হযরত আলী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে সুআয়দ ইব্ন আফলা, খায়সামা, আ’মাশ, সুফিয়ান, মুহাম্মদ ইব্ন কাছীর ও ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘হযরত আলী (রাঃ) বলেন- আমি নবী করীম (সাঃ)-কে এইরূপ বলিতে শুনিয়াছি যে, ‘শেষ যামানায় এইরূপ একদল লোকের আবির্ভাব ঘটিবে যাহারা বয়সে অর্বাচীন এবং বুদ্ধিতে নির্বোধ হইবে। তাহাদের মুখের কথা হইবে বড়ই উত্তম। যেরূপে তীর শিকার ভেদ করিয়া উহার বাহিরে চলিয়া যায়, তাহারা সেইরূপে ইসলাম ভেদ করিয়া চলিয়া যাইবে। তাহাদের ঈমান তাহাদের কণ্ঠদেশ অতিক্রম করিবে না (তাহাদের হৃদয়ে ঈমান প্রবেশ করিবে না)। তোমরা তাহাদিগকে যেখানেই পাইবে, সেখানেই হত্যা করিবে। কারণ, তাহাদিগকে যে ব্যক্তি হত্যা করিবে, কিয়ামতের দিনে সে পুরস্কার পাইবে।’
ইমাম বুখারী উপরোক্ত হাদীস অন্যত্র দুইবার বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ দাউদ এবং ইমাম নাসায়ী উহা উপরোক্ত রাবী আ’মাশ হইতে উক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং আ’মাশের পর বিভিন্ন অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন।
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ সালামা ইব্ন আবদুর রহমান, মুহাম্মদ ইব্ন ইবরাহীম ইব্ন হারিছ তায়মী, ইয়াহিয়া ইব্ন সাঈদ, মালিক, আবদুল্লাহ্ ইব্ন ইউসুফ ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন- আমি নবী করীম (সাঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছিঃ ‘তোমাদের মধ্যে এইরূপ একদল লোকের আবির্ভাব ঘটিবে যাহাদের নামাযের তুলনায় নিজেদের নামাযকে এবং যাহাদের রোযার তুলনায় নিজেদের রোযাকে তোমরা তুচ্ছ মনে করিবে। তাহারা কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবে; কিন্তু উহা তাহাদের কণ্ঠদেশ অতিক্রম করিবে না। যেরূপে তীর শিকার ভেদ করিয়া উহার বাহিরে চলিয়া যায়; তাহারা সেইরূপে দীন হইতে বাহিরে চলিয়া যাইবে। শিকারী তীরের ফলকের প্রতি তাকাইয়া দেখে উহাতে কিছুই (রক্তের কোন চিহ্নই) নাই; সে তীর দণ্ডের দিকে তাকাইয়া দেখে- উহাতে কিছুই নাই। সে তীরের সংলগ্ন পালকের প্রতি তাকাইয়া দেখে উহাতেও কিছুই নাই। অবশেষে তীর ফলকের নল সদৃশ অংশে কোন কিছু লাগিয়াছে কিনা তাহা লইয়া সে চিন্তা-ভাবনা করে।
ইমাম বুখারী উপরোক্ত হাদীস অন্যত্রও বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম এবং ইমাম নাসায়ীও উহা হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ সালামা ইব্ন আবদুর রহমান ও মুহরী প্রমুখ রাবীর সনদে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম ইব্ন নাজীহ উহা হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ সালামা ইব্ন আবদুর রহমান ও মুহাম্মদ ইব্ন আমর ইব্ন আলকামা প্রমুখ রাবীর সনদে বর্ণনা করিয়াছেন।
হযরত আবূ মূসা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত আনাস ইবন মালিক (রাঃ), কাতাদাহ, শু’বা, ইয়াহিয়া ইব্ন সাঈদ, মুসাদ্দাদ ইব্ন মুসারহাদ ও ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘যে মুমিন ব্যক্তি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে এবং উহা আমল করে, তাহার অবস্থা লেবুর সহিত তুলনীয়। উহার স্বাদও সুখকর এবং ঘ্রাণও সুমধুর। আর যে মু’মিন ব্যক্তি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে না; তবে উহা আমল করে, তাহার অবস্থা খেজুরের সহিত তুলনীয়। উহার স্বাদ মধুর; কিন্তু উহাতে কোন সুঘ্রাণ নাই। যে মুনাফিক ব্যক্তি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে, তাহার অবস্থা পুষ্পস্তবকের সহিত তুলনীয়। উহার ঘ্রাণ আনন্দকর; কিন্তু স্বাদ তিক্ত। আর যে মুনাফিক ব্যক্তি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে না, তাহার অবস্থা হানযাল (মাকাল) ফলের সহিত তুলনীয়। উহার স্বাদও তিক্ত এবং ঘ্রাণও বিশ্রী।’ ইমাম বুখারী উহা অন্যত্রও বর্ণনা করিয়াছেন। সিহাহ সিত্তার অন্যান্য সংকলক ও উহা উপরোক্ত রাবী কাতাদাহ হইতে উক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং বিভিন্ন অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন।
