উক্ত শিরোনামে ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ ইউসুফ ইব্ন মাহিক হইতে ধারাবাহিকভাবে ইব্ন জুরায়জ, হিশাম ইব্ন ইউসুফ ও ইবরাহীম ইব্ন মূসা আমার নিকট বর্ণনা করিয়াছেন যে, ইউসুফ ইব্ন মাহিক বলেন- একদা আমি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম ! এই সময়ে তাঁহার নিকট জনৈক ইরাকী আগমন করত প্রশ্ন করিল- কোন রং-এর কাফন উত্তম? তিনি উত্তর করিলেন- কোনো রং-এর কাফনই অনুত্তম নহে। ইরাকী লোকটি বলিল- আপনার কুরআন মজীদখানা আমাকে দেখান। তিনি বলিলেন- ‘উহাতে তোমার কি কাজ? লোকটি বলিল, আমি উহার অনুরূপ করিয়া কুরআন মজীদকে বিন্যস্ত করিব । কারণ, কুরআন মজীদ অবিন্যস্ত অবস্থায় পঠিত হইয়া থাকে । তিনি বলিলেন- কুরআন মজীদের যে কোন সূরাই পূর্বে পড় না কেন, তাহাতে কিছু যায় আসে না। নবূওতের প্রথম দিকে বেহেশত ও দোযখের আলোচনা সম্বলিত ক্ষুদ্রাবয়ব সূরা নাযিল হয়। অতঃপর লোকে যখন ইসলামের পতাকা তলে সমবেত হইতে থাকে, তখন হালাল-হারাম সম্বলিত সূরা নাযিল হয়। প্রথম দিকেই যদি নাযিল হইত ‘তোমার শরাব পান করিও না’ তবে লোকে বলিত- ‘আমরা কখনও শরাব ত্যাগ করিব না।’ অনুরূপভাবে প্রথম দিকে যদি নাযিল হইত, ‘তোমরা যিনা করিও না’ তবে লোকে বলিত- ‘আমরা কখনো যিনা ত্যাগ করিব না।’ আমি যখন খেলাধূলায় লিপ্ত ছোট্ট বালিকা মাত্র, তখন পবিত্র মক্কায় রাসূল করীম (সাঃ)-এর উপর بل السساعة موعدهم والساعةأدفى وأمر (বরং কিয়ামতই হইতেছে তাহাদের প্রতিশ্রুত দিবস; আর কিয়ামত হইতেছে অতিশয় লাঞ্ছনার ও অতিশয় তিক্ত) এই আয়াত নাযিল হয়। নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি যখন সূরা বাকারা ও সূরা নিসা নাযিল হয়, তখন আমি তাঁহার সহধর্মিণী ছিলাম।’ রাবী বলেন- অঃপর হযরত আয়েশা (রাঃ) স্বীয় কুরআন মজীদখানা খুলিয়া ইরাকী লোকটিকে বিভিন্ন সূরার কতগুলি আয়াত শুনাইলেন ।
এইস্থলে কুরআন মজীদের বিন্যাসের অর্থ হইতেছে উহার সূরাসমূহের বিন্যাস। ইরাকী লোকটির কাফন সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর প্রদানে হযরত আয়েশা (রাঃ) যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, ইহা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নহে এবং ইহার পশ্চাতে পরিশ্রম ও দৌড়াদৌড়ি করা নিষ্প্রয়োজন । ইহাতে অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় শ্রম নিয়োগ করা ছাড়া কোন লাভ নাই ৷ এখানে উল্লেখযোগ্য যে, লোকেরা তৎকালে ইরাকবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিত যে, তাহারা অপরকে নাকাল করিবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করিয়া থাকে । একদা জনৈক ইবাকী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রাঃ)-এর নিকট কাপড়ে মশার রক্ত লাগিলে উহা নাপাক হইয়া যায় কিনা— এইরূপ প্রশ্ন করিল। তিনি বলিলেন- ‘ইরাকীদের আচরণ দেখো। ইহারা মশার রক্ত কাপড়ে লাগিলে কাপড় নাপাক হইয়া যায় কিনা, তাহা জানিতে চাহে। অথচ ইহারাই আল্লাহ্র রাসূলের স্নেহের কন্যার গর্ভজাত সন্তান, তাঁহার আদরের দুলাল হযরত হুসায়ন (রাঃ)-কে হত্যা করিয়াছে! উপরোক্ত কারণেই হযরত আয়েশা (রাঃ) ইরাকী প্রশ্নকারী লোকটির