কেন আমার মৃতদেহ মেডিক্যালে দান করছি

বিগত ৩০শে ফাল্গুন ১৩৮৭ তারিখের ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ‘মানব কল্যাণের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত’ শীর্ষক নাম দিয়ে। তাতে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে আমার মৃতদেহ দানের প্রসঙ্গটির উল্লেখ আছে। সংবাদটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথে বহু লোকে আমাকে প্রশ্ন করতে থাকে – কেন আমার মৃতদেহ মেডিক্যালে দান করছি, তার কারণ জানার জন্যে। অনেকে আবার ওর কারণ আবিষ্কারও করে ফেলেছেন, আমার কাছে ও বিষয়ে কিছু শোনাবার আগেই। তাঁদের মতে ওর কারণ নাকি – কবরে মনকির ও নকির নামক ফেরেস্তাদ্বয়ের দৌরাত্ম এড়ানো। এরূপ মনোভাব যারা পোষণ করতেন, তাঁদের কাছে আমি সবিনয়ে বলছি, কারণ ওটি নয়, অন্য রকম দু’টি।

প্রথম কারণ

চার বছর বয়সে আমার বাবা মারা যান। কায়িক শ্রমের দ্বারা বহুকষ্টে আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন স্বামী ও বিত্তহীনা আমার মা। বিশেষত আমি আমার মার একটিমাত্র সন্তান। তাই আমার ওপর তাঁর স্নেহটা ছিলো অন্যান্য মা-দের চেয়ে অনেক বেশি। পক্ষান্তরে বাবা জীবিত না থাকায় আমার পিতৃস্নেহটুকুও পতিত হচ্ছিলো মায়ের উপরেই। তাই আমার মাতৃস্নেহ ছিলো অন্যান্যদের চেয়ে কিছু বেশীই।

বিগত (ইং) ২৭-১০-৭৮ তারিখের ‘বিচিত্রা’ ১০-৬-৮১ তারিখের ‘সংবাদ’ পত্রিকা, ১৯-৭-৮১ তারিখের ‘বিল্পবী বাংলাদেশ’ পত্রিকা এবং ৪-৯-৮১ তারিখে প্রকাশিত ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা যারা পাঠ করেছেন, তাঁরা হয়তো জানেন আমার দুঃখজনক একটি ঘটনা। তবুও সেই অবিস্মরণীয় বিষাদময় ঘটনাটি সংক্ষেপে এখানে বলছি। যে ঘটনা করেছে আমাকে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দ্রোহী।

১৩৩৯ সালে আমার মা মারা গেলে আমি আমার মৃত মায়ের ফটো তুলি। তা দেখে আমার মার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাধা করতে যে সমস্ত আলেম ও মুসল্লিরা এসেছিলেন, তাঁরা আমার মার নামাজে জানাজা ও দাফন করা ত্যাগ করে লাশ ফেলে চলে যান, যেহেতু ফটো তোলা নাকি হারাম। অগত্যা কতিপয় অমুসল্লি নিয়ে জানাজা ছাড়াই আমার মায়ের মরদেহটি সৃষ্টিকর্তার হাতে সোপর্দ করতে হল কবরে। আমার মা ছিলেন অতিশয় ধার্মিকা-নারী। তাঁর নামাজ-রোজা বাদ পড়া তো দূরের কথা, ‘কাজা’ হতেও দেখিনি কোনদিন আমার জীবনে, বাদ পড়েনি তাঁর তাহাজ্জোদ নামাজ মাঘ মাসের দারূন শীতের রাতেও। এহেন পুণ্যবতী মায়ের জানাজা হল না আমার একটি দুষ্কর্মের ফলে। হায়রে পবিত্র ধর্ম। (আজকাল ওসব হারামের তম্বি নেই বললেই চলে।)

ইসলামের দৃষ্টিতে ছবি তোলা দূষণীয় হলেও এ ক্ষেত্রে সে দোষে দোষী হয়তো স্বয়ং আমিই, আমার মা নন। কেননা এতে আমার মার সম্মতি ছিলো না। আমার অপরাধে কেন যে আমার মার মরদেহের অবমাননা করা হল, তা আজো আমি খুঁজে পাচ্ছি না। পক্ষান্তরে নানা কারণে আমার নিজের বহু ফটো তোলা হয়েছে ও হচ্ছে। বিশেষত আমার ছেলেরা আমার মৃতদেহের ফটো তুলে রাখারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় আমার মৃতদেহটি গোঁড়া মুসল্লিদের কাছে আনুষ্ঠানিক সৎকারের মর্যাদা না পাওয়াই সম্ভব। যদিও পায় তবে আমার মায়ের মরদেহের অমর্যাদা ও আমার মরদেহের মর্যাদা দেখে তাতে আমার বিদেহী আত্মা তুষ্ট হবার কথা নয়। তাই আমি আমার মৃতদেহটিকে বিশ্বাসীদের অবহেলার বস্তু ও কবরে গলিত পদার্থে পরিণত না করে, তা মানবকল্যাণে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।

