হযরত জুনদুব ইব্ন আবদুল্লাহ্ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইমরান জওনী, হাম্মাদ ইব্ন যায়দ, আবূ নু’মান মুহাম্মদ ইব্ ফুযায়েল আমের ও ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘যতক্ষণ তোমাদের অন্তর কুরআন মজীদের প্রতি অভিনিবিষ্ট থাকে, শুধু ততক্ষণই উহা তিলাওয়াত করিবে। অভিনিবেশ ও মনোযোগ দূরীভূত হইবার পর উহার তিলাওয়াত স্থগিত রাখিবে।’
হযরত জুনদুব ইব্ন আবদুল্লাহ্ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইমরান জওনী, সালাম ইব্ন আবূ মু‘তী, আবদুর রহমান ইব্ন মাহদী, আমর ইব্ন আলী ইব্ন বাহর আল-ফাল্লাস ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘কুরআন মজীদের সহিত যতক্ষণ তোমাদের হৃদয় লাগিয়া থাকে, শুধু ততক্ষণই উহা তিলাওয়াত করিবে। মনোযোগ ও অভিনিবেশ দূরীভূত হইবার পর উহার তিলাওয়াত স্থগিত রাখিবে।’
উক্ত হাদীস উপরোক্ত রাবী আবূ ইমরান হইতে হারিছ ইব্ন উবায়দ এবং সাঈদ ইব্ন যায়দ বর্ণনা করিয়াছেন। হাম্মাদ ইব্ন সালামা এবং আব্বানের বর্ণনায় উহা স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী হিসাবে নহে; বরং হযরত জুনদুব ইব্ন আবদুল্লাহ্ (রা)-এর নিজস্ব উক্তি হিসাবে বর্ণিত হইয়াছে। আবূ ইমরান হইতে ধারাবাহিকভাবে শু’বা ও গুনদুর বর্ণনা করিয়াছেন যে, আবূ ইমরান বলেন- ‘আমি উহা হযরত জুনদুব (রাঃ)-এর নিজস্ব উক্তি হিসাবে তাঁহার নিকট হইতে শুনিয়াছি।’ তেমনি হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন সামিত (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইমরান ও ইব্ন আওফ বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন সামিত (রাঃ) বলেন- ‘তিনি উহা হযরত উমর ফারূক (রাঃ)-এর নিজস্ব উক্তি হিসাবে তাঁহার নিকট হইতে বর্ণনা করিয়াছেন।’ তবে হযরত জুনদুব (রাঃ) হইতেই উহা অধিকতর সংখ্যক রিওয়ায়েতে বর্ণিত হইয়াছে এবং তাহার নিকট হইতে উহার বর্ণিত হওয়াই অধিকতর সহীহ ও সঠিক।
ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ই উপরোক্ত হাদীস উক্ত রাবী আবূ ইমরান হইতে ধারাবাহিকভাবে হুমাম, আবদুস সামাদ ও ইসহাক ইব্ন মানসূরের সনদে একাধিক স্থানে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম আবার উহা আবূ ইমরান হইতে ধারাবাহিকভাবে হারিস ইব্ন উবায়দ, আবূ কুদামা ও ইয়াহিয়া ইব্ন ইয়াহিয়ার সনদেও বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি (ইমাম মুসলিম) উহা আবূ ইমরান হইতে ধারাবাহিকভাবে আব্বান আত্তার ও আহমদ ইবন সাঈদ ইব্ন হাব্বান ইব্ন হিলালের সনদে স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম বুখারী অবশ্য বর্ণনা করিয়াছেন যে, রাবী আব্বান এবং হাম্মাদ ইব্ন সালামা উহা স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী হিসাবে বর্ণনা করেন নাই। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।
