হযরত উসমান (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত আবূ আবদুর রহমান, সা’দ ইব্ন উবায়দা, আলকামা ইব্ন মারসাদ, শু’বা, হাজ্জাজ ইব্ন মিনহাল ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘সেই ব্যক্তিই তোমাদের মধ্যে উত্তম যে ব্যক্তি কুরআন মজীদের শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা প্রদান করে।’ উক্ত হাদীসের মর্ম অনুযায়ী উত্তম মর্যাদা লাভ করিবার উদ্দেশ্যে রাবী আবূ আবদুর রহমান হযরত উসমান (রাঃ)-এর খিলাফতকাল হইতে হাজ্জাজ ইব্ন ইউসুফের কাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময় ধরিয়া মানুষকে কুরআন মজীদ তা’লীম দিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন- ‘এই হাদীসই আমাকে এই স্থানে উপবিষ্ট করিয়াছে।’ ইমাম মুসলিম ভিন্ন সিহাহ সিত্তার অন্যান্য সংকলক উপরোক্ত হাদীস উপরোক্ত রাবী শু’বা হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং বিভিন্ন অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। রাবী আবূ আবদুর রহমানের অন্য নাম হইতেছে আবদুল্লাহ্ ইব্ন হাবীব সালমী।
হযরত উসমান (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত আবূ আবদুর রহমান সালমী, আলকামা ইব্ন মারসাদ, সুফিয়ান, আবূ নাঈম ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘তোমাদের মধ্যে উত্তম হইতেছে সেই ব্যক্তি যে কুরআন মজীদের শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা প্রদান করে।’ ইমাম তিরমিযী, ইমাম নাসাঈ এবং ইমাম ইব্ন মাজাহ ও উপরোক্ত রাবী হযরত সুফিয়ান ছাওরী হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং বিভিন্ন অধস্তন সনদাংশে উপরোক্ত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। লক্ষ্যণীয় যে, পূর্ববর্তী হাদীসের সনদে আলকামা ও আবূ আবদুর রহমান এই দুই রাবীর মধ্যবর্তী রাবী হিসাবে সা’দ ইবন উবায়দার নাম উল্লেখিত হইয়া থাকিলেও শেষোক্ত হাদীসের সনদে সা’দ ইবন উবায়দার নাম উল্লেখিত হয় নাই। আরও লক্ষ্যণীয় যে, প্রথমোক্ত সনদের যে পর্যায়ে শু’বার নাম উল্লেখিত রহিয়াছে, শেষোক্ত সনদের সেই পর্যায়ে হযরত সুফিয়ান ছাওরীর নাম উল্লেখিত রহিয়াছে। অতএব দেখা যাইতেছে, হযরত সুফিয়ান ছাওরী কর্তৃক উল্লেখিত সনদে সা’দ ইব্ন উবায়দার নাম উল্লেখিত হয় নাই। আর হযরত সুফিয়ান ছাওরী আলোচ্য সনদ যেরূপে উল্লেখ করিয়াছেন উহাই যে সঠিক, তাহার পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ রহিয়াছে। অবশ্য বিনদার ইয়াহিয়া ইবন সাঈদ উপরোক্ত হাদীস হযরত সুফিয়ান ছাওরীর মাধ্যমে বর্ণনা করিতে গিয়া সনদের পূর্বোল্লেখিত পর্যায়ে সা’দ ইবন উবায়দার নাম উল্লেখ করিয়াছেন। উহা তাঁহার একটি ভুল। তিনি মন্তব্য করিয়াছেন যে, ‘সুফিয়ানের একদল শিষ্য তাঁহার নিকট হইতে উপরোক্ত হাদীসের সনদে সা’দ ইব্ন উবায়দার নাম উল্লেখ না করিয়াই বর্ণনা করিয়াছেন। তবে সুফিয়ান হইতে আমি যে সনদ উল্লেখ করিয়াছি, উহাই অধিকতর সহীহ।’
