৫৮ নং বালিগঞ্জ, কোলকাতা
মুজিব নগর সরকারের পিঠস্থান। লোকাকির্ণ ছোট্ট একটা জায়গা। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা রক্ষা করা ছিল অসম্ভব।
বালিগঞ্জের বাড়িটা নেহায়েতই ছোট। সবসময় অসংখ্য লোকজন ভীড় করে থাকে। নিরাপত্তা রক্ষা করা দুঃস্কর, কথাটা অতি সত্য। সর্বক্ষণ অগুনিত লোক মাছির মত ভনভন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক কামরা ছেড়ে অন্য কামরায়, কেউবা এমপি, কেউবা জাদরেল আমলা, কেউবা নেতাদের বিশেষ পরিচিত এবং আস্থাভাজন চামচা। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য নেতা, পাতি-নেতার ভীড়। গায়ে মানে না সকলেই আপনে মোড়ল। যার যার হাতে প্রত্যেকেই সাড়ে তিন হাত। গেটে প্রহরীরা কিছু জিজ্ঞাসা করলেই লংকাকান্ড বেধে যায়। সবাই যারা আসছেন তাদের ভাবসাব হচ্ছে, ‘আমরা কি হনুরে’। সবার পরিধানে নতুন নতুন কাপড়-চোপড়। হাল ফ্যাশনের অন্ত নেই। দিব্যি হেলেদুলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দেখা হলে দাত বের করে নিজের পরিচয় দিয়ে খাজুরে আলাপ জমিয়ে তুলতে চেষ্টা করছেন। ঢালাওভাবে ভাত, গোস্ত আর ডাল রান্না হচ্ছে কিচেনে। যে আসছেন সেই খাচ্ছেন নির্দ্বিধায়। কেউ কাউকে কিছু বলছেন না। ভুড়ি ভোজনের পর বিভিন্ন ঘরে চেয়ারের উপর, বসার বেঞ্চে এমনকি টেবিলের উপরও সটান হয়ে শুয়ে পড়ে দিবা নিদ্ৰা কিংবা রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করে নিতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করছেন না এ সমস্ত ভিআইপি ব্যক্তিদের দল। প্রত্যেকের হাতে একটা নতুন ব্রিফকেস কিংবা ছোট এট্যাচী। কোন কোন নেতার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। তারা যা কিছুই করছেন এ সমস্ত জিনিসগুলোও থাকছে তাদের সাথে সাথে। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাবার সময়ও সেগুলো সাথে নেয়া হচ্ছে, পাছে হারিয়ে যায়। ব্যাপার কি? এ সমস্ত ব্রিফকেস, এট্যাচী এবং ঝোলায় কি এমন দুর্লভ জিনিষ রয়েছে ভেবেই পাচ্ছিলাম না। রহস্যটা মতিই উৎঘাটন করল কিছুদিন পর। ও জানালো,
– স্যার, সমস্ত ডিস্ট্রিক্ট ও সাব-ডিভিশন থেকে মুক্তিফৌজের সাথে বর্ডার ক্রস করে আসার সময় ব্যাংক ট্রেজারীগুলো সব উজাড় করে নিয়ে এসেছেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। যার ভাগ্যে যতটুকু পরেছে সেগুলো রাখা আছে এ সমস্ত ব্রিফকেসে, এট্যাচীতে এবং ঝোলায়। তাই এগুলোকে এভাবে হেফাজত করা হচ্ছে।
– বলো কি?
– বিশ্বাস না হয় পরীক্ষা করে দেখেন? বলল মতি।
একদিন কোন এক অজানা মহারথী তার মাথার নিচে ব্রিফকেসটা রেখে খাবার পর সুখনিদ্রা দিচ্ছিলেন। ঘুমের ঘোরে ব্রিফকেসটা মাথার নিচ থেকে সরে গিয়েছিল। আশেপাশে কাউকে না দেখে মতি সেটা চট করে তুলে নিয়ে খুলে ফেলল। ভদ্রলোকের ব্রিফকেসে তালা ছিল না। খুলতেই মতি ও আমার চোখ চড়কগাছ! একি! থরে থরে সাজানো পাকিস্তানী পাচঁশত টাকার নোটের বান্ডিলে ব্রিফকেসটা বোঝাই। ব্রিফকেসটা নিয়ে আমরা চুপিসারে কেটে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর ঘুম থেকে উঠে ভদ্রলোক তার ব্রিফকেসের হদিস না পেয়ে সারা বাড়ি মাথায় তুলে হায় হায় করতে লাগলেন। আরদালীকে পাঠিয়ে ভদ্রলোককে ডেকে পাঠালাম। তিনি এলেন। জিজ্ঞেস করলাম,
– কি ব্যাপার? এতো হৈ চৈ করছেন কেন?
– আমার ব্রিফকেস চুরি হয়ে গেছে। তিনি কাদো কাদো হয়ে বললেন।
– কি ছিল তাতে?
– আমার কিছু কাপড় ও প্রয়োজনীয় জরুরী কিছু কাগজপত্র ছিল।
টাকা সম্পর্কে সবটাই গোপন করলেন ভদ্রলোক। ইতিমধ্যে নূর উঠে গিয়ে পাশের ঘরে কর্নেল ওসমানীকে সবকিছু খুলে বলেছে। সব শুনে কর্নেল ওসমানী আমরা যে ঘরে বসেছিলাম সেখানে আসেন। তিনি ভদ্রলোককে অনেকভাবে জেরা করেন। ভদ্রলোক টাকার কথা সম্পূর্ন চেপে গিয়ে ঝোলাতে শুধু কিছু কাপড় ও জরুরী কাগজপত্র ছিল সে কথাই কর্নেল ওসমানীকে জানান। সব শুনে কর্নেল ওসামানী নূরকে আদেশ করেন ব্রিফকেসটি ভদ্রলোককে ফিরিয়ে দিতে। ইতিমধ্যেই ব্রিফকেস থেকে প্রায় ১২ লাখ টাকা আলাদা করে রেখে দেওয়া হয়েছিল। কাপড়-চোপড় ও কিছু কাগজপত্রসহ ব্রিফকেসটি ভদ্রলোককে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তিনি তাড়াতাড়ি ব্রিফকেস খুলে দেখেন টাকা ছাড়া অন্য সবকিছুই ঠিক আছে। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কিন্তু অবস্থা বেগতিক বুঝে ব্রিফকেস বন্ধ করে নিয়ে আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে সুর সুর করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এরপর সেই ভদ্রলোককে আর কখনও দেখিনি পুরো ৯ মাস সংগ্রামকালে। উদ্ধারকৃত টাকাটা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে জমা করে দেয়া হয়। এ ঘটনার অবতারনা এখানে এজন্য করলাম, তখন তথাকথিত মুজিবনগর সরকারের কার্যালয় দেখে বোঝা কষ্ট হত যে একটি জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম চলছে বাংলাদেশে। আর সে সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন প্রবাসী বালিগঞ্জস্থ লোকজন। যে সমস্ত লোকজন তখন অকারণে বালিগঞ্জের বাড়িতে ভীড় করে সর্বদা ঘুর ঘুর করতেন তাদের হাবভাব দেখে মনে হত সবাই যেন বরযাত্রী হয়ে এসেছেন কোন দূরদেশ থেকে! কোন ভাবনা নেই, কোন চিন্তা নেই ! নির্বিঘ্নে হেসে খেলে সময় কাটিয়ে আনন্দেই আবার ফিরে যাবেন তারা।
৮নং এবং ৯নং সেক্টরে যোগদান
স্বয়ং কর্নেল ওসমানীই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ৮নং এবং ৯নং সেক্টরের অধিনায়কদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে।
থিয়েটার রোড থেকে কর্নেল ওসমানী একদিন আমাকে নিয়ে চললেন ৮নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারস বনগাঁয়, সাথে নূর। শহর থেকে প্রায় ৯০-৯৫ মাইল দূরে যশোর বর্ডারের গা ঘেসে বনগাঁ৷ ওখানে পৌঁছে কর্নেল ওসমানী আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর ওসমান এবং ৯নং সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জলিলের সাথে। তাদের বিস্তারিত ব্রিফিং দিলেন তিনি। সেখানে পরিচয় হল বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হাফিজ, লেফটেন্যান্ট হালিম, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিন, পুলিশের এসডিপিও মাহবুব, সিএসপি কামাল সিদ্দিকী এবং তৌফিক এলাহী চৌধুরী ও লেফটেন্যান্ট মাহবুবের সাথে। ওরা সবাই আমাকে সাদর অভিনন্দন জানালেন। দুপুরের খাওয়ার পর কর্নেল ওসমানী নূরকে নিয়ে ফিরে গেলেন। যাবার আগে জানিয়ে গেলেন শীঘ্রই তিনি সেক্টর কমান্ডারদের একটি গুরত্বপূর্ন কনফারেন্স ডাকবেন কোলকাতায়। কনফারেন্সে মুক্তিযুদ্ধের বর্তমান স্তর এবং ভবিষ্যত রনকৌশল ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করে কর্মপদ্ধতি ঠিক করা হবে। থিয়েটার রোড ছেড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে পৌঁছে ভীষণ ভালো লাগছিল। মতিও আমি চলে আসার পরপরই উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের সেক্টরগুলোর দায়িত্ব নিয়ে চলে যায়।
শুরু হল নতুন কর্মজীবন। খুলনা, যশোরের ছিন্নমূল ও বিক্ষিপ্ত অনেক ইপিআর, কিছুসংখ্যক নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদদের নিয়ে মেজর ওসমানের অধিনে শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। তার সাথে যোগ দেয় স্থানীয় ছাত্র-জনতা। নড়াইলের তরুণ এসডিও জনাব কামাল সিদ্দিকী, মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরী এবং মাগুরার এসডিও ওয়ালীউর রহমানও প্রতিরোধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মেজর ওসমান তার অধিনস্থ সমস্ত নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের ৭টি কোম্পানীতে বিভক্ত করে সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের নিয়োগ করেন।
১। প্রথম কোম্পানী উত্তরে মহেশকুন্ড বিওপি এলাকায় লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীরের অধিনে।
২। দ্বিতীয় কোম্পানী তার দক্ষিনে ইছাখালী বিওপি এলাকায়। কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী।
৩। তৃতীয় কোম্পানী আরো দক্ষিনে জীবননগর বিওপি এলাকায়। নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমান।
৪। চতুর্থ কোম্পানী কাশিমপুর-মুকুন্দপুর-বয়ড়া এলাকায় ক্যাপ্টেন খন্দোকার নাজমুল হুদার অধিনে।
৫। পঞ্চম কোম্পানী বেনাপোল কাস্টমস্ চেকপোষ্ট এলাকায় লেফটেন্যান্ট আবদুল হালিমের অধিনে। এ কোম্পানী পরবর্তী পর্যায়ে ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী সিএসপির অধিনে দেওয়া হয়।
৬। ষষ্ঠ কোম্পানী আরও দক্ষিনে বকশা-কাকডাঙ্গা-বেনাপোল থানার এলাকায় ক্যাপ্টেন শফিকউল্লার অধিনে ৷
৭। সপ্তম কোম্পানী ভোমরা এলাকার গোজভাঙ্গায় ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিনের অধিনে।
মে মাসের শেষে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনকে হেডকোয়ার্টারসে গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব নেয়ার জন্য চলে যেতে হয় মুজিবনগর তথা ৮নং থিয়েটার রোডে। তখন ঐ সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিনকে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রাক্তন ফ্ল্যাইট লেফটেন্যান্ট জামালউদ্দিন এমপি, ক্যাপ্টেন ওয়াহাব এবং লেফটেন্যান্ট এনামুল হক ৮নং সেক্টরে যোগদান করেন। ফ্ল্যাইট লেফটেন্যান্ট জামালউদ্দিনকে সেক্টর হেডকোয়ার্টারস এ ষ্টাফ অফিসার হিসাবে নিয়োজিত করা হয়।
যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধ করতে করতে বর্ডার পেরিয়ে ৮নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেন ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অকুতোভয় সেনারা। বেনাপোল বর্ডার পর্যন্ত মাত্র ১৮৮ জন সৈনিককে জীবিত অবস্থায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল হাফিজ। পুরো রেজিমেন্টের বাকি সবাই যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। বেনাপোল পৌঁছে সেক্টর হেডকোয়ার্টারস এর কাছেই সে তার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। বনগাঁ বিওপির বিপরীতে মুক্ত এলাকায় বাংলাদেশের পতাকা সমুন্নত রাখার পবিত্র দায়িত্ব যথাযথ বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গলের বীর জোয়ানরা শেষদিন পর্যন্ত পালন করেছিলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ আমার বিশেষ বন্ধু বিধায় ওর সাথেই আমার থাকার বন্দোবস্ত করি৷
বরিশাল ও খুলনায় একইভাবে ২৫শে মার্চ রাতের পর থেকে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন জলিল। তিনি ছিলেন আর্মড কোরের একজন সৈনিক এবং পরে মেধাবলে অফিসার হয়েছিলেন তিনি। পুলিশ বাহিনীর অস্ত্রাগার লুন্ঠন করেই তিনি শুরু করেন প্রতিরোধ সংগ্রাম। তার সাথে যোগ দেন লেঃ মেহেদী, লেঃ জিয়া এবং লেঃ নাসের। এছাড়াও তার সাথে যোগ দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর, লেঃ খুরশীদ প্রমুখ। লেফটেন্যান্ট খুরশীদ তথাকথিত আগরতলা মামলার একজন আসামীও ছিলেন। এরপর এমএ বেগ নামে একজন যুবক এসে নবম সেক্টরে যোগ দেয়। তিনি পাকিস্তান সেনা বাহিনীর একজন দক্ষ প্যারাস্যুট জাম্পার ও ফ্রগম্যান হিসেবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিক বিধায় পরে তাকে নৌবাহিনীতে শীপম্যান হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। ৯নং সেক্টরকে গঠন করা হয় খুলনার কিছু অংশ, ফরিদপুরের কিছু অংশ এবং পুরো বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা নিয়ে। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন ক্যাপ্টেন জলিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথমার্ধে বরিশাল, পটুয়াখালীতে ক্যাপ্টেন মেহেদী, খুলনার সুন্দরবন এলাকায় লেঃ জিয়া এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় ক্যাপ্টেন হুদা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। জুলাই মাসে ৯নং সেক্টরকে পুনর্গঠিত করা হয়। বরিশাল জেলার দায়িত্ব দেয়া হয় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরকে। পটুয়াখালীর দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন মেহেদীকে। সুন্দরবন ও খুলনার দায়িত্ব দেয়া হয় লেঃ জিয়াকে। পিরোজপুর, বাগেরহাট এলাকা দেয়া হয় সুবেদার তাজুল ইসলামকে। ক্যাপ্টেন হুদাকে দেয়া হয় সীমান্তবর্তী এলাকা। সেক্টর হেডকোয়ার্টারস প্রথম স্থাপন করা হয় হাসনাবাদে। পরে সরিয়ে নেয়া হয় টাকীতে। সেক্টর হেডকোয়ার্টারসে থাকতেন ক্যাপ্টেন জলিল, এডজ্যুটেন্ট এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ফ্ল্যাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক ও মফিজ। এদের সাথে ষ্টাফ অফিসার হিসেবে ছিল ক্যাপ্টেন আরিফিন। সেক্টরের প্রধান প্রশিক্ষণ কেন্দ্ৰ ছিল তকিপুর। ইনচার্জ ছিলেন সুবেদার গোলাম আজম। ৯নং সেক্টরের নৌবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন চীফ পেটি অফিসার এম ইউ আলম। সুন্দরবনে লেঃ জিয়ার অধিনে ছিলেন ফুল মিয়া ও মধু প্রথম পর্যায়ে টাকী, হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ এবং শমসের নগরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হল। এরপর হিঙ্গলগঞ্জের ক্যাম্প উক্শা পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। এরপর বরিশাল, খুলনা অঞ্চলে ক্রমে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল।
ক্যাপ্টেন জলিলকে শাসানো হয়
সীমিত গোলাবারুদ ও অস্ত্র নিয়ে মোকাবেলা করতে ভিষণ অসুবিধার সম্মুখিন হতে হচ্ছিল ক্যাপ্টেন জলিল এবং অন্যান্য অধিনায়কদের। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ক্যাপ্টেন জলিল কোন সোর্স এর মাধ্যমে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং ভারতীয় বিএসএফ এর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। তাদের মাধ্যমে তিনি কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম পর্যন্ত পৌছাতে সক্ষম হন। ইষ্টার্ণ কমান্ড হেডকোয়াটার্স তাকে কিছু হাতিয়ার ও গোলাবারুদ দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সেগুলো বরিশাল নিয়ে যাবার পথে পথিমধ্যে খানসেনাদের এক আচমকা অ্যামবুশ আক্রান্ত হয়ে কোনরকমে প্রাণে বেচে ফিরে আসেন।
প্রবাসী সরকার এবং কর্নেল ওসমানী তার এই ধরনের উদ্যোগে ক্ষেপে উঠেন৷ বিশেষ করে কর্নেল ওসমানী তার প্রতি ভিষণভাবে রাগান্বিত হন এবং তাকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে অপসারনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু অন্যান্য কমান্ডাররা এবং আমি ও নূর কোন রকমে কর্নেল ওসমানীকে বোঝাতে সক্ষম হই যুদ্ধের সেই প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন জলিলের মতো একজন বীর এবং জনপ্রিয় কমান্ডারকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হবে। আমাদের সবার আকুতি এবং অনুরোধে কর্নেল ওসমানী তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন জলিলকে ঐ ধরনের উদ্যোগ ও গাফিলতির জন্য হুশিয়ার করে তাকে শাসিয়েছিলেন কড়াভাবে। কিন্তু আশ্চয্যের বিষয় হলো প্রবাসী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের একাংশ ঐ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে নাখোশ হয়েছিলেন।
অন্যান্য অভিজ্ঞতা
আমি সালাম জানাই ঐ সমস্ত যুবকদের চেতনা এবং দেশপ্রেমকে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাতির মেরুদন্ড হয়ে উঠেছিলেন।
ইতিমধ্যে ঝড়ের বেগে আমার কাজ এগিয়ে চলেছে। কৃষ্ণনগর থেকে তকীপুর, সমস্ত সেক্টর আমি ঝাটিকা সফর করে বেড়াচ্ছি। আমার মূল দায়িত্ব যুবশিবির ও শরনার্থী শিবির থেকে গেরিলাদের রিক্রুট করে তাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা। সাথে সাথে সেক্টর ট্রুপসদের প্রশিক্ষন ও অপারেশনে সাব সেক্টর কমান্ডারদের সাহায্য করা। এরই ফাকে ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে পুনর্গঠিত করার কাজেও ক্যাপ্টেন হাফিজকে সাহায্য করছিলাম যতটুকু সম্ভব। রাতদিন পরিশ্রম করে জুন মাসের মধ্যেই প্রায় হাজার দশেক গেরিলা রিক্রুট করে ফেলেছিলাম। তাদেরকে ২০০ থেকে ৫০০ এর একটি ব্যাচে বিহারের চাকুলিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের ট্রেনিং এ পাঠানো হচ্ছিল। একই সাথে যুব শিবির এবং সাব সেক্টরগুলোতেও আমরা কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। সেক্টরের নিয়মিত বাহিনীর অভিজ্ঞ সৈনিকরা গেরিলাদের হালকা অস্ত্র, গ্রেনেড, ডেমোলিশন, রেইড, অ্যামবুশ, আনআর্মড কাম্বেট, ম্যাপ রিডিং, আরবান এবং জঙ্গল ওয়ারফেয়ার, অবস্ট্যাকলস প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষন দিচ্ছিলেন। লাইভ ফায়ারিং এর বন্দোবস্তও করা হয়েছিল টেম্পোরারী রেঞ্জ তৈরি করে। একই সাথে চলছিল মটিভেশন ক্লাশ।
এখানে রিক্রুটিং এর কাজে নিয়োজিত থাকাকালে একটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। যুদ্ধকালে প্রায় এক লাখের মত মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নেয়। কিন্তু এর মধ্যে শতকরা একভাগও শরনার্থী শিবিরের লোক ছিল না। শরনার্থী শিবিরের আশ্রয় গ্রহণকারী বেশিরভাগ লোকই ছিলেন হিন্দু। তাদের মধ্যে খুব কম লোকের মাঝেই ট্রেনিং গ্রহণ করে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য যুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ দেখা যেত। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে শরনার্থী শিবিরে যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারা পরিবারের সব সদস্য নিয়েই সেখানে থাকত। জীবন বাচাঁনোর জন্য দু’বেলা দু’মুঠো আহারের নিশ্চয়তাও শিবিরে তাদের ছিল। বাংলাদেশ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার মত তাদের খুব বেশি কেউই ছিল না৷ শিবিরে তাদের জীবনের নিরাপত্তাও ছিল। নিরাপত্তাও ছিল। তাদেরকে নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা কারা করছে, কিভাবে করছে, এ নিয়ে তাদের তেমন কোন মাথাব্যাথা ছিল না। মনে মনে হয়তো বা তারা চাইত কষ্টের কাজটুকু অন্যে করুক, তারা একদিন ধীরে সুস্থে ফিরতে পারলেই হয়। শরনার্থী শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকেরই আবার পশ্চিমবঙ্গে আত্মীয়- স্বজন বিভিন্ন শহর গ্রামে পার্টিশনের সময় এসে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার চাপ এড়াতে বয়ষ্করা যুবকদের বর্ডার থেকে দূরে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দিত। ওরা সেখানে কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করে জীবন চালাত। শরনার্থীদের মধ্যে এবং নিছক প্রাণের ভয়ে যারা দেশত্যাগ করেছিল তাদের মধ্যে সুবিধাবাদী মনোবৃত্তিই লক্ষ্য করা গেছে। যুদ্ধে তাদের বিশেষ কোন অবদান ছিল না। কিছু থাকলে তা ছিল পরিস্থিতি সাপেক্ষে, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নয়। অনেক ক্ষেত্রে শরনার্থী শিবিরগুলোতে খুঁজেও সমর্থ লোক পেতাম না। পাওয়া যেত শুধু বুড়ো মানুষ, শিশু ও মহিলাদের।
এরই বিপরীত অবস্থা ছিল যুব শিবিরগুলোতে। হাজার হাজার তরুণ, যুবক, ছাত্র/ছাত্রী, সমাজের অন্যান্য পেশাজীবি, সমর্থ ছেলেদের ভীড়ে প্রতিটি যুব শিবিরই ভরে থাকত সবসময়। বাসস্থানের সংকুলানের অভাবে অনেককে ফিরিয়েও দেয়া হত বাধ্য হয়ে। তারা তাদের আত্মীয়-পরিজনদের বাংলাদেশে ফেলে রেখে ছুটে আসত সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ট্রেনিং গ্রহণ করে হাতিয়ার নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে খান সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। তারা অতি কষ্টকর পরিবেশে যুব শিবিরে দিনের পর দিন আধপেটা খেয়ে অনেকক্ষেত্রে অভূক্ত থেকে উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করত কবে তাদের রিক্রুট করে ট্রেনিং এ পাঠানো হবে। শতকষ্টে তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। প্রত্যেকের মধ্যে দেখেছি প্রতিশোধের স্পৃহা এবং দেশকে স্বাধীন করার অঙ্গীকার। আজ একটি কথা স্পষ্ট করে স্বীকার করছি, শরনার্থী শিবিরে পালিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে যারা নিরাপদ জীবন-যাপন করেছিল তাদের তুলনায় হাজার রকমের ভয়ভীতি, অজানা আশংকা ও সমূহ বিপদের মোকাবেলা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালী যারা দেশেই থেকে গিয়েছিল, স্বাধীনতার জন্য তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অবদানের মূল্য কোন অংশে কম নয়৷ তাদের অনেককেই দিতে হয়েছে চরম আহুতি।
