সময় ২০০২ সাল। খবরটা দিয়েছিল সুদীপ চক্রবর্তী। যুক্তিবাদী সমিতির উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক। হাবড়া পারপাটনা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে একটা খেজুর গাছের তলার মাটি খেতে নাকি প্রতিদিন কয়েক হাজার করে মানুষ আসছেন। শনি-মঙ্গলে ভিড় থাকে ব্যাপক। মাটি খেলে নাকি যেকোন অসুখ সারে, তা সে ক্যানসার হোক, কি এইডস।
প্রাথমিক সত্যানুসন্ধানের দায়িত্ব দিলাম সদীপকে। পলাশ ও টিটু দুই যুক্তিবাদীকে নিয়ে সুদীপ অনুসন্ধান চালালেন। মছলন্দপুরের এক এক টি ডি বুথের মালিক তাপস রায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। অনেক তথ্য জানালেন খেজুরতলা ও বুড়ি মা’র বিষয়ে। সুদীপ জানালেন, এখন প্রত্যেকদিন ভক্ত সমাগম হচ্ছে অন্তত ১৫ হাজার। শনি-মঙ্গলে ভিড়টা ৩০-৪০ হাজারে পৌঁছেছে। খেজুর তলায় বুড়ি মা’র থানে পুজো দিয়ে বুড়ি মা’র দেখা পাওয়া ব্রজেন ব্রক্ষ্মার ছোঁয়া মাটি খেলেই শুধু অসুখ নয়, সব সমস্যা-ই মিটে যায়। বুড়ি মা আসলে ব্যাঘ্র বাঘিনী দুর্গা, নাকি বনবিবি –এই নিয়ে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ইতিমধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে।
সবশুনে ঠিক করলাম, ‘খোঁজ খবর’ –এর সঙ্গে কাজটা করব। সুদীপকে আমার পরিকল্পনাটা জানিয়ে বললাম ৪ জুন মঙ্গলবার সকাল ৮টার মধ্যে হাবড়ার ২ নম্বর রেল গেঁটে পৌঁছে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে একটা কাজ সেরে ফেললাম। বেলঘরিয়ার আশিস মণ্ডল আশৈব তোতলা। আশিককে নিয়ে গেলাম নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি পরীক্ষা করে নিজের ছাপান প্যাডে লিখেছিলেন বর্তমানে ওর তোতলা হবার কারণ জিভ ও আলজিভের বিশেষ গঠন বৈশিষ্ট্য। বৈশিষ্ট্যের কারণ লিখে দিলেন।
দমদমে আমার ফ্ল্যাটে খোঁজখবর –এর গাড়ি এলো সকাল ৬টায়। সঙ্গে ফটোগ্রাফার দেবজ্যোতি ও আশিস। সকাল ৮টায় হাবড়া ২ নম্বর রেল গেটে পৌঁছে গেলাম। আমাদের জন্য সঙ্গীদের নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সুদীপ। সুদীপকে গাড়িতে তুললাম। ওঁর বান্ধবীদের বললাম, আমাদের অপরিচিত হিসেবে আমাদের কাছাকাছি থেকে খেজুর তলার দিকে এগোতে। কোন সিচুয়েশনে কি করতে হবে তাও বোঝালাম। এখান থেকে ভ্যান রিকশা, সাইকেল আর অটোর বিশাল ভিড়। বাস, ট্রেকার, মোটরগাড়ি ও মোটর বাইকেরও দেখা মিলছে মাঝে-মাঝেই। ওদের গন্তব্যস্থল কুমড়ো কাশীপুরের মোড়।
হাওড়া-মগরা রোড ধরে ভিড় ঠেলে এগোলাম। এসে পৌঁছলাম কুমড়ো কাশীর মোড়ে। এখান থেকে সবাই ঢুকবে পিচ রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তা ধরে। মোড়ের পাশে গাড়ি দাঁড় করালাম। দেবজ্যোতিকে বললাম ‘বুম’ থেকে (যেটা বাগিয়ে ধরে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়) ‘খোঁজখবর’ –এর ‘লোগো’টা খুলে নিতে। এখন থেকে আমাদের প্রত্যেককে ভুলে যেতে হবে – খোঁজখবরের হয়ে ছবি তোলা হচ্ছে।আমি আমার দেবজ্যোতি ছাড়া সুদীপ আমাদের টিভি টিমের সঙ্গী হিসেবে পরিচয় দেবেন। তাপস রায় তিন সঙ্গী ও এক সঙ্গিনী এবং মা, বউদি-কে নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন ওখানে। তাঁদের প্রত্যেকের করণীয় বুঝিয়ে দিলাম।
