এইস্থলেও ইমাম বুখারী হযরত সাহল (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত উল্লেখিত হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন। উহাতে বর্ণিত হইয়াছেঃ নবী করীম (সাঃ) সাহাবীকে বলিলেন- তোমার নিকট কুরআন মজীদের কতটুকু অংশ রক্ষিত আছে? সাহাবী বলিলেন- আমার নিকট অমুক অমুক সূরা রক্ষিত রহিয়াছে। এই বলিয়া তিনি কয়েকটি সূরার নাম উল্লেখ করিলেন। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- তুমি কি সেইগুলিকে মুখস্থ তিলাওয়াত করিতে পারো? সাহাবী বলিলেন- হ্যাঁ; আমি সেইগুলি মুখস্থ তিলাওয়াত করিতে পারি। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- যাও, তোমার নিকট কুরআন মজীদের যে অংশটুকু রক্ষিত রহিয়াছে, তাহার পরিবর্তে তোমাকে তাহার (মহিলাটির) মালিক বানাইয়া দিলাম (অর্থাৎ তাহাকে তোমার সহিত বিবাহ দিলাম)।
ইমাম বুখারী (রঃ) ‘ফাযায়িলুল কুরআন’ অধ্যায়ে ‘কুরআন মজীদের মুখস্থ তিলাওয়াত’ এই শিরোনামায় একটি পরিচ্ছেদ রচনা করিয়াছেন। তিনি উহা দ্বারা এই ইঙ্গিত প্রদান করিতে চাহিয়াছেন যে, কুরআন মজীদ দেখিয়া তিলাওয়াত করা অপেক্ষা উহা মুখস্থ তিলাওয়াত করা শ্রেয়তর। তবে বিপুলসংখ্যক ফকীহ বলেন- কুরআন মজীদ মুখস্থ তিলাওয়াত করা অপেক্ষা উহা দেখিয়া তিলাওয়াত করা শ্রেয়তর। কারন, উহা দ্বারা একদিকে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবার সওয়াব এবং অন্যদিকে কুরআন মজীদ দেখিবার সওয়াব পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, কুরআন মজীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করাও সওয়াবের কাজ। পূর্বসুরী একাধিক বিজ্ঞ ব্যক্তি উহা বলিয়াছেন। তাহারা কোন ব্যক্তির সারাদিনেও কুরআন মজীদ না দেখাকে মাকরূহ ও অপছন্দনীয় কাজ বলিয়া অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন। কুরআন মজীদ মুখস্থ তিলাওয়াত করা অপেক্ষা উহা দেখিয়া তিলাওয়াত করা যে শ্রেয়তর, উক্ত অভিমতের পোষকগণ নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা তাহা প্রমাণ করেনঃ
জনৈক সাহাবী হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ্ ইব্ন আবদুর রহমান, সালীম ইব্ন মুসলিম, মুআবিয়া ইব্ন ইয়াহিয়া, বাকিয়াহ ইব্ন ওয়ালীদ, নাঈম ইব্ন হাম্মাদ ও ইমাম আবূ উবায়দ স্বীয় ‘ফাযায়েলুল কুরআন’ গ্রন্থে বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন— ‘ফরয নামায যেরূপ নফল নামায অপেক্ষা শ্রেয়, কুরআন মজীদ দেখিয়া তিলাওয়াত করা উহা মুখস্থ তিলাওয়াত করা অপেক্ষা সেইরূপ শ্রেয়।’ উক্ত হাদীসের সনদ দুর্বল। কারণ, উহার অন্যতম রাবী মুআবিয়া ইব্ন ইয়াহিয়া মুআবিয়া, সদফীই হউক আর মুআবিয়াহ আতরাবলিসীই হউক, একজন দুর্বল রাবী।
‘যর’ হইতে ধারাবাহিকভাবে আসিম ও হযরত সুফিয়ান ছওরী বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) বলিয়াছেন- ‘তোমরা সর্বদা কুরআন মজীদ দেখিয়া তিলাওয়াত করিও।’ হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ইউসুফ ইব্ন মাহিক, আলী ইব্ন যায়দ ও হাম্মাদ ইব্ন সালমা বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত উমর (রাঃ) বাহির হইতে আসিয়া গৃহে প্রবেশ করিবার পর কুরআন মজীদ খুলিয়া লইয়া তিলাওয়াত করিতেন।
আবদুর রহমান ইব্ন আবূ লায়লা হইতে ধারাবাহিকভাবে ছাবিত ও হাম্মাদ ইব্ন সালমা আরও বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর নিকট তাঁহার সহচরগণ একত্রিত হইলে তিনি কুরআন মজীদ খুলিয়া তাহাদিগকে উহার তিলাওয়াত অথবা তাফসীর শুনাইতেন। উক্ত রিওয়ায়েতের সনদ সহীহ।
হযরত ইব্ন উমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ছাওয়ের ইব্ন আবূ ফাখতা, হাজ্জাজ ইব্ন আরতাত ও হাম্মাদ ইব্ন সালমা বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত ইব্ন উমর (রাঃ) বলেন- তোমাদের কেহ যখন বাজার হইতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে, তখন সে যেন (সর্বপ্রথম) কুরআন মজীদ খুলিয়া উহা তিলাওয়াত করে।
খায়ছাম হইতে আ’মাশ বর্ণনা করিয়াছেনঃ খায়ছাম বলেন- একদা আমি হযরত ইব্ন উমর (রাঃ)-এর নিকট গমন করিলাম। তিনি তখন কুরআন মজীদ খুলিয়া উহা তিলাওয়াত করিতেছিলেন। তিনি বলিলেন- এই হইতেছে আমার আজিকার রাত্রিতে তিলাওয়াত করিবার অংশ।
সাহাবায়ে কিরামের উপরোক্ত কার্যাবলী ও বাক্যাবলী দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআন মজীদ দেখিয়া তিলাওয়াত করা শ্রেয়তর।(১) উহার একটি ফায়দা এই যে, এইরূপ তিলাওয়াত করিলে লিখিত কুরআন মজীদ বেকার, পরিত্যক্ত ও বিনষ্ট হইয়া যাইবে না। উহার আরও উপকার এই যে, কুরআন মজীদের হাফিজ উহা মুখস্থ তিলাওয়াত করিতে গিয়া উহার কোন শব্দ বা আয়াত ভ্রান্তরূপে তিলাওয়াত করিতে পারে অথবা এক আয়াতের স্থলে অন্য আয়াত তিলাওয়াত করিতে পারে। এমতাবস্থায় উহা দেখিয়া তিলাওয়াত করা মুখস্থ তিলাওয়াত করা অপেক্ষা অধিকতর নিরাপদ ও ভ্রান্তির আশংকা হইতে অধিকতর মুক্ত।
কুরআন মজীদের তিলাওয়াত তা’লীম দিবারকালে অবশ্য মুআল্লিমের মৌখিক তিলাওয়াতের সাহায্য লওয়া মুতাআল্লিম বা শিক্ষানবীসের কর্তব্য। কারণ, মুআল্লিমের মুখ হইতে নিঃসৃত উচ্চারণের সাহায্য গ্রহণ ছাড়া শুধু লিখিত কুরআন মজীদ দেখিয়া উহার তিলাওয়াত শিখিতে গিয়া শিক্ষানবীস অনেক ক্ষেত্রেই ভুল উচ্চারণ শিখিয়া ফেলে। কারণ, লিখিত কুরআন মজীদে শুধু বর্ণ ও শব্দ লিখিত থাকে; উহার উচ্চারণ লিখিত থাকে না; থাকা সম্ভবপরও নহে। উহার উচ্চারণ উস্তাদের মুখ হইতেই শিখিতে হয়। অবশ্য উস্তাদ পাওয়া না গেলে অক্ষমতা বা ওজরের কারণে (ভাষা জ্ঞান ও উহার উচ্চারণ জ্ঞানের সাহায্যে) উহার তিলাওয়াত্ শিক্ষানবীসের নিজেকেই শিখিয়া লইতে হয়। এইরূপ অবস্থায় কোনরূপ ভুল হইয়া গেলে আল্লাহ্ তা’অিলার নিকট উহা ক্ষমার যোগ্য হইবে। কুরআন মজীদ দেখিয়া তিলাওয়াত করিলেও ভুল হইতে পারে। অনিচ্ছাকৃত ভুল আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে ক্ষমাই ।
ইমাম আওযাঈ হইতে ধারাবাহিকভাবে মুহাম্মদ ইব্ন শুআয়ব, হিশাম ইবন ইসমাঈল দামেশকী ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ ইমাম আওযাঈ বলেন- একদা সফরে একটি লোক আমাদের সঙ্গী হইয়াছিল । লোকটি একটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছিল। আমার মনে
পড়ে, সে উহা নবী করীম (সাঃ)-এর হাদীস হিসাবেই বর্ণনা করিয়াছিল। লোকটি যাহা বৰ্ণনা করিয়াছিল, তাহা এইঃ ‘আল্লাহর কোন বান্দা কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবারকালে কোন ভুল করিলে উহা যেরূপে নাযিল হইয়াছে, ফেরেশতা তাহার তিলাওয়াতকে সেইরূপেই (তাহার আমলনামায়) লিপিবদ্ধ করেন।