তাদের আত্মত্যাগের স্পৃহা, আবেগ এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রত্যয় ছিল জাতির গর্বের বিষয়। তাদের ঐ ধরনের চারিত্রিক মনোবল দেখে আমার আত্মবিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছিল যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোন অপশক্তি, কোন ষড়যন্ত্রই দাবিয়ে রাখতে পারবে না। দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। আল্লাহ কখনোই তাদের এই ধরনের নিঃস্বার্থ ত্যাগ ব্যর্থ হতে দেবেন না। জনগণ বিশেষ করে তরুণ সমাজের এমন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে স্বতঃস্ফুর্তভাবে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে যোগদানের নজীর বিশ্বে খুব কম জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাসে খুজে পাওয়া যায়। গণচীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইন্দোচায়না, আফ্রিকা, ল্যাতিন আমেরিকা, পূর্ব ইউরোপের এ ধরনের গর্বের দাবি করতে পারে না। এ সমস্ত দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে বৃহত্তর কোন সংঘর্ষের সুযোগ কিংবা যুদ্ধকালিন এবং এর পরবর্তী অবস্থাতে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রস্তুতির পর। এ সত্য খন্ডাবার কোনো সুযোগ নাই। অন্য কেউ নয় শুধুমাত্র তারাই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যদি কোন গোষ্ঠি, পার্টি এককভাবে নিজেদের স্বাধীনতার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মনে করে তবে সেটা হবে সত্যের বরখেলাপ এবং এক অমার্জনীয় ধৃষ্টতা। সার্বিকভাবে স্বাধীনতার কৃতিত্ব দেশের জনগণের এবং বিশেষভাবে নিঃস্বার্থ, ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের।
বিনা মেঘে বজ্রপাত
কর্নেল ওসমানী পদত্যাগ করলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঠিক অধিনায়কদের মহাসম্মেলনের প্রাক্কালে।
ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সহায়তায় ক্যাপ্টেন জলিলের ফোর্ট উইলিয়ামের পূর্বাঞ্চলীয় হেডকোয়ার্টারসের কর্মকর্তাদের সাথে গোপন যোগাযোগ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠল। ভারতীয় সরকার শুধুমাত্র প্রবাসী সরকার এবং মুক্তি বাহিনীর সদর দপ্তরের মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক গতিধারাকে নিয়ন্ত্রন করছিল তা নয়, তারা ক্ষমতাধর কমান্ডারদের সাথেও সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। অত্যন্ত চতুরতার সাথে তারা তাজুদ্দিনের প্রবাসী সরকারের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে তাকেও দুর্বল করে চাপের মুখে রাখছিল যাতে তিনি তাদের নিয়ন্ত্রনের মধ্যে থাকতে বাধ্য হন। অপরদিকে মুজিবনগর সরকার ও মুক্তিযোদ্ধের সর্বাধিনায়ক জনাব ওসমানীর মধ্যেও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে কর্নেল ওসমানীর ক্ষমতা সীমিত করে রাখা হচিছল একইভাবে। কর্নেল ওসমানীকে সাইড ট্র্যাক করে প্রবাসী সরকার ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এ ধরণের কার্যকলাপে কর্নেল ওসমানী অতি যুক্তিসঙ্গত কারণেই ভীষণভাবে অপমানিত বোধ করছিলেন। তার বক্তব্য ছিল পরিষ্কার। ভারত বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের বক্তব্য অনুযায়ী মানবিক কারণে সাহায্য দিতে সম্মত হয়েছে সেটার জন্য বাঙ্গালী জাতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামটা পূর্ব বাংলার ৮ কোটি বাঙ্গালীর নিজস্ব সংগ্রাম। এ সংগ্রাম তাদেরই সংগঠিত করতে হবে। যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে তাদেরকেই অর্জন করতে হবে জাতীয় স্বাধীনতা, সংগ্রামের নেতৃত্ব ও সব দায়িত্বও থাকতে হবে মুক্তিফৌজ কমান্ড ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীন। জনাব ওসমানী নীতির এ প্রশ্নে কখনোই আপোষ করেননি। এ বিষয় নিয়ে তৎকালীন প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বের সাথে অনেক বির্তক হয়েছে তার। কিন্ত তার এ নীতির প্রতি সমর্থন দেননি আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতৃত্ব ও গণপরিষদ সদস্যরা।
ইতিমধ্যেই ৮ই জুলাই কোলকাতায় সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন ডাকা হয় কর্নেল ওসামানীর নির্দেশে। কিন্তু সম্মেলনের কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই একদিন ঘটল এক ঘটনা। ক্যাবিনেট মিটিং এ কর্নেল ওসমানী প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিনকে পরিষ্কার ভাষায় হুশিয়াঁরী দিয়ে বললেন,
– ভারতের গোয়েন্দা ও সেনা বাহিনীর কর্তৃপক্ষ যদি মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালাতে থাকেন তবে শুধুমাত্র শিখন্ডী কমান্ডার ইন চীফ হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব থেকে আমি স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেব৷
তিনি মিটিং এ জনাব তাজুদ্দিনকে প্রশ্ন করেন,
– বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামটা কাদের সংগ্রাম? এটা যদি ভারতের সংগ্রাম হয়ে থাকে তবে আমরা সবাই কি তাদের হাতে ক্রিয়ানক হয়ে ইসলামাবাদ থেকে দিল্লীতে তথাকথিত স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী স্থানান্তরের প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি?
ঐ বক্তব্যের পর তিনি একটি পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সকলকে স্তম্ভিত করে সভা কক্ষ ত্যাগ করেন। কথাটা মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত থিয়েটার রোড হেডকোয়ার্টারসে ছড়িয়ে পড়ল। আমরা ইয়াং অফিসার যারা সেখানে উপস্থিত ছিলাম তাদের মাঝে ভীষণ উত্তেজনা সৃষ্টি হল। আমাদের হাবভাব দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে থিয়েটার রোড ছেড়ে সংসদ সদস্যদের দল, মন্ত্রীবর্গ সবাই কেটে পড়লেন। আমরা সোজা প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে অনুরোধ জানালাম, যে করেই হোক কর্নেল ওসমানীকে আপনার আশ্বাস দিতে হবে যাতে তাকে বাইপাস করে ভারতীয়রা কোন কিছু না করে। আপনি যদি এ আশ্বাস তাকে দিতে পারেন তবে আমরা তাকে তার পদত্যাগ পত্র ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ জানাব এবং যে করেই হোক তাকে রাজি করাব। এটা যদি আপনি করতে ব্যর্থ হন তবে দু’দিন পর সেক্টর কমান্ডারদের যে মিটিং এখানে হবে তার পরিণতি কি হবে সেটা আপনি নিশ্চয়ই ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছেন। আপনাকে শুধু এতটুকুই বলছি, আমাদের মুক্তি বাহিনীর একজন সৈনিক বেঁচে থাকতে কর্নেল ওসমানীর গায়ে এতটুকু আচড় কেউ দিতে পারবে না। আমরা কেউ তার এতটুকু অপমানও বরদাস্ত করব না।
তাছাড়া তার বক্তব্যে যুক্তি রয়েছে। আগে আপনি বলেছেন বিএলএফ-মুজিব বাহিনী গঠনের ব্যাপারে আপনি কিছুই জানতেন না। এ খবর আপনি জানতে পেরে নাকি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার অ্যাডভাইজারদের সাথে এর প্রতিবিধান করার চেষ্ঠা করে ব্যর্থ হয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নেহায়েত অপারগ হয়েই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আপনাদের এ ধরণের অপারগতার সুযোগে তারা তাদের নীল নকশার জাল বিস্তার করে চলেছে। তাদের জালে আটকে পড়ে থাকা নির্জীব বাংলাদেশ আমাদের কাম্য নয়। পরনির্ভরশীল পঙ্গু বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য হাজার হাজার বাঙ্গালী রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিচ্ছে না বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে। আমরা তথা আপমর জনসাধারণ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পৃথিবীর অন্যান্য জাতি যদি ১২ বছর, ১৫ বছর, ২০ বছর রক্তক্ষরণের ত্যাগ স্বীকার করে নিজেদের শক্তির বলে তাদের দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করে থাকতে পারেন তবে আমরাই বা পারব না কেন আমাদের নিজ শক্তিতে স্বাধীনতার সূর্যকে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে ছিনিয়ে নিতে? পৃথিবীর অনেক জাতি তাদের মুক্তি সংগ্রামে মিত্র দেশের সহযোগিতা গ্রহণ করেছে সংগ্রামকালে কিন্তু তাই বলে তারা নিজেদের সত্ত্বাকে তো বিকিয়ে দেয়নি। আপনি প্রধানমন্ত্রী। আপনার দায়িত্ব হচ্ছে সব কিছু দেখে বুঝে শুনে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দৃঢ়তার সাথে সমস্যার মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়া। আপনি যদি সততা ও আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে চলেন তবে আপনি আপনার যাত্রা পথে নিঃসঙ্গ হবেন না৷ আমরা সবাই থাকব আপনার সাথে৷
প্রধানমন্ত্রী আমাদের বক্তব্য শুনে বললেন তিনি কিছু একটা করবেন। কর্নেল ওসমানীকে passify করার দায়িত্ব নিয়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। বাইরে এসে শুনলাম গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, তাজুদ্দিন এবং প্রবাসী সরকারের সাথে কর্নেল ওসমানীর মতানৈক্য ঘটায় তিনি নাকি কমান্ডার ইন চীফ হিসেবে হুকুম দিয়েছেন সমস্ত আওয়ামী লীগ সরকারকে অ্যারেষ্ট করতে। প্রধানমন্ত্রীকে ইতিমধ্যেই নাকি অ্যারেষ্ট করে রাখা হয়েছে থিয়েটার রোডেই! বাকিরা পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন। গুজবটা শুনে হাসব কি কাঁদব ভেবে পেলাম না। ভাবলাম, গুজবটা ছড়িয়ে আওয়ামী লীগাররা তাদের দুর্বলতাটাকেই প্রকাশ করে দিলেন তাদের অজান্তে।
অধিনায়কদের মহাসম্মেলন
৮ই জুলাই মহাসম্মেলনের দিন ধার্য্য করা ছিল। অধিনায়কদের অনেকেই কোলকাতায় পৌঁছে গেছেন। আমরা তখনও চেষ্টা করছিলাম যাতে কর্ণেল ওসমানী তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন।