মোড়ের ভিড় সামলাচ্ছে গাদাগুচ্ছের ভলেন্টিয়ার। ২৫-৩০ জন কিশোর থেকে যুবক ফেরি করছে খেজুর তলার বুড়ি মা’র পাঁচালী। ২০-২৫ জন লেখকের লেখা পাঁচালিগুলোর দাম ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮ থেকে ১৬। খেজুর তলার হাতে আঁকা ছবির ছাপানো কপি বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা, সবের-ই দেদার বিক্রি। চা-বিস্কুট-ওমলেট-পরোটা-ঘুগনি-আলুরদমের দোকানগুলোয় গিজগিজ করছে ভিড়। খেজুর তলার কল্যাণে ওদের শ্রী ফিরেছে।
দেবজ্যোতি কিছুক্ষণ ছবি তুলল। আমাদের গাড়ি এগোলো কাঁচা রাস্তা ধরে। কাঁচা রাস্তায় দু-চার দিন হল রাবিশ পড়েছে। হাজারে হাজারে মানুষ চলেছেন ভারতীনগর কলোনি। সেখান থেকে জলা পেরিয়ে যেতে হবে পারপাটনা গ্রামের খেজুরতলায়। খেজুর তলায় কৃপায় বহু নতুন অটো পথে নেমেছে। অত্যন্ত ধীর গতিতে এগোচ্ছি। আগে-পিছে হেঁটে, ভ্যান রিকশায়, অটোয়, সাইকেলে, বাইকে করে ভক্তরা চলেছেন। হাজারে হাজারে মানুষ ফিরছেনও। ভ্যান রিকশায় পঙ্গু, অশক্ত, শায়িত রোগী-রোগিণী বেশি। ওদের অনেকেই দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলী, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগনা এমনকি বাংলাদেশের খুলনা থেকে। রাত কাটিয়েছেন হাবড়া স্টেশনে অথবা যশোর রোডের পাশে গজিয়ে ওঠা বুড়িমার যাত্রীনিবাসে। যাত্রীদের শতকরা ৯০ ভাগ-ই অত্যন্ত গরিব ও শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া মানুষ।
রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। পঞ্চায়েতের ব্যবস্থাপনায় যাত্রীদের সুবিধার জন্য বহু মজুর খাটছেন মাটির পথকে রাবিশ ঢেলে গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত করতে।
দু কিলোমিটার গিয়ে আমাদের গাড়ি থামাতে হল। ভ্যান রিকশা থেকে মটর বাইক –সবার যাত্রাপথ এখানেই শেষ। জায়গাটার নাম ভারতীনগর কলোনি। দু’দিন আগের অজ গাঁ, আশ্চর্য জাদুতে জমজমাট। গাড়ি জমা রাখতে হচ্ছে কলোনির কুঁড়েঘরের সামনে। টাকা আদায় করছেন বাড়ির মেয়ে-বউরা। দক্ষিণা সাইকেল থেকে গাড়ি –এক টাকা থেকে পাঁচ টাকা। রাতারাতি প্রচুর দোকান গজিয়ে উঠেছে। দোকানে পাওয়া যাচ্ছে চা, বিস্কুট, ওমলেট, মুড়ি, ঘুগনি, ফুল-বাতাসা-ধূপ-বুড়িমা’র পাঁচালি, ছোটদের খেলনা বেলুন, পান-বিড়ি-সিগারেট ইত্যাদি।
আর কয়েক পা এগোলেই বিস্তীর্ণ জলাভূমি। জলাভূমি পার হয়ে আবার তিন কিলোমিটারের মতো হাঁটলে খেজুরতলা, বুড়িমা’র থান। জলা পার হতে হয়েছে সাঁকো ও নৌকো। সাঁকোয় পার হতে এক টাকা টিকিট। নৌকোয় দু’টাকা।
ভারতীনগর কলোনিতে আমরা পা দিতেই খেজুরতলা মন্দির কমিটির নেতারা ও স্বেচ্ছাসেবকরা আমাদের গাড়ি ঘিরে ধরলেন। কোন টিভি কোম্পানির হয়ে আসছি, কিভাবে বিষয়টা দেখাতে চাই ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন তাঁদের। মন্দির কমিটির কেউই ‘কাচ্চা খিলাড়ি’ নন। তাঁরা রাজনীতি করেন। সি পি এম থেকে তৃণমূল –সবার শান্তিপূর্ণ সহবস্থান। মাইক ফুঁকে ভক্তদের উদ্দেশ্যে জানানো হচ্ছে –কোন অসুবিধা হলে তাঁরা মন্দির কমিটির অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন। বাঁশের খুটির উপর টিনের চাল ও রঙ্গিন কাপড়ে ঘেরা মন্দির কমিটির অফিস, মন্দির কমিটির অনুরোধে আমাদের চা ওমলেট খেতে হল। আমাদের উপর নজর রাখার জন্য তিনজন স্বেচ্ছাসেবী দিয়ে দিলেন। ওই তিনজন এখন গাইড।
নৌকোয় উঠলাম আমরা। যাত্রী আরও অনেকেই। গাইডদের কল্যাণে আমরা বিনে পয়সার সওয়ার। লগি ঠেলে মিনিট পনেরো জল কেটে আমরা পারে পৌঁছলাম। ডাঙ্গায় নামতেই জুতো সমেত পা আধ-হাঁটু জলের তলায়। আলঅথ আর ধানক্ষেত মিলে-মিশে একাকার লক্ষ মানুষের দাপাদাপিতে। চ্যাট-চ্যাটে কাদা ভেঙ্গে পতন সামলাতে সামলাতে এগোচ্ছি আমরা। হাজারে-হাজারে কাতারে-কাতারে মানুষের মহা মিছিল। একদল যাচ্ছেন। একদল ফিরছেন। দূরে দেখা যাচ্ছে সাঁকো পথে পিঁপড়ের সারির মতো মহামিছিল। এঁটেল মাটি থেকে পা তুলে তুলে পতন সামলাতে সামলাতে এগোনোর চেষ্টা আমাদের মত অনভিজ্ঞ শহরবাসীদের কাছে যে কি কষ্টকর –তা হাড়ে হারে টের পাচ্ছিলাম। তিন কিলোমিটার পথ পেরুতে আমাদের প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লাগল।
একটা লম্বা খেজুর গাছ ঘিরে বিশাল এলাকা জুড়ে উঁচু টিনের শেড গড়ে উঠেছে। খেজুর গাছটার বৈশিষ্ট্য, সাধারণ খেজুর গাছের তুলনায় অনেক বেশি লম্বা। উচ্চতায় ৪০-৪৫ ফুট হবে। আমাদের দেশের মানুষ অসাধারণ অনেক কিছুতেই দেবত্ব আরোপ করেন। যেমন জোড়া মানুষ, বাড়তি পা ওয়ালা গরু ইত্যাদি। তেমন-ই ব্যাপার ঘটেছে খেজুরের এই গাছের বেলায়। তবে এমন লম্বা বা এর চেয়ে লম্বা খেজুর গাছ আমার যাযাবর জীবনে এর আগেও কয়েকবার দেখেছি।
খেজুর তলার গায়েই মানিক পীরের মাজার। এই মাজার-ই বলতে গেলে এখন বুড়িমার থানে রূপান্তরিত হয়েছে।
যখন পৌঁছলাম, তখন খেজুর গাছ পুজো হচ্ছে। গাছ ঘিরে নতুন টিনের বিশাল হল গড়ে উঠেছে। গাছের তলায় ঘট পাতা। ঘটের উপর প্রচুর শাড়ি। খেজুর গাছেও প্রচুর শাড়ি জড়ানো। ঢাকের বাদ্যি, কাসর ঘণ্টার আওয়াজ, ধুনোর ধোঁয়া ও গন্ধ হাজার ভক্তের ভিড়। পুরোহিত ব্রজেন ব্রক্ষ্ম। তাঁকে ঘিরে একগাদা নারী-পুরুষ। এঁরা পুরোহিতের সাহায্যকারী। এঁরা হাতে হাতে মাটির তাল এনে দিচ্ছেন ব্রজেন ব্রক্ষ্মের কাছে। ব্রজেন ব্রক্ষ্ম মাটির তাল খেজুর গাছে ছুঁইয়ে আবার ফিরিয়ে দিচ্ছেন। তাল হাতে হাতে ফিরে এসে ছোট ছোট নাড়ু বাঁ মোয়ার সাইজ হয়ে ভক্তদের হাতে যাচ্ছে। অনেকে ওখানেই পরম ভক্তির সঙ্গে কপ-কপ করে কামড়ে মাটি খেয়ে নিচ্ছেন। সে এক বড় অদ্ভূত গণউন্মাদনা। মন্দির কমিটির এজেন্টরা গোটা দশেক মাইকে ঘোষণা করে চলেছেন, আপনারা যারা খেজুর তলার অলৌকিক মাটি সংগ্রহ করেছেন, তাঁরা বেরিয়ে আসুন এবং বাইরে অপেক্ষারত হাজার হাজার ভক্তদের ঢোকবার সুযোগ করে দিন। টিনের শেডের তলায় অন্তত ৫০জন স্বেচ্ছাসেবী। তাঁরা ভিতরের ভক্তদের বের করে দিয়ে বাইরের মানুষদের ঢুকতে সাহায্য করছেন। থেকে থেকে স্লোগান উঠছে ‘জয় খেজুরতলার জয়’, ‘জয় বুড়িমা’র জয়’। স্লোগান দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। সুর মেলাচ্ছেন ভেতর-বাইরের হাজার হাজার ভক্ত। গণহিস্টিরিয়ার সব প্রকরণই তৈরি।
মাইকে যিনি ঘোষণা করছিলেন তাঁকে অনুরোধ করলাম, সাক্ষাৎকার নেবো ব্রজেন ব্রক্ষ্মের, এই সময় ঢাক-কাঁসর আর জয়ধ্বনি যেন বন্ধ থাকে। মাইকে ঘোষণা কর হল –কলকাতা থেকে টিভি টিম এসেছে। তাঁরা ব্রজনে ব্রক্ষ্মের ইন্টারভিউ নেবেন। তাই ঢাক ও কাঁসর বাজানো বন্ধ রাখতে অনুরোধ করছি।
