১৯৮২ সালে হার্ভার্ডে লোয়েব (Loeb) বক্তৃতাবলী দানের পর থেকেই আমি সিদ্ধান্ত করেছিলাম স্থান এবং কাল বিষয়ে সাধারণের জন্য একটি বই লেখার চেষ্টা করব। মহাবিশ্বের প্রথম অবস্থা এবং কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে ইতিপূর্বে অনেকগুলি বই লেখা হয়েছিল। স্টিফেন উইনবার্গের অত্যন্ত ভাল বই ‘প্রথম তিন মিনিট’ (The First Three Minutes) থেকে শুরু করে অত্যন্ত খারাপ বই পর্যন্ত (তবে অত্যন্ত খারাপ বইয়ের নামটা আমি করব না)। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে সমস্ত প্রশ্ন আমার সৃষ্টিতত্ত্ব (cosmology) এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব (কণাবাদী তত্ত্ব) নিয়ে গবেষণার পথিকৃৎ, কোনও বইয়েই সে প্রশ্নগুলি নিয়ে সঠিক আলোচনা হয়নি। প্রশ্নগুলি হলঃ মহাবিশ্ব কোত্থেকে এসেছে? কিভাবে এর শুরু? কেনই বা এর শুরু হল? মহাবিশ্ব কি শেষ হয়ে যাবে? যদি হয় তবে কি ভাবে হবে? এ প্রশ্নগুলি সম্পর্কে আমাদের সবারই ঔৎসুক্য রয়েছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এমন জটিল (technical) হয়ে উঠেছে যে শুধুমাত্র তার বিবরণের জন্য ব্যবহৃত গণিত আয়ত্ব করতে পেরেছেন খুব স্বল্পসংখ্যক বিশেষজ্ঞ। তবুও মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও নিয়তি (fate) সম্পর্কিত মূলগত ধারণাগুলি গণিত ছাড়াই বলা যায়। এবং এমনভাবে বলা যায় যে, যাদের বিশেষ বৈজ্ঞানিক শিক্ষা নেই, তাঁরাও সেটা বুঝতে পারবেন। এ বইয়ে আমি সেটা চেষ্টা করেছি। সফল হয়েছি কি না সে বিচার করবেন পাঠক।
আমাকে একজন বলেছিলেনঃ এক একটি সমীকরণ ব্যবহার করার অর্থ হবে পাঠকের সংখ্যা অর্ধেক করে কমে যাওয়া। সুতরাং আমি সিদ্ধান্ত করেছিলাম, কোন সমীকরণই (equation) ব্যবহার করব না। শেষ পর্যন্ত আমি একটি সমীকরণ ব্যবহার করেছি- আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E= mc2 । আমার আশা, এর ফলে আমার ভাবী পাঠকদের অর্ধেক ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবেন না।
এ. এল. এস (ALS) অথবা মোটর নিউরন (Motor Neuron) ব্যাধির মতো একটি দুর্ভাগ্য ছাড়া অন্য প্রায় সব ব্যাপারেই আমি ভাগ্যবান। আমার স্ত্রী জেন এবং আমার ছেলেমেয়ে রবার্ট, লুসি আর টিমির কাছে আমি যে সাহায্য পেয়েছি, তার ফলে আমার পক্ষে মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব হয়েছে এবং সম্ভব হয়েছে কর্মজীবনে সাফল্য লাভ করা। তাছাড়া আছে আর একটি সৌভাগ্য- আমি বেছে নিয়েছিলাম তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা। তার সবটাই মনের ভিতরে কাজ। সুতরাং আমার অসুস্থতা একটা কঠিন প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় নি। আমার বৈজ্ঞানিক সহকর্মীদের প্রত্যেকেই যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন।
আমার কর্মজীবনে প্রথম ক্লাসিক্যাল পর্যায়ে আমার প্রধান সহচর এবং সহকর্মী ছিলেন পেনরোজ (Roger Penrose), রবার্ট গেরক (Robert Geroch), ব্রান্ডন কার্টার (Brandon Carter) এবং জর্জ এলিস (George Ellish)। এরা আমাকে যা সাহায্য করেছেন এবং আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে যে কাজ করেছি, তার জন্য আমি এঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।
এই অধ্যায়ের সংক্ষিপ্তসার রয়েছে ‘বৃহৎ মানে স্থান-কালের গঠন’ (The Large Scale Structure of Spacetime) পুস্তকে। সে পুস্তকটি আমি আর এলিস লিখেছিলাম ১৯৭৩ সালে। আমার পাঠকদের প্রতি আমার উপদেশ আরও সংবাদ সংগ্রহের আশায় ও বইটা না পড়া। বইটা অত্যন্ত জটিল, বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলে পূর্ণ এবং বেশ অপাঠ্য। আমার আশা- কি করে সহজে বোধগম্য হওয়ার মতো লিখতে হয়, ঐ বইটা লেখার পর এত দিনে আমি সেটা শিখেছি।