বিন্দার ইয়াহিয়া ইব্ন সাঈদের উপরোক্ত মন্তব্যও ভ্রান্ত। উক্ত সনদে সা’দ ইব্ন উবায়দা নাম অন্তর্ভুক্ত করা সম্পর্কে পূর্বে আমি যাহা বলিয়াছি, তাহাই সঠিক। এই স্থলে সনদশাস্ত্র সম্পর্কিত দীর্ঘ আলোচনার অবতারণা করা যাইত। এখানে আলোচনা করিবার মতো সুদীর্ঘ বিষয়ও ছিল। তবে পাঠকের বিরক্তি এড়াইবার উদ্দেশ্যে উহা পরিত্যক্ত হইল। অবশ্য সংক্ষেপে যতটুকু বিবৃত হইল, উহা পরিত্যক্ত অংশের প্রতি ইঙ্গিত প্রদানে যথেষ্ট। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।
উপরে বর্ণিত হাদীসে যে দুইটি গুণ উল্লেখিত হইয়াছে, উহা আল্লাহ্ তা’আলার রাসূলগণের অনুসারী মু’মিনদের গুণ। রাসূলগণ একদিকে নিজেরা পূর্ণ মানব ছিলেন এবং অন্যদিকে মানবজাতিকে পূর্ণ মানবতা শিক্ষা দিতে সচেষ্ট ছিলেন। আলোচ্য হাদীসে সর্বোত্তম মু’মিনের দুইটি সর্বোত্তম গুণ যথা কুরআন মজীদের শিক্ষা গ্রহণ এবং উহার শিক্ষা প্রদানের কথা বর্ণিত হইয়াছে। প্রথম উত্তম গুণটি দ্বারা মু’মিন নিজে উপকৃত হয় এবং দ্বিতীয় উত্তম গুণটি দ্বারা অপরে উপকৃত হয়। ইহাই মু’মিনের আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য। সে নিজেও কুরআন মজীদের হিদায়েত গ্রহণ করিয়া মানবতা লাভ করে এবং অপরকে উহার হিদায়েত দ্বারা মানবতা লাভ করিতে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে। পক্ষান্তরে কাফিরের স্বভাব ও আদর্শ ইহার ঠিক বিপরীত। তাহারা একদিকে নিজেরা কুরআন মজীদের হিদায়েত গ্রহণপূর্বক মানবতা লাভ করিতে অসম্মতি জানায় এবং অন্যদিকে অপরকে উহার হিদায়েত হইতে দূরে রাখিতে সচেষ্ট থাকে। তাহাদের সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيْلِ اللَّهِ زِدْنَاهُمْ عَذَابًا فَوْقَ الْعَذَابِ
নিজেরা সত্যকে গ্রহণ করিতে অসম্মতি জানাইয়াছে এবং অপরকেও আল্লাহ্র পথ হইতে দূরে রাখিয়াছে, আমি তাহাদিগকে শাস্তির উপর শাস্তি প্রদান করিতে থাকিব।’
আল্লাহ্ তা’আলা আরও বলেনঃ
وهم ينهونَ عَنْهُ وَيَنْتَونَ عَنْهُ
এবং ‘তাহারা অপরকেও উহা গ্রহণ করিতে দেয় না আর নিজেরাও উহা গ্রহণ করিতে বিরত থাকে।’
পক্ষান্তরে মু’মিনদের সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلاً ممَّنْ دَعَا إِلَى اللهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنْ
‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে আহ্বান জানায় এবং নেক কাজ করে আর বলে, নিশ্চয় আমি সত্যের কাছে আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত, কথায় তাহার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর কে হইতে পারে?’ আলোচ্য হাদীসটি কুরআন মজীদের উক্ত আয়াতের প্রতিধ্বনি বটে। উহার অন্যতম রাবী হযরত আবূ আবদুর রহমান আবদুল্লাহ্ ইব্ন হাবীব সালমী কূফী ইসলামের একজন ইমাম ও শায়েখ ছিলেন। তিনি উক্ত আয়াত ও হাদীসে বর্ণনা মাকাম ও মর্যাদা লাভ করিবার উদ্দেশ্যে কুরআন মজীদের শিক্ষা গ্রহণ ও উহার শিক্ষা প্রদানে আত্মনিবেদিত হন। তিনি হযরত উসমান (রাঃ)-এর খিলাফতের যুগ হইতে হাজ্জাজের শাসনকাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সত্তর বৎসর ধরিয়া মানুষকে কুরআন মজীদের তা’লীম ও শিক্ষা প্রদান করেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহাকে তাঁহার ঈপ্সিত মাকাম ও মর্যাদা প্রদান করুন। আমিন !
