হাসান মাহমুদ (ফতে মোল্লা)
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। দিনটি ছিল রবিবার ২৭শে জুন ৩৩ মুক্তিসন (২০০৪ সাল)। সকাল দশটায় ঢাকাতে ‘নাস্তিক-মুরতাদ প্রতিরোধ কমিটি’ আর “মুসলিম মিল্লাত শারিয়া কাউন্সিলের’ ঢাকা মহানগরী কমিটির সভায় প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মওলানা সাফায়েত উল্লাহ জালালী’র সভাপতিত্বে শারিয়া কাউন্সিলের সভাপতি মওলানা মুফতি কুদরতে এলাহী এবং সদস্য মওলানা জাকারিয়া, মওলানা একায়েদ উল্লাহ, মওলানা কেরামত আলী, মওলানা জব্বার ফতেহপুরী, মুফতি সালেহ আহমদ প্রমুখ (তাঁদের মতে) এক বিশেষ সিদ্ধান্তে বিভিন্ন ‘ইসলাম বিরোধী’ কর্মকাণ্ডের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসির মামুন আর অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুল মোকাদ্দেস আকাশকে সুরা তওবার ৬ নম্বর আয়াত অনুযায়ী ‘মুরতাদ’ অর্থাৎ ইসলাম-ত্যাগী ঘোষণা করে ইসলামের আনুষ্ঠানিকতায় ফিরে আসার জন্য তিন মাসের সময় দিয়েছেন। তিন মাসের মধ্যে অধ্যাপকরা এ প্রস্তাবে সম্মত না হলে সুরা তওবার ১১ নম্বর আয়াত অনুযায়ী তাদের হত্যার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। ড. হুমায়ুন আজাদ তখনও জীবিত।
ওই নামের মওলানা-মুফতিদের নাকি পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু কাণ্ডটা কেউ করেছে তাতে সন্দেহ নেই। এবং এ ‘ইচ্ছে’টা বাংলাদেশের কারো কারো মাথায় খেলা করছে তাতেও সন্দেহ থাকার কথা নয়। সে হিসেবে ঘটনাটা তাঁদের ভবিষ্যৎ মহাপরিকল্পনার আরেকটা ‘স্টেট কেস’ হিসেবে ধরে নিতে পারি আমরা। ‘মুরতাদ’ বিষয়টা বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক নয় এবং এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এ ঘোষণায় বাংলাদেশী মুসলমানের ধর্মীয় আবেগের অপব্যবহার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক অধঃপতন এবং প্রশাসনের ব্যর্থতা ছাড়াও অন্য কিছু দিক সুস্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সেগুলো হল, উল্লিখিত মওলানা- মুফতিরা-
১। তাঁদের আপত্তিগুলো দেশের প্রতিষ্ঠিত সরকারের কাছে না জানিয়ে বেআইনীভাবে নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়েছেন।
২। আদালতের সিদ্ধান্তের বাইরে মানুষ খুন করার ঘোষণার মত মারাত্মক অপরাধের দায়িত্ব নিয়েছেন।
৩। বিশ্বে সবাই এটা জেনেছে, তাঁরা ইসলামের বিকৃত হিংস্র রূপ তুলে ধরে দেশের ও ইসলামের ভাবমূর্তি আবারো নষ্ট করেছেন।
৪। মুরতাদ বিষয়ে কোরান-হাদিসের নির্দেশ অমান্য করে ইসলামের সীমা লংঘন করেছেন, যে বিষয়ে কোরান বারবার মুসলমানদের নিষেধ করেছে, সাবধান করেছে।
৫। সুরা তওবার ছয় ও এগারো নম্বর আয়াত সম্পর্কে নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
৬। আচার-আনুষ্ঠানিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে ইসলামের মূল শান্তি-বাণীকে অস্বীকার করেছেন।
৭। নিজেরা সন্ত্রাসের উদাহরণ শুরু করে অন্যদেরকে সন্ত্রাসে উৎসাহিত করেছেন ।
আল কোরানের অনেক আয়াতে মুসলমানদের প্রতি চিরকালের নির্দেশ আছে যেগুলো মুসলমানদের চিরকাল পালন করতে হবে। আবার অন্য অনেক আয়াতে শুধুমাত্র তখনকার তাৎক্ষণিক কিছু ঘটনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে, সে পটভূমির বাইরে ওই আয়াতগুলো প্রয়োগ করার নির্দেশ কোরান দেয়ওনি, প্ৰয়োগ করা যায়ও না। সে চেষ্টার ফলও হবে আমাদের জন্য মারাত্মক। যেমন, সুরা নিসা’র ১৫৪ আয়াতে আল্লাহ বলছেন ‘শনিবারের সীমা’ লংঘন না করতে। এটা ছিল আল্লাহ’র তরফ থেকে শুধু সেই সময়ের আরবের সংস্কৃতি-ভিত্তিক নির্দেশ যেহেতু আরবের বাইরে পৃথিবীতে কোন ‘শনিবারের সীমা’ কোনদিনই ছিল না এবং এখন আরবেও সে সংস্কৃতি আর নেই, তাই বাস্তবে এ আদেশ প্রযোজ্য হবার অবকাশ নেই। বাংলাদেশের ঘাড়ে এখন জোর করে ‘শনিবারের সীমা’ চাপিয়ে দিলে কি দাঁড়াবে অবস্থাটা?
