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই স্তরের আনন্দানুভূতির কারণ হচ্ছে, সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত জীব সাধারণত পাপকর্ম থেকে অনেকটা মুক্ত থাকেন। প্রকৃতপক্ষে, বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সত্ত্বগুণের অর্থ হচ্ছে উন্নত জ্ঞান এবং অধিকতর সুখানুভুতি।
এখানে অসুবিধা হচ্ছে এই যে, জীব যখন সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হন, তখন তিনি মোহাচ্ছন্ন হয়ে মনে করেন যে, তিনি খুব জ্ঞানী এবং অন্যদের থেকে শ্রেয়। এভাবেই তিনি জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। সেই সম্বন্ধে সবচেয়ে ভাল দৃষ্টান্ত হচ্ছে বিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরা। তাঁরা নিজেদের জ্ঞানের গর্বে মত্ত এবং যেহেতু তাঁরা সাধারণত তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে তোলেন, তাই তাঁরা এক ধরনের জড় সুখ অনুভব করেন। বন্ধ জীবনের এই উন্নত সুখানুভূতি তাঁদের জড়া প্রকৃতির সত্ত্বগুণের বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলে। সেই হেতু, তাঁরা সত্ত্বগুণে কর্ম করার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এভাবেই কর্ম করার দিকে তাঁদের আকর্ষণ থাকে, ততক্ষণ তাদের প্রকৃতির গুণজাত কোন একটি জড় দেহ ধারণ করতেই হয়। তাই, মুক্তি লাভ করে চিৎ-জগতে প্রবেশ করবার কোন সম্ভাবনাই তাঁদের নেই। তাঁরা হয়ত দার্শনিক, বিজ্ঞানী বা কবি হয়ে বারবার জন্মাতে পারেন, তবু জন্ম-মৃত্যুর ক্লেশদায়ক বন্ধনে তাঁদের বারবার আবর্তিত হতে হয়। কিন্তু জড়া প্রকৃতির মোহে আচ্ছন্ন হয়ে তাঁরা মনে করেন যে, সেই ধরনের জীবনযাত্রা সুখদায়ক।