হযরত সাহল ইব্ন সা’দ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হাম্মাদ ইব্ন আবূ হাযিম, আমর ইব্ন আওন ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ একদা নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট জনৈকা মহিলা আসিয়া বলিল- আমি আল্লাহ্ ও রাসূলের জন্য নিজেকে সমর্পণ করিলাম। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘নারীতে আমার কোন প্রয়োজন নাই।’ ইহাতে জনৈক সাহাবী বলিলেন- “হে আল্লাহর রাসূল ! তাহাকে আমার সহিত বিবাহ দিন।’ নবী করীম (সাঃ) বলিলেন— ‘তাহাকে একখানা কাপড় দাও।’ সাহাবী বলিলেন- ‘কাপড় দিবার সামর্থ্য আমার নাই।’ নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘তাহাকে একটি লোহার আংটি দিতে পারিলেও দাও।’ সে উহাতেও অসমর্থ জানাইল। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘তুমি কুরআন মজীদের কতটুকু জানো?’ সাহাবী বলিলেন— ‘আমি উহার অমুক অমুক অংশ জানি।’ নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘তোমার নিকট কুরআন মজীদের যে অংশটুকু রহিয়াছে, উহা শিক্ষাদানের বিনিময়ে তাহাকে তোমার সহিত বিবাহ দিলাম ।’ উপরোক্ত হাদীস একাধিক সহীহ সনদে বর্ণিত হইয়াছে। এইস্থলে ইমাম বুখারী (রঃ) উহা বর্ণনা করিয়া প্রমাণ করিতে চাহেন যে, ‘উল্লেখিত সাহাবী কুরআন মজীদের যতটুকু আয়ত্ত করিয়াছিলেন, তাহা সেই মহিলাকে শিক্ষা দিতে নবী করীম (সাঃ) তাহাকে আদেশ দিয়াছিলেন। আর কুরআন মজীদের এই তা’লীমকেই তিনি উক্ত মহিলার দেন-মহর হিসাবে ধার্য করিয়াছিলেন।’
অবশ্য কুরআন মজীদের তা’লীম দেওয়া বিবাহের দেন-মহর হইতে পারে কিনা; কুরআন মজীদের তা’লীমের পরিবর্তে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয কিনা; এই ব্যবস্থা শুধু উপরোক্ত সাহাবীর জন্যে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট ছিল কিনা; তাহা লইয়া ফকীহগণের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। ‘তোমার নিকট কুরআন মজীদের যে বিশেষ অংশটুকু রহিয়াছে, উহার পরিবর্তে আমি তাহাকে তোমার সহিত বিবাহ দিলাম’- নবী করীম (সাঃ)-এর এই উক্তির তাৎপর্য কি এই হইবে যে, ‘তোমার নিকট কুরআন মজীদের যে অংশ রহিয়াছে, তজ্জন্য তোমাকে মর্যাদা দিতেছি এবং বিনা মহরেই মহিলাটিকে তোমার সহিত বিবাহ দিতেছি?’ অথবা উহার তাৎপর্য কি এই হইবে যে, ‘তোমার নিকট কুরআন মজীদের যে অংশ রহিয়াছে, উহার তা’লীমের বিনিময়ে তাহাকে তোমার সহিত বিবাহ দিলাম?’ এই ব্যাপারেই ফকীহগণের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়াছে । ইমাম আহমদ বলেন- নবী করীম (সাঃ)-এর উপরোক্ত বাণীর তাৎপর্য এই যে, উক্ত সাহাবীর স্মৃতিতে রক্ষিত কুরআন মজীদের অংশ বিশেষকে মর্যাদা দিয়া নবী করীম (সাঃ) উক্ত মহিলাটিকে তাহার সহিত বিবাহ দিয়াছিলেন। তবে নবী করীম (সাঃ)-এর বাণীর শেষোক্ত তাৎপর্য বর্ণনা করাই অধিকতর সঙ্গত। কারণ, মুসলিম শরীফে বর্ণিত রিওয়ায়েতে উল্লেখিত হইয়াছেঃ নবী করীম (সাঃ) তাহাকে বলিলেন- ‘তুমি তাহাকে কুরআন মজীদ শিক্ষা দাও।’ উক্ত বিষয়টিকে (কুরআন মজীদের তা’লীমকে) প্রমাণিত করিবার উদ্দেশ্যেই ইমাম বুখারী এইস্থলে উক্ত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। মতভেদের অন্যান্য বিষয় বিবাহ ও ইজারা সম্পর্কিত অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে।