চতুর্দশ অধ্যায়
গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
শ্লোকঃ ১
শ্রীভগবানুবাচ
পরং ভূয়ঃ প্রবক্ষ্যামি জ্ঞানানাং জ্ঞানমুত্তমম্ ।
যজ্ঞাত্বা মুনয়ঃ সর্বে পরাং সিদ্ধিমিতো গতাঃ ॥ ১॥
শ্রীভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন; পরম্ অপ্রাকৃত; ভূয়ঃ- পুনরায়: প্রবক্ষ্যামি —আমি বলব; জ্ঞানানাম্ — সমস্ত জ্ঞানের মধ্যে; জ্ঞানম্—জ্ঞান; উত্তমন্— শ্রেষ্ঠ, যৎ – যা, তাত্বা – জেনে, মুনয়ঃ——মুনিগণ, সর্বে— সমস্ত পরা পরম সিদ্ধিম্—সিদ্ধি; ইতঃ—এই জগৎ থেকে; গতাঃ— লাভ করেছিলেন।
গীতার গান
শ্রীভগবান কহিলেনঃ
আবার পরম জ্ঞান বলিব তোমারে ।
জ্ঞানচর্চা যত আছে উত্তম সবারে ।।
যে জ্ঞানেতে মুনি জ্ঞানী হইয়া সর্বত ৷
পূর্ব ইতিহাস ছিল সিদ্ধি পারঙ্গত ।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন— পুনরায় আমি তোমাকে সমস্ত জ্ঞানের মধ্যে সর্বোত্তম জ্ঞান সম্বন্ধে বলব, যা জেনে মুনিগণ এই জড় জগৎ থেকে পরম সিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
তাৎপর্যঃ সপ্তম অধ্যায় থেকে শুরু করে দ্বাদশ অধ্যায় পর্যন্ত পরমতত্ত্ব বা পরম পুরুষোত্তম ভগবান সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণ বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। এখানে ভগবান স্বয়ং অর্জুনকে ভগবৎ-তত্ত্ব সম্বন্ধে আরও জ্ঞান দান করছেন। দার্শনিক অনুমানের মাধ্যমে কেউ যদি এই অধ্যায়ের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেন, তা হলে তিনি ভগবদ্ভক্তির মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। ত্রয়োদশ অধ্যায়ে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, বিনীতভাবে জ্ঞান আহরণ করার মাধ্যমে জড় জগতের বন্ধন থেকে যুক্ত হওয়া যেতে পারে। আরও বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, জড়া প্রকৃতির গুণের সাথে সঙ্গ করার ফলে জীবাত্মা জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এখন এই অধ্যায়ে ভগবান বর্ণনা করছেন, প্রকৃতির সেই গুণগুলি কি, তারা কিভাবে ক্রিয়া করে, তারা কিভাবে জীবকে বন্ধনে আবদ্ধ করে এবং কিভাবে তারা মুক্তি দান করে। এই অধ্যায়ে প্রদত্ত জ্ঞানকে পূর্ববর্তী সমস্ত অধ্যায়ে প্রদত্ত জ্ঞান থেকে শ্রেয় বলে পরমেশ্বর ভগবান ঘোষণা করছেন। এই জ্ঞান উপলব্ধি করার মাধ্যমে বহু মহর্ষি সিদ্ধি লাভ করে চিৎ-জগতে প্রবেশ করেছেন। ভগবান এখন সেই জ্ঞানই আরও ভালভাবে ব্যাখ্যা করে শোনাচ্ছেন। অন্যান্য যে সমস্ত জ্ঞানের পন্থা তিনি এ পর্যন্ত ব্যাখ্যা করেছেন, তা থেকে এই জ্ঞান অনেক অনেক গুণে শ্রেয় এবং এই জ্ঞান লাভ করে অনেকেই সিদ্ধি লাভ করেছেন। সুতরাং আশা করা যায় যে, এই চতুর্দশ অধ্যায়ে বর্ণিত তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধি করতে পারলে মানুষ পূর্ণতা প্রাপ্ত হতে পারবে।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন— পুনরায় আমি তোমাকে সমস্ত জ্ঞানের মধ্যে সর্বোত্তম জ্ঞান সম্বন্ধে বলব, যা জেনে মুনিগণ এই জড় জগৎ থেকে পরম সিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
