হৃদরোগে ভুগে কৃষিকাজ ত্যাগ করার প্রায় সাত বছর পর ১৩৪১ সালের ১৬ই কার্তিক লাঙ্গল-জোয়াল-গরু নিয়ে আবার মাঠে নামলাম। সম্প্রতি কিছু কিছু রবি ফসলের আবাদ করলাম, ক্রমে অন্যান্য। ১৩৪২ সালের কার্তিক মাসে কিছু পরিমাণ জমিতে নৈনিতাল আলুর চাষ করলাম। ফলন পেলাম অতি ভাল। মনে পড়ে এ অঞ্চলে কৃষিক্ষেত্রে গোল আলুর চাষ এই-ই প্রথম।

অত্যাধিক উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে পাটের মূল্য হ্রাসের দরুন- চাষীদের পাটচাষ কমাইবার উদ্দেশ্যে সরকার পক্ষ এ সময় গ্রামে গ্রামে প্রচার কার্য চালাচ্ছিলেন। ১৯শে ফাল্গুন (১৩৪২) মাননীয় এস,ডি,ও সাহেব, সি,ও মাননীয় আমীর আলী সাহেব, জনৈক কৃষি কর্মচারী ও কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসলেন আমাদের গ্রামে, সভা ডাকলেন কাছাড়ী বাড়িতে। গ্রামের চাষীদের নিমন্ত্রণ ছিল, বহুলোক উপস্থিত হলেন। সভায় অনেকে বক্তৃতা করলেন। সকলের সকল বক্তৃতার সারমর্ম হল- পাটের চাষ কমিয়ে খাদ্য শষ্যের চাষ বাড়ানো। শুনে কোন কোন চাষী বললেন যে, পাট ছাড়া আমাদের জমিতে অন্য ফসল ভাল জন্মে না। আবার কেহ আমাকে নির্দেশ করে বললেন- মাতুব্বর সাহেব জমিতে এ বছর অতি উত্তম আলু জন্মেছে। ইহা শূনে এস.ডি ও সাহেব আমার কাছে সেই আলুর নমুনা দেখতে চাইলেন এবং আমি বাড়ি হতে নিয়ে তাঁকে দশটি আলু দেখতে উপহার দিলাম। আমার ক্ষেতের জন্মানো আলু দেখে সবাই আনন্দিত হলেন। কেননা আলু দশটি ওজনে ছিল আড়াই সের।

এস.ডি ও সাহেবকে বললাম যে, আমি গতানুগতিক পন্থায় পেশাদারী কৃষিকাজ করতে শিখেছি মাত্র, কৃষিবিদ্যা শেখার কোন সুযোগ পাইনি কখনো। আধুনিক পদ্ধতিতে নিত্য-নূতন ফসল জন্মাতে আমি আগ্রহী। এন,জি মুখারজী কৃত “সরল কৃষি বিজ্ঞান” ও “কৃষি সহায়” নামক দুখানা বই এনেছিলাম আমি বিগত ১১/৯/৪১ তারিখে কৃষক অফিস ৬৩ নং বহুবাজার স্ট্রিট কলিকাতা হতে পার্সেল করায়ে। ঐ বই দুখানার সহায়তায় আমার বর্তমান কৃষি পদ্ধতি কিছুটা উন্নত মানের হচ্ছে। শিক্ষার সুযোগ পেলে আমি কৃষি উন্নয়নে ব্রতী হতাম। শুনে এস,ডি ও সাহেব উপস্থিত কৃষি কর্মচারীটিকে অনুরোধ করে বললেন যে, তিনি যেন বরিশাল কৃষি অফিস এবং সাগরদী কৃষি ফার্ম হতে এ বিষয় আমাকে যথা সম্ভব সাহায্য দানের ব্যবস্থা করেন। কৃষি কর্মচারীটি সম্মতি জানালেন।

অতঃপর আমি বরিশাল কৃষি অফিসের সাথে সংযোগ রেখে চলতে লাগলাম। কৃষি অফিসের মারফতে- “কৃষক” নামক (তদানিন্তন) একখানা কৃষি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা বিনামূল্যে আমি যাতে পেতে পারি, তার ব্যবস্থা করা হ’ল। ১৩৪৩ সালের বৈশাখ সংখ্যা হ’তে নিয়মিতভাবে আমি মাসিক “কৃষক” পত্রিকা খানি পেতে লাগলাম।

