হযরত আবূ মূসা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত আনাস ইব্ন মালিক (রাঃ), হুমাম, হাদিয়াহ ইব্ন খালিদ, আবূ খালিদ ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ ‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- যে নেককার ব্যক্তি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে, তাহার অবস্থা লেবুর অবস্থার সমতুল্য । উহার স্বাদ ও ঘ্রাণ উভয়ই ভাল । যে নেককার ব্যক্তি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে না, তাহার অবস্থা খেজুরের অবস্থার সমতুল্য। উহার স্বাদ ভাল; কিন্তু উহাতে কোন সুঘ্রাণ নাই। যে বদকার ব্যক্তি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে, তাহার অবস্থা পুষ্প স্তবকের অবস্থার সমতুল্য। উহার ঘ্রাণ আনন্দদায়ক, কিন্তু উহার স্বাদ তিক্ত। আর যে বদকার ব্যক্তি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে না, তাহার অবস্থা হানযাল (মাকাল) ফলের অবস্থার সমতুল্য। উহার স্বাদও তিক্ত এবং উহাতে কোন সুঘ্রাণও নাই।’ ইমাম বুখারী (রঃ) উপরোক্ত হাদীস সিহাহ সিত্তার অন্যান্য সংকলকের সঙ্গে কাতাদাহর মাধ্যমে একাধিক স্থানে বর্ণনা করিয়াছেন। আলোচ্য পরিচ্ছেদের সহিত উপরোক্ত হাদীসের সম্পর্ক এই যে, উক্ত হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে যে, কোন ব্যক্তির আত্মার মধ্যে সুঘ্রাণ থাকা বা না থাকা কুরআন মজীদের তিলাওয়াতের উপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে, তাহার আত্মা সুঘ্রাণযুক্ত । পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে না তাহার আত্মা সুঘ্রাণ হইতে বঞ্চিত। উহা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআন মজীদ হইতেছে নেককার বা বদকার যে কোনরূপ মানুষের কথা হইতে শ্রেষ্ঠতম ।
হযরত ইবন উমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ্ ইব্ন দীনার, সুফিয়ান, ইয়াহিয়া, মুসাদ্দাদ ও ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলেন- ‘পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের লোকদের হায়াতের তুলনায় তোমাদের হায়াত হইতেছে আসরের ওয়াক্ত হইতে মাগরিবের ওয়াক্তের মধ্যবর্তী সময়ের সমতুল্য। আর তোমাদের, ইয়াহুদীদের এবং নাসারাদের অবস্থা হইতেছে এইরূপ যে, একটি লোক কতকগুলি শ্রমিককে কর্মে নিযুক্ত করিল । লোকটি বলিল- মাত্র এক কীরাত (দিরহামের দ্বাদশাংশ)-এর বিনিময়ে বেলা দ্বিপ্রহর পর্যন্ত সময় আমার কাজ করিয়া দিতে কে রাজী আছ? তাহার কথায় ইয়াহুদীগণ কাজ করিল । অতঃপর লোকটি বলিল- মাত্র এক কীরাতের বিনিময়ে বেলা দ্বিপ্রহর হইতে আসর পর্যন্ত সময়ে কে আমার কাজ করিয়া দিতে রাজী আছ? তাহার কথায় নাসারাগণ কাজ করিল। এক্ষণে তোমরা দুই কীরাতের বিনিময়ে আসর হইতে মাগরিব পর্যন্ত সময়ে কাজ করিতেছ। ইহাতে ইয়াহুদী ও নাসারারা বলিল- আমরা বেশী পরিশ্রম করিয়া কম পারিশ্রমিক পাইয়াছি । নিয়োগকর্তা বলিল- আমি কি তোমাদিগকে তোমাদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক হইতে সামান্যও কম দিয়াছি? তাহারা বলিল- ‘না।’ নিয়োগকর্তা বলিল- ‘উহাদিগকে প্রদত্ত অতিরিক্ত পারিশ্রমিক হইতেছে আমার দান। উহা যাহাকে ইচ্ছা করি, দান করি।’ উপরোক্ত সনদে উহা শুধু ইমাম বুখারীই বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম উহা উপরোক্ত সনদে বর্ণনা করেন নাই। বক্ষ্যমান পরিচ্ছেদের শিরোনামের সহিত উপরোক্ত হাদীসের সম্বন্ধ এই যে, উহাতে বর্ণিত হইয়াছে, যদিও পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের লোকদের আয়ু অপেক্ষা উম্মতে মুহাম্মদীর লোকদের আয়ু স্বল্পতর, তথাপি এই উম্মতকে পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হইয়াছে ।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
كنتم خير أمّة أخرجت للدّاس আর তোমরা হইতেছ মানবজাতির কল্যাণের জন্য মনোনীত সর্বোত্তম উম্মত।
বাহায ইবন হাকীমের পিতামহ হইতে ধারাবাহিকভাবে হাকীম এবং বাহায ইবন হাকীম কর্তৃক ‘মুসনাদ’ ও ‘সুনান’ সংকলনে বর্ণিত হইয়াছে যে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘তোমরা সত্তরটি উম্মতের মধ্যে সর্বশেষ উম্মত । আল্লাহর নিকট তোমরা সর্বোত্তম উম্মত।’ কোন্ কারণে উম্মাতে মুহাম্মদী (সাঃ) উক্ত ফযীলত ও মর্যাদার অধিকারী হইয়াছে? তাহারা কুরআন মজীদের বরকতের উসীলায় উক্ত ফযীলত ও মর্যাদার অধিকারী হইতে পারিয়াছে। কুরআন মজীদ হইতেছে যাবতীয় আসমানী কিতাবের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম কিতাব। উহা অন্যান্য আসমানী কিতাবের মুহাফিজ ও অন্যান্য সকল আসমানী কিতাবের রহিতকারক। কুরআন মজীদের এই ফযীলতের কারণ কি? কুরআন মজীদের এই ফযীলতের কারণ এই যে, পূর্ববর্তী সকল কিতাবই একবারে নাযিল হইয়াছিল। পক্ষান্তরে, কুরআন মজীদ একবারে নাযিল হয় নাই; বরং উহা নাযিল হইয়াছে প্রয়োজন অনুসারে অংশ অংশ করিয়া। কারণ, কুরআন মজীদ এবং উহার ধারকগণ উভয়ই অত্যন্ত মর্যাদাশালী। অতএব, উহার একটি অংশের অবতারণ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের পূর্ণ কিতাবের অবতারণের সমতুল্য।(১)
পূর্ববর্তী প্রধান দুইটি উম্মত হইতেছে ইয়াহুদী ও নাসারা। ইয়াহুদী জাতিকে আল্লাহ্ তা’আলা হযরত মূসা (আঃ)-এর নবূওতের কাল হইতে হযরত ঈসা (আঃ)-এর নবৃওতের কাল পর্যন্ত সময়ে কার্যে নিয়োজিত করেন। নাসারা জাতিকে তিনি হযরত ঈসা (আঃ)-এর নবূওতের কাল হইতে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর নবৃওতের কাল পর্যন্ত সময়ে কার্যে নিয়োজিত করেন। অতঃপর মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর উম্মতকে তাঁহার নবূওতের কাল হইতে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ে কার্যে নিয়োজিত করিয়াছেন। তাহাদের কার্যকালকে দিনের শেষ অংশের সহিত তুলনা করা হইয়াছে। আল্লাহ্ তা’আলা পূর্ববর্তী উম্মতকে যে পারিশ্রমিক প্রদান করিয়াছেন, এই উম্মতকে উহার দ্বিগুণ পারিশ্রমিক প্রদান করিয়াছেন। ইহাতে পূর্ববর্তী উম্মতগণ বলিয়াছে- হে আমাদের প্রভু ! আমরা বেশী কাজ করিয়া কম পারিশ্রমিক পাইলাম কেন? আল্লাহ্ তা’আলা বলিলেন- আমি কি তোমাদিগকে তোমাদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক হইতে কোন অংশ কম প্ৰদান করিয়াছি? তাহারা বলিল- না। আল্লাহ্ তা’আলা বলিলেন- অতিরিক্ত পারিশ্রমিকটুকু হইতেছে আমার কৃপার দান। আমি যাহাকে ইচ্ছা করি, তাহাকে উহা দান করিতে পারি। এই প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত আয়াত প্ৰণিধানযোগ্যঃ
ياَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَآمِنُوا بِرَسُولِهِ يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِنْ رَّحْمَتِهِ وَيَجْعَلْ لَكُمْ نُورًا تَمْشُونَ بِهِ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ، وَاللهُ غَفُورٌ رَّحِيمُ – لَثَلَا يَعْلَمَ أَهْلُ الكتاب الأ يُقْدِرُونَ عَلى شَيْئ مِّنْ فَضْلِ اللهِ وَأَنَّ الْفَضْلَ بيدِ اللهِ يُؤْتِيهِ مَنْ تِشاء- وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيم.
‘হে মু’মিনগণ ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁহার রাসূলের প্রতি ঈমানে অটল থাক । তোমরা এইরূপ করিলে তিনি তোমাদিগকে স্বীয় রহমত হইতে দ্বিগুণ রহমত প্রদান করিবেন এবং তোমাদের জন্য নূর সৃষ্টি করিবেন। তোমরা উহার সাহায্যে চলিতে পারিবে। আর তিনি তোমাদিগকে ক্ষমা করিয়া দিবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, কৃপাময়। ফলত আহলে কিতাব জাতি জানিতে পারিবে যে, আল্লাহ্র কোন দানে তাহাদের কোন হাত নাই। তিনি যাহাকে ইচ্ছা করেন, তাহাকেই উহা দান করিতে পারেন । আর আল্লাহ্ মহাদানের অধিকারী।