ব্রজেন ব্রক্ষ্ম ওরফে ব্রজেন ব্রক্ষ্মচারী স্বাস্থ্যবান লম্বায় ৫ ফুট ১০ থেকে ১১ ইঞ্চির মধ্যে। গায়ের রং কালো। পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি, খালি গা। সাক্ষাৎ দিলেন। শোনালেন বুড়ি মা’কে পাওয়ার কাহিনী।
শিক্ষার সুযোগ মেলেনি। পেশা –আশেপাশের গাঁ থেকে ডিম কিনে হাবড়া বাজারে বিক্রি করা। থাকেন মাঠপাড়ায়। ওপার বাংলার ছিন্নমূল উদ্বাস্তু। গুছিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত।
জানালেন, মাসখানেকও হয়নি; গত ৮ জ্যৈষ্ঠ দুপুর বেলার ঘটনা। ডিমের ঝুড়ি নিয়ে খেজুরতলা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠা-ঠা রোদ্দুর। হঠাৎ পেটে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হল। ডিমের ঝুড়ি নামিয়ে পেটে চেপে কাতরাতে থাকেন। ঠিক সেই সময় ওখানে আবির্ভূতা হলেন অসাধারণ সুন্দরী এক বৃদ্ধা। পরনে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। গোটা শরীর থেকে সূর্যরশ্মির মতো তেজ বেরুচ্ছে। বুড়ি মা বললেন, ভক্তই আর বিশ্বাস নিয়ে এই খেজুরতলার মাটি খাঁ, তোর ব্যথা সেরে যাবে।
খেতে সত্যিই মুহূর্তে ব্যথা সেরে গেল। বুড়ি মা-কে গড় হয়ে প্রণাম করলেন ব্রজেন ব্রক্ষ্ম। মা বললেন, “বাবা ব্রজেন, তুই এই কথা প্রচার কর, যে ব্যক্তি ভক্তি ও বিশ্বাস নিয়ে খেজুরতলার মাটি খাবে, বুড়ি মা’র কৃপায় সে যে কোন রোগ থেকে মুক্ত হবে।“
ব্রজেন ব্রক্ষ্ম তারপর পারপাটনা গ্রামের কয়েকজনকে ঘটনার কথা বলেন। গ্রামের কার্তিক পাড়ুই, মাধব হাজরা আরো কিছু যুবকের নেতৃত্বে খেজুর পাশের আশে-পাশের জঙ্গল কেটে বুড়ি মা’র থান তৈরি করে। মায়ের কৃপায় দেখতে দেখতে এখন প্রত্যেকদিন হাজার তিরিশেকের মতো লোক হচ্ছে। শনি-মঙ্গলবার ৪০-৫০ হাজার। ভক্তি ও বিশ্বাস নিয়ে এই খেজুর তলার মাটি খেয়ে এইডস রোগী, ক্যানসার রোগীও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে। যে কোন সমস্যা নিয়ে-ই আসুন, অলৌকিক মাটির গুণে সব সমস্যার-ই সমাধান হবে।
আশিস মণ্ডলকে এগিয়ে দিয়ে জানালাম, বেচারা তোতলা। ওকে মাটি খাইয়ে সারিয়ে তুলতে পারলে আমরা হাতে গরম প্রমাণ পেয়ে যাই।
ব্রজেনবাবু আশিসকে মাটি খাওয়ালেন। সে’সব ছবিও ডিজিটাল ক্যামেরায় তুললেন দেবজ্যোতি।
জিজ্ঞেস করলাম, মানিক পীরের মাজারকে আপনারা বুড়িমা’র থান বানিয়ে স্রেফ ব্যবসা করছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় মুসলিম ধর্মের মানুষরা। এখানে বনবিবির পুজো করতেন স্থানীয় মানুষরা। বনবিবিকে আপনারা বুড়ি মা বানিয়ে টাকা কামাচ্ছেন, লোক ঠকাচ্ছেন বলে ওঁদের অভিযোগ। আপনি কি বলেন?
ব্রজেন ব্রক্ষ্ম এমন বেয়াড়া প্রশ্নের জন্য বোধহয় তৈরি ছিলেন না। তারপর হঠাৎ করে ক্ষোভ উগরে দিলেন মন্দির কমিটির উপর। বললেন, যা প্রণামী পড়ে, ছবি, সাঁকো, নৌকো থেকে যা রোজগার হয়, সবই নিয়ে নেয় মন্দির কমিটি। ব্রজেন ব্রক্ষ্ম মাসে মাত্র দেড় হাজার টাকা পান। নৌকোর মাঝি থেকে স্বেচ্ছাসেবকরাও মাসে সামান্য টাকা মাইনে পান। এ’সবই দেয় মন্দির কমিটি। খেজুরতলা মন্দির কমিটিতে যারা আছেন তাঁরা-ই মোটা টাকা কামাচ্ছেন। আর তাইতে-ই রাগ গ্রামের মুসলিম মুরুব্বিদের। তাঁদের আসল উদ্দেশ্য, চাপ দিয়ে মন্দির কমিটিতে ঢুকে পড়া। এই জমিটা ইউনিস বিশ্বাসদের। তারাও মন্দির কমিটিতে ঢুকতে চায়, টাকার গন্ধে।
- মন্দির কমিটিতে কারা আছেন?
- আশে-পাশের অঞ্চলের রাজনীতিকরা লোকগুলোই মন্দির কমিটির নেতা হয়ে বসেছেন। আমাকে ভাঙ্গিয়ে খাচ্ছে, হাড়-ভাঙ্গা খাটাচ্ছে, আমাকেই ঠকাচ্ছে। আপনারা একটু দেখুন।
বললাম, ভক্তি আর বিশ্বাস নিয়ে মাটি খেয়ে নিজের সমস্যার সমাধান করছেন না কেন? কেন আমাদের সাহায্য চাইছেন? তার মানে, আপনি নিজে-ই খেজুর তলার মাটির অলৌকিক গূনে বিশ্বাস করেন না!
না। কিছুক্ষণ আমতা-আমতা করলেন। জবাব দিতে পারলেন না।
গেলাম মন্দির কমিটির অফিসে। খেজুরতলা থেকে দশ গজের পথ। নতুন ঢেউখেলানো টিন দিয়ে সদ্য তৈরি একটা হল। কয়েকটা টেবল জোড়া দিয়ে বসানো হয়েছে হলের মাঝে। চার-পাশেই পাতা হয়েছে অনেকগুলো ফোলডিং চেয়ার।
মন্দির কমিটির অনেককেই পেয়ে গেলাম। সভাপতি কালিপদ বিশ্বাস পেশায় সাব-ইন্সপেক্টর অফ স্কুল। যুগলচন্দ্র দাস সম্পাদক। এখানকার প্রভাবশালী সি পি এম রাজনীতিক। সুনীলকুমার বিশ্বাস কোষাধ্যক্ষ। পেশায় উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। ৩৭ জনকে নিয়ে গড়ে উঠেছে মন্দির কমিটি। কমিটিতে সি পি এম, তৃণমূল, কংগ্রেস শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছেন।
আমাদের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন কালিপদ বিশ্বাস, যুগলচন্দ্র দাস, সুনীল বিশ্বাস ও কমিটির সদস্য কার্তিক দাস (স্থানীয় তৃণমূল নেতা)। টি ভি ক্যামেরার সামনে কথা বলতে হবে বুঝে-সমঝে। যেকোন হিজিবিজি লোককে তো আর মুখপাত্র হিসেবে হাজির হতে দেওয়া যায় না। মুখপাত্রদের হিসেব –দৈনিক গড়ে ৩০-৪০ হাজার লোক হচ্ছে। গত শনি-মঙ্গল হয়েছে ৬০ থেকে ৮০ হাজার। প্রণামী পড়ছে দু-পাঁচ টাকা থেদকে হাজার টাকাও। বললাম, তাহলে গড়ে দৈনিক অন্তত লাখ দুয়েক টাকা আয় হচ্ছে? অনিচ্ছায় সে কথা স্বীকার করলেন কোষাধ্যক্ষ। ব্রজেনবাবুর অভিযোগের উত্তরে জানালেন, প্রণামীর টাকা জমা রাখছি মন্দির, ভক্তদের জন্য রাত্রিনিবাস, রাস্তা তৈরির খরচ করব বলে।
কোনও ব্যাঙ্কে নিশ্চয়-ই জমা রাখছেন? জিজ্ঞেস করলাম।
উত্তর না দিয়ে কোনও একটা কাজের কথা হঠাৎ করে মনে পড়ে যাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।
কথায় কথায় খেজুরতলা মন্দির কমিটির মুখপাত্ররা স্বীকার করলেন, (১) কয়েক দিন আগে একটা বিবাদ হয়েছিল। কিছু লোভী মানুষ তাদেরও মন্দির কমিটিতে ঢোকার দাবি তুলে ঘোঁট পাকিয়ে দিল। (২) ঘোঁটটা একটু বড় আকার ধারণ করায় দেগঙ্গা থানাকে খবর দিতে হয়। (৩) থানার অফিসার ইনচার্জ –অরুণকুমার হাজরা নিজে-ই এসেছিলেন। গোলমাল মিটে গেছে। (৪) বুড়িমা আসলে ব্যাঘ্রবাহিনী দুর্গা। স্থানীয় কিছু মুসলিম বদ মতলবে মা দুর্গাকে বনবিবি বলে চালাতে চাইছে। (৫) হ্যাঁ, এই খেজুর তলায় বনবিবির থান ছিল, তো কি হয়েছে? (৬) ডাকাত বাল্মীকি অবতার হয়েছিলেন। আবার ভক্ত রাবণ নারী লোভে সোনার লঙ্কা ছারখার করে দিলেন। ব্রজেন ব্রক্ষ্ম’কে মা দুর্গা দেখা দিলেন, এরপরও লোকটা রাবণের মত-ই লোভি হয়ে উঠছে বলতে হবে –যদি ওর ক্ষোভের কথা সত্যি হয়। (৭) পারপাটনার চাষী লক্ষ্মণ দাস একদিন রাতে জমিতে জলসেচ দিতে এলে দেখেন এক অপূর্ব সুন্দরী বৃদ্ধা বিশাল এক বাঘের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। (৮) ওই গ্রামের-ই আরেক চাষী জগদীশ দাস একদিন রাতে জমিতে জলসেচের জন্য পাম্প চালাতে এলে দেখেন, দুর্গা প্রতিমার মত রূপের এক বৃদ্ধা তিনটে বিশাল বাঘকে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। (৯) তিন বোবার নাম ঠিকানা দিলেন যারা মাটি খেয়ে কথা বলছেন। তাঁরা হলেন (ক) বোধ দাস, দত্তপুকুর, উত্তর ২৪ পরগনা (খ) দীপক ভট্টাচার্য, পারপাটনা, উত্তর ২৪ পরগনা (গ) প্রদ্যুৎ দাস, এ জি কলোনি, হাবড়া। দশ বছর ধরে প্যারালিসিস ছিলেন গাইঘাটার নিখিল দে। মা’ইয়ের অপার কৃপায় স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে শুরু করেছেন মাটি খাওয়ার পরের দিন থেকেই। কুমড়ার (একটা জায়গার নাম) অনিল ঘোষের নাতি থ্যালাসেমিয়া রোগী। মাটি খেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ। ধীরেন গোলদার। নিবাস কুমড়া, উত্তর ২৪ পরগনা। উন্মাদ পাগল। মা’য়ের কৃপায় এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। এমনি মাটি খেয়ে রোগমুক্ত হওয়া মানুষের আরও ঠিকানা ওঁরা দিতে পারেন –যদি আমরা চাই। (১০) গঙ্গানগর থানার ওসি অরুণ হাজরা নিজের মন্দির কমিটির সদস্য।
ভক্তদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, সে তো আগেই বলেছি। কিন্তু তাঁদের কেউই পাসপোর্ট বাঁ ভিসা নিয়ে আসেননি। এসেছেন দালাল ধরে, দু’পারের সীমান্তরক্ষিদের ঘুষ দিয়ে। সে’সব কথাও ক্যামেরার সামনেই ওঁদের অনেকেই বললেন। আরও একটা জরুরি তথ্য জানালেন, দেগঙ্গা থানার যে ক’জন পুলিশ এখানে ডিউটি করেন, তাঁরা নাকি ওদের ভাষা শুনে ঠিক ধরে ফেলেন। তারপর নাকি অবৈধভাবে প্রবেশের জন্য গ্রেফতার করে কোর্টে তোলার নাম করে যার কাছ থেকে যতটা পারেন লুটে নেন।
গঙ্গানগর থানার অফিসার ইনচার্জকে থানায় পেলাম। তাঁকে বে-আইনি অনুপ্রবেশ ও পুলিশি অত্যাচারের কথা জানালাম। এই অনুপ্রবেশকারীদের কেউ যদি পাকিস্তানের গুপ্তচর বাঁ আলকায়দার সদস্য হয়? এত বড় জনসমাবেশে বিস্ফোরণ ঘটায়? তখন আপনার পুলিশকেই আমরা এর জন্য দায়ী করব।
ওসি অরুণকুমার হাজরা কাঁধ থেকে মাছি তাড়াবার মতো করেই বিষয়টা উড়িয়ে দিলেন –ধুর। এমন ঘটনা ঘটতে-ই পারে না। অনুপ্রবেশ ঘটলে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ খবর দিত।
ওসি’র সামনে রেকর্ড করা ক্যাসেট চালু করলেন দেবজ্যোতি। সব দেখেশুনে অরুণবাবু থতমত। শুধু বললেন, এসব জানতাম না। এখন জানলাম। যা ব্যবস্থা নেওয়ার নিচ্ছি। স্বীকার করলেন, বনবিবির থানকে বুড়ি মা’র মন্দির তৈরি করা নিয়ে একটা উত্তেজনা রয়েছে। দিন কয়েক আগে রায়টের মতো একটা পরিস্থিতি হয়েছিল। পুলিশবাহিনী নিয়ে ওখানকার পরিস্থিতি সামলাই। মন্দির কমিটিতে কয়েকজন মুসলিমকেও নিয়েছি। হ্যাঁ মন্দির কমিটিতে আমি আছি।
খেজুরতলার মাটি খেলে যে কোনও অসুখ সেরে যাবে বলে যে প্রচার মন্দির কমিটি চালাচ্ছে, তা সম্পূর্ণ বে-আইনি। ড্রাগ কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট থেকে ড্রাগ লাইসেন্স না নিয়ে এমন অকৌকিক ওষুধ বিক্রির কম করে শাস্তি পাঁচ বছরের জেল। আপনার কি ড্রাগকন্ট্রোল খেজুরতলার মাটি দিয়েছিলেন পরীক্ষা করতে? তাঁরা কি পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, এই মাটিতে যে কোন অসুখ সারাবার ক্ষমতা রয়েছে। তাঁরা কি এই মাটি সব রোগের দাওয়াই হিসেবে রোগীদের হাতে তুলে দেবার জন্য লাইসেন্স দিয়েছেন? (এই আইন বিস্তৃতভাবে জানতে ‘জ্যোতিষীর কফিনে শেষ পেরেক’ পড়তে পারেন)।
আমি জানি না। এ বিষয়ে কিছু জানতে হলে মন্দির কমিটিকে জিজ্ঞেস করুন। বললেন অরুণবাবু।
আপনিও মন্দির কমিটির সদস্য। সুতরাং আপনাকেও এ’সব প্রশ্নের উত্তর জানতে-ই হবে। মাটি খেয়ে অনেকের অসুখ বেড়েছে কি না, খবর নিয়েছেন? বাড়লে বাঁ নতুন অসুখ হলে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে প্রতারণার অভিযোগ আপনাদের বিরুদ্ধে আনা যায়। এ ধরণের গুজব ছড়ানোটা ক্রাইম। আপনি কি বলেন?