তাৎপর্যঃ সপ্তম অধ্যায় থেকে শুরু করে দ্বাদশ অধ্যায় পর্যন্ত পরমতত্ত্ব বা পরম পুরুষোত্তম ভগবান সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণ বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। এখানে ভগবান স্বয়ং অর্জুনকে ভগবৎ-তত্ত্ব সম্বন্ধে আরও জ্ঞান দান করছেন। দার্শনিক অনুমানের মাধ্যমে কেউ যদি এই অধ্যায়ের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেন, তা হলে তিনি ভগবদ্ভক্তির মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। ত্রয়োদশ অধ্যায়ে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, বিনীতভাবে জ্ঞান আহরণ করার মাধ্যমে জড় জগতের বন্ধন থেকে যুক্ত হওয়া যেতে পারে। আরও বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, জড়া প্রকৃতির গুণের সাথে সঙ্গ করার ফলে জীবাত্মা জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এখন এই অধ্যায়ে ভগবান বর্ণনা করছেন, প্রকৃতির সেই গুণগুলি কি, তারা কিভাবে ক্রিয়া করে, তারা কিভাবে জীবকে বন্ধনে আবদ্ধ করে এবং কিভাবে তারা মুক্তি দান করে। এই অধ্যায়ে প্রদত্ত জ্ঞানকে পূর্ববর্তী সমস্ত অধ্যায়ে প্রদত্ত জ্ঞান থেকে শ্রেয় বলে পরমেশ্বর ভগবান ঘোষণা করছেন। এই জ্ঞান উপলব্ধি করার মাধ্যমে বহু মহর্ষি সিদ্ধি লাভ করে চিৎ-জগতে প্রবেশ করেছেন। ভগবান এখন সেই জ্ঞানই আরও ভালভাবে ব্যাখ্যা করে শোনাচ্ছেন। অন্যান্য যে সমস্ত জ্ঞানের পন্থা তিনি এ পর্যন্ত ব্যাখ্যা করেছেন, তা থেকে এই জ্ঞান অনেক অনেক গুণে শ্রেয় এবং এই জ্ঞান লাভ করে অনেকেই সিদ্ধি লাভ করেছেন। সুতরাং আশা করা যায় যে, এই চতুর্দশ অধ্যায়ে বর্ণিত তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধি করতে পারলে মানুষ পূর্ণতা প্রাপ্ত হতে পারবে।
শ্লোকঃ ২
ইদং জ্ঞানমুপাশ্রিত্য মম সাধর্ম্যমাগতাঃ ।
সর্গেঽপি নোপজায়ন্তে প্রলয়ে ন ব্যথন্তি চ ॥ ২॥
ইদম্—এই; জ্ঞানম্—জ্ঞান; উপাশ্রিত্য — আশ্রয় গ্রহণ করে; মম—আমার; সাধর্মাম্—একই প্রকৃতি; আগতাঃ – লাভ করে, সর্গে অপি— সৃষ্টিকালেও; ন–না; উপজায়ন্তে—জন্মগ্রহণ করে; প্রনয়ে প্রলয় কালে; ন–না; ব্যথন্তি— ব্যথিত হয়; চ—ও।
গীতার গান
এই জ্ঞান লাভ করি নির্গুণ জ্ঞানেতে ।
অবস্থিত হয় লোক নিৰ্গুণ আমাতে ।৷
তাহার না হয় জন্ম পুনঃ সৃষ্টির সময় ৷
কিংবা দুঃখ নাই তার যখন প্রলয় ৷।
অনুবাদঃ এই জ্ঞান আশ্রয় করলে জীব আমার পরা প্রকৃতি লাভ করে। তখন আর সে সৃষ্টির সময়ে জন্মগ্রহণ করে না এবং প্রলয়কালেও ব্যথিত হয় না।
তাৎপর্যঃ পূর্ণরূপে দিব্যজ্ঞান লাভ করতে পারলে জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হয়ে গুণগতভাবে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সঙ্গে একাত্মতা লাভ করা যায়। কিন্তু তাই বলে জীবাত্মা তখন তার ব্যক্তিগত সত্তা হারিয়ে ফেলে না। বৈদিক শাস্ত্ৰ থেকে জানতে পারা যায় যে, মুক্ত জীবাত্মারা যাঁরা চিদাকাশে বৈকুণ্ঠলোকে ফিরে গেছেন, তাঁরা সর্বদাই পরমেশ্বর ভগবানের ভক্তিযুক্ত সেবায় নিযুক্ত হয়ে তাঁর শ্রীচরণ- কমল দর্শন করেন। সুতরাং, মুক্তির পরেও ভগবত্তক্তেরা তাঁদের ব্যক্তিগত সত্তা হারিয়ে ফেলেন না ।
সাধারণত, এই জড় জগতে আমরা যে জ্ঞান আহরণ করি, তা জড় জগতের তিনটি গুণের দ্বারা কলুষিত। কিন্তু যে জ্ঞান প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা কলুষিত নয়, তাকে বলা হয় দিব্যজ্ঞান। কেউ যখন সেই দিব্যজ্ঞানে অধিষ্ঠিত হন, তিনি তখন পরমেশ্বর ভগবানের সমপর্যায়ভুক্ত হন। চিদাকাশ সম্বন্ধে যাদের কোন জ্ঞান নেই, তারা মনে করে যে, জড় রূপের দ্বারা সম্পাদিত জাগতিক কার্যকলাপ থেকে মুক্ত হওয়ার পরে চিন্ময় সত্তা সব রকম বৈচিত্র্যহীন নিরাকার হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চিহ্ন-জগৎও জড় জগতের মতো বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। যারা এই সম্বন্ধে অজ্ঞ, তারাই