তাৎক্ষণিক নির্দেশের এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ আছে সারা কোরান জুড়ে, আছে সুরা মুনাফিকুন, মুমতাহিনা নূর, তাওবাহ, আনফাল, মায়েদাহ, নিসা, বাকারা ইত্যাদি বহু বহু সুরায়। সুরা তওবার ছয় ও এগারো নম্বর আয়াতেরও সুস্পষ্ট কারণ ও পটভূমি ছিল যা তাৎক্ষণিক, শাশ্বত নয়। রসুল আর মক্কীদের মধ্যে সম্পাদিত হোদায়বিয়া সন্ধির চুক্তি যখন মক্কীরা ভঙ্গ করেছিল, তখন চুক্তিভঙ্গের অপরাধে মক্কীদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল এবং চুক্তিবদ্ধ অন্যান্য মুশরিকদের সাথেও চুক্তি নবায়ন না করার ঘোষণা করা হয়। তওবা’র প্রথম আয়াতগুলো হোদায়বিয়া সন্ধির সাথে সম্পর্কিত, তার বাইরে অন্য কোন ব্যাপারের সাথে নয়। সে জন্যই আয়াতগুলোতে বারবার ‘চুক্তি’ ও ‘চুক্তিভঙ্গ’ শব্দ দুটোর উল্লেখ আছে। এছাড়া সুরা তওবার ৬ নম্বর আয়াতে মুশরিকদের ক্ষমা করার কথা আছে, খুন করার নয়। খুন করার কথা আছে পাঁচ নম্বর আয়াতে, তাও সেটা মুশরিকদেরকে, মুরতাদকে নয় । আর ১১ নম্বর আয়াতও নাজিল হয়েছে নবীজীর তৃতীয় আকাবা-বায়াতের ঘটনায় কিছু লোকের ব্যক্তিগত প্রশ্নের জবাব হিসেবে। আজকের বাংলাদেশে এ আয়াত প্রয়োগ করে খুন-খারাপী করার প্রশ্নই উঠে না ।
এবারে দেখা যাক কাউকে ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করার অধিকার কোরান-রসুল দিয়েছেন কি না, কেউ কাউকে মুরতাদ ঘোষণা করলে সেটা কি ইসলাম-সম্মত, না কি কোরানের খেলাফ করার মত মারাত্মক অপরাধ। কোন কোন মওলানা বলেন, মুরতাদ শব্দটা এসেছে ‘রিদ্দা’ থেকে, রিদ্দার মূল হল ‘রাদ’। সম্পর্কিত শব্দগুলো ইরতাদা, রিদ্দা, এবং রাদ সবই হল স্বকর্ম অর্থাৎ নিজে করতে হয়। বাইরে থেকে কেউ কাউকে স্বকর্ম করাতে পারে না। কোরানও ‘মুরতাদ’ শব্দটার এই অর্থটাই ধরে রেখেছে, নিচে দেখুন। যেমন, আত্মহত্যা। আত্মহত্যা যে করে, সে-ই করতে পারে। বাইরে থেকে কেউ অন্যকে খুন করতে পারে কিন্তু আত্মহত্যা করতে পারে না। রিক্যান্টেশন বা ধর্মত্যাগও নিজে করতে হয়, নিজমুখে বলতে হয়। যেহেতু কর্মটা স্বকর্ম, তাই কেউ নিজ মুখে ঘোষণা না করা পর্যন্ত কাউকে মুরতাদ বলার অবকাশ বা অধিকার কারোরই নেই। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বা অধ্যাপক আকাশ নিজেদের মুরতাদ ঘোষণা করেন নি। কাজেই উনাদের ব্যাপারে মওলানাদের ঘোষণা প্রযোজ্য নয়। ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর কিছু বইতে ধর্মে তাঁর অবিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন। সে হিসেবে উনাকে আমরা ইসলাম ত্যাগী অর্থাৎ মুরতাদ বলতে পারি। এবারে দেখা যাক তাঁর ব্যাপারে মওলানাদের ঘোষণা ইসলামসম্মত কি না, মুরতাদদের ব্যাপারে খোদ আল কোরান কি বলছে ।