ইমাম নাসাঈ এবং ইমাম তাবারানী উহা আবূ ইমরান হইতে ধারাবাহিকভাবে হারূন ইব্ন মূসা আল-আ’ওয়ার নাহবী, মুসলিম ইব্ন ইবরাহীম প্রমুখ রাবীর সনদে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমান নাসায়ী আবার উহা আবূ ইমরান হইতে ধারাবাহিকভাবে হাজ্জাজ ইব্ন কুরাফসাহ, সুফিয়ান ও পরবর্তী বিভিন্ন মাধ্যমে স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি আবার উহা হযরত জুনদুব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইমরান, হাজ্জাজ, সুফিয়ান, যায়দ ইব্ন আবূ যারকা ও হারূন ইব্ন যায়দ ইব্ন আবূ যারকার সনদে হযরত জুনদুব (রাঃ)-এর নিজস্ব উক্তি হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। তেমনি তিনি (ইমাম নাসাঈ) উহা হযরত উমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন সামিত (রাঃ), আবূ ইমরান, আবদুল্লাহ্ ইব্ন আওন, ইসহাক ইব্ন আজরাক ও মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল ইবন ইবরাহীমের সনদে হযরত উমর (রাঃ)-এর নিজস্ব উক্তি হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম আবূ বকর ইব্নঃ আবূ দাউদ মন্তব্য করিয়াছেনঃ রাবী আবদুল্লাহ্ ইব্ন আওন অন্য কোন হাদীসেই ভুল করেন নাই, তবে তিনি আলোচ্য হাদীসে ভুল করিয়াছেন। প্রকৃত পক্ষে উহা হযরত জুনদুব (রাঃ) হইতে বর্ণিত হাদীস।’ ইমাম তাবারানী উহা নিম্নোক্তরূপে বর্ণনা করিয়াছেনঃ
হযরত জুনদুব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইমরান, হারিছ ইব্ন উবায়দ, মুসলিম ইব্ন ইবরাহীম, সাঈদ ইব্ন মানসূর ও আলী ইব্ন আবদুল আযীয আমার নিকট বর্ণনা করিয়াছেনঃ (এখানে রাবী পূর্বোক্ত রিওয়ায়েতটি স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন।)
উপরোক্ত আলোচনা আলোচ্য হাদীসের বিভিন্ন সনদের সহিত সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত আলোচনা। হাদীস শাস্ত্রের বিজ্ঞ ইমাম ও শায়খ ইমাম বুখারী উক্ত হাদীস সম্বন্ধে যে মন্তব্য করিয়াছেন তাহাই সহীহ, সঠিক ও গৃহীতব্য। তিনি বলিয়াছেন—‘উক্ত হাদীস যে হযরত জুনদুব (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে এবং উহা যে স্বয়ং নবী করীম (সা)-এর বাণী (حديث مر فوع), ইহাই অধিকতর সহীহ ও সঠিক। অধিকাংশ সনদে উহা ঐরূপেই বর্ণিত হইয়াছে।’
যাহা হউক উক্ত হাদীসের তাৎপর্য এই যে, যতক্ষণ তিলাওয়াতকারীর অন্তর তিলাওয়াতের প্রতি নিবিষ্ট থাকে এবং কোন আয়াত তিলাওয়াত করিবার কালে সে উহার মর্ম ও তাৎপর্য সম্বন্ধে চিন্তা ও অনুধাবন করিতে আগ্রহী ও ইচ্ছুক থাকে, শুধু ততক্ষণই কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবার জন্যে নবী করীম (সাঃ) স্বীয় উম্মতকে নির্দেশ দিয়াছেন। তিলাওয়াত করিয়ার কালে কুরআন মজীদের আয়াতের প্রতি অন্তরের নিবিষ্টতা নষ্ট হইলে এবং উহার মর্ম ও তাৎপর্য সম্বন্ধে চিন্তা ও গবেষণা করিতে মন অনাগ্রহী হইয়া পড়িলে নবী করীম (সাঃ) তিলাওয়াত স্থগিত রাখিতে আদেশ দিয়াছেন। কারণ, অমনোযোগী অবস্থায় তিলাওয়াত করিলে তিলাওয়াতের উদ্দেশ্যই বানচাল হইয়া যাইবে। বলাবাহুল্য, কুরআন মজীদের তিলাওয়াতের উদ্দেশ্য হইতেছে—উহার মর্ম ও তাৎপর্য অনুধাবন করত তৎপ্রতি আমল করা। নবী করীম (সাঃ) আরও বলিয়াছেন—’তোমাদের মধ্যে যেই নেক (নফল) কাজ করিবার সামর্থ্য ও শক্তি রহিয়াছে, শুধু তাহাই করিবে। কারণ, তোমরা যতক্ষণ বিরক্ত ও ক্লান্ত হইয়া না পড়, আল্লাহ্ তা’আলা ততক্ষণ বিরক্ত ও অনিচ্ছুক হন না।’ নবী করীম (সাঃ) আরও বলিয়াছেন –যে নেক আমল বা কাজ’ নেককার ব্যক্তি স্থায়ীভাবে করিতে থাকে, উহার পরিমাণ কম হইলেও উহা অধিকতর পছন্দনীয় নেক কাজ।’