ক্রমে আমি বরিশাল কৃষি অফিস হতে নিম্ন লিখিত পুস্তিকাগুলো পেলাম-

(১) গোপাল বান্ধব —— পি, সি, সরকার

(২) সব্জীচাষ —— এন,সি চৌধুরী

(৩) কৃষি ক্ষেত্র —- পি.সি. দে

(৪) সব্জীবাগ —- পি.সি. দে

(৫) ভূমি কর্ষণ —- পি.সি. দে

(৬) উদ্ভিদ জীবন —- পি.সি. দে

(৭) গো-সেবা —- জে, আর মজুমদার

(৮) বাংলার মাটি —- জে, আর মজুমদার

(৯) সরল কৃষি কথা —- জে, আর মজুমদার

(১০) ফসলের খাদ্য —- জে, আর মজুমদার

(১১) মৎস্য বিজ্ঞান —- জে, আর মজুমদার

(১২) আলুর চাষ —- জে, আর মজুমদার

(১৩) কলার চাষ —- জে, আর মজুমদার

(১৪) ইক্ষু চাষ —- জে, আর মজুমদার

(১৫) পান চাষ —- জে, আর মজুমদার

কোন নতুন বই পুথি হাতে পেলে, তা একবার পড়ে দেখার আগ্রহটা থাকে প্রত্যেক পাঠকের, আমারও আছে। প্রত্যেকটি পুস্তক পাঠে কিছু না কিছু লাভবান হওয়া যায়। গল্প, উপন্যাসাদি সাহিত্য শ্রেণীর পুস্তক পাঠে প্রথমতঃ আনন্দ লাভ হয়, দ্বিতীয়তঃ ওতে নৈতিক চরিত্র উন্নয়নের উপকরণ পাওয়া যায়। তবুও ওসবের প্রতি আমার মনের আকর্ষণ ততটা বেশি নয়, যতটা বিজ্ঞানের প্রতি। বিজ্ঞানের পুথিতে বর্ণিত সাধারণ বিষয়গুলো হাতে নাতে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে দেখায় আমার একটা আনন্দ।

তাই আমি “চুম্বক” (বই) পড়ে চুম্বক (লোহা) গড়ে কম্পাস বানিয়েছি, “চলবিদ্যুৎ” পড়ে ব্যাটারী ও ডাইনামো বানিয়েছি এবং “গ্রহ-নক্ষত্র” বই খানা পড়ে আকাশের-রাশি, নক্ষত্র, গ্রহ এবং অন্যান্য নক্ষত্র যথা- কালপুরুষ, সপ্তর্ষি, পারসুস, পেগাসস, ধ্রুব, ক্যাসোপিয়া, এন্ড্রোমিডা, ক্যাপেলা, লুব্ধক, সরমা ইত্যাদি রাতের পর রাত জাগিয়ে আকাশে খোঁজ করেছি, খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি, কতগুলো হয়তো চিনেছি। এভাবে ক্রমাগত তিন বছর যাবত আমি আকাশ চাষ করেছি এবং এ বছর আবার শুরু করেছি বিজ্ঞানের ভিত্তিক জমিনের চাষ। হয়ত কেহ প্রশ্ন করতে পারেন যে, আমার মত একজন কৃষকের পক্ষে আকাশ চাষে লাভ কি? উত্তরে বলব- আর্থিক লাভ আমার কিছুই হয়নি, তবে আত্মিক লাভ হয়েছে যথেষ্ট। এ বিষয় অন্য সময় বলব।

কৃষি সংক্রান্ত বইগুলো পেয়ে ওর উপদেশ ও নিয়ম মাফিক- প্রথমঃ পরীক্ষামূলক এবং পরে কার্যকরীভাবে কৃষি কাজ করতে লাগলাম। সচরাচর আমাদের এ অঞ্চলে- ধান, পাট, আখ, তিল, সরিষা, মুগ, মশুরী, খেসারী, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, মানকচু, মূলা, ফুটী, খেরো তরমুজ, কুমড়া ইত্যাদি ফসলের চাষ করা হয়ে থাকে এবং আমিও এগুলো সাধারণ ভাবে আবাদ করেছি। এ ছাড়া আমি আরো কতিপয় ফসলের চাষ করেছি, যা সে সময় অন্য কেহ করেননি। যথা- আলু, গম, তিসি, চিনাবাদাম, হরিদ্রা, শন, কোয়েম্বাটুর (৪২১ ও ৫২৭) ইক্ষু, পান ইত্যাদি। এ ভাবে কৃষি কাজ চালালাম ১৩৬৬ সাল পর্যন্ত।