সুরা নিসা আয়াত ৯৪’এ বলা হয়েছেঃ ‘যে তোমাদেরকে সালাম করে তাহাকে বলিও না যে তুমি মুসলমান নও…’ অর্থাৎ যে সালাম করে, তাকে মুরতাদ বলার অধিকার কোরান কাউকে দেয়নি। বললেই সেটা হবে সরাসরি আল্লাহর আদেশের বিরোধিতা করা, যেটা আমাদের মওলানা-মুফতিরা এক্ষেত্রে করেছেন। না জেনে করে থাকলে এখন জানলেন, তওবা করে তাঁরা ঘোষণাটা ফিরিয়ে নিতে পারেন। আর জেনেও যদি করে থাকেন, তবে তাঁরা সরাসরি আল কোরানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছেন, সে দায়িত্ব সম্পূর্ণ তাঁদেরই। তবে আমরাও আমাদের জাতির বুদ্ধিসত্ত্বাকে কারো খেয়াল-খুশির খেলনা হতে দিতে পারি না। ওই কোরানের ভিত্তিতেই প্রতিবাদ পর্যায় পার হয়ে প্রতিরোধ আমাদের গড়ে তুলতে হবে।
মোটামুটি যে সুরা-আয়াতগুলোতে মুরতাদের ব্যাপারে কোরানের নির্দেশ আছে তার মধ্যে সুরা নাহ্ল এসেছে মক্কাতে, বাকি নয়টা এসেছে মদিনাতে । লম্বা হয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট উদ্ধৃতিগুলো দেব না, আপনারা মিলিয়ে নিতে পারেন। আগে-পরের আয়াতগুলোর সাথে শানে নজুলও পড়ে নিন, যাতে ‘পটভূমির বাইরে’— এই অভিযোগের সম্ভাবনা না থাকে। পড়ে নিন সুরা বাক্কারা-২১৮, ইমরান- ১০৬ ও ১৪৪, মায়েদা-৫৪, আদ-দাহার-২৯, কাহফ-২৯, আল যুমার- ১৫, আল গাসিয়াহ-২৩ ও ২৪। আশুরা’র আয়াত ১৬ দেখা যেতে পারে, দেখা যেতে পারে সুরা তওবার আয়াতগুলোও, সংশ্লিষ্ট হিসেবে। সুরা ইমরান আয়াত-৭ এবং আরো অনেক আয়াতে কোরান বলেছে, কোরানের কিছু অংশ সুস্পষ্ট এবং সেটাই এ কেতাবের আসল অংশ। সেই আসল অংশের সুস্পষ্ট উদ্ধৃতি দিচ্ছি এবারে ।
আল্লাহ ইসলাম ত্যাগী মুরতাদদের কথা অনেকবারই বলেছেন এবং নিজেই শাস্তি দেবেন বলেছেন। নিজে শাস্তি দেবেন বলেই আল্লাহ মুরতাদকে খুন তো দূরের কথা, কাউকে মুরতাদ ঘোষণারও অধিকার দেননি। আমি আমাদের মওলানাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ করব তাঁরা যেন অন্য যেকোন কারণেই হোক কোরআনের এ সুস্পষ্ট নির্দেশ উপেক্ষা না করেন। হাদিসেও মুরতাদ খুনের কোন সূত্র নেই, সে কথায় পরে আসছি ।
সুরা মুনাফিকুন, আয়াত-৩ ও ৪ : ইহা এই জন্য যে তাহারা বিশ্বাস করিবার পর পুনরায় কাফের হইয়াছে । . তাহাদের সম্পর্কে সতর্ক হোন। ধ্বংস করুন আল্লাহ তাহাদিগকে ।
সুরা আত তাওবাহ, আয়াত ৬৬ : ‘ছলনা করিও না, তোমরা যে কাফের হইয়া গিয়াছ ঈমান প্রকাশ করিবার পর। তোমাদের মধ্যে কোন কোন লোককে আমি যদি ক্ষমা করিয়াও দেই তবে অবশ্য কিছু লোককে আজাবও দিব।’
সুরাত আত্ তাওবাহ, আয়াত ৭৪ :
মুসলমানগণ হইবার পর অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী হইয়াছে… তাহাদিগকে আজাব দিবেন আল্লাহতা’লা, বেদনাদায়ক আজাব দুনিয়াতে এবং আখেরাতে’।
সুরা নাহল, আয়াত ১০৬ : অবিশ্বাসী হয় এবং কুফরীর জন্য মন উন্মুক্ত করিয়া দেয়, তাহাদের উপর আপতিত হইবে আল্লাহর গজব এবং তাহাদের জন্য রহিয়াছে শাস্তি’ ।
সুরা নিসা, আয়াত ১৩৭ : ‘যাহারা একবার মুসলমান হইয়া পরে আবার কাফের হইয়া গিয়াছে, আবার মুসলমান হইয়াছে এবং আবারও কাফের হইয়াছে এবং কুফরিতেই উন্নতিলাভ করিয়াছে, আল্লাহ তাহাদেরকে না কখনও ক্ষমা করিবেন, না পথ দেখাইবেন।’
এবারে কোরআনের আরও সুস্পষ্ট বাণী, সুরা ইউনুস, আয়াত ৯৯ : ‘আর তোমার পরওয়ারদিগার যদি চাহিতেন তবে পৃথিবীর বুকে যাহারা রহিয়াছে, তাহারা সকলেই ইমান নিয়া আসিত সমবেতভাবে। তুমি কি মানুষের উপর জবরদস্তি করিবে ইমান আনিবার জন্য’ ?
