হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে সালিম ইব্‌ন আবদুল্লাহ্, যুহরী, শুআয়ব, আবুল ইয়ামান ও ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ

নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন— ‘দুই ব্যক্তির প্রতি ছাড়া কাহারও প্রতি ঈর্ষা করা যায় নাঃ (১) যাহাকে আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় কিতাব দান করিয়াছেন এবং সে উহা রাত্র-দিন নামাযে তিলাওয়াত করে এবং (২) যাহাকে আল্লাহ্ তা’আলা ধন-সম্পত্তি দান করিয়াছেন এবং সে উহা দিবা-রাত্র সাদকা করে।’

উপরোক্ত সনদে উহা শুধু ইমাম বুখারীই বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম উহা উপরোক্ত সনদে বর্ণনা করেন নাই। তবে যুহরী হইতে সুফিয়ানের মাধ্যমে উহা ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ই বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে যাকওয়ান,সুলায়মান, শু’বা, রওহ, আলী ইব্‌ন ইবরাহীম ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ

নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন— ‘দুই ব্যক্তির প্রতি ছাড়া কাহারও প্রতি ঈর্ষা করা যায় না৷ (১) আল্লাহ্ তা’আলা যাহাকে কুরআন মজীদের জ্ঞান দান করিয়াছেন এবং সে উহা রাত্র-দিন নামাযে তিলাওয়াত করে আর তাহার কোন প্রতিবেশী উহা শুনিতে পাইয়া বলে, আহা ! অমুক লোকটিকে যে জ্ঞান দান করা হইয়াছে, আমাকে যদি উহার সমতুল্য জ্ঞান দান করা হইত, তবে আমিও তাহার ন্যায় আমল করিতে পারিতাম; তবে তাহার এই ঈর্ষা অসঙ্গত হইবে না। (২) আল্লাহ্ তা’আলা যাহাকে ধন-সম্পত্তি দান করিয়াছেন এবং সে উহা হক ও ন্যায় পথে ব্যয় করায় যদি কোন ব্যক্তি বলে, আহা ! অমুক লোকটিকে যে ধন-সম্পত্তি দান করা হইয়াছে, আমাকেও যদি উহার সমতুল্য ধন-সম্পত্তি দান করা হইত, তবে আমি তাহার ন্যায় আমল করিতাম; তবে তাহার এই ঈর্ষা অসঙ্গত হইবে না।’

উপরোক্ত দুইটি হাদীসের তাৎপর্য এই যে, কুরআন মজীদের জ্ঞান সম্পদে সম্পদশালী হওয়া ও উহা দিবা-রাত্র নামাযে তিলাওয়াত করা হইতেছে এক মহাসৌভাগ্য তথা আধ্যাত্মিক প্রশান্তি। অনুরূপভাবে ধন-সম্পত্তির মালিক হওয়া এবং উহা আল্লাহ্র পথে খরচ করাও এক বিরাট আধ্যাত্মিক সৌভাগ্য তথা পরিতৃপ্তি বটে। প্রথম সম্পদটি দ্বারা উহার মালিক নিজে উপকৃত হয় এবং দ্বিতীয় সম্পদটি দ্বারা সে অপরকেও উপকৃত করে। যাহা হউক, উপরোক্ত দুইটি সৌভাগ্য এতই মহান ও গুরুত্বপূর্ণ যে, কাহারও মধ্যে উহার কোনটি দেখিতে পাইয়া নিজের জন্য তাহা কামনা করা অন্যের পক্ষে অন্যায় বা অসঙ্গত তো নয়ই; বরং এইরূপ সৌভাগ্য কামনা করা কাম্যই বটে। নিম্নোক্ত আয়াতে উপরোক্ত সৌভাগ্য দুইটির গুরুত্ব বর্ণিত হইয়াছেঃ

إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ وَأَقَامُوا الصَّلوةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًا وَعَلَانِيَةً يَرْجُونَ تِجَارَةً لَنْ تَبُورَ

“যাহারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, সালাত কায়েম করে, আর আমি তাহাদিগকে যে সম্পদ দান করিয়াছি, তাহা হইতে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে সৎ পথে ব্যয় করে, তাহারা অবিনশ্বর তিজারতের আশা করিতে পারে।”