দ্বিতীয় কারণ

এককালে মানব সমাজে প্রসিদ্ধি লাভ করে থাকলেও বর্তমান শিক্ষিত সমাজ বিশেষত বৈজ্ঞানিক সমাজ ভূত-প্রেত, দেও-দানব, জীন-পরী, শয়তান-ফেরেস্তা ইত্যাদি কাল্পনিক জীবগণকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করে অযথা সময় নষ্ট করেন না। এমনকি আধুনিক কালের কোনো ঔপন্যাসিকও ওসব অতিজীবকে নিয়ে বা ওদের সমন্বয়ে কোন উপন্যাস রচনা করেন না। কেননা এখন আর ওসব উপন্যাস বাজারে বিকায় না। তাই আমিও ওসব অতিজীবকে নিয়ে কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা করি না, করি মানবকল্যাণের চেষ্টা যতোটুকু পারি। মানবকল্যাণ আমার ব্রত।

কোন অট্টালিকা ধ্বংস হলে তা পরিণত হয় রাবিশে এবং মানুষের যথোপযুক্ত কাজে লাগে। অনুরূপভাবে জীবের মৃতদেহগুলো পচে-গলে নষ্ট হলে তা পরিণত হয় কতোগুলো জৈবাজৈব পদার্থে এবং তা মানুষের কল্যাণ সাধন করে নানাভাবে। কৃষক হিসেবে আমি আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলছি। মাঠের কোথায়ও কোনো জীবদেহ পচে-গলে নষ্ট হলে সেখানের মাটিতে কয়েক বছর যাবত যে কোনো ফসল জন্মে ভালো। ওতে মানুষের কল্যাণ সাধিত হয়। তবে ওর একটি অকল্যাণেরও আশংকা রয়েছে। সেটি হচ্ছে – শবদেহ পচে-গলে নষ্ট হবার প্রাক্কালে দুর্গন্ধে মানুষের স্বাস্থ্য নষ্ট হবার আশংকা। বোধ হয় যে, সে কারণেই সেমিটিক জাতিরা মানুষের শবদেহ মাটিতে পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। এতে মানুষের অকল্যাণের পথ রুদ্ধ হলেও কল্যাণের পথ ততো প্রশস্ত হয়নি। কেননা যতটুকু গভীরে শবদেহ রাখা হয়, কোন ঔষধি জাতীয় ফসলের শিকড় ততটুকু গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। তাই তাতে কোন ফসল বাড়ে না। তবে আম, কাঁঠাল ইত্যাদি গাছের শিকড় ততোধিক গভীরে প্রবেশ করতে পারে। তাই দেখা যায় যে, কবরের ওপর কোন ফলের গাছ জন্মালে তাতে ফল ধরে প্রচুর। বিশেষত জীবের অস্থিতে থাকে ‘ফসফরাস’ নামীয় একটি পদার্থের আধিক্য এবং তা হচ্ছে ফলের স্বাদ ও ফলন বৃদ্ধির সহায়ক। পক্ষান্তরে শবদেহ জলভাগে পতিত হলে তা জলজীবের ভক্ষ্য হয় এবং জলজীবগুলো নানাভাবে মানুষের কাজে লাগে। এ সবে দেখা যায় যে, জীবের মৃতদেহগুলো মানুষের কল্যাণ সাধন করে নানারূপে –  প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মুখ্য বা গৌণভাবে। কিন্তু এতে কারো ইহকালের মনমানসের সম্পর্ক থাকে না। সম্পর্ক যদি থাকতো, তবে তাদের নিজেদের দেহের এরূপ মানবকল্যাণের ভূমিকা দেখে তাঁরা নিশ্চয় ই আনন্দলাভ করতো।

মেডিক্যালে আমার দেহ দানের কারণ মায়ের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং আমার মরদেহটি দ্বারা মানবকল্যাণের সম্ভাবনা বিধানে আমার সজীব মনের পরিতোষ ও আনন্দলাভের প্রয়াসমাত্র। আমার মরদেহটির সাহায্যে মেডিক্যাল কলেজের শল্যবিদ্যা শিক্ষার্থীগণ শল্যবিদ্যা আয়ত্ব করবে, আবার তাদের সাহায্যে রুগ্ন মানুষ রোগমুক্ত হয়ে শক্তিলাভ করবে। আর এসব প্রত্যক্ষ অনুভূতিই আমাকে দিয়েছে মেডিক্যালে শবদেহ দানের মাধ্যমে মানবকল্যাণের আনন্দলাভের প্রেরণা। এতে আমার পরিজনের বা অন্য কারো উদ্বিগ্ন হওয়া সমীচীন নয়।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x