এই আয়াতগুলোতে প্রতিটি বিশ্বাসী মুসলমানের জন্য রয়েছে তার মা’বুদের জলদগম্ভীর সুস্পষ্ট নির্দেশ, ধর্মত্যাগীকে তাঁর হাতেই ছেড়ে দিতে, ওতে মানুষের এখতিয়ার নেই। তিনি ওদের দেখে নেবেন, কোন মানুষ কোন রকম জবরদস্তি করতে পারবে না। কাজেই, অধ্যাপকদের ‘ইসলামে ফিরে আসার’ জন্য জবরদস্তি করে (তা-ও আবার তিন মাসের মধ্যে) কোরানের সুস্পষ্ট বরখেলাপ করেছেন আমাদের মওলানারা। দ্বিতীয়ত : সুরা, নিসা, আয়াত ১৩৭- ‘একবার মুসলমান হইয়া পরে আবার কাফের হইয়া গিয়াছে, আবার মুসলমান হইয়াছে এবং আবারও কাফের হইয়াছে’– এ আয়াতে একই মুসলমানের প্রথমে মুরতাদ হবার পর আবার ইসলাম গ্রহণ করে আবারও মুরতাদ হবার কথা বলা আছে। হ্যাঁ, এ-ই হল ‘লা ইকরাহা ফিদ্বীন’— ধর্মে জবরদস্তি নেই। মওলানারা যদি মুরতাদকে খুন করেন, তবে এক্ষেত্রে প্রথমবার মুরতাদ হলে তাকে খুন করতে হবে, তারপর সেই লাশকে আবার মুসলমান হতে হবে। তারপর সেই লাশকে আবারও ইসলাম ত্যাগ করতে হবে এবং সেজন্য সেই লাশকে দ্বিতীয়বার খুন করতে হবে। এ জগাখিচুড়ী বাস্তবে সম্ভব নয়। লাশ তার ধর্মবিশ্বাস পাল্টাতে পারে না আর এক লোককে দু’বার খুন করা যায় না। আমাদের মওলানাদের বুঝতে হবে, ইসলামকে রক্ষা করার জন্য অনেক বড় শক্তি নিরন্তর কাজ করছে, মানুষকে এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হবে না । খামোখা হুড়-হাঙ্গামা করলে সেই মহাশক্তিকে শুধু বিরক্তই করা হয় ।
‘শান্তির ধর্ম’ মুখে দাবি কারাটা সহজ, কাজে দেখানোটা বড় কঠিন। অশান্ত পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা এবং শান্তি বজায় রাখাই এ দাবির সুকঠিন মর্মবাণী। সে যুগের যুদ্ধ বিগ্রহের কিছু তাৎক্ষণিক আয়াত ছাড়া এই শাশ্বত দাবির মর্যাদা কোরান রেখেছে বার বার, শত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও। আমি আবারও আমাদের মওলানাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ করব তাঁরা যেন নিজেদের উত্তেজিত আবেগে ভুল না করেন, শান্ত ব্যবহারের মাধ্যমে কোরানের এই গুরুত্বপূর্ণ দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেন, গরম মাথায় এ দাবির ক্ষতি না করেন। মুরতাদদের কথা ছেড়ে দিন, আল্লাহ- কোরআন-রসুলকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা বা বিদ্রূপ করাটা কি তার চেয়েও অনেক বেশি অপরাধ নয়? এই জঘন্য অপকর্মটাই করেছেন সালমান রুশদী, গঠনমূলক সমালোচনা না করে ইসলামকে নিয়ে শুধু ঠাট্টা-তামাশা করেছেন তাঁর ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বইতে। এক্ষেত্রে রাগে রক্ত মাথায় চড়ে আমরা তাঁর ওপর ডাণ্ডা হাতে চড়াও হলে তার পেছনে একটা আবেগ কাজ করে বোঝা যায়। কিন্তু এই অসহ্য পরিস্থিতিতেও ‘শান্তির ধর্ম’-এর কঠিন দাবি বজায় রেখেছে কোরান। নিষেধের তর্জনী তুলে কোন রকম হিংস্রতা করতে সরাসরি নিষেধ করেছে সে, দূরদর্শী বেহেশতি নেতার মত শান্ত থাকার আদেশ দিয়েছে। কাজটা কঠিন, কিন্তু সত্যিকারের মুসলমান হতে হলে এ আদেশ মানা ছাড়া উপায় নেই। দেখুন সুরা আল জাসিয়া আয়াত ৯: ‘যখন আমার কোন আয়াত অবগত হয়, তখন তাহাকে ঠাট্টারূপে গ্রহণ করে। ইহাদের জন্যই রহিয়াছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি, তাহাদের সম্মুখে রহিয়াছে জাহান্নাম।’ আর দেখুন সুরা নিসা আয়াত ১৪০-এর পরিষ্কার আদেশ : ‘যখন আল্লাহতা’লার আয়াতসমূহের প্রতি অস্বীকৃতিজ্ঞাপন ও বিদ্রূপ হইতে শুনিবে, তখন তোমরা তাহাদের সহিত বসিবে না, যতক্ষণ না তাহারা অন্য প্রসঙ্গে চলিয়া যায়’ । হ্যাঁ, এ-ই হল সত্যিকারের শান্তির ধর্ম । এ আদেশ না মানলে কি হবে? সেটাও বলে দিয়েছে আল কোরান পরের আয়াতেই— ‘তাহা না করিলে তোমরাও তাহাদের মত হইয়া যাইবে’।