কুরআন মজীদের তিলাওয়াত হইতেছে আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভের অন্যতম প্রধান পথ ও মাধ্যম। হাদীস শরীফে আসিয়াছে যে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘আর জানিয়া রাখ, কুরআন দ্বারা তুমি আল্লাহ্ তা’আলার যতটুকু নৈকট্য লাভ করিতে পারিবে, ততটুকু নৈকট্য অন্য কিছুতেই লাভ করিতে পারিবে না।’ কুরআন তিলাওয়াত এত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও উহা মানুষকে দেখাইবার জন্যে করা উপরোক্ত হাদীসসমূহে নিষিদ্ধ হইয়াছে। উপরোক্ত হাদীসসমূহে লোক দেখানো তিলাওয়াতের বিরুদ্ধে মানুষকে সতর্ক করা হইয়াছে।
হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত উপরোক্ত হাদীসদ্বয়ে যে গোমরাহ সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখিত হইয়াছে, উহা হইতেছে খারিজী সম্প্রদায়। ঈমান উক্ত সম্প্রদায়ের লোকদের কণ্ঠদেশ অতিক্রম করিয়া তাহাদের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে না। অর্থাৎ তাহাদের ঈমান আন্তরিক ঈমান নহে; তাহাদের ঈমান নিছক মৌখিক ঈমান। তাহাদের সম্বন্ধে অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছেঃ … … তাহাদের কিরাআতের তুলনায় তোমাদের কিরাআত, তাহাদের নামাযের তুলনায় তোমাদের নামায এবং তাহাদের রোযার তুলনায় তোমাদের রোযা তোমাদের নিকট তুচ্ছ বলিয়া মনে হইবে।’ খারিজীগণ কুরআন মজীদের তিলাওয়াতকারী এবং বাহ্যত কুরআন মজীদের প্রতি শ্রদ্ধাবান হইলেও তাহাদের তিলাওয়াত ও শ্রদ্ধা প্রকৃতপক্ষে লোক দেখানো তিলাওয়াত ও শ্রদ্ধা। তাই হাদীসে তাহাদিগকে হত্যা করিবার জন্যে নির্দেশ প্রদান করা হইয়াছে। তাহাদের কেহ কেহ অবশ্য উক্ত লোক দেখানো তিলাওয়াত ও শ্রদ্ধা হইতে মুক্ত। কিন্তু তাহাদের তিলাওয়াত এবং শ্রদ্ধা যেহেতু ভ্রান্ত আকীদা ও বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই তাহারাও তাহাদের অন্যান্য স্বমতাবলম্বীদের নায় ভ্রান্ত ও নিন্দনীয়। অন্তরের আকীদা ও তাকওয়ার উপরই যে নেক আমল প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে, নিম্নোক্ত আয়াতে তাহা সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হইয়াছেঃ
(যে ব্যক্তি আল্লাহর তাকওয়া ও সন্তোষের উপর স্বীয় মসজিদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, সেই ব্যক্তি ভালো, না যে ব্যক্তি ধ্বংসোন্মুখ খাদের কিনারায় স্বীয় গৃহ নির্মাণ করিয়াছে, অতঃপর উহা তাহাকে লইয়া জাহান্নামের আগুনে ধ্বসিয়া পড়িয়াছে, সেই ব্যক্তি ভালো? আর আল্লাহ্ জালিম কওমকে হিদায়েত করেন না।
খারিজী সম্প্রদায় কাফির অথবা ফাসিক কিনা এবং তাহাদের দ্বারা বর্ণিত রিওয়ায়েত গ্রহণযোগ্য কিনা এই বিষয়ে ফকীহগণের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। আল্লাহ্ চাহেন তো যথাস্থানে উহা বিশদভাবে আলোচিত হইবে।
মুনাফিকের কুরআন তিলাওয়াতকে উপরোক্ত হাদীসে পুষ্পস্তবকের সুঘ্রাণের সহিত কেন তুলনা করা হইয়াছে, তাহা সহজে অনুমেয়। মূলত মুনাফিক মানুষকে দেখাইবার উদ্দেশ্যে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে। তাহার এই অবস্থা পুষ্পস্তবকের তিক্ত স্বাদের সহিত তুলনীয়। মুনাফিকের রিয়াকারী বা লোক দেখানো মানসিকতা সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
إِنَّ الْمُنفِقِينَ يُخَادِعُونَ اللهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ – وَإِذَا قَامُوا إلى الصلوة قَامُوا كُسَالَى يُرَاتُونَ النَّاسَ وَلا