১৩২০/২১ সালের কথা। বয়স আমার তখন ১৩-১৪ বছর। বাড়িতে সোনার কর্মকার ছিলেন মধুসুদন ও তাঁর ছেলে রসিক চন্দ্র। রসিক সুর করে রামায়ন পড়ত, আমি পড়তে পারতাম না, তবে কাছে বসে মনোযোগ দিয়ে রাম-রাবনের কাহিনী শোনতাম। শোনতাম যে, রাবণ রাক্ষক জাতি, ওঁরা মানুষ ভক্ষন করে রাবনের দশটি মাথা, বিশটি চক্ষু, বিশ খানা হাত ইত্যাদি। কোথায় লঙ্কা আর কোথায় রাবণ এবং কোন যুগের কাহিনী কোন যুগে শোনা; সে সব হিসাব করতাম না, শুনে শুধু ভয় করত। কাহিনীটা কয়েক যুগের পুরোনো বা বাসি হলেও ভয়টা হত একদম তাজা। কল্পনার চক্ষে যেন দেখতাম রাবণকে, আর মনে হত সে যেন কাছে পেলে আমাকেও খাবে।

আবার ভাবতাম রাক্ষসরা মানুষ খায়। তাই তারা মানুষের কাছে রাক্ষস। কিন্তু মানুষেও তো গরু খায়, মোষ খায়, কোন কোন দেশে নাকি ঘোড়াও খায়। ওদের রক্ত, মাংস ইত্যাদি মানুষের মতই এবং আকারে ও শক্তিতে ওরা মানুষের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তবে এদের ভক্ষন করে “মানুষ রাক্ষস নয়” কেন? রাবণ তাঁর জীবনে কয়টি মানুষ ভক্ষণ করেছিল এবং কোন দেশের কাকে ভক্ষণ করেছিল, রামায়নে কবি তা একবারও বলেন নাই। পশু, পাখী, মৎস্য ভক্ষন করেও “মানুষ রাক্ষস নয়” কেন?

আমি মনে মনে “রাক্ষস” নামের একটা সংজ্ঞা দিলাম। রাক্ষসরা মানুষ ভক্ষণ করে, তাই তারা মানুষের কাছে “রাক্ষস”। অনুরূপ- হরিণের কাছে বাঘ “রাক্ষস”, ইঁদুরের কাছে বিড়াল “রাক্ষস”। অর্থাৎ জীবে জীবে ভক্ষন করাটাই রাক্ষসীপনা। অধিকন্তু মানুষ যত রকম জীব ভক্ষন করে, অন্য কোন জীবই তত রকম জীব ভক্ষন করে না। সুতরাং মানুষই সবের চেয়ে বড় রাক্ষস। সিদ্ধান্ত করলাম- “আমি রাক্ষস হব না।“

মাছ-মাংসের প্রতি আমার লোভ ছিল না এর আগেও, ছিল ঘৃণা। কেননা তখন আমি মনে করতাম যে, শশা, পেপে, টম্যাটো ইত্যাদি লোকে রান্না না করে কাঁচাও খেয়ে থাকে। লাউ, কুমড়া, সীম, বরবটি ইত্যাদি তরকারি গুলো কাঁচাও ভক্ষন করা যায়। কেননা উহা কাঁচা ভক্ষন করলে বা মুখে দিয়ে চিবুলে ঘৃণার উদ্রেক হয় না। কিন্তু এক টুকরা কাঁচা মাছ বা মাংস ঐ রূপ কেউ ভক্ষন বা চর্বণ করতে পারে না, করতে গেলে তার বমন না হয়ে যায় না। কেননা কাঁচা মাছ বা মাংস একান্তই অখাদ্য, অত্যন্ত ঘৃণার বস্তু। মানুষ তার ঐ ঘৃণাটা দূর করার চেষ্টা করে মাছ-মাংস রান্না করে। হলুদ-মরিচ দিয়ে রং ও ঝাল করে, পেইজ-রোসনাদি দিয়ে দুর্গন্ধ নষ্ট করে, তৈল-লবণ দিয়ে স্বাদ বৃদ্ধি করে এবং তাপ দিয়ে কমল করে মাত্র। কিন্তু মূল বস্তুটি যা, তাই থেকে যায় নতুবা সাপ, কুঁচে, ইদুর-বাঁদর ও বিড়াল-কুকুরের মাংস রান্না করে খাওয়া হয় না কেন?