আর কত স্পষ্ট করে বলতে হবে কথাটা? এই হল শান্তির ইসলাম, কারণ ঠাট্টা করে কোন ঐশী দর্শনকে উৎখাত করা যায় না ।
এবারে নবীজীর দিকে তাকানো যাক। আল্লাহর রসুল, আল কোরানেই প্রতিধ্বনি করেছেন তিনি। তাঁর সাহাবী উসামা যখন এক কাফেরকে খুন করতে উদ্যত, তখন সেই শেষ মুহূর্তে সে কাফের বলে উঠল— ‘লা ইলাহা ইল্লাললাহ, মুহম্মাদুর রসুলুল্লাহ’। কিন্তু সেটা জান বাঁচানোর জন্য মিথ্যে মনে করে উসামা তাকে খুন করলেন। শুনে নবীজী এত আক্ষেপ করেছিলেন, উসামা’র ওপরে এত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যা বলার নয়। একবার নয়, বার বার তিনি বলছিলেন, ‘কে তোমাকে কলমা’র দায় হইতে মুক্ত করিবে, উসামা?’ ‘তুমি কি তাহার বক্ষ চিরিয়া দেখিয়াছ তাহার মনের মধ্যে কি আছে’? উসামা বলেন— ‘আমি তাঁহার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করিলাম এবং প্রতিজ্ঞা করিলাম যে আর কখনোই কাহাকেও কতল করিব না যে কলমা পড়িয়াছে’ (সিরাত রসুলুল্লাহ-ইবনে হিশাম-ইশাক অনুবাদ এ, গয়োম- পৃষ্ঠা ৬৬৭, Volume 9, Book 83, Number 11)। নবীজীর কত বড় বরখেলাপ করেছেন আমাদের মওলানারা, ভাবলে চোখে পানি এসে যায়। আমি তাঁদের দাঁড় করিয়ে দিতে চাই নবীজীর সামনে জবাব দেবার জন্য । কলমা’র কাছে দায়ী হয়েছে তাঁরা, কলমার দায় বড় দায়। তাঁর জীবনে অসংখ্য ঘটনার মধ্যে নবীজী যত ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ধর্মে বাড়াবাড়ি করার জন্য, তত ক্ষিপ্ত তিনি আর কোন কারণেই হননি (সহি বোখারি- খণ্ড ১, হাদিস ৬৭০)। এ কথাও তিনি বলেছেন ‘যে কেউ আল্লাহর সাথে অংশীদার না করবে, সে-ই বেহেশতে যেতে পারে’ (ঐ, হাদিস ১৩০)।
আরও আছে। দেখুনঃ ‘আমার পরে তোমরা একে অন্যের গলা কেটে নিজেরাই মুরতাদ হয়ে যেও না’ (ঐ হাদিস ১২২)।
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ড. মুহসিন খানের বোখারি- অনুবাদেও আছে এই হুশিয়ারী : volume 9, Book 83, Number 5 : Narrated Al- Miqdad bin ‘Amr Al-Kindi :
An ally of Bani Zuhra who took part in the battle of Badr with the prophet, that he said, “O Allah’s Apostle! If meet an unbeliever and we have a fight, and he strikes my hand with the sword and cuts it off, and then takes refuge from me under a tree, and says, ‘I have Surrendered to Allah (i.e. embraced Islam),’ may I kill him after he has said so?’ Allah’s Apostl said, “Do not kill him for if you kill him. he would be in the position in which you had been before you kill him. and- – you. would be in the position in which he was before he said the sentence.” “The prophet also said to Al – Miqdad, “If a faithful believer conceals his faith (Islam) from the disbelievers, and then when he declares his Islam, You kill him, (you will be sinful ).
Remember that you were also concealing your faith (Islam) at Mecca before.”
Volume 9, Book 83, Number 7 and 8: Narrated ‘Abdullah bin Umar : The Prophet said,
“After me (i.e. after my death), do not become disbelievers, by striking (cutting) the necks of one another. –
Narrated Abu Zur’a bin ‘Amr bin Jarir:
The prophet said “After me, do not become disbelievers, by striking (cutting) the necks of one another.”
এবারে কি বলবেন আমাদের মুরতাদ ঘোষণাকারী মওলানারা? জাতির আজ কত বড় দুর্ভাগ্য, আমাদের মওলানা-মুফতিরা নবীজীর এত স্পষ্ট হুঁশিয়ারী সরাসরি অমান্য করে আজ আমাদেরই অধ্যাপকদের গলা কাটতে উদ্যত। ওপরের হাদিসগুলোর আলোকে দেখলে ফল কি দাঁড়ায়? কে মুরতাদ?