সহিত কথোপকথনে বেশী অগ্রসর হইতে চাহেন নাই। এতদ্ব্যতীত পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, তিনি চাহিয়াছিলেন, লোকটি যেন বিষয়টিকে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ মনে করিয়া না বসে। তাই তিনি তাহার প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিতে গিয়া সংক্ষিপ্ত পথ অনুসরণ করিয়াছিলেন। প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের দীর্ঘ উত্তরও হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট ছিল। হযরত সামুরাহ (রাঃ) ও হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ইমাম আহমদ এবং ‘সুনান’ এর সংকলকগণ বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘তোমরা সাদা রং এর কাপড় পরিধান কর এবং উহাতে মুর্দা দাফন কর। কারণ, সাদা রং-এর কাপড় সুন্দর ও আনন্দদায়ক।’ ইমাম তিরমিযী উক্ত হাদীস উভয় সনদেই সহীহ নামে আখ্যায়িত করিয়াছেন। বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে বর্ণিত রহিয়াছেঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন- ‘নবী করীম (সাঃ)-কে একহারা সূতায় প্রস্তুত সাদা রং-এর তিনখানা কাপড়ে দাফন করা হইয়াছিল। উহাদের মধ্যে জামা বা পাগড়ী ছিল না।’ উক্ত হাদীস জানাযা অধ্যায়ের অন্তর্গত ‘কাফন’ পরিচ্ছেদে লিখিত রহিয়াছে । যাহা হউক, উপরোল্লেখিত কারণে হযরত আয়েশা (রাঃ) ইরাকী প্রশ্নকর্তাকে উপরোক্ত হাদীস শুনাইতে যান নাই ।
প্রথম প্রশ্নের উত্তর প্রাপ্তির পর ইরাকী লোকটি দীর্ঘ এক প্রশ্নের অবতারণা করিল। সে হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে জানাইল যে, সে যে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে, উহার সূরাসমূহ অবিন্যস্ত। হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক কুরআন মজীদ সুবিন্যস্তভাবে সংকলিত ও বিভিন্ন মুসলিম এলাকায় উহা প্রেরিত হইবার এবং হযরত উসমান (রাঃ-এর বিরুদ্ধে কুরআন মজীদ জ্বালাইয়া দিবার অভিযোগ উত্থাপিত হইবার পূর্বে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট ইরাকীর প্রশ্ন করিবার উপরোক্ত ঘটনা ঘটিয়াছিল । আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। উপরোক্ত কারণেই হযরত আয়েশা (রাঃ) প্রশ্নকর্তাকে বলিয়া দিলেন- ‘তুমি যে কোন সূরাকেই পূর্বে পাঠ কর না কেন, তাহাতে কিছু যায় আসে না।’ হযরত আয়েশা (রাঃ) তাহাকে আরও বলিয়াছিলেন যে, নবূওতের প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরায় বেহেশত ও দোযখের বর্ণনা ছিল। উক্ত সূরা কোন্ সূরা ছিল? উহা যদি সূরা আলাক না হইয়া থাকে, তবে এইরূপ হইতে পারে যে, ‘সূরা’ শব্দ বলিতে হযরত আয়েশা (রাঃ) নির্দিষ্ট সূরা বিশেষকে না বুঝাইয়া ক্ষুদ্রাবয়ব সূরা শ্রেণীকে বুঝাইতে চাহিয়াছেন। এই শ্রেণীর সূরাসমূহে জান্নাতের পুরস্কারের ওয়াদা ও জাহান্নামের শাস্তির ব্যাপারে সতর্কবাণী বিবৃত হইয়াছে।