এদিকে কনফারেন্সের দিন ক্রমশঃ ঘনিয়ে আসছে। বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডাররাও ইতিমধ্যে কোলকাতায় এসে উপস্থিত হচ্ছেন। কর্নেল ওসমানীকে আমরা একনাগাড়ে বুঝিয়ে চলেছি। অনুরোধ করে চলেছি তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নিতে। ভীষণ একরোখা মানুষ কর্নেল ওসমানী। যারা তার সান্নিধ্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন তারা সবাই সেটা জানেন। অত্যন্ত আত্মসম্মানবোধী এবং অভিমানী তিনি। নীতির প্রশ্নে জীবনে কেউই তাকে আপোষ করাতে সক্ষম হয়নি। নূর ও আমাকে তিনি ভীষণভাবে স্নেহ করতেন। বকাও খেয়েছি অনেক। কোন সময় অযৌক্তিকভাবেও বটে। তবুও তার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তার যে আন্তরিক ভালোবাসা আমি পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সেটা এক অমূল্য অনুভূতি। একান্ত নিভৃতে শ্রদ্ধার সাথে তাকে ও তার স্মৃতিগুলো আমি স্মরন করে যাব সারাজীবন। চাকুরিতে থাকাকালীন এবং চাকুরিচ্যুত অবস্থায় আমরা নিজেদের মাঝে অনেক মতামত বিনিময় করেছি নির্দ্বিধায়। এমনকি অনেক ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সমস্যা সম্পর্কেও তার পিতৃসুলভ আচরণ ও উপদেশাবলীর কথা আজও মনে হলে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে।
যাক সে কথা। বাইরের ওসমানীর চেয়ে তার অন্তরের কিছুটা জানতে পারার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল বলে নিজেকে আমি ধন্য মনে করি। আমাদের আকুতি-মিনতির জবাবে তিনি কিছুই বলছেন না; এমন একটা অনিশ্চিতয়তার মাঝেই শুরু হল সম্মেলন ১১ই জুলাই ১৯৭১-এ। অধিবেশনের আগে যখন এ সমস্ত ঘটনা ঘটছিল তখনই মে মাসের শেষ দিকে একদিন বয়রা সেক্টর এর একটি অপারেশনে আমি প্রথমবারের মত গুলিবিদ্ধ হই। ইনজ্যুরিটা বিশেষ সিরিয়াস ছিল না। ডান হাতের মাঝের আঙ্গুলটা ভেঙ্গে গিয়েছিল গুলি লেগে। আল্লাহর অসীম কৃপায় প্ৰাণে বেঁচে যাই। ক্ষত নিয়েই আমার দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছিলাম। হাতের ব্যান্ডেজ নিয়েই সেক্টরে সেক্টরে ঘুরে ফিরেছি। ফলে ঠিকমত ঔষধ এবং কেয়ার না নেয়ায় ক্ষতে একটা খারাপ ধরণের ইনফেকশান দেখা দেয়। ফলে হেডকোয়ার্টারসের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আমি রক্ষা করতে পারিনি। অবশ্য নূরের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে খবরা-খবর যতটুকু সম্ভব জানার চেষ্টা করেছি। সেক্টর থেকে যোগাযোগের ব্যবস্থাও ছিল খুবই সীমিত। সম্মেলনে সব সেক্টর থেকে কমান্ডাররা এসেছিলেন। সম্মেলনের দিন সকালে নূর এসে বলল, কর্নেল ওসমানী কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করবেন না৷ কারণ প্রধানমন্ত্রী ও মুজিবনগর সরকারের কাছ থেকে তিনি তার পদত্যাগের ব্যাপারে সন্তোষজনক কোন জবাব জবাব পাননি। সেক্ষেত্রে তার পক্ষে সম্মেলনে উপস্থিত হওয়াটা হবে অসম্মানজনক। তাছাড়া সম্মেলনে সবাই তাকে পদত্যাগের কারণও জিজ্ঞাসা করতে পারেন। পদত্যাগের সঠিক কারণ এই মুহুর্তে সবাইকে জানানোটা সমীচীন মনে করছেন না কর্নেল ওসমানী। নূর এ খবরটা আমাকে জানিয়ে অনুরোধ করল সমস্ত ব্যাপারটা গোপন রাখতে। মুজিবনগর সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখে কর্নেল ওসমানী তার পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবেন আভাস পেলাম।
থিয়েটার রোডেই কনফারেন্স শুরু হল। সবাই উপস্থিত। জনাব তাজুদ্দিন আহ্মদ প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে হাজির হলেন। বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর সেনা প্রধান হিসাবে ওসমানী অনুপস্থিত। তিনি জানিয়েছেন বিশেষ কারণবশতঃ তার পক্ষে সম্মেলনে উপস্থিত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী কর্নেল ওসমানীর উপস্থিতি সেখানে ছিল অপরিহার্য। কিন্তু তিনি নেই দেখে সবার কাছে ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক মনে হল। যাই হোক জনাব তাজুদ্দিন লম্বা-চওড়া ভাষণ শুরু করলেন। তার ভাষণে তিনি সবাইকে জানালেন,
– সেক্টর কমান্ডারদের অনাস্থাবশতঃ কর্নেল ওসমানী পদত্যাগ পত্র দাখিল করেছেন।
উপস্থিত সবাই প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কথাটা এতই আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত ছিল যে, কমান্ডারদের মধ্যে ভীষণ উত্তেজনার সৃষ্টি হল। কর্নেল ওসমানীর উপর কমান্ডারদের আস্থা নেই এ কথা প্রধানমন্ত্রী কি করে জানলেন সে বিষয়ে অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করলেন। প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার কোন জবাব দিতে পারলেন না। বাক-বিতন্ডার মাঝে অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে কনফারেন্স হল ত্যাগ করে চলে যেতে হল। সম্মেলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা। কর্নেল ওসমানী সবার কাছে বিশেষ করে বাঙ্গালী বীর যোদ্ধাদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তার উপর অনাস্থা এনেছেন কারা সে রহস্য উদঘাটন না হওয়া পর্যন্ত কোন কনফারেন্স হবে না বলে সিদ্ধান্ত গৃহিত হল প্রধানমন্ত্রীর অবর্তমানেই। এ অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে আমি ও নূর মেজর জিয়া, মেজর খালেদ মোশাররফ এবং উইং কমান্ডার বাশারকে একান্তভাবে কর্নেল ওসমানীর পদত্যাগের আসল কারণ খুলে বললাম। আমরা এটাও তাদের বুঝিয়ে বললাম কর্নেল ওসমানীর এ ধরণের ষ্ট্যান্ড এ অস্থায়ী সরকার ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নীল নকশা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। তাই তারা অতি কৌশলে কমান্ডার ইন চীফের পদ থেকে তাকে বাদ দেয়ার পরিকল্পনা আটছে তার পদত্যাগের সুযোগ গ্রহণ করে। তাদের এ পরিকল্পনার পেছনে মুক্তিযুদ্ধের কয়েকজন কমান্ডারও পরোক্ষভাবে সমর্থন জানাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা তাদের আমাদের দিল্লীর অভিজ্ঞতা এবং বিএলএফ-মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার নীল নকশার কথাও খুলে বললাম। সব কিছু বিস্তারিত জানিয়ে তাদের অনুরোধ করলাম, যে করেই হোক কর্নেল ওসমানীকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে রাখতে হবে। তাকে সম্মুখে রাখতে না পারলে নীল নকশার মোকাবেলা করতে আমরা সবাই ব্যর্থ হব। আর তাতে জাতীয় স্বার্থ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের সাথে তারা একমত হলেন। ঠিক হল উপস্থিত সবার তরফ থেকে তারা কর্নেল ওসমানীর সাথে দেখা করে তাকে তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে অনুরোধ জানাবেন। একইসাথে তাকে আশ্বাসও দেয়া হবে তিনি যাতে স্বসম্মানে তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নিতে পারেন সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অস্থায়ী সরকারকে বাধ্য করা হবে সমগ্র মুক্তিযোদ্ধাদের তরফ থেকে। কর্নেল ওসমানীর সাথে গোপন বৈঠক হল। আমরা যা বলেছিলাম তার পুনরাবৃত্তিই তিনি করলেন তাদের কাছে। সবাই তার পদত্যাগ করার পেছনের যুক্তি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন। সব বুঝে তারা তাকে অনুরোধ জানালেন জাতীয় স্বার্থ বিরোধী সব ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করার জন্য তার নেতৃত্ব বিশেষভাবে প্রয়োজন। একমাত্র তিনিই মুক্তি বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেন। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া কোন ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাদের দেয়া Assurance এর পরিপ্রেক্ষিতে কর্নেল ওসমানী তার পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করবেন বলে আমাদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। তার সাথে আলাপের পর আমরা গেলাম অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট জনাব নজরুল ইসলাম ও অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিনের কাছে। আমাদের দেখে দু’জনই বেশ কিছুটা অস্বস্থিবোধ করছিলেন। সকালের মিটিং-এর অবস্থা বুঝে জনাব তাজুদ্দিন ইতিমধ্যেই শংকিত হয়ে পড়েছিলেন। সরাসরিভাবে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হল,
– আপনি কোন যুক্তির ভিত্তিতে সকালে আপনার বক্তব্যে বললেন সেক্টর কমান্ডারদের অনাস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কর্নেল ওসমানী পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
জবাবে কিছুটা বিব্রত হয়ে তাজুদ্দিন সাহেব বললেন,
– তার কাছে খবর রয়েছে যে বেশ কিছু কমান্ডার জনাব ওসমানীর উপর অনাস্থা পোষণ করছেন।
– মহামান্য প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, শুধুমাত্র কমান্ডারদের তরফ থেকেই নয়, সমগ্র মুক্তি ফৌজের তরফ থেকে আমাদের পূর্ণ আস্থাই যে রয়েছে কর্নেল ওসমানীর উপর মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে তা নয় তিনি আমাদের অতি শ্রদ্ধার পাত্রও বটে। তার পরিবর্তে অন্য কাউকে যদি কমান্ডার ইন চীফ বানাবার চিন্তা-ভাবনা করে থাকেন তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি আমাদের বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারেন। প্রবাসী সরকারের হয়তো বা ক্ষমতা থাকতে পারে, সরকার ইচ্ছামত একজন সর্বাধিনায়কও নিয়োগ করতে পারে কিন্তু তার পরিণতি কি হবে সেটাও একটু ভেবে দেখবেন। মেজর জিয়াই প্রধানমন্ত্রীর কথার জবাব দিলেন।
জনাব নজরুল ইসলাম ও তাজুদ্দিন দু’জনই মেজর জিয়ার কথা শুনে ভীষণভাবে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষন ভেবে তাজুদ্দিন সাহেব বললেন,
– ওসমানী সাহেব স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন। তিনি সেটা প্রত্যাহার করলে সরকার তার পূনর্নিয়োগ সর্ম্পকে পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
– তিনি স্বেচ্ছায় ইস্তফা দিয়েছেন সেটা ঠিক। কিন্তু সম্মেলনে আপনি যে কারণে তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন সেটা সত্য নয়। কি কারণে তিনি পদত্যাগপত্র সরকারকে স্বেচ্ছায় দিয়েছেন সেটা আমরা অবশ্যই শুনব তার কাছ থেকেই। আমাদের অনুরোধ কাল সম্মেলনে আপনি বলবেন, আপনার কাছে যে খবর এসেছিল কিছু কমান্ডারের অনাস্থার ব্যাপারে সেটা তদন্তে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তাই নয় আপনি আরও বলবেন উপস্থিত সব কমান্ডার এবং সমগ্র মুক্তি ফৌজের দাবি একমাত্র কর্নেল ওসমানীই থাকবেন কমান্ডার ইন চীফ হিসেবে। অন্য কেউ নয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে সবার তরফ থেকে আপনি স্বয়ং তাকে তার ইস্তফা প্রত্যাহার করে নেবার জন্য অনুরোধ জানাবেন এবং একমাত্র সে ক্ষেত্রেই তিনি তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করবেন।
কথার ধরণ থেকে বুদ্ধিমান জনাব তাজুদ্দিন আহমদ বুঝে নিলেন মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডাররা ইতিমধ্যে অনেক কিছুই জেনে গেছেন। পর্দার অন্তরালে পাশা খেলার চালগুলো সম্পর্কেও হয়তোবা অনেকেই অবগত হয়ে পড়েছেন। তাই কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে না পড়ার জন্য মেজর জিয়ার অনুরোধ মেনে নিতে রাজি হলেন প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন। পুরো মিটিং এ নির্বাক নিরব সাক্ষী হয়ে নিশ্চুপ বসে ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব নজরুল ইসলাম। মিটিং এর বিস্তারিত বিবরণ নূরের মাধ্যমে জানানো হল কর্নেল ওসমানীকে। পরদিন কথামত কাজ করলেন প্রধানমন্ত্রী। তার অনুরোধে কর্নেল ওসমানী তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে সম্মেলনের নেতৃত্ব দেবার স্বীকৃতি জানালে করতালির মাধ্যমে উপস্থিত সবাই কর্নেল ওসমানীর সিদ্ধান্তকে আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন। কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে সম্মেলন শুরু হল। চানক্য বুদ্ধির দূরভিসন্ধি নস্যাৎ করে কর্নেল ওসমানীকে কমান্ডার ইন চীফ পদে বহাল রাখতে পেরে আমরা তার উপযুক্ত মর্যাদা দিতে পেরেছিলাম বলে নিজেদের আত্মপ্রত্যয় অনেক বেড়ে গিয়েছিল। আমাদের এই বিজয় থেকে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন যে, জানবাজ মুক্তিসেনারা অন্যায় ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কোন কিছুই মুখ বুজে সহ্য করবেন না। এ সম্মেলনে যুদ্ধের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন সমস্যা এবং ভবিষ্যতে কর্মপন্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে কর্নেল ওসমানীর মনোভাব আমাদের আগেই জনা ছিল, সে আলোকেই আলোচনা পরিচালিত হয়। ঐ বৈঠকে লেঃ কর্নেল এম এ রব বাংলাদেশ মুক্তি ফৌজের চীফ অফ ষ্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দোকার ডেপুটি চীফ অফ ষ্টাফ নিযুক্ত হন। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যেসব নেয়া হয়েছিল তা হচ্ছেঃ-
১। বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা নির্ধারন।
২। মুক্তিযুদ্ধের কৌশল পদ্ধতির সারসংক্ষেপ এবং বর্ণনা।
(ক) নির্ধারিত এলাকায় নির্দিষ্ট দায়িত্বে পাঁচ অথবা দশজনকে নিয়ে গঠিত ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা দলগুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হবে।
(খ) গেরিলাদের শ্রেণী বিভক্তিঃ-
এ্যাকশন গ্রুপঃ
এ গ্রুপের সদস্যরা শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি তবে গেরিলা হামলা চালাবে। তারা শতকরা ৫০ থেকে ১০০ ভাগ হাতিয়ার বহন করবে।
গোয়েন্দা সেনাঃ
এই গ্রুপের গেরিলারা হেডকোয়ার্টারসের অধিনে প্রতিষ্ঠিত গোয়েন্দা বিভাগের নির্দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এরা সাধারণত সম্মুখ সংঘর্ষে জড়িত হবে না। এদের মূল দায়িত্ব হবে খবরা-খবর সংগ্রহ করা। এদের কাছে শতকরা ৩০ থেকে ৫০ ভাগের বেশী অস্ত্র থাকবে না।
গেরিলা ঘাটিঃ
প্রতিটি গেরিলা ঘাটি সেক্টর ট্রুপস এর দ্বারা রক্ষিত হবে। প্রতিটি ঘাটিতে গেরিলাদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা এবং ট্রেনিং এর ব্যবস্থা থাকবে৷ প্ৰত্যেক ঘাটিতে একটি করে মেডিকেল টিম থাকবে প্রয়োজনে গেরিলাদের চিকিৎসার জন্য। প্রত্যেক ঘাটিতে গেরিলাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলার জন্য একজন রাজনৈতিক নেতা থাকবেন। তার দায়িত্ব হবে বিভিন্ন কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে পাকিস্তানীদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়া এবং একই সঙ্গে বাঙ্গালীরা যেন মানসিক সাহস ও শক্তি হারিয়ে না ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। শত্রুর বিরুদ্ধে বড় ধরণের আক্রমন পরিচালনার উদ্দ্যেশ্যে আরো বেশি সংখ্যক গেরিলা কিংবা নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকদের সংকুলানের জন্য প্রতিটি ঘাটিকে তৈরি রাখাও এদের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু বাস্তবে পরবর্তিকালে এই রাজনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য মুজিবনগর সরকার থেকে কোন প্রতিনিধিই আসেনি। সেক্টর এবং সাব-সেক্টর কমান্ডারদেরকেই নিজেদের উদ্যোগে এ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল।
৩। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের অবিলম্বে ব্যাটালিয়ন ফোর্স এবং সেক্টর ট্রুপস এ সংগঠিত করতে হবে।
৪। যুদ্ধ পরিকল্পনার পদ্ধতি ছিল নিম্নরূপঃ-
(ক) প্রতিটি সুবিধাজনক স্থানে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানার জন্য বিপুল সংখ্যক গেরিলাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর বন্দোবস্ত করতে হবে।
(খ) কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে দেয়া হবে না। বিদ্যুতের খুঁটি, সাবস্টেশন প্রভৃতি ধ্বংস করে বিদ্যুৎ সরবরাহ অচল করে দিতে হবে।
(গ) কোন কাঁচামাল কিংবা উৎপাদিত পণ্য রফতানি করতে দেয়া হবে না৷ এ সমস্ত জিনিস যে সমস্ত গুদামে থাকবে সেগুলো ধ্বংস করে দিতে হবে।
(ঘ) শত্রুপক্ষের সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম, রসদপত্র আনা নেয়ার জন্য ব্যবহারযোগ্য যানবাহন, রেলপথ, নৌযান, রাস্তা, পুল প্রভৃতি পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করতে হবে।
(ঙ) রণকৌশলগত পরিকল্পনা এভাবে করতে হবে যাতে শত্রুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
(চ)শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করার পর তাদের বিচ্ছিন্ন গ্রুপগুলোর উপর গেরিলারা মরণপন আঘাত হানবে। এ সম্মেলনে বাংলাদেশকে নিম্মোক্ত এগারোটি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়ঃ
১নং সেক্টরঃ
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী জেলার অংশ বিশেষ মুহুরী নদীর পূর্ব এলাকা নিয়ে এই সেক্টর গঠিত হয়। সমগ্র সেক্টরকে ৫টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। মেজর জিয়া সেক্টর কমান্ডার নিয়োজিত হন। (পরে জিয়া জেড ফোর্স কমান্ডার নিযুক্ত হওয়ার পর ক্যাপ্টেন রফিক ১নং সেক্টর কমান্ডার নিয়োজিত হন। ) এ সেক্টরের মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল ২১ শত। এর মধ্যে ১৫’শত ইপিআর, ২’শ পুলিশ, ৩’শ সামরিক বাহিনী এবং নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১’শ। এখানে গেরিলাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার। এদের মধ্যে ৮ হাজারকে এ্যাকশন গ্রুপ হিসাবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শতকরা ৩৫ ভাগ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দেয়া হয় এই সেক্টরকে।
২নং সেক্টরঃ
কুমিল্লা, ফরিদপুর জেলা, নোয়াখালী ও ঢাকার অংশ বিশেষ নিয়ে এ সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর খালেদ মোশাররফ। সেক্টরটিকে ৬টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। সমগ্র সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ হাজার। গেরিলা ছিল ৩০ হাজার। (মেজর খালেদ মোশাররফ ফোর্স কমান্ডার হিসেবে গুরুতরভাবে আহত হওয়ার পর ক্যাপ্টেন হায়দার সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। )
৩নং সেক্টরঃ
মৌলভীবাজার, ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ নিয়ে এই সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টরটিকে ১০টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। গেরিলাদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর শফিউল্লাহ। (এস’ ফোর্স গঠনের পর মেজর শফিউল্লাহর জায়গায় মেজর নূরুজ্জামানকে ৩নং সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়। )
৪ নং সেক্টরঃ
উত্তরে সিলেট সদর এবং দক্ষিনে হবিগঞ্জ থানার মধ্যবর্তী সমস্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ৪নং সেক্টর। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। সেক্টরটিকে ৬টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ হাজার। গেরিলা ছিল প্রায় ১২ হাজার।
৫নং সেক্টরঃ
সিলেট জেলার উত্তরাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় এই সেক্টর। কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর মীর শওকত আলী। নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮’শ, গেরিলা ছিল প্রায় ৫ হাজার। সেক্টরটিকে ৬টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।
৬নং সেক্টরঃ
এই সেক্টর রংপুর এবং দিনাজপুর নিয়ে গঠিত হয়। উইং কমান্ডার এম কে বাশার নিযুক্ত হন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। সাব-সেক্টর ৫টি। নিয়মিত বাহিনী সংখ্যা প্রায় ১২’শ। গেরিলা ছিল প্রায় ৬ হাজার।
৭নং সেক্টরঃ
রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া জেলা এবং দিনাজপুর জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত হয় এ সেক্টর। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর নাজমুল হক। (যুদ্ধকালীন সময় এক মটর দুর্ঘটনায় তিনি শহীদ হলে তার স্থলে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর এম হাসান। ) সাব-সেক্টরের সংখ্যা ৮টি। সৈন্য সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। গেরিলা প্রায় ৮ হাজার।
৮নং সেক্টরঃ