ইসলাম ত্যাগের ঘটনাটা নবীজীর সময়ও কয়েকবারই ঘটেছে বলেই তো কোরানে ওই আয়াতগুলো এসেছে। এমনকি এত সম্মানিত সাহাবি তাঁর ওহি- লেখক আবদুল্লাহ বিন সা’আদও হঠাৎ মুরতাদ হয়ে মদিনা থেকে মক্কায় পালিয়ে গিয়েছিল। ছোটখাট মুরতাদ তো নয়ই, এ হেন মহা-মুরতাদকেও খুন করেননি নবীজী। এতে করে আমাদের মওলানাদের জন্য প্রত্যক্ষ এবং জ্বলন্ত উদাহরণ রেখে গেছেন । প্রায় একশ’টা যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে নবীজীর সময়, অনেক খুন-জখমও হয়েছে। সেসব সুস্পষ্ট এবং বিস্তারিত ধরা আছে তারিখ আল তাবারি, সহি সিত্তা (বোখারি-মুসলিম-নাসায়ী-আবু দাউদ-তিরমিজি এবং ইবনে মাজাহ বা মুয়াত্তা), ইমাম শাফি’ই আর ইমাম আবু হানিফার শারিয়া কেতাব আর ইবনে হিশাম- ইশাকের সিরাত রসুলুল্লাহ বইগুলোতে। কিন্তু হাজার হাজার পৃষ্ঠার এই সুবিশাল দলিলগুলোর মধ্যে একটা উদাহরণও পাওয়া যায়নি যেখানে কোন মুরতাদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন নবীজী, কেউ পারলে দেখাক আমাদের। হারিথ নামের যে মুসলমান মুরতাদ হয়েছিল, তাকেও মাফ করেছিলেন তিনি (সিরাত- পৃঃ-৩৮৪)। উকিল গোত্রের যে আটজনকে অনেক পরে মক্কা বিজয়ের দিনে ইবনে খাত্তালসহ যে চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তিনি, তারা অন্যান্য অপরাধ করেছিল (সহি বোখারি- খণ্ড ৪, হাদিস ২৬১ ও অধ্যায় ১৬৯)। তাঁর সামনেই প্রকাশ্য কথায় এক নাম না জানা বেদুঈনও মুরতাদ হয়েছিল, তার কোনই শাস্তি দেননি নবীজী ।
অথচ নবীজী নিজে না দিলেও সহি বোখারিতে দেখি এক মুসলমান খুন করেছে এক মুরতাদকে, ‘নবীজী বলেছেন’ বলে। আমরা জানি, বহু লোকেরা ‘নবীজী বলেছেন’ বলে কত জাল হাদিস দিয়ে নিজেদের অপকর্মকে ওই নবীজীর নামেই হালাল করেছে। নবীজীর মৃত্যুর পরে পরেই আবুবকরের বিরুদ্ধে কিছু রাজনৈতিক বিদ্রোহ হয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিল রাজনৈতিক টানাপোড়নের ব্যাপার । সেটাকে কেউ ইসলাম ত্যাগ বলে নি, পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরাও বলেননি। বার্নার্ড লুইসও সে কথা স্পষ্টই বলেছেন তাঁর ‘দি অ্যারাবস ইন হিস্ট্রি’ বইতে। খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে কোনই মুরতাদ-হত্যার দলিল পাওয়া যায়নি।
এবারে শারিয়ার আইন । শারিয়া যখন বানানো হচ্ছিল, সেই সপ্তম-অষ্টম-নবম শতাব্দীর মুসলমানদের অবস্থা খেয়াল করুন। পূর্ব-পশ্চিমে, উত্তর-দক্ষিণে যুদ্ধ তখন তুমুল । আরবের শুকনো মরুভূমি থেকে অবিশ্বাস্য সামরিক শক্তিতে বেরিয়ে এসে মুসলিম সৈন্যরা তখন ঝড়ের মত ছুটে গিয়েছিল সর্বত্র। পুরোটা মধ্যপ্রাচ্য শুধু নয়, আফ্রিকা-এশিয়ার দেশের পর দেশ তাদের পদানত হচ্ছিল প্রত্যেকটা দিন। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সেই উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে বানানো হচ্ছিল মুসলমানের আইন, শারিয়া। এ হেন ক্রান্তিকালে মুসলমানের সুসংহত ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কোন এক মুসলমান মুরতাদ হয়ে গেলে যুদ্ধজর্জরিত অন্য মুসলমানদের ওপরে তার প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা প্রবল, সেটা মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত সর্বনাশা হতে পারে। তাই সে পথে মুরতাদের মৃত্যুদণ্ড, বিয়ে নাকচ, উত্তরাধিকার নাকচ ইত্যাদির লাঠি তুলে ধরেছেন আমাদের শারিয়া-ইমামেরা। পরবর্তীকালেও শারিয়া এই একই চাপের মধ্যে বড় হয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দীতে ইবনে তাইমিয়ার সময়ের কথাই ধরুন। পূবদিকে অমুসলিম মঙ্গোলের ধাক্কা, পশ্চিমেও মুসলিম শক্তির অবক্ষয় তখন শুধু দেয়ালের লিখন। খ্রিষ্টানদের প্রচণ্ড চাপের মুখে পুরো স্পেন থেকে পেছনে হটে এসেছে মুসলিম শক্তি, ছোট্ট প্রদেশ গ্রানাডার রশি ধরে কোন রকমে ঝুলে রয়েছে সে। প্যালেস্টাইন উপকূলে মঙ্গোলদের সহায়তায় ক্রুসেডারেরা আঘাতের পর আঘাত হানছে পশ্চিমে শেষ মুসলিম শক্তি মামলুক সাম্রাজ্যের ওপর। মুসলমানের এই আত্মরক্ষার অগ্নিযুগে কোন মুসলমানের ইসলাম ত্যাগ করার উদাহরণ স্বভাবতই মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য। এই কারণগুলো সাময়িক এবং রাজনৈতিক। কোরান-হাদিসের খেলাফ বলে এগুলো ইসলামের ধর্ম-বিশ্বাসের অঙ্গও নয় এবং এগুলো এখন আর খাটেও না ।