মন্দির কমিটি নিয়ে স্থানীয় মানুষদের আরও অভিযোগ আছে। মন্দির কমিটির বিশাল আয়, কিন্তু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। অভিযোগ উঠেছে, প্রণামীর টাকা মন্দির কমিটির নেতারা-ই মেরে দিচ্ছেন। খরচ করছেন ছিটে-ফোঁটা। মন্দির কমিটির একজন হিসেবে অভিযোগের তিরটা আপনার দিকেও আছে।
অপ্রিয় প্রশ্নগুলো শোনার পর অরুণবাবুর মনে পড়ে গেল একটা জরুরি কাজের কথা। বললেন, এক্ষুণি বের হতে হবে। আপনারা বরং আর কিছু জানতে হলে সাব-ইন্সপেক্টর অর্ঘ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলুন। মিস্টার চক্রবর্তী পাশের রুমে আছেন। আমি ওকে বলে দিচ্ছি আপনাদের সাহায্য করার জন্য।
অর্ঘ চক্রবর্তী টি ভি সিরিয়ালে অভিনয় করেন। ওসি’র আছে করা কোনও প্রশ্নের-ই উত্তর দিলেন না বাঁ দিতে পারলেন না। ও সি যে আমাদের এড়াতেই অর্ঘকে দেখিয়ে দিয়েছেন বুঝতে অসুবিধে হল না।
একটা ঘটনা সাংঘাতিকভাবে নাড়া দিল। অন্তত দশ জন জমির মালিক জানালেন, গত দু মাস আগে এখানে জমির দাম ছিল বিঘা ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। এখন বিঘা ৫ লাখে উঠেছে। দাম আরও উঠবে ভেবে অনেক জমির মালিক এখন জমি ছাড়তে চাইছে না। গত মাস খানেক আগে যারা বিঘা ১৫-২০ হাজারে জমি বায়না নামায় সই করে অ্যাডভান্স নিয়েছেন, তারা এখন কপাল চাপড়াছেন।
কত জমি এমন বায়না নামায় বাঁধা পড়েছে?
আমার এই প্রশ্নের উত্তরে মন্দির কমিটির সভাপতি কালীপদ বিশ্বাস জানালেন শ’দুয়েক বিঘা তো হবে-ই। সম্পাদক যুগলচন্দ্র দাসের অনুমান তিন’শো বিঘার কম নয়। খেজুরতলার জমি যাদের, সেই বিশ্বাস পরিবারের ইউনিস ভাই বললেন, আমাদের জমি বিক্রি করার জন্য চাপ আসছে। খেজুরতলার লাগোয়া জমি। দাম অনেক উঠবে। তবে অনেকেই বায়না নামায় সই করে টাকা নিয়েছেন।
একটা বিস্ময়কর ব্যাপার হল, সমস্ত জমি কেনার জন্য বায়না করেছেন একজন-ই। আবার সেই একজন-ই নাকি চাকলার বিস্তীর্ণ জমির মালিক ছিলেন। তিনিই সস্তায় প্রচুর জমি কিনে চাকলাকে লোকনাথের জন্মস্থান বলে প্রচার করতে শুরু করেন। চাকলায় বাঁকে জল নিয়ে মানুষের মিছিলের পরিকল্পনা নেন। সেই মত লোকনাথ ভক্তদের জন্য পথের পাশে-পাশে শ’য়ে শ’য়ে অস্থায়ী বিশ্রামালয় তৈরি করে দেন। সেখানে বাঁকগুলো ঝুলিয়ে রেখে ভক্তরা জল- শরবত-ফল-বাতাসা-সন্দেশ খান, চেয়ারে বসে জিরিয়ে নিয়ে আবার পথ চলেন। ম্যারাপ বেঁধে, মাইকে লোকনাথের গান বাজিয়ে, হাজার হাজার ছেলে-মেয়েদের কাজে লাগিয়ে একটা পরিকল্পিত গণউন্মাদনা তৈরি করা হয়েছিল। ফল মিলেছিল হাতে হাতে। ৩-৪ হাজার টাকা বিঘায় কেনা জমি এখন ৫০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা কাঠায় বিকোচ্ছে। অর্থাৎ ১৫০ টাকা কাঠায় কেনা জমি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭৫ হাজারে।
যে লোকনাথের নাম কোনও ঐতিহাসিকের জানা ছিল না, ইতিহাসে অনুল্লিখিত লোকনাথ’কে প্রচারে কিংবদন্তি করে দিলো এক জমির প্রোমোটার! প্রোমোটার এখন কয়েকশো কোটি টাকার মালিক।
সে নাকি এ’বার খেজুরতলাকে তীর্থ বানাতে হাত দিয়েছেন।
সত্যিই বড় আশ্চর্য আধ্যাত্মবাদের দেশ এই ভারত?