হযরত আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে নাযাল ইব্ন সুবরাহ, আবদুল মালিক ইবন মায়সারাহ, শু‘বা, সুলায়মান ইব্ন হারব ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) বলেন—একদা আমি জনৈক ব্যক্তিকে কুরআন মজীদের একটি আয়াত এমনভাবে তিলাওয়াত করিতে শুনিলাম—যাহা হইতে স্বতন্ত্ররূপে আমি নবী করীম (সাঃ)-কে উহা তিলাওয়াত করিতে শুনিয়াছি। আমি তাহার হাত ধরিয়া তাহাকে নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট লইয়া গেলাম। তিনি বলিলেন—‘তোমাদের উভয়ের তিলাওয়াতই সঠিক ও শুদ্ধ। তোমরা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব উচ্চারণে তিলাওয়াত করিও।’ আমার মনে পড়ে, নবী করীম (সাঃ) আরও বলিলেন—’তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের লোকেরা আসমানী কিতাব লইয়া মতভেদে লিপ্ত হইয়াছিল এবং আল্লাহ্ তা’আলা উহার পরিণতিতে তাহাদিগকে ধ্বংস করিয়া দিয়াছেন।’
ইমাম নাসাঈ উপরোক্ত হাদীস শু‘বা হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং অন্যরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। ইতিপূর্বে উহার অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। উক্ত হাদীসে কুরআন মজীদের কিরাআত লইয়া মতভেদ নিষিদ্ধ হইয়াছে। উক্ত হাদীসই ইমাম বুখারী কর্তৃক ‘ফাযায়েলুল কুরআন’ অধ্যায়ে বর্ণিত সর্বশেষ হাদীস। আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।
ইমাম আহমদের পুত্র আবদুল্লাহ স্বীয় পিতার ‘মুসনাদ’ সংকলনে যে হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন, উহা উপরোক্ত হাদীসের প্রায় অনুরূপ। হযরত আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে যর ইব্ন হুরায়েশ, আসিম, আ‘মাশ, ইয়াহিয়া ইব্ন সাঈদ উমুবী, আবূ – মুহাম্মদ সাঈদ ইব্ন মুহাম্মদ আল জারমী ও আবদুল্লাহ ইব্ন ইমাম আহমদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত ইবন মাসঊদ (রাঃ) বলেন-একদা কুরআন মজীদের একটি সূরা সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে মতভেদ দেকা দিল। আমাদের একজন উহার আয়াতের সংখ্যা পঁয়ত্রিশ এবং অন্যজন ছত্রিশ বলিয়া অভিমত প্রকাশ করিল। আমরা মীমাংসার জন্যে নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হইলাম। সে সময়ে হযরত আলী (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর সহিত কোন গোপন আলোচনায় রত ছিলেন। আমরা নবী করীম (সাঃ)-এর খেদমতে আরয করিলাম- ‘কিরাআতের বিষয় লইয়া, আমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়াছে।’ এতদশ্রবণে নবী করীম (সাঃ)-এর চেহারা মুবারক রক্তিম হইয়া গেল। হযরত আলী (রাঃ) বলিলেন- তোমাদিগকে যেরূপে শিখানো হইয়াছে, সেইরূপে পড়িতে নবী করীম (সাঃ) আদেশ করিতেছেন।’ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার প্রাপ্য।