মুরতাদ ফতোয়ার প্রথম বলি হলেন নবীজীর আদরের নাতি ইমাম হোসেন । এজিদের সাম্রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে দেয়া হল ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে ফতোয়া, এজিদ-পালিত মোল্লারাই ছড়ালেন সেটা রাজ্যময় । এজিদের রাজকীয় আদেশ নয়, সেই ফতোয়াই ছিল ইমামের, ঘাতকদের আসল মানসিক শক্তি, সেই ফতোয়া নিজের পাগড়ির ভেতরে রাখত ইমামের ঘাতক সীমার নিজে। ফতোয়াটা তারিখ- আল-তাবারিতে পাওয়া যায় (ডঃ সাচেদিনা)। ভারতের ইতিহাসে একমাত্র উদাহরণ হল আওরঙ্গজেবের আমলে এক পর্তুগীজ ইসলাম গ্রহণ করে পরে মুরতাদ হয়, সে গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, সম্রাট তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পরের দিকে কোন রকম কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে মুরতাদ- ফতোয়া নিয়ে শুরু হল হরিলুট। যে যাকে পারে মুরতাদ বলা শুরু করল। এই নাগিনীর বিষাক্ত ছোবলের হাত থেকে রেহাই পাননি বড়পীর সাহেবের মত বুজর্গ আর ইমাম তাইমিয়ার মত যুগশ্রেষ্ঠ নেতা, তাঁদেরকেও মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছিল— (ফতহুল গয়ব- বড়পীর সাহেবের বক্তৃতার সংকলন আর) ‘এ শর্ট হিস্ট্রি অফ দি রিভাইভালিস্ট মুভমেন্ট ইন ইসলাম’ মৌদুদি- পৃঃ ৬৬)। চিন্তা করা যায়! মনসুর হাল্লাজ থেকে আমাদের মানবদরদী কবি নজরুল পর্যন্ত রক্ষা পাননি এ থেকে। নসর জায়েদের মত অনেক মুসলমান পণ্ডিত ইসলাম না ছেড়েও এই ফতোয়ার উদ্যত খঞ্জর থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন, নাওয়াল সাদাবীর ৩৭ বছরের বিয়েকে তালাক ফতোয়া দেয়া হয়েছে। রক্ষা পাননি মওলানা মৌদুদিও। এ লম্বা লিস্টিতে আর যাব না, তবে দেওবন্দি- বেরিলভির মওলানাদের পরস্পরকে ‘কাফের’ বলার ফতোয়া আমাদের মনে আছে । মোদ্দা কথাটা হল, কোন না কোন মওলানার হুংকারে দুনিয়ার প্রতিটি মুসলমানই মুরতাদ, এমনকি একদল মওলানাদের ফতোয়ায় অন্যদল মওলানারাও মুরতাদ । সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এই ‘মুরতাদ’ ফতোয়া নিয়ে। এ দলিল স্পষ্ট ধরা আছে পাকিস্তানের চিফ জাস্টিস মুনির আর জাস্টিস কায়ানি নিয়ে গঠিত ১৯৫৪ সালের পাঞ্জাব অ্যাক্ট-২ এর অধীনে কোর্ট অফ ইনকুয়ারী’র রিপোর্টে। পাকিস্তানের নামকরা মওলানাদের সাথে দীর্ঘকাল আলোচনা করে এই সত্য পাওয়া গেছে, একদল মওলানা রাষ্ট্রের গদীতে বসলে অন্য সব মওলানাদেরকে ‘মুরতাদ’ ফতোয়ায় কল্লা কেটে ফেলবেন। গত বছর একই কথা বলেছেন বিখ্যাত শারিয়া বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল্লাহ নঈম নাইজিরিয়ার কনফারেন্সের বক্তৃতায়, একই কথা বলেছেন মাহমুদ তাহা, বলে চলেছেন ড. সাচেজদিনা, ড. আসগর আলী ইঞ্জিনিয়ার, আরও অনেক মুসলমান ইসলামী বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশের ড. তাজ হাশমী, ড. মায়মুল খান, কিন্তু কেউ শুনছে না ।
গত চৌদ্দ’শ বছরে আজ পর্যন্ত কোন মুরতাদের সঙ্গে মওলানাদের সংলাপের উদাহরণ পাইনি। মওলানাদের সে সংস্কৃতিই গড়ে ওঠেনি। তাঁদের উচিত ছিল প্রত্যেকটি মুরতাদকে সমাদরে ডেকে আলোচনায় বসে তার ইসলাম ত্যাগের কারণ খুঁজে বের করা, সে কারণ নিরসনের চেষ্টা করে তাকে ইসলামে ফেরানোর চেষ্টা করা। এ চেষ্টায় ফল কিছু হতই, ফল না হলেও অন্তত ভাল কিছুর চেষ্টা তো হত। এই দরকারি কাজটাকে কখনই দরকারি মনে করা হয়নি, সরাসরি খুনের চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্মের লালন ও বিকাশ যে শুধুমাত্র আত্মার স্নিগ্ধ নীড়েই, ডাণ্ডায়-হুংকারে নয়, ইসলামের এ সত্যটাকে উপলব্ধি করা হয়নি। মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে জেলখানার মত করে বন্দি করে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা হয়েছে ।
১৯৬৫ সালে গৃহীত মানবাধিকার সনদের ১৮ নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী বিশ্বের প্রত্যেকটি লোকের ধর্ম পরিবর্তনের সম্পূর্ণ অধিকার আছে। সব মুসলিম রাষ্ট্র সেটাতে সইও করেছে (একমাত্র সৌদি আরব ছাড়া)। পৃথিবীর জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ, একশ’ বিশ-ত্রিশ কোটির অসীম সমুদ্র, সুবিশাল জনতার বিশ্ব মুসলিম ! কোথায় আকাশ ভেঙে পড়ে যদি দু’চার শ’ চলেই যায়? কোরআনের ‘তোমার ধর্ম তোমার, আমারটা আমার’, ‘ধর্মে শক্তিপ্রয়োগ নেই’, এ বাণী দুটোর মর্যাদা তো রক্ষা হয়, নবীজীর প্রত্যক্ষ উদাহরণের মর্যাদা তো রক্ষা হয়, দুনিয়ার সামনে শান্তি র ধর্মের অন্তত একটা প্রমাণ তো হয়! ওদিকে অনেক অমুসলিম তো মুসলমান হচ্ছেই! ওরা মুসলমান হলে খুশিতে ফেটে পড়ি আমরা, কিন্তু কোন মুসলমান ঐ একই কাজ করলে যদি তাকে কতল করি তবে সেটা ইসলাম হতে পারে না । কোরান-রসুলই এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ, ইসলাম কোন ইঁদুর মারা কল নয় যে তার মধ্যে ঢোকা যাবে কিন্তু বেরোনো যাবে না ।
মওলানারা ভুল করেছেন, কোরানের বাণী উপেক্ষা করে মহাভুল করেছেন। কোরানের সুরা নিসা ৯৪, সুরা বাকারা ২৫৬ আর সুরা কাফিরুন আয়াত ৬-এর অবমাননা না করে মুরতাদকে হত্যা তো দূরের কথা, মুরতাদ ঘোষণাও সম্ভব নয়। শক্তি দিয়ে কারো ওপরে ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা চাপিয়ে দিলেই ইসলামের শাশ্বত মর্মবাণীর প্রতি আত্মার আনুগত্য আসবে, এটা তাঁদের নিদারুণ ভ্রান্তি। শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে অবশ্যম্ভাবী ঘৃণারই জন্ম হয়। এই করে করেই আজ ইসলামের মধ্যে রক্তচোখের দানব দেখছে দুনিয়ার মানুষ। আনুষ্ঠানিকতায় ধর্ম প্রমাণ হয় না, নামাজ-রোজা করা অনেক খুনী-ধর্ষকও আছে ইতিহাসে। মওলানাদের উচিত অনতিবিলম্বে ইসলামবিরোধী এ ঘোষণা ফিরিয়ে নেয়া। এতে দোষের কিছু নেই, শ্লাঘারও কিছু নেই । এ মহাভুল আরও ভুলের জন্ম দিতে পারে। জাতির পিঠ ধীরে ধীরে দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে, কেউ হয়ত এ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় মরিয়া হয়ে নজরুলের মত — দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি’ বলে তাঁদের ওপরেও চড়াও হয়ে ‘মুরতাদ’ ঘোষণা দিতে পারে, মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করতে পারে, এমনকি মাথার দামও ঘোষণা করতে পারে। আর বাংলাদেশে তো ভাড়াটে খুনি পাওয়াই যায় ।
প্রথম অধ্যায়ঃ যুক্তিবাদ মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতা
♦ মন্দের যুক্তি ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব
♦ বিজ্ঞান মনস্কতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজনির্মাণ
♦ ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে কূটকচাল
♦ ব্রুনোর আত্মত্যাগ ও যুক্তিবাদ
♦ ইহজাগতিকতা ও আরজ আলী মাতুব্বর- একজন যুক্তিবাদী দার্শনিক
♦ বাংলাদেশে চেতনা-মুক্তির লড়াই
♦ ইসলাম যেভাবে নিজের পথ থেকে সরে গেছে
♦ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা বনাম কোরানিক বিজ্ঞান
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ ধর্ম ও নৈতিকতা
♦ জীবিত ইসলামের মৃত গৌরবের কথা
♦ রামায়ণ কাহিনীর ঐতিহাসিকতা একটি একাডেমিক আলোচনা
♦ মানবতাভিত্তিক সংবিধান এবং অমানবিক বিধান
♦ ধর্মের উপযোগিতাঃ জনৈক বিবর্তনবাদীর দৃষ্টিতে
♦ ধর্মরাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম
♦ মানুষের জন্য ধর্ম, না ধর্মের জন্য মানুষ?
♦ বিজ্ঞান কি উপাসনা-ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী
তৃতীয় অধ্যায়ঃ অন্যান্য প্রসঙ্গ
♦ হাইপেশিয়াঃ এক বিস্মৃতপ্ৰায় গণিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান
♦ শাশ্বত এথেন্সের নারী ও তার বিপর্যস্ত ধারাবাহিকতা
“স্বতন্ত্র ভাবনাঃ মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