ঐ সমস্ত ভেবে ভেবে আমি আমিষ ভোজন পরিত্যাগ করে নিরামিষ ভোজের সংকল্প করলাম এবং ধীরে ধীরে উহা কার্যকর করতে সচেষ্ট হলাম। কিন্তু মা-বোনের আদরের জ্বালায় সহসা আমিষ ছাড়তে পারলাম না। তবে পুরোপুরি নিরামিষ ভোজী হয়ে গেলাম আমি স্বয়ং সংসারী হবার পর (১৩২৯)।

১৩৫৫ সালের ভাদ্র মাসে চারু চন্দ্র ভট্টাচার্য প্রণীত “জগদীশ চন্দ্রের আবিষ্কার” নামকি পুস্তক খানা আমার হাতে এলো। ওতে দেখলাম যে, মানুষ, পশু, পাখী ইত্যাদির সহিত গাছ পালার জীবন ও জীবনানুভূতির বিশেষ কোন পার্থক্য নাই। এমন কি দৈহিক গঠনেও না। প্রাণীর বিশেষতঃ মানুষের ন্যায় উহাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, জড়া-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, বেদনার অনুভূতি আছে। এমন কি শ্রবনানুভূতিও আছে। তবে সে অনুভূতি ব্যক্ত নয়, অব্যক্ত। প্রাণীদের মতই- উহাদের হৃৎপিণ্ড, শ্বাস যন্ত্র, পাকযন্ত্র, পেশি, স্নায়ু ইত্যাদি সবই আছে। সুতরাং উদ্ভিদরাও প্রাণী মনে করা যেতে পারে যে, প্রাণীরা-সচল ও সবাক, উদ্ভিদরা অচল ও নির্বাক কিন্তু উহাই বা সম্পূর্ণ সত্য কোথায়। মানুষ এক স্থানে বসে বা দাঁড়িয়ে শুধু হস্ত সঞ্চালন পূর্বক বহু কাজ সমাধা করে থাকে। তদ্রুপ পদ সঞ্চালন না করেও উদ্ভিদরা শুরু অঙ্গ চালনা দ্বারা অনেক আবশ্যকীয় কাজ সেরে নিয়ে থাকে। মূল এক জায়গায় ঠিক রেখেও উদ্ভিদ তার শাখা-প্রশাখা ও শিকড়-উপশিকড় গুলো এদিক সেদিক পাঠিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করে। এবং চলার পথে বাধা পেলে মানুষের মতই পথ বদলায়। উদ্ভিদেরও ভাষা আছে। উহা শাব্দিক নয়, ইঙ্গিত পূর্ণ এবং উহা বোঝাবার মত আমাদের অনুভূতি নেই। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু উহা ক্রেস্কোগ্রাফ, রেজোনান্ট রেকর্ডার ইত্যাদি যন্ত্রের সাহায্যে উদ্ভিদকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, উদ্ভিদের ভাষা আছে।

এ সমস্ত জেনে শুনে আমার এত দিনের পোষা ছেলে বেলার কল্পনার গায়ে আঘাত লাগল। “প্রাণ” থাকলেও “প্রাণীদের মত উদ্ভিদের অনুভূতি নাই”, ইহাই ছিল আমার তখনকার ধারণা। তাই, নিঃসঙ্কোচে উদ্ভিদদের হত্যা করা নিরামিষ ভোজন করেছি এবং সহানুভূতি দেখিয়েছি প্রাণীদের। আর এখন দেখতে পাচ্ছি যে, আমিষ বা নিরামিষ-ভোজন, উভয়তঃই সমান জীব হত্যা।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x