এই ইপিসোড দেখান হল খোঁজ খবর-এ।
বিশিষ্ট রসায়নবিদ ডঃ শ্যামল রায় চৌধুরীর হাতে তুলে দিলাম খেজুরতলার মাটি। কয়েকদিন সময় নিলাম মাটি পরীক্ষার দিতে। সাত দিন পরে রিপোর্ট মিললো। মাটিতে পাওয়া গেছে কৃমি, কৃমির ডিম ও নানা রোগ-জীবাণু।
সাত-দিনেও আশিসের তোতলামোর একটুও উন্নতি দেখা গেল না। ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য আশিসকে আবার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে জানালেন, আশিসের গলার অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে।
তা-হলে?
আমরা খেজুরতলায় যা দেখেছি, যা পেয়েছি, সব-ই দেখান হল খোঁজ খবর-এ। তারপর দ্রুত কয়েকটি ঘটনা ঘটলো। (১) একটি বিজ্ঞান সংগঠনে কুমড়ো কাশীপুর বাজার মোড়ে খেজুর তলার বুজরুকির বিরুদ্ধে সভা করতে গিয়ে আক্রান্ত হল। (২) বিশাল এলাকা জুড়ে যুক্তিবাদী সমিতির পোস্টার পড়ল, বিষয়-খেজুরতলার বুজরুকি। (৩) স্থানীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দাবদাহ’ –তে আমার সত্যানুসন্ধান –এর রিপোর্ট এবং খেজুরতলার বুজরুকির খবর প্রকাশিত হতে-ই দাবদাহ –এর সম্পাদক কালীকুমার চক্রবর্তী খুনের হুমকি দিয়ে গেল। দলে চাকলা’র কয়েকজন মস্তান, কুমড়ো কাশীপুরের মস্তান ও যুক্তিবাদী সমিতি থেকে বহিষ্কৃত দীপককে দেখা গেছে। অশোকনগর থানাকে বিষয়টি জানিয়েছেন কালীকুমার চক্রবর্তী। (৪) ভক্তের ভিড়ে স্পষ্টত-ই ভাটার টান দেখা দিয়েছে।
২৩ দিন পর আবার আমরা হাজির হলাম খেজুরতলায়। এ’বারও আমি আর দেবজ্যোতি। হাবড়া থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন সুদীপ চক্রবর্তী। কাছি-কাছি অঞ্চলের যারা রোগমুক্ত হতে মাটি খেয়েছেন, তাঁদের ঠিকানা গতবার-ই সংগ্রহ করা ছিল। সে’সব বাড়ি খুঁজে খুঁজে তাঁদের শারীরিক অবস্থার খবর নিলাম। উপেন-এর মোড়ের এক নিঃসন্তান মহিলা মাটি খেয়ে পেট ব্যথায় নার্সিংহোমে ছিলেন পাঁচ দিন। মাটি-খাওয়া মানুষগুলো ক্যামেরার সামনে প্রচন্ড ক্ষোভ উগরে দিলেন –বিশাল কষ্ট করে খেজুরতলায় গিয়ে মাটি খেয়ে রোগ তো সারেই-নি, বরং বেড়েছে। মন্দির কমিটির দেওয়া রোগমুক্তদের তালিকা খুঁজতে গিয়ে অবাক হলাম, ওঁদের বাস্তব অস্তিত্ব-ই নেই।
গঙ্গানগর থানার ইটভাটায় দাঁড়িয়ে থাকে ডজন’খানেক লরিতে মাটি বোঝাই হচ্ছে দেখে আমাদের গাড়ি থামল। মাটি কোতাহয় যাবে? জিজ্ঞেস করতেই আশ্চর্য উত্তর পেলাম। রাতে এইসব লরি যাবে খেজুরতলায়, মাটি ফেলতে। জমে যাওয়া মাটি ভরাট করার কি বিচিত্র কারচুপি?
কুমড়ো কাশীপুরের মোড়ে এলাম। এখানে আমাদের জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। সেই ভিড় কোথায়? লোক কোথায়? ভক্তরা ভ্যানিশ?
হায় প্রোমোটার! হায় মন্দির কমিটি! হায় বুড়ি মা’র খেজুরতলা! গুজবের ঢাউস গ্যাস বেলুনে পিন ফোটাতেই ফু-উ-স, চুপসে লাটিতে।
খোঁজ খবর-এর দ্বিতীয় এপিসোড দেকানো হল রসায়ন বিজ্ঞানী ডঃ শ্যামল রায়চৌধুরীর মতামত, আশিস সম্বন্ধে ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্যের মতামত, মাটি ফেলার কেচ্ছা, মাটি খেয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষদের তীব্র ক্ষোভ ও সুপার-ফ্লপ ভক্ত-সমাগম, অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে খেজুরতলায় ফেলার কাহিনি।
এখন মানুষ আর মাটি খেতে যায় না।