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আলোচ্য হাদীসদ্বয়ে যে ঈর্ষাকে বৈধ ও সঙ্গত বলা হইয়াছে, উহার অর্থ অপরের সম্পদের বিলুপ্তি ও ধ্বংস কামনা নহে; বরং উহার অর্থ হইতেছে নিজের জন্যে অপরের সম্পদের তুল্য সম্পদ কামনা করা। অপরের কোন প্রশংসনীয় গুণ বা সৌভাগ্যের প্রতি এইরূপ ঈর্ষা বা কামনা নিন্দনীয় নহে। তবে উপরোক্ত দুইটি গুণ ও সৌভাগ্য যেহেতু অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ, তাই হাদীসে বিশেষত উহার প্রতি ঈর্ষা করিবার অনুমতি ও বৈধতা বর্ণিত হইয়াছে।

উপরোক্ত হাদীস অন্যরূপ সনদেও বর্ণিত হইয়াছে। ইমাম আহমদের পুত্র আবদুল্লাহ্ বলেন- আমি আমার পিতার কিতাবে তাঁহার নিজ হস্তে লিখিত এই কথাগুলি পাইয়াছিঃ ‘আমার নিকট আবূ তাওবা রবী’ ইব্‌ন নাফে’ লিখিয়াছেন- হযরত ইয়াযীদ ইব্‌ন আখনাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে কাছীর ইবন মুররা, সালীম ইব্‌ন মূসা, যায়দ ইব্‌ন ওয়াকিদ ও হায়ছাম ইব্‌ন হামীদ আমার নিকট বর্ণনা করিয়াছেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- দুইটি বিষয় ভিন্ন অন্য কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হইতে পারে না । এক. একটি লোককে আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন মজীদের জ্ঞান দান করিয়াছেন। সে উহা রাত্র-দিন নামাযে তিলাওয়াত করে এবং উহার উপর আমল করে। উহা দেখিয়া অন্য একটি লোক বলে, অমুক ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তা’আলা যে নিয়ামত দান করিয়াছেন, আহা ! আমাকে যদি তিনি উহার সমতুল্য নিআমাত দান করিতেন তাহা হইলে আমি তাহার ন্যায় রাত্র-দিন উহা নামাযে তিলাওয়াত করিতাম। দুই, একটি লোককে আল্লাহ্ তা’আলা সম্পদ দান করিয়াছেন। সে উহা আল্লাহ্র পথে খরচ এবং সাদকা করে। উহা দেখিয়া অন্য একটি লোক বলে, আহা ! আল্লাহ্ তা’আলা অমুক ব্যক্তিকে যে নিআমাত দান করিয়াছেন, আমাকেও যদি তিনি উহার সমতুল্য নিয়ামত দান করিতেন, তাহা হইলে আমি উহা সাদকা করিয়া দিতাম ।’

ইমাম আহমদও প্রায় অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলেনঃ হযরত আবূ কাবশা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে সাঈদ আবুল বুহতারী আততাঈ, ইউনুস ইব্‌ন হাব্বাব, ইবাদাহ ইব্‌ন মুসলিম ও আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন নুমায়র আমার নিকট বর্ণনা করিয়াছেন যে, একদা নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেনঃ আমি আল্লাহ্ শপথ করিয়া তিনটি বিষয় তোমাদিগকে জ্ঞাপন করিতেছি এবং অন্য একটি বিষয়ে তোমাদের নিকট প্রকাশ করিতেছি। তোমরা উহা স্মরণ রাখিও। প্রথম তিনটি হইতেছে এইঃ (১) কোন বান্দার মাল সাদকার কারণে কমিয়া যায় না, (২) কোন ব্যক্তি অত্যাচারিত হইয়া সবর করিলে আল্লাহ্ তা’আলা নিশ্চয় উহার পরিবর্তে তাহার সম্মান বাড়াইয়া দেন এবং (৩) কোন ব্যক্তি অপরের নিকট হাত পাতিবার পথ গ্রহণ করিলে আল্লাহ্ তা’আলা নিশ্চয় তাহার জন্যে অভাবের দরজা খুলিয়া দেন।

চতুর্থ বিষয়টি হইতেছে এই যে, দুনিয়াতে চারি শ্রেণীর লোক রহিয়াছেঃ প্রথম শ্রেণীর লোক হইতেছে সেই বান্দা যাহাকে আল্লাহ্ তা’আলা মাল ও ইলম দান করিয়াছেন এবং সে স্বীয় প্রভুর দানের ব্যাপারে তাঁহাকে ভয় করিয়া চলে। অধিকন্তু রক্ত সম্পর্ক রক্ষা করিয়া চলে এবং উক্ত দানে তাহার প্রভুর কি হক ও প্রাপ্য রহিয়াছে তাহা জানে। এই ব্যক্তি সর্বোত্তম স্থানে অবস্থান করে।

দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক হইতেছে সেই বান্দা যাহাকে আল্লাহ্ তা’আলা ইলম দান করিয়াছেন, কিন্তু মাল দান করেন নাই। তাই সে বলে, আহা ! আমি যদি মালের মালিক হইতাম, তবে অমুক ব্যক্তির ন্যায় কাজ করিতাম ! উক্ত দুই শ্রেণীর লোক সমান পুরস্কার লাভ করিবে ।

তৃতীয় শ্রেণীর লোক হইতেছে সেই বান্দা যাহাকে আল্লাহ্ তা’আলা মাল দান করিয়াছেন; কিন্তু ইলমের অভাবে মাল যত্রতত্র ব্যয় করে। উহার ব্যাপারে সে স্বীয় প্রভুকে ভয় করিয়া চলে না, উহা দ্বারা সম্পর্ক রক্ষা করিয়া চলে না এবং উহার মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার যে হক ও প্রাপ্য রহিয়াছে, তাহাও চিনে না। এই শ্রেণীর লোক নিকৃষ্টতম স্থানে অবস্থান করে।

চতুর্থ শ্রেণীর লোক হইতেছে সেই বান্দা যাহাকে আল্লাহ্ তা’আলা না মাল দান করিয়াছেন আর না ইলম দান করিয়াছেন। তাই সে বলে, আহা! আমি যদি মালের মালিক হইতাম, তবে অমুক ব্যক্তির ন্যায় কাজ করিতাম। উহা হইতেছে তাহার অন্তরের কামনা মাত্র। মালের ক্ষেত্রে ইহারা দুইজন সমান গুনাহ স্কন্ধে বহন করিবে।

হযরত আবূ কাবশা আনসারী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে সালিম ইব্‌ন আবুল জা’দ, আ’মাশ, ওয়াকী’ ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করিয়াছেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘এই উম্মাতের লোক চারি শ্রেণীতে বিভক্ত। প্রথম প্রকারের লোক হইতেছে সেই ব্যক্তি যাহাকে আল্লাহ্ তা’আলা মাল ও ইলম উভয়ই দান করিয়াছেন। আর সে ব্যক্তি স্বীয় ইলমের সাহায্যে মালের ব্যাপারে করণীয় কাজ সম্পাদন করিয়া থাকে অর্থাৎ আল্লাহ্ প্রাপ্য আদায়ের ক্ষেত্রে খরচ করে। দ্বিতীয় প্রকারের লোক হইতেছে সেই ব্যক্তি যাহাকে আল্লাহ্ তা’আলা ইলম দান করিয়াছেন; কিন্তু মাল দান করেন নাই। তাই সে বলে, আহা ! যদি আমি এই লোকটির ন্যায় মালের মালিক হইতাম, তবে উহার ব্যাপারে তাহার ন্যায় কাজ করিতাম। তাহারা দুইজনে সমান পুরস্কার লাভ করিবে। তৃতীয় প্রকারের লোক হইতেছে সেই ব্যক্তি যাহাকে আল্লাহ্ ‘তা’আলা মাল দিয়াছেন; কিন্তু ইলম দেন নাই। সে উহা যথেচ্ছভাবে ব্যয় করে এবং সে আল্লাহ্র প্রাপ্য ক্ষেত্র ভিন্ন অন্য ক্ষেত্রে ব্যয় করে। চতুর্থ প্রকারের লোক হইতেছে সেই ব্যক্তি যাহাকে আল্লাহ্ তা’আলা না মাল দিয়াছেন, আর না ইলম দিয়াছেন। সে বলে, আহা ! আমি যদি এই লোকটির ন্যায় মালের মালিক হইতাম, তবে উহার ব্যাপারে তাহার ন্যায় কাজ করিতাম। ইহারা দুইজনে সমান গুনাহ স্কন্ধে বহন করিবে।’ উক্ত হাদীসের সনদ সহীহ। সকল প্রশংসা আল্লাহর প্রাপ্য।

error: Content is protected !!