১৯৭৪ সাল থেকে আমার কর্মজীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ “কোয়ান্টাম (কণাবাদী)” পর্যায়ে আমার প্রধান সহযোগী ছিলেন গ্যারী গিবনস (Gari Gibbons), ডন পেজ (Don Page) এবং জিম হ্যর্টল (Jim Hartle)। তাঁদের কাছে এবং আমার গবেষণাকারী ছাত্রদের কাছে আমার অনেক ঋণ। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয় অর্থেই তাঁরা আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন। ছাত্রদের সঙ্গে কাজ করা আমাকে বিরাট ভাবে উদ্ভুদ্ধ করেছে। আমার আশা, আমি সেজন্যই কোন না কোন গলিতে ঢুকে পড়িনি।
এই বইটির ব্যাপারে আমার ছাত্র ব্রায়ান হুইটের (Brian Whitt) কাছ থেকে আমি প্রচুর সাহায্য পেয়েছি। বইটির প্রথম খসড়া করার পর ১৯৮৫ সালে আমার নিউমোনিয়া হয়। আমার ট্রাকিওষ্টমি (Tracheostomy)- শ্বাসনালীর একটি অপারেশন) করতে হয়। ফলে আমার কথা বলার ক্ষমতা লোপ পায় এবং অন্যের সঙ্গে বাক্যালাপও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমি ভেবেছিলাম বইটি আমি শেষ করতে পারব না। কিন্তু ব্রায়ান শুধুমাত্র পুনর্বিচারের জন্য আবার পাঠ করতেই সাহায্য করেনি, উপরন্তু সে আমাকে লিভিং সেন্টার (Living Center) নামক যোগাযোগ পদ্ধতি (Communication Programme) ব্যবহার করায়। এটা আবার আমাকে দান করেছিল ক্যালিফোর্নিয়ার সানিভেলের ওয়ার্ডস প্লাস ইনকরপোরেটেড-এর (Words Plus Inc) ওয়াল্ট ওলটোজ (Walt Woitosz) এর সাহায্যে আমি বই এই গবেষণাপত্র লিখতে পারি। তাছাড়া স্পীচ প্লাস (Speech Plus) আমাকে যে স্পীচ সিনথেসাইজার (Speech Synthesizer) দান করেছেন তার সাহায্যে আমি লোকজনের সঙ্গে কথাও বলতে পারি। এঁরাও ক্যালিফোর্নিয়ার সানিভেলের। ডেভিড মেসন (David Mason) আমার হুইল চেয়ারে একটা সিনথেসাইজার এবং ছোট একটা ব্যক্তিগত কম্প্যুটার লাগিয়ে দিয়েছেন। এর ফলে বিরাট একটা পার্থক্য হয়েছেঃ আসলে আমার কন্ঠস্বর নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে যা পারতাম এখন তার চাইতে ভাল ব্যাক্যালাপ করতে পারি।
যারা প্রথম খসড়াটি দেখেছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই বইটির উন্নতির জন্য উপদেশ দিয়েছেন। বিশেষ করে উপদেশ দিয়েছেন ব্যান্টাম বুকস (Bantam Books)। আমার এ বইটির সম্পাদক পিটার গাজার্ডি (Peter Guzzardi) যে সব বিষয়ে ভাল ব্যাখ্যা করা হয়নি বলে তিনি ভেবেছিলেনঃ সেগুলি সম্পর্কে তিনি পাতার পর পাতা মন্তব্য আর প্রশ্ন পাঠিয়েছেন। যে সব জিনিস পাল্টাতে হবে, তাঁর ঐ বিরাট তালিকা পেয়ে আমি রীতিমতো বিরক্ত হয়েছিলাম সন্দেহ নেই কিন্তু তিনি ঠিকই করেছিলেন। আমার নাকটা মাটিতে ঘষে দেওয়ার ফলে বইটা অনেক ভাল হয়েছে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
আমার সহকারী কলিন উইলিয়ামস (Colin Williams), ডেভিড টমাস (David Thomas) এবং রেমন্ড লাফ্লাম (Raymond Laflamme), আমার সেক্রেটারি জুডি ফেলা (Judy Fella), অ্যান র্যালফ (Ann Ralph), চেরিল বিলিংটন (Cheryl Billington) এবং সু ম্যাসে (Sue Masey) এবং আমার নার্সদের দলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার গবেষণা এবং চিকিৎসা বাবদ গনভিল (Gonville) এবং কাইয়াস কলেজ (Caius College), দি সায়েন্স এ্যান্ড এনজিনিয়ারীং রিসার্চ কাউন্সিল (The Science and Engineering Research Council) এবং লেডারহিউম (Leverhulme), ম্যাক আর্থার (Mac Arthur), নুফিল্ড (Nuffield) এবং র্যালফ স্মিথ ফাউন্ডেশন (Ralph Smith Foundations)- এঁরা যদি আমায় অর্থ দান না করতেন, তা হলে এ সমস্ত কাজ সম্ভব হতো না। আমি সবার কাছেই অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
স্টিফেন হকিং
২০ শে অক্টোবর, ১৯৮৭
“কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