বুকায়ের ইব্ন আখনাস হইতে ধারাবাহিকভাবে শায়বানী, হাফস ইব্ন আবূ গিয়াস ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ কথিত আছে, কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবারকালে কোন অনারব লোক বা অন্য কেহ অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল করিলে উহা যেরূপে নাযিল হইয়াছে, ফেরেশতা তাহার তিলাওয়াতকে সেইরূপেই (তাহার আমলনামায়) লিপিবদ্ধ করেন।
কুরআন মজীদ দেখিয়া তিলাওয়াত করা কিংবা মুখস্থ তিলাওয়াত করার কোটি শ্রেয়তর, সে সম্বন্ধে একদল বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেনঃ শ্রেয়তর হইবার ভিত্তি হইতেছে আল্লাহর ভয়, ভালবাসা ও আন্তরিক বিনয়। কুরআন মজীদ দেখিয়া তিলাওয়াত করা এবং মুখস্থ তিলাওয়াত করা- ইহাদের মধ্যে যে তিলাওয়াতে আল্লাহ্ ভয় ও ভালবাসা এবং আন্তরিক বিনয় অধিকতর পরিমাণে অর্জিত হইবে, সেই তিলাওয়াতই শ্রেয়তর হইবে। উভয়বিধ তিলাওয়াতে সমপরিমাণের আল্লাহ্ ভীতি, আল্লাহ্ প্রেম ও আন্তরিক বিনয় অর্জিত হইলে কুরআন মজীদ দেখিয়া তিলাওয়াত করাই শ্রেয়তর হইবে। কারণ, উহাতে ভুলের আশাংকা কম থাকে ৷ উল্লেখযোগ্য যে, কুরআন মজীদের উভয়বিধ তিলাওয়াত সকল তিলাওয়াতকারীর উপরই সমান প্রভাব বিস্তার করে না। ব্যক্তির বিভিন্নতায় উহাদের প্রভাব বিস্তারেও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। শায়খ আবূ যাকারিয়া নববী ‘তিয়ান’ গ্রন্থে মন্তব্য করিয়াছেন— ‘পূর্বসূরী আহলে ইলমের এতদসম্পর্কীয় কথা ও কার্য এবং তাহাদের মতভেদ উপরোক্ত ব্যাখ্যার উপর নির্ভরশীল। উপরোক্ত ব্যাখ্যার আলোকেই এ সম্পর্কে তাহাদের পারস্পরিক মতভেদের স্বরূপ ও রহস্য উদঘাটন করিতে হইবে।
বর্তমান পরিচ্ছেদের প্রথম দিকে আমরা দেখিয়াছি যে, ইমাম বুখারী হযরত সাহল ইব্ন সা’দ হইতে একটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। উহা দ্বারা তিনি যদি প্রমাণ করিতে চাহিয়া থাকেন যে, কুরআন মজীদ মুখস্থ তিলাওয়াত করা উহা দেখিয়া তিলাওয়াত করা অপেক্ষা শ্রেয়তর, তবে তিনি ভুল করিয়াছেন। কারণ, হযরত সাহল ইব্ন সা’দ কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের ঘটনাটি নির্দিষ্ট এক ব্যক্তির ঘটনা। এইরূপ হওয়া বিচিত্র নহে যে, সংশ্লিষ্ট সাহাবী লেখাপড়া জানিতেন না এবং নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট উহা বিদিত ছিল। তাই উক্ত সাহাবী কুরআন মজীদ মুখস্থ তিলাওয়াত করিতে পারেন কিনা নবী করীম (সাঃ) তাহা তাহার নিকট জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। অতএব, উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, কুরআন মজীদ দেখিয়া তিলাওয়াত করিতে সমর্থ ও অসমর্থ- উভয় শ্রেণীর লোকের জন্যেই উহা মুখস্থ তিলাওয়াত করা শ্রেয়তর। এইরূপ ঘটনা দ্বারা উহা প্রমাণিত হইলে স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবার ঘটনা বর্ণনা করাই ইমাম বুখারীর জন্যে অধিকর সমীচীন ছিল।
কারণ, নবী করীম (সাঃ) নিজে একজন উম্মী বা নিরক্ষর মানব ছিলেন। তাই তিনি কুরআন মজীদ মুখস্থ তিলাওয়াত করিতেন। বস্তুত আলোচ্য হাদীস দ্বারা শুধু ইহাই প্রমাণিত হয় যে, সংশ্লিষ্ট সাহাবী স্বীয় স্ত্রীকে কুরআন মজীদের তিলাওয়াত শিক্ষা দিতে পারিবেন কিনা, তাহা জানিবার জন্যেই নবী করীম (সাঃ) তাহার নিকট জানিতে চাহিয়াছিলেন যে, তিনি কুরআন মজীদ মুখস্থ তিলাওয়াত করিতে পারেন কিনা। ইহাতে মুখস্থ তিলাওয়াতের শ্রেষ্ঠত্ব বা অশ্রেষ্ঠত্ব- কোনটিই প্রমাণিত হয় না। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানের অধিকারী।