কুষ্টিয়া, যশোর এবং খুলনার অংশ বিশেষ নিয়ে এ সেক্টর গঠন করা হয়। ১৫ই জুলাই পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ ওসমান চৌধুরী। পরবর্তিকালে মেজর ওসমানকে হেডকোয়ার্টারসএ বদলি করে নিয়ে আসা হয়। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার পর মেজর মঞ্জুর ৮ নং সেক্টরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ হাজার। গেরিলা প্ৰায় ৮ হাজার। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ৭টি।
৯নং সেক্টরঃ
বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনার অংশ বিশেষ, ফরিদপুরের একাংশ নিয়ে এ সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ৮টি। নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫’শ। গেরিলা প্রায় ১৫ হাজার।
১০নং সেক্টরঃ
এ সেক্টরের কোন আঞ্চলিক সীমানা ছিলনা। নৌ কমান্ডোরাই এ সেক্টরের অধিনে ছিল। শত্রুপক্ষেও টার্গেট ধ্বংস করার জন্য প্রয়োজন মত বিভিন্ন সেক্টরে গ্রুপ গঠন করে তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্বে পাঠানো হবে সেই সিদ্ধান্তই নেয়া হয়। তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য সার্বিক সহযোগিতা করার নির্দেশ দেয়া হয় সেক্টর কমান্ডারদের। দায়িত্ব সম্পন্ন করার পর নৌ কমান্ডোরা সব আবার তাদের মূল আস্তানা ১০নং সেক্টরে ফিরে আসবে ঠিক করা হয়।
১১নং সেক্টরঃ
এ সেক্টর ছিল বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল এবং তুরা ও গারো অঞ্চল নিয়ে। কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর তাহের। (১৫ই নভেম্বর এক অভিযানে তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়ে একটি পা হারান।) সাব-সেক্টর ছিল ৮টি। গেরিলা সংখ্যা ২৫ হাজার।
এ সম্মেলনে সেক্টরসমূহ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার পর মুক্তি ফৌজের সৈনিকদেরকেও নিম্নলিখিত ক্যাটাগরিতে পূনর্গঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ঃ-
নিয়মিত বাহিনীঃ
২৫শে মার্চ রাতের শ্বেত সন্ত্রাসের পর ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ কোর এবং অন্যান্য সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যদের নামকরণ করা হয় নিয়মিত বাহিনী।
বিশেষ ফোর্সঃ
আর্মি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে তিনটি ব্রিগেড গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷ তখনকার ৫টি ব্যাটালিয়নকে কেন্দ্র করেই নিয়মিত বাহিনীর পূনর্গঠনের কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এইসব ব্যাটালিয়নের জনশক্তি ছিল খুবই কম। প্রত্যেক সেক্টর থেকে উপযুক্ত লোক সংগ্রহ করে এদের শক্তি বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ক্রমান্বয়ে নতুন আরও ব্যাটালিয়ন দাড় করানোর সিদ্ধান্ত হয়।
এগুলোকে পরে ব্রিগেড গ্রুপে সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এদের দ্বারা গঠিত তিনটি ব্রিগেড গ্রুপই পরে জেড’ ফোর্স, এস’ ফোর্স এবং কে’ ফোর্স নামে পরিচিত হয়।
সেক্টর ট্রুপস্ঃ
উপরোক্ত ব্যাটালিয়নগুলোতে যেসব ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও সামরিক বাহিনীর সৈনিকদের অর্ন্তভুক্ত করা সম্ভব হবে না তাদেরকে সেক্টর ট্রুপস হিসাবে যুদ্ধ করার জন্য ইউনিট এবং সাব-ইউনিটে সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন ধারনের জন্য নগন্য সম্মানী দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের তরফ থেকে । কিন্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের বেশিরভাগই ঐ অর্থ গ্রহণ না করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন।
অনিয়মিত বাহিনী অথবা ফ্রিডম ফাইটারস (এফ. এফ) :
গেরিলা হিসেবে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যাদের ট্রেনিং দেয়া হত তাদের বলা হত অনিয়মিত বাহিনী, গণবাহিনী, অথবা ফ্রিডম ফাইটাস। ফাইটার্স প্রথম পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলার অভাব ছিল। সঠিক রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ এবং কঠোর সংগ্রামী জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তাদের সুশৃঙ্খল গেরিলা হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গণবাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিংকালে সামান্য পকেট খরচা এবং বাংলাদেশের ভেতরে পাঠাবার সময় প্রথমবার তাদের কিছু রাহা খরচ দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এরপর তাদের বিশাল জনসমুদ্রে মিশে গিয়ে তাদেরই একজন হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার প্রশিক্ষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমাকে, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন, লেঃ মতি ও লেঃ নূরকে আগের দায়িত্বেই বহাল রাখা হয়।
কনফারেন্সে কমান্ডারদের নিয়মিত এবং অনিয়মিত বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো এবং সদস্য সংখ্যা হিসাব করে তাদের জন্য কাপড়-চোপড়, রেশন, অস্ত্র, গোলা-বারুদ, ওয়্যারলেস সেট, টেলিফোন, অতি আবশ্যকীয় রসদপত্রের তালিকা তৈরি করে মুজিবনগর সরকারের কাছে পেশ করতে বলা হয়। অস্থায়ী সরকার চাহিদা অনুযায়ী ভারত সরকারের কাছ থেকে জিনিসগুলো সংগ্রহ করবে সেই কথাই জানানো হয়েছিল মিটিং-এ। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কয়েকটি ফিল্ড হাসপাতাল গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এছাড়া সেক্টর এবং সাব-সেক্টরগুলোতেও চিকিৎসা কেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্তও গৃহিত হয়। কনফারেন্সে কর্নেল ওসমানী সবাইকে জানালেন ইতিমধ্যে পাকিস্তান থেকেও বাঙ্গালী সামরিক বাহিনীর অফিসাররা পালিয়ে আসার চেষ্টা এবং উদ্যোগ নিচ্ছে। এপ্রিল মাসে তিনজনের সর্বপ্রথম দলটির মাঝে রয়েছি আমি, লেঃ মতি ও লেঃ নূর। আমাদের কাছ থেকে জানা তথ্যের ভিত্তিতে তিনি আরও বলেছিলেন অনেক বাঙ্গালী অফিসারই স্বাধীনতা যুদ্ধ যোগ দেবার জন্য পালিয়ে আসার সুযোগ খুঁজছে কিন্তু সীমান্ত পার হয়ে ভারতে পালিয়ে এসে তারপর যুদ্ধে যোগ দেয়ার কাজটি খুবই বিপদজনক; বিশেষ করে পাকিস্তানে পরিবার-পরিজন নিয়ে যারা বসবাস করছে তাদের জন্য তো বটেই। তাছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারত সরকারের মনোভাব কি সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে না পারায় অনেকেই পালিয়ে ভারতে আসতে ভরসা পাচ্ছে না। তাদের এ ব্যাপারে প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করার আহ্বান জানানো হয়েছে বিশেষ যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে। পাকিস্তান থেকে অফিসাররা চলে আসছে জানতে পেরে সকলেই খুশি হলেন। আমাদের উষ্ণ অভিনন্দন জানানো হল।
অস্ত্রশস্ত্র এবং রসদপত্র সংগ্রহের ব্যাপারে পরে আমাদের হয়েছিল তিক্ত অভিজ্ঞতা৷ কখনোই আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং রসদপত্র পাইনি। যা পেয়েছি তার পরিমাণ চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। নিঃসন্দেহে এ সমস্যার কারণে আমাদের যুদ্ধের প্রথম অবস্থায় শত্রুর হাতে মার খেতে হয়েছিল অনেকক্ষেত্রে। পরবর্তিকালে কমান্ডাররা ক্রমান্বয়ে নিজেরাই সব ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ন হবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যান। শত্রুপক্ষ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রই ছিল আমাদের হাতিয়ারের মূল উৎস। এতে করে আমাদের পাঁচমিশালী হাতিয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। ফলে গোলাবারুদ নিয়ে আমাদের নিদারুণ সংকটে পড়তে হত। যানবাহনের সমস্যা ছিল অতি প্রকট। আমরা সম্পূর্নভাবে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা এবং মুক্তাঞ্চল থেকে কব্জা করা গাড়িগুলোর উপরই নির্ভরশীল ছিলাম। এদের রক্ষনা-বেক্ষনের দায়িত্বও নিতে হয় কমান্ডারদেরকেই। আমাদের চিকিৎসার সমস্যাও ছিল প্রকট। ভারতীয় হাসপাতালগুলো প্রায় সময় ভরে থাকত শরনার্থীতে।
যুদ্ধকালীন সময় সবচেয়ে বড় ফিল্ড হাসপাতালটি স্থাপিত হয়েছিল ২নং সেক্টরের বিশ্রামগঞ্জে। বৃটেন থেকে আগত ডাঃ জাফরুল্লাহ, ডাঃ মোমেন এবং তাদের আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের উদ্যোগে এবং প্রবাসী বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী হিতৈশীদের সাহায্যে এই বেসরকারি ফিল্ড হাসপাতাল অতি কষ্টে স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধে তারা অমূল্য অবদান রাখেন। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে খুব কম সংখ্যক চিকিৎসকই যুদ্ধে যোগদান করে। তাই তাদের ঘাটতি পূরণ করতে হয়েছিল মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সাহায্যে। তাদের নিঃস্বার্থ প্রাণঢালা সেবার কথা মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই ভুলতে পারবেন না।
এ ধরণের আরো অনেক সমস্যা ও সমাধানের উপায় কনফারেন্সে যদিও বা আলোচিত হয়েছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সব চাহিদাই পূরণ করা হবে বলে মুজিবনগর সরকারের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধকালীন সময় মুক্তিযোদ্ধারা কখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে কিছুই পায়নি। ঠিক সময়মত পাওয়া যায়নি অতি প্রয়োজনীয় যুদ্ধসম্ভার। বর্ষাকালে জরুরী ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আচ্ছাদন নির্মানের কথা থাকলেও সে আচ্ছাদন তৈরি করতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। মুক্তিযোদ্ধারা হাড়কাপুনী শীতে রাত কাটিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে। তাবু এবং শীতবস্ত্রের পর্যাপ্ত কোন বন্দোবস্তই করা সম্ভব হয়নি সরকারের পক্ষে। কম্বলের উষ্ণতা থেকে বঞ্চিত থেকেছেন আহত মুক্তিযোদ্ধারা। অধিকাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন আধপেটা খেয়ে, খালিগায়ে, খালিপায়ে। সব কষ্ট, সব অসুবিধা তারা হাসিমুখে মোকাবেলা করেছিলেন একটি স্বপ্নের নেশায়। সে স্বপ্ন স্বাধীন শোষণমুক্ত বাংলাদেশ।
জুলাই মাসে পৌঁছলেন ক্যাপ্টেন তাহের, ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী এবং মেজর মঞ্জুর-তার পরিবার এবং দু’জন সৈনিক দেহরক্ষী। তারা শিয়ালকোট সেক্টর দিয়ে পালিয়ে আসেন। তাদের পর আরো যারা পালিয়ে আসেন তারা হল ক্যাপ্টেন খায়রুল আনাম, ক্যাপ্টেন পাশা, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশিদ খান, লেঃ বজলুল হুদা, ক্যাপ্টেন রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন ফারুক রহমান, ক্যাপ্টেন রশিদ, লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর প্রমুখ। কনফারেন্সের সুযোগে অনেকের সাথেই আমাদের মত বিনিময় হয় ভারতীয় নীল নকশার প্রভাব ও পরিণতি নিয়ে। যাদের সাথে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলাম শুধু তাদের সাথেই গোপনে আলোচনা করা হয়েছিল এই অতি স্পর্শকাতর বিষয়টি। মেজর জিয়া, মেজর খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন জলিল এবং উইং কমান্ডার বাশার এর অন্যতম। পরবর্তী পর্যায়ে মেজর মঞ্জুর, ক্যাপ্টেন তাহের, ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন, ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিন, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার, ক্যাপ্টেন হাফিজ, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন রশিদ, ক্যাপ্টেন মহসীন, ল্যোটেনেন্ট হুদা, লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর ছাড়াও যাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল তাদের সাথেও বিস্তারিত আলোচনা হয়। পর্দার অন্তরালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন মহল, অস্থায়ী সরকার ও ভারতীয় প্রশাসনের চক্রান্ত ও স্বার্থ নিয়ে আলোচনার ফলে কতগুলো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে ঐক্যমত্যের সৃষ্টি হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ভারত সরকারের নীতি এবং মুজিবনগর সরকারের অযোগ্যতাকে নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করা ঠিক হবে না। আমাদের বিভিন্ন মহলের উদ্দ্যেশ্য এবং তাদের হীন উদ্দ্যেশ্য হাসিলের চক্রান্তের ব্যাপারে সদা সচেতন থাকতে হবে। একইসাথে মুক্তিযোদ্ধাদের পূনর্গঠন করে তাদেরকে সামরিক এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে চক্রান্তের বিভিন্ন দিক। তাদের মটিভেট করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে সব চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দিয়ে আমাদের দেশ স্বাধীন করতে হবে আমাদের নিজেদেরকেই। শুধুমাত্র ইসলামাবাদ থেকে দিল্লীতে রাজধানী বদলের জন্য যুদ্ধ করছি না আমরা, প্রয়োজনে পাক বাহিনীর সাথে সাথে অবস্থা অনুযায়ী ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করার জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে মুক্তিযোদ্ধাদের। আট কোটি বাঙ্গালীর জন্য হাসিল করতে হবে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে একটি যথার্থ স্বাধীন বাংলাদেশ। কোন করদ রাজ্য কিংবা নামেমাত্র স্বাধীনতা নয়, চাই প্রকৃত স্বাধীনতা এবং জাতীয় মুক্তি। প্রত্যেক কমান্ডারকে তার কর্মদক্ষতা, শৌর্য্য-বীর্য, সাংগঠনিক দক্ষতা, আত্মত্যাগ, রাজনৈতিক সচেতনতা, দেশপ্রেম, রণযোগ্যতা, সাহস ও নৈতিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তাঙ্গনের জনগণের হৃদয়ে নেতৃত্বের স্থান করে নিতে হবে যাতে করে যুদ্ধত্তোর পর্বে প্রয়োজনে যে কোন ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হয়। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে তৈরি করে তুলতে হবে জনগণের Natural Leader হিসেবে। এভাবেই সম্ভব হবে নিজেদের শক্তির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা। এভাবে নিজেদের তৈরি করতে পারলে ভবিষ্যতে যে কোন হুমকির মোকাবেলায় জনগণকে সাথে নিয়ে পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে সক্ষম হবেন যে কোন ক্রান্তিলগ্নে। স্বার্থপর রাজনৈতিক নেতৃত্ব জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের সংগ্রামে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন।
ভৌগলিক সীমানা বিকৃত করার চক্রান্ত
বর্তমান বাংলাদেশ আদি বঙ্গের একটি অংশমাত্র। ১৯৭১ সালে জাতীয় পতাকার মাঝখানে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র বসিয়ে দেয়ার বিষয়টি ছিল চক্রান্তমূলক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং সচেতন জনতার বিরোধিতার চাপে মুজিবনগর সরকার মানচিত্র সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। আদি বঙ্গের পরিসীমা নির্ধারিত ছিল এভাবেঃ উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা, নেপাল, সিকিম এবং ভূটান। উত্তরপূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র এবং এর অববাহিকার গড়ে উঠা ব-দ্বীপ অঞ্চল, উত্তর পশ্চিমে দাড় গঙ্গা, উত্তরে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত ভাগিরথী নদীর অববাহিকার সমতলভূমি, পূর্বদিকে বার্মার পর্বতমালা, পশ্চিম বঙ্গের সর্বাঞ্চল, বীরভূম, মালভূম, ধলভূম, কেওজ্ঞর, ময়ূরভজ্ঞের অরণ্যময় মালভূমি, দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর। এই সমগ্ৰ জায়গা নিয়েই ছিল প্রাচীনকালের বঙ্গ অথবা বাংলাদেশ। উল্লেখযোগ্য জনপদগুলো ছিল গৌড়, পুন্ড্র, বরেন্দ্র, রাড়, সুহস্র, তাম্রলিপ্ত, সমতট, বঙ্গ, বাঙ্গাল, হরিকল প্রভৃতি জনপদ গড়ে তুলেছিল বঙ্গবাসী বা বাংলাদেশীরা। কোল, ভীল, সাবর, পুলিন্দ, হড়ী, ডোম, চন্ডাল, সাওঁতাল, মুন্ডা, ওরাঁও, ভূমিজ, বাগদী, বাউড়ী, পোদ, মালপাহাড়ী প্রমুখ অস্তজ এদের সমন্বয়েই সৃষ্টি হয়েছিল বঙ্গবাসী অথবা বাঙ্গালী জাতিগোষ্ঠি। কালের আবর্তে বিদেশী আগ্রাসী শক্তিসমূহ এদেশকে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশকে বিভক্ত করেছে তাদের শাসন ও শোষণ কায়েম রাখার জন্য ভৌগোলিক দ্বিধা-বিভক্তির ফলে জাতি হয়ে পরেছে বিভক্ত। কিন্তু ভৌগোলিক সীমানা অপরিবর্তনীয় নয়। আমাদের পূর্ব পুরুষরা গড়ে তুলেছিলেন সর্বোৎকৃষ্ট জনপদ, শহর, নগর, বন্দর এবং সমৃদ্ধ রাজ্য ও জনপদ। তারা সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটিয়েছিলেন উন্নতমানের সংস্কৃতি এবং বিষ্ময়কর ঐতিহ্যবাহী শিল্প ব্যবস্থা। এর সবকিছুই আমাদের জাতীয় গৌরব। কায়েমী স্বার্থবাদীরা যতই চেষ্টা করুক না কেন আমাদের আবাসভূমি সীমানা সর্ম্পকে ধূম্রজাল সৃষ্টি করতে এবং জাতীয়তাবাদ নিয়ে জটিলতা এবং উৎভ্রান্তি সৃষ্টি করতে যাতে করে তাদের কায়েমী স্বার্থ টিকে থাকে তা একদিন নস্যাৎ হয়ে যাবে। কোন বিতর্ক সৃষ্টি করতে জনগণকে সর্বকালের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা কিছুতেই সম্ভব হবে না। জাতি একদিন ঐতিহাসিক সত্যকে অনুধাবন করতে সক্ষম হবে এবং ইনশাল্লাহ এমন একদিন নিশ্চয়ই আসবে যখন তারা তাদের দীর্ঘদিনের অন্যায় এবং বঞ্চনার হিসাব-নিকাশ করে তাদের ঐতিহাসিক পাওনা আবার আদায় করে নেবে।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ই কাদের সিদ্দিকীকে আলোচ্য ব্যক্তিত্ব হিসাবে গড়ে তোলে।
আমি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছি। পুরোপুরিভাবে সুস্থ না হলেও সেপ্টেম্বরের শেষাশেষি আমি সেক্টরে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেই ।
কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠার পর সেপ্টেম্বরে ফিরে গেলাম সেক্টরে। বা হাতে তখনও প্লাষ্টার। যুদ্ধ তখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলাদেশে। মুক্তিফৌজ এবং গেরিলাদের হাতে প্রচন্ড মার খেয়ে হানাদার বাহিনী দিশেহারা। তাদের মনোবল সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। তীব্র গেরিলা অভিযানে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে খানসেনারা তখন বড়বড় শহরে Defensive Position -এ বাধ্য হয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। শহরগুলো ছাড়া সারা বাংলাদেশ তখন বিশাল এক মুক্তাঙ্গন। েেগরিলারা প্রায় পুরো দেশই তাদের অবাধ বিচরণ ভূমিতে পরিণত করেছেন। তাদের সফল তৎপরতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিমধ্যেই সময়সাপেক্ষে একটি বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। মুক্তিফৌজের সাহস, উদ্দম এবং সাংগঠনিক শক্তি ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। প্রধান প্রধান শহরগুলো এমনকি ঢাকা শহরেও প্রকাশ্য দিবালোকে অসীম সাহসিকতার সাথে একটার পর একটা সফল অভিযান করে চলেছে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। নাস্তনাবুদ বেসামাল খানসেনারা ‘মুক্তি’-দের সর্বদা তটস্থ অবস্থায় থাকছে। বিশেষ করে রাতের আধাঁর ওদের জন্য হয়ে উঠেছে নাভিশ্বাসের কারণ। জানবাজ মুক্তিযোদ্ধাদের অভূতপূর্ব সাফল্যের খবরগুলো বিদেশী প্রচার মাধ্যগুলোতে শিরোনামে প্রকাশিত হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। আমাদের Moral ভীষণ High. ইতিমধ্যে বিএলএফ এর ট্রেনিংপ্রাপ্ত সদস্যরা দেশের ভিতরে বিভিন্ন Strategic Point -এ অবস্থান নিয়েছে। তাদের অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিফৌজের তুলনায় অনেক উচুমানের। এ সত্ত্বেও খান সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সংঘাতে তেমন একটা অংশগ্রহণ করছে না তারা। পক্ষান্তরে অনেক জায়গায় জনগণের উপর অন্যায়-জুলুম, চাঁদাবাজী এবং লুটপাট করছিল তারা। সে সমস্ত খবর পাচ্ছিলাম আমরা। তাদের ঐ ধরণের কার্যকলাপে বাধা দেবার কালে অনেক জায়গায় মুক্তিফৌজের যোদ্ধাদের সাথে তাদের সংঘর্ষ হচ্ছিল।
এই সময় হঠাৎ করে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমগুলো কাদের সিদ্দিকী নামক এক বিএলএফ সদস্য সম্পর্কে ফলাও করে প্রচারণা শুরু করে এমনভাবে যেন শুধুমাত্র কাদের সিদ্দিকীই মুক্তিযুদ্ধ করছে। এ ধরণের প্রচারণায় আমরা কিছুটা বিস্মিত হলাম। পাকিস্তান আমলে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই সৈনিক নায়েক কাদের সিদ্দিকীকে Disciplinary Charge এ শাস্তিমূলকভাবে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তার তেমন কোন বিশেষ ভূমিকার কথাও শোনা যায়নি। সেক্ষেত্রে তাকে নিয়ে এতটা হৈ চৈ কি উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। একইভাবে মাঝে মেজর খালেদ মোশাররফকেও ফোকাস এ আনার চেষ্টা চলেছিল কিছুদিন। পক্ষান্তরে মেজর জিয়া তার প্রাপ্য মর্যাদা কখনোই পাননি প্রবাসী ও ভারত সরকারের কাছ থেকে। দুই সরকার তার প্রতি ছিল সন্দিহান এবং বিদ্বেষপ্রবণ। কালুরঘাট থেকে দেশবাসীর প্রতি স্বতঃস্ফুর্তভাবে স্বাধীনতার যে উদাত্ত আহ্বান তিনি জানিয়েছিলেন তাকে মেনে নিতে পারেনি আওয়ামী সরকার।
মন্ত্রিসভা এবং সচিবালয় গঠন করা হলো
তরুণ আমলারা মুজিবনগর সচিবালয়ে যোগদানে অসম্মতি জানায়।
জুলাই আগষ্ট মাসে প্রবাসী সরকার সেই পুরোনো ঔপনিবেশিক ধাচেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সচিবালয় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সমস্ত আমলারা সীমান্ত পেরিয়ে কোলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিল তাদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল এ সমস্ত আমলাতান্ত্রিক সংগঠন। সেক্টর এবং সাব সেক্টরগুলোর মতো এ সমস্ত সংগঠনেও ভারতীয় প্রতিপক্ষ নিয়োগ করা হয়েছিল। কিছু তরুণ দেশপ্রেমিক আমলা ধরনের উদ্যোগের অসাড়তা উপলব্দি করে ঐ সমস্ত মন্ত্রণালয় এবং সচিবালয়ে যোগদানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। পরিবর্তে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগদান করে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। জনাব তৌফিক এলাহি চৌধুরি এবং জনাব কামাল সিদ্দিকী ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব খন্দোকার মোশতাক আমদ তার মন্ত্রণালয় স্থাপন করলেন সার্কাস এ্যাভেনিউতে। পুরো মিশনটাই তখন থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান দপ্তর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিল। পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন জনাব মাহবুবুল আলম চাষী। খন্দোকার মোশতাক আহমদের একান্ত সচিব জনাব কামাল সিদ্দিকী। এ ছাড়া সার্কাস এ্যাভেনিউতে জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং জনাব মওদুদ আহমদ বর্হিবিশ্বের সাথে এবং বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য একটি তথ্য সেল খুলেছিলেন। সেটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যোগসাজসে পরিচালিত হত। আইনজীবি হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জনাব মওদুদ আহমদ আওয়ামী লীগের পক্ষে কৌসুলী হয়ে যথেষ্ট কাজ করেছিলেন তবুও প্রবাসী সরকারের কাছ থেকে তিনি তার উদ্যোগের কোন স্বীকৃতি পাননি। এ ব্যাপারে বিশেষ দুঃখ প্রকাশ করে জনাব মওদুদ আহমদ প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহ্মদকে একটি নিবেদন পত্রও লিখেছিলেন। তিনি চাইছিলেন স্বীয় উদ্যোগে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে তিনি যা কিছুই করছিলেন প্রবাসী সরকার তার স্বীকৃতি দিয়ে তাকেও কোন একটা বড়সড় পদে বহাল করুক। কিন্তু তার সে আশা পূরণ করেনি মুজিবনগর সরকার অজানা কোন কারণবশতঃ।
তাজুদ্দিন আহমদ এবং খন্দোকার মোশতাক আহমদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।
শুরু থেকেই নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে মতপার্থক্য হতে থাকে। ভারত সরকার যে কোন কারণেই হোক খন্দোকার মোশতাক আহমদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না।
ইতিমধ্যে থিয়েটার রোডের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতার কথা প্রকাশ হয়ে পড়তে থাকে। নীতিগত অনেক বিষয়েই জনাব তাজুদ্দিন ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মাঝে ব্যবধান গড়ে উঠতে থাকে। ভারতীয় সরকারও জনাব মোশতাকের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠে। বাজারে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ গোপনে সিআইএ এর মাধ্যমে আমেরিকার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। অস্থায়ী সরকারের অলক্ষ্যে আমেরিকার মধ্যস্থতায় তিনি নাকি পাকিস্তান সরকার ও শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান খুজে পাবার চেষ্টায় আছেন। তার এই উদ্যোগের পেছনে আওয়ামী লীগের দক্ষিনপন্থী বেশ একটা বড় প্রভাবশালী অংশের সমর্থনও নাকি রয়েছে। এ ধরণের গুজব ছড়িয়ে পড়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। তার এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হল। নেতাদের অনেকেই তখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ করে সহসা বা কোনদিনই দেশ স্বাধীন করা যাবে কিনা এ বিষয়ে বিশেষ সন্দেহ পোষণ করতেন।
তাদের মনোভাব ছিল এরূপঃ- যা হবার তাতো হয়েই গেছে। আথের যতটুকু গোছাবার তাও বেশ গুছিয়ে ফেলা হয়েছে সেক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরতে না পারলে, গোছান সম্পদ ভোগ করা যাবে না। তাই ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমার সুযোগটা বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।
তারা কোলকাতায় বেশ আরাম-আয়েশেই সময় কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে তাদের অসৎ উপায়ে লুটপাট করার কথা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছিল। এতে তাদের সম্মানেরই শুধু হানি হচ্ছিল তা নয় তাদের অনেকের প্রতিই বিক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তারা যেখানে অনাহারে, অস্ত্রহীন-বস্ত্রহীন অবস্থায় দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবনবাজী রেখে রণাঙ্গনে লড়ছেন তখন এ সমস্ত অসৎ রাজনীতিবিদ ও লুটেরার দল লুটপাটের বেশুমার টাকায় বিলাসী জীবন যাপন করে বাঙ্গালীদের বদনাম করছিলেন অতি নির্লজ্জভাবে। এ অপমান মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিতে চাচ্ছেন আওয়ামী লীগের অনেক সদস্যই। তারা বাংলাদেশের অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে দোদুল্যমনতায় ভুগছেন। অনেকেই আবার ভারতীয় নীল নকশার কথা আচঁ করতে পেরে শংকিত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু তাদের ফিরে যাবার পথে মূল বাধা হয়ে দাড়িয়েছে ইন্দিরা সরকার। ভারত সরকার কিছুতেই চাচ্ছে না বাংলাদেশ প্রবাসী সরকার ইয়াহিয়া সরকারের সাথে কোনরূপ রাজনৈতিক আপোষের চেষ্টা করুক। তাদের চাপের মুখে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে জনাব তাজুদ্দিন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে বাধ্য হন, “ইয়াহিয়া সরকারের সাধারণ ক্ষমা প্রবাসী সরকারের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।” মুক্তিযোদ্ধারাও সংগ্রামের এই পর্যায়ে কোনরকম আপোষের বিরোধিতা করছিলেন। তারা চাইছিলেন দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে। এভাবেই সার্বিক অবস্থা ক্রমশঃ জটিল হয়ে উঠছিল। হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশতাক আমদ আমেরিকা যাচ্ছেন লন্ডন হয়ে এক সফরে। বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে জাতিসংঘ প্রধান এবং অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধান বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়কদের সাথে তিনি মত বিনিময় করে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি তাদের সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করবেন তিনি এ সফরকালে। অতএব তার এই সফর হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাবার সব প্রস্তুতিই প্রায় শেষ। কামাল সিদ্দিকীও যাচ্ছে সফরসঙ্গী হয়ে। কিন্তু সেই অবস্থাতেই আকস্মিকভাবেই সফর স্থগিত করে দেয় প্রবাসী সরকার। শুধু তাই নয়, মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয় এবং তার স্থলে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানানো হয়। জনাব মাহ্রুব আলম চাষীকেও সরিয়ে দেয়া হয় পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব থেকে। এই ধরণের পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে সবকিছুই চেপে যায় তাজুদ্দিন সরকার। কিন্তু পরে সব গোপনীয়তাই ফাঁস হয়ে যায়।
জানা যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা নাকি জানতে পারে যে, জনাব মোশতাক আহ্মদ গোপনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। তার লন্ডন সফরের উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন সরকারের মধ্যস্থতায় শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া সরকারের সাথে একটা চুড়ান্ত ফায়সলা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছা। এই চক্রান্তের খবর পেয়েই জনাব তাজুদ্দিন ভারত সরকারের নির্দেশেই ঐ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন। আরো তথ্য জানা যায়- খন্দোকার মোশতাক আহমদ, ইয়াহিয়া সরকার এবং মার্কিন সরকারের ত্রি-পাক্ষিক ঐ সমঝোতা-আলোচনার প্রতি শেখ মুজিবর রহমানের সমর্থন ছিল।
♦ পাকিস্তানের রাজনীতির পরিণাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আমাদের সিদ্ধান্ত
♦ কোলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ
♦ ভারতীয় নীলনকশা এবং মুজিব নগর সরকার
♦ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হল ; আদর্শিক দেউলিয়াপনা, কোন্দল ও ভাঙ্গন
♦ ৭১ এর চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আওয়ামী কুশাসন এবং প্রতিরোধ
♦ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এবং মুজিব সরকার
♦ আওয়ামী দুঃশাসন এবং দুর্নীতির মুখোমুখি সামরিক বাহিনী
♦ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম
♦ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ১৫ই আগষ্টের মহান বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান
♦ প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, মোশতাক সরকার এবং সেনা পরিষদ
♦ ৩রা নভেম্বরের ব্যর্থ ক্যু’দাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার সফল বিপ্লব
“আমি মেজর ডালিম বলছি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