মনে করে যে, চিন্ময় অস্তিত্ব জড় বৈচিত্রের ঠিক বিপরীত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চিন্ময় ভগবৎ-বামে প্রবেশ করলে জীব তার চিন্ময় রূপ প্রাপ্ত হয়। সেখানে তার সমস্ত কার্যকলাপ হয়ে ওঠে চিন্তায়। এই চিনায় অবস্থাকে বলা হয় ভক্তজীবন। চিৎ-জগতের পরিবেশ সম্বন্ধে বলা হয় যে, তা সমস্ত কলুষমুক্ত এবং সেখানে সকলেই গুণগতভাবে পরমেশ্বর ভগবানের সমপর্যায়ভুক্ত। এই প্রকার জ্ঞান আহরণ করতে হলে অবশ্যই দিব্য গুণাবলীতে বিভূষিত হতে হবে। এভাবেই যিনি তাঁর দিব্য গুণাবলীর বিকাশ সাধন করেন, তিনি এই জড় জগতের সৃষ্টি অথবা বিনাশ কোনটির দ্বারাই প্রভাবিত হন না।
শ্লোকঃ ৩
মম যোনির্মহদ্ ব্রহ্ম তস্মিন্ গর্ভং দধাম্যহম্ ৷
সম্ভবঃ সর্বভূতানাং ততো ভবতি ভারত ৷। ৩ ।।
মম – আমার যোনিঃ —গর্ভাধানের স্থান; মহৎ—সমগ্ৰ জড় প্রকাশ; ব্রহ্ম—ব্রহ্ম; তস্মিন্ – তাতে; গর্ভম—সৃষ্টির বীজ; দধামি — অর্পণ করি, অহম্ – আমি; সম্ভবঃ—উৎপত্তি; সর্বভূতানাম্ — সমস্ত জীবের, ততঃ – তা থেকে; ভবতি – হয়; ভারত—হে ভারত।
গীতার গান
জগতের মাতৃযোনি জড়া মহত্তত্ত্ব ৷
সেই ব্রহ্মে গর্ভাধান করি সে মহত্ত্ব ॥
হে ভারত তাই জন্মে সর্বভূত যত ৷
জগতের ভূত সৃষ্টি হয় সেই মত ৷৷
অনুবাদঃ হে ভারত ! প্রকৃতি সংজ্ঞক ব্রহ্ম আমার যোনিস্বরূপ এবং সেই ব্রহ্মে আমি গর্ভাধান করি, যার ফলে সমস্ত জীবের জন্ম হয়।
তাৎপর্যঃ জড় জগৎ সম্বন্ধে একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে— ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ বা দেহ ও আত্মার সমন্বয়ের ফলেই সব কিছু ঘটছে। জড়া প্রকৃতি ও জীবাত্মার সমন্বয় ভগবানের ইচ্ছার প্রভাবেই সাধিত হয়। মহৎ-তত্ত্বই হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের মূল কারণ, এবং যেহেতু জড় প্রকাশের মূল উপাদানে রয়েছে প্রকৃতির তিনটি গুণ, তাই তাকে কখনও কখনও ব্রহ্ম বলা হয়। পরমেশ্বর ভগবান মহৎ-তত্বকে গর্ভবর্তী করেন এবং তার ফলে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ডের প্রকাশ হয়। বৈদিক শাস্ত্রে (মুণ্ডক উপনিষদ ১/১/৯) এই মহৎ-তত্ত্বকে ব্রহ্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে— তস্মাদেতদ ব্ৰহ্ম নামরূপমরং চ জায়তে। পরম পুরুষ সেই ব্রহ্মের গর্ভে জীবাত্মাসমূহকে সঞ্চারিত করেন। মাটি, জল, অগ্নি, বায়ু আদি চব্বিশটি উপাদানের সব করটি হচ্ছে মহদ্ ব্রহ্ম নামক জড়া প্রকৃতি। সপ্তম অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে, এই জড়া প্রকৃতির ঊর্ধ্বে রয়েছে পরা প্রকৃতি বা জীবভূত। পরম পুরুষ ভগবানের ইচ্ছার প্রভাবে জড়া প্রকৃতিতে পরা প্রকৃতি মিশ্রিত হয়েছে এবং তাই এই জড়া প্রকৃতিতে সমস্ত জীবের জন্ম হয়েছে।
কাঁকড়াবিছে চালের গাদায় ডিম পাড়ে, তাই অনেক সময় বলা হয় যে, চাল থেকে কাঁকড়াবিছের জন্ম হয়। কিন্তু চাল থেকে কখনই কাঁকড়াবিছের জন্ম হয় না। প্রকৃতপক্ষে মা বিছা সেই ডিমগুলি পেড়েছিল। তেমনই, জড়া প্রকৃতি জীবের জন্মের কারণ নয়। পরম পুরুষ ভগবান বীজ প্রদান করেন এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যেন জড়া প্রকৃতি থেকে সমস্ত জীব উদ্ভূত হল। এভাবেই প্রতিটি জীব তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে জড়া প্রকৃতির দ্বারা সৃষ্ট ভিন্ন ভিন্ন দেহ প্রাপ্ত হয়, যাতে তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে সেই জীব সুখ অথবা দুঃখ ভোগ করতে পারে। এই জড় জগতে সমস্ত জীবের প্রকাশের কারণ হচ্ছেন ভগবান।