(১) হযরত আয়েশা (রাঃ) তাহাকে আরও বলিয়াছিলেন- সূরা বাকারা ও সূরা নিসা নাযিল হইয়াছিল নবূওতের শেষ দিকে, যখন লোকে ঈমানে উদ্বুদ্ধ হইয়া ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হইতেছিল এবং এই সময়ে তিনি নবী করীম (সাঃ)-এর সহধর্মিণী ছিলেন। এই সময়ে আল্লাহ্ তা’আলা ধীরে ধীরে হালাল-হারাম ইত্যাদি আদেশ-নিষেধ নাযিল করিয়াছিলেন। ইহা ছিল আল্লাহ্ তা’আলার বিশেষ হিকমাত। যাহা হউক, হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর শেষোক্ত দুইটি কথার তাৎপর্য এই যে, ক্ষুদ্রাবয়ব সূরা শ্রেণী অথবা সূরা বিশেষ নবৃওতের প্রথম দিকে নাযিল হইলেও কুরআন মজীদে উহার অবস্থান প্রথম দিকে না হইয়া শেষ দিকে রহিয়াছে। পক্ষান্তরে, সূরা বাকারা ও সূরা নিসা নবৃওতের শেষ দিকে নাযিল হইলেও কুরআন মজীদে উহাদের অবস্থান প্রথম দিকে রহিয়াছে ।
এই গেল কুরআন মজীদের সূরাসমূহের বিন্যাস সম্পর্কিত হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর উক্তি । তাঁহার উক্তিতে প্রতীয়মান হয় যে, কুরআন মজীদের সূরাসমূহের যে কোনটিকে যে কোনটির পূর্বে বা পরে তিলাওয়াত করা বৈধ। কুরআন মজীদের সূরাসমূহের ক্ষেত্রে উপরোক্ত
অনুমোদন প্রযোজ্য হইলেও উহার সূরাসমূহের বিভিন্ন আয়াতের ক্ষেত্রে উহা প্রযোজ্য নহে । কারণ, আয়াতসমূহের বিন্যাস আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশে স্বয়ং নবী করীম (সাঃ) কর্তৃক সম্পাদিত হইয়াছে। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হইয়াছে। কোনো সূরার যে কোনো আয়াতকে যে কোনো আয়াতের পূর্বে বা পরে তিলাওয়াত করিবার অনুমতি শরীআতে নাই বলিয়াই হযরত আয়েশা (রাঃ) প্রশ্নকর্তাকে সেইরূপ অনুমতি দেন নাই। বরং তিনি স্বীয় কুরআন মজীদখানা বাহির করিয়া তাহার সূরাসমূহের কতগুলি আয়াত শুনাইয়া দিলেন। ‘তুমি যে কোনো সূরাকেই পূর্বে পড়িতে পার’- প্রশ্নকর্তার প্রতি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর এই উক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ‘নামাযে যে কোনো সূরা পূর্বে বা পরে পড়া বৈধ।’ সহীহ হাদীস গ্রন্থে হযরত হুযায়ফা (রাঃ) হইতে বর্ণিত হাদীস দ্বারাও উহা প্রমাণিত হয়। হযরত হুযায়ফা (রাঃ) বলেন- নবী করীম (সাঃ) তাহাজ্জুদ নামাযে প্রথম সূরা বাকারা, তৎপর সূরা নিসা এবং তৎপর সূরা আলে ইমরান তিলাওয়াত করিয়াছেন।
ইমাম কুরতুবী ‘প্রতিবাদ পুস্তক’ নামক স্বীয় গ্রন্থে আবূ বকর ইব্ন আম্বারীর এইরূপ উক্তি উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ ‘কুরআন মজীদে সূরাসমূহ যেইরূপে বিন্যস্ত রহিয়াছে, কেহ যদি উহা লঙ্ঘন করিয়া পূর্বে অবস্থিত সূরা পরে অথবা পরে অবস্থিত সূরা পূর্বে তিলাওয়াত করে, তবে উহা দ্বারা তাহার কোন সূরার আয়াতসমূহের বিন্যাসকে লঙ্ঘন করিয়া তিলাওয়াত করিবার অথবা কোন শব্দের বিভিন্ন বর্ণের অবস্থানকে পরিবর্তন করিয়া তিলাওয়াত করিবার অপরাধের ন্যায় অপরাধই হইবে। আবূ বকর ইব্ন আম্বারী স্বীয় অভিমতের পক্ষে এই যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, ‘হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক সংকলিত কুরআন মজীদ যেইরূপে বিন্যস্ত হইয়াছে, উহাই অনুসরণীয় । উহার যে কোনরূপ লঙ্ঘনই অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।’ অবশ্য, সূরা তাওবার প্রথমে বিস্ মিল্লাহ্ না লিখিবার এবং সূরা আনফালকে দীর্ঘাবয়ব সাতটি সূরার অন্তর্ভুক্ত করিবার ব্যাপারে হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হযরত উসমান (রাঃ)-এর নিকট যে প্রশ্ন করিয়াছিলেন এবং তিনি উহার যে উত্তর প্রদান করিয়াছিলেন, তাহাতে প্রমাণিত হয় যে, সূরাসমূহের তারতীব বা বিন্যাস নবী করীম (সা) কর্তৃক নহে, বরং হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক সম্পন্ন হইয়াছিল । তিরমিযী শরীফসহ একাধিক হাদীস গ্রন্থে উপরোক্ত হাদীস বর্ণিত রহিয়াছে। উহার সনদ মজবুত ও শক্তিশালী।(১)
ইতিপূর্বে আমি উল্লেখ করিয়াছি যে, হযরত আলী (রাঃ) কুরআন মজীদকে উহার অবতীর্ণ হইবার ক্রম অনুসারে সাজাইয়া সংকলিত করিতে চাহিয়াছিলেন।(২) কাযী বাকিলানী বর্ণনা করিয়াছেন— ‘হযরত আলী (রাঃ)-এর কুরআন মজীদের প্রথম সূরা ছিল اقرأ باسم ربكالذنى خلق(৩) হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর কুরআন মজীদের প্রথম সূরা ছিল مالك يوم
الدين উহার পর যথাক্রমে বাকারা ও নিসা ছিল। উহাদের বিন্যাস ছিল (প্রচলিত কুরআন মজীদের সূরাসমূহের বিন্যাস হইতে) পৃথক ও স্বতন্ত্র। তেমনি হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ)-এর কুরআন মজীদের প্রথম সূরা ছিল الحمد للد উহার পর যথাক্রমে নিসা, আলে ইমরান, আনআম ও মায়িদা ইত্যাদি। উহাদের বিন্যাস ছিল লক্ষণীয়ভাবে পৃথক ও স্বতন্ত্র।(১)
অতঃপর কাযী বাকিলানী মন্তব্য করিয়াছেন- ‘সম্ভবত সাহাবায়ে কিরামই স্বীয় ইজতিহাদ অনুযায়ী কুরআন মজীদের সূরাসমূহকে বর্তমান আকারে বিন্যস্ত করিয়াছেন।’ তাফসীরকার মক্কীও স্বীয় তাফসীর গ্রন্থের সূরা তাওবার তাফসীরে অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন । তিনি বলিয়াছেন- ‘সূরাসমূহের আয়াতের বিন্যাস এবং প্রতিটি সূরার পূর্বে বিস্মিল্লাহ্ শরীফ স্থাপনের কার্যটি নবী করীম (সাঃ) কর্তৃক সম্পাদিত হইয়াছে।’ একদল আহলে ইলমের ন্যায় ইন ওহাব বলেন- আমি সুলায়মান ইব্ন বিলালের নিকট শুনিয়াছি— ‘একদা রবীআর নিকট জিজ্ঞাসা করা হইল, সূরা বাকারা সূরা আলে ইমরানের পূর্বে আশিটির বেশী সূরা নাযিল হওয়া সত্ত্বেও উক্ত সূরাদ্বয়কে কেন উহাদের পূর্বে কুরআন মজীদের প্রথম দিকে স্থাপন করা হইয়াছে? তিনি বলিলেন— ‘কুরআন মজীদকে যাঁহারা সংকলিত করিয়াছেন, তাঁহাদের জ্ঞান মতে উহার সূরাসমূহ বিন্যস্ত হইয়াছে। উক্ত সূরাদ্বয়ের অবস্থানও তাঁহাদের জ্ঞান মতে নির্ধারিত হইয়াছে। তাঁহারা তাঁহাদের জ্ঞান অনুযায়ী একমত হইয়াই উহা করিয়াছেন। অতএব এই বিন্যাস প্রক্রিয়ার মূলে তাঁহাদের (সাহাবীগণের) ঐকমত্যই সক্রিয় ছিল। আর তাঁহাদের ইজমা বা সর্ববাদীসম্মত রায়ের বিরুদ্ধে কোনরূপ প্রশ্ন তোলা যায় না।’ ইবন ওহাব আবার বলেন- আমি ইমাম মালিককে বলিতে শুনিয়াছি যে, ‘সাহাবীগণ নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট হইতে কুরআন মজীদকে যেইরূপে শুনিয়াছেন, সেইরূপেই উহা বিন্যস্ত হইয়াছে।’ আবুল হাসান ইব্ন বাত্তাল বলেন- “আমরা কুরআন মজীদের সূরাসমূহকে শুধু লিখিত অবস্থায় বিশেষ একটি রূপে বিন্যস্ত আকারে পাই। কিন্তু, উক্ত বিশেষরূপে বিন্যস্ত আকারেই উহা নামাযে কিংবা নামাযের বাহিরে তিলাওয়াতে বা শিক্ষাদানে পড়িতে হইবে এবং উক্ত বিন্যাসে কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটানো যাইবে না, কেহ এইরূপ কথা বলিয়াছে বলিয়া আমাদের জানা নাই। কাহাকেও বলিতে শোনা যায় নাই যে, বাকারার পূর্বে কাহাফ অথবা কাহাফের পূর্বে ‘হজ্জ’ শিক্ষা করা অবৈধ বা নিষিদ্ধ । হযরত আয়েশা (রাঃ) বলিয়াছেন- ‘তুমি যে কোন সূরাকেই পূর্বে পড়িতে পারো। উহাতে কোন ক্ষতি নাই।’ নবী করীম (সাঃ) নামাযে প্রথম রাকআতে কোন একটি সূরা তিলাওয়াত করিয়া দ্বিতীয় রাকআতে উহার অব্যবহিত পরবর্তী সূরার পরিবর্তে অন্য কোন সূরা তিলাওয়াত করিতেন। আবুল হাসান বাত্তাল অতঃপর বলেন- ‘হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) এবং হযরত ইব্ন উমর (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, কুরআন মজীদ উল্টাভাবে পড়া ঘোরতর অপরাধ। যে ব্যক্তি উহা তদ্রূপ পড়ে, তাহার অন্তঃকরণই উল্টা। উহার তাৎপর্য এই যে, কোন সূরার শেষদিক হইতে তিলাওয়াত আরম্ভ করিয়া উহার প্রথমদিকে তিলাওয়াত শেষ করা জঘন্য গুনাহ ও অপরাধ । ইহা হারাম ও কবীরা গুনাহ।
হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুর রহমান, ইব্ন ইয়াযীদ, ইসহাক, শু’বা, আদম ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ
বনী ইসরাঈল, কাহাফ, মরিয়াম, ত্বা-হা ও আম্বিয়া এই সকল সূরা সম্বন্ধে হযরত ইব্ মাসউদ (রাঃ) বলেন- ‘এইগুলি (নবুওতের) প্রথমদিকে অবতীর্ণ সূরা; ইহা আমার পুরাতন সম্পদ।’ উক্ত হাদীস শুধু ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম (রঃ) উহা বর্ণনা করেন নাই । হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর ব্যক্তিগত কুরআন মজীদে উপরোক্ত সূরাসমূহের বিন্যাস যে হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক সংকলিত কুরআন মজীদের সেই সকল সূরার বিন্যাসের সহিত সামঞ্জস্যশীল ছিল তাহা প্রমাণ করিবার উদ্দেশ্যেই ইমাম বুখারী (রঃ) উপরোক্ত হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন ।
হযরত বারা ইব্ন আযিব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইসহাক, শু’বা, আবুল ওয়ালীদ ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত বারা ইবন আযিব (রাঃ) বলেন- ‘নবী করীম (সাঃ)-এর মদীনা শরীফে আগমন করিবার পূর্বেই আমি সূরা আ’লা (سبح اسم ربك الأعلى) শিখিয়া ফেলিয়াছিলাম ।’ ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ই উক্ত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
শাকীক হইতে ধারাবাহিকভাবে আ’মাশ, আবূ হামযা, আবদান ও ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ শাকীক বলেন- একদা হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রাঃ) বলিলেন, নবী করীম (সাঃ) অর্থগত দিক দিয়া ঘনিষ্টরূপে পরস্পর সম্পৃক্ত যে সকল সূরার (المفصل) দুইটি করিয়া প্রতি রাকআতে তিলাওয়াত করিতেন, সেইগুলি আমি নিশ্চয় চিনি। এই বলিয়া তিনি উঠিয়া গেলেন। তাঁহার সহিত হযরত আলকামা অন্দর মহলে প্রবেশ করিলেন। কিছুক্ষণ পর হযরত আলকামা বাহিরে আসিলে আমি তাঁহাকে উক্ত সূরাসমূহ সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলাম । তিনি বলিলেন- ‘উহা হইতেছে ক্ষুদ্রাবয়ব বিশিষ্ট সূরাসমূহের (المفصل) মধ্য হইতে প্রথম বিশটি সূরা । তবে এই বিশটি সূরা হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) কর্তৃক বিন্যস্ত তাঁহার ব্যক্তিগত কুরআন মজীদের সূরাসমূহের মধ্য হইতে ক্ষুদ্র আয়াত বিশিষ্ট সূরা সমষ্টির প্রথম বিশটি সূরা । উক্ত বিশটি সূরার শেষভাগে হইতেছে সূরা দুখান ও সূরা নাবা ৷’
হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) কর্তৃক গৃহীত কুরআন মজীদের যে ক্রমবিন্যাসের কথা ইতিপূর্বে একাধিকবার আলোচিত হইয়াছে, উহা একদিকে যেমন হযরত উসমান কর্তৃক গৃহীত বিন্যাসক্রমের বিরোধী, অন্যদিকে তেমনি সাধারণভাবে সাহাবীগণ কর্তৃক অসমর্থিত ও প্রত্যাখ্যাত। হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক সংকলিত কুরআন মজীদে ক্ষুদ্রাবয়ব বিশিষ্ট সূরা শ্রেণী (المفصل) হইতেছে— সূরা হুজুরাত হইতে কুরআন মজীদের শেষ অংশের সূরা সকল । সূরা দুখান কোনক্রমেই উহাদের অন্তর্ভুক্ত নহে। (অথচ, হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ)-এর বিন্যাসক্রম অনুসারে উক্ত সূরা মুফাস্সাল শ্রেণীভুক্ত)। ইমাম আহমদ (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা উহা প্রমাণিত হয়ঃ
হযরত আওস ইব্ন হুযায়ফা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে উসমান ইব্ন আবদুল্লাহ্, ইব্ন আওস ছাকাফী, আবদুল্লাহ্ ইব্ন আবদুর রহমান তায়েফী, আবদুর রহমান ইব্ন মাহদী ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত আওস ইব্ন হুযায়ফা (রাঃ) বলেন- ‘আমি একদা নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট আগত প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলাম।’ অতঃপর হযরত আওস (রাঃ) একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। উহার একাংশ হইতেছে এইঃ ‘প্রতিদিন ইশার • নামায আদায় করিবার পর নবী করীম (সাঃ) আমাদের প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সহিত আলাপ-আলোচনা করিতেন। একদা তিনি ইশার নামাযের পর দীর্ঘক্ষণ বিলম্ব করিয়া আমাদের নিকট আসিলেন। আমরা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম- হে আল্লাহ্র রাসূল ! আমাদের নিকট আসিতে আজ আপনার বিলম্ব হইল কেন? তিনি বলিলেন- ‘আজ কুরআন মজীদের একটি অংশ আমার সম্মুখে আসিয়াছিল । আমি ভাবিলাম, উহা তিলাওয়াত না করিয়া বাহিরে আসিব না।’ সকাল বেলায় আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সাহাবীগণের নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম- তোমরা কুরআন মজীদ কোন্ নিয়মে অংশ অংশ করিয়া তিলাওয়াত কর? তাহারা বলিল- ‘আমরা কুরআন মজীদের তিন সূরা, পাঁচ সূরা, সাত সূরা, নয় সূরা, এগার সূরা এবং তের সূরাকে একটি অংশ বানাইয়া (নামাযে) তিলাওয়াত করি। আর মুফাসসাল (المفصل) অংশটি হইতেছে- সূরা কাফ হইতে কুরআন মজীদের শেষ পর্যন্ত।’ ইমাম আবূ দাউদ এবং ইমাম ইব্ন মাজাও উক্ত হাদীস উপরোক্ত রাবী আবদুল্লাহ্ ইব্ন আবদুর রহমান ইব্ন ইয়ালা তায়েফী হইতে উপরোক্ত ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং অন্যরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। উক্ত হাদীসের সনদ গ্রহণযোগ্য।