কৃষি বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের মধ্যে একটি বিশিষ্ট বিষয় হল যে, রসায়ন শাস্ত্রের নিয়মে একাধিক পদার্থের মিলনের ফলে একটি অভিনব পদার্থ উৎপন্ন হয়ে থাকে। যেমন- সোডিয়াম ও ক্লোরিন নামক দুটি পদার্থ যোগে “লবণ” এবং তামা, গন্ধক ও অক্সিজেন যোগে “তুঁতে” উৎপন্ন হয়। আবার হরিদ্রার সাথে চুন মিশালে উৎপন্ন হয় “লাল রং”। আমাদের কৃষি ক্ষেত্রটাও অনুরুপ একটি রাসায়নিক লীলাভূমি। যেখানে একটি শুষ্ক বীজ ভিন্ন আর কিছুই থাকে না, -পরিমিত জল প্রয়োগে সেখানে দেখা দেয় একটি “অঙ্কুর”। আবার জল, বায়ু, সূর্যালোক ও (মাটিস্থ) জৈবাজৈব কতগুলো পদার্থ যোগে অঙ্গুরটি পরিণত হয় একটি “বৃক্ষে”। কোন কোন পদার্থ বৃক্ষের পাতা, পল্লব বা ফুল বৃদ্ধির সহায়তা করে আবার কোন কোন পদার্থ  মিশ্রিত হয়ে গাছের “খাদ্য” (সার) প্রস্তুত করে এবং কোন কোন কোন পদার্থ করে (গাছের শত্রু) পোকা-মাকড় ধ্বংস। এভাবে কৃষি ক্ষেত্রের সর্বত্রই চলছে রসায়ন বা দ্রব্যগুলির ব্যবহার। কৃষকরা ওসব না জানার জন্যই কৃষিজাত ফসলের তথা কৃষিকাজের উন্নতি হচ্ছে না; হচ্ছে অবনতিই।

কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

নিবেদন

ভিখারীর আত্মকাহিনী- প্রথম খন্ড

চর পূর্বাভাস ও জন্ম (১১৫৮-১৩০৭)

ছবি ও জলের কল (১৩২২)

মুন্সি আহম্মদ দেওয়ান (১৩২৩

পলায়ন (১৩২৪)

মুন্সি আপছার উদ্দিন (১৩২৫)

আরবী শিক্ষায় উদ্যোগ (১৩২৬)

চিকিৎসা শিক্ষা (১৩৩০)

জীবন প্রবাহের গতি (১৩৩১)

ছুতার কাজ শিক্ষা (১৩৩১)

জরীপ কাজ শিক্ষা (১৩৩৩)

বস্ত্র বয়ন শিক্ষা (১৩৩৫)

উচ্চ শিক্ষার প্রচেষ্টা (১৩৩৫)

জাল বুনা শিক্ষা (১৩৩৬)

ভিখারীর আত্মকাহিনী- দ্বিতীয় খন্ড

জাল বোনা ও মৎস্য শিকার

মোসলেম সমিতিঃ স্কুল প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষকতা (১৩৩৬-১৩৪১)

মোসলেম সমিতিরঃ ভাঙ্গন

পাঠাগার স্থাপন (১৩৩৭)

পাখা তৈয়ার (১৩৩৯)

ইঞ্জিনিয়ারিং শিখার উদ্যোগ ও মাতৃবিয়োগ (১৩৩৯)

সীজের ফুল রচনা (১৩৪০)

বিশ্বাসের বিবর্তন (১৩৪১)

ডাইনামো তৈয়ার (১৩৪১)

ভিখারীর আত্মকাহিনী- তৃতীয় খন্ড

কৃষি বিদ্যা শিক্ষা 

জলঘড়ী তৈয়ার

বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীর শিক্ষা 

সাইক্লোন

দুর্ভিক্ষ

অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদিরের সান্নিধ্যে

লাল গোলা যাতায়াত

ভিখারীর আত্মকাহিনী- পঞ্চম খন্ড

“ক্ষেত্র-ফল” রচনা

স্টেট বাটারা

আদেশাবলী

“সৃষ্টি – রহস্য” রচনা

“সত্যের সন্ধান” এর পান্ডুলিপ

সত্যের সন্ধান প্রকাশ

সন্তান-সন্ততি

ভূসম্পত্তি

দেশ সেবা

খোরাক-পোসাক

জীবন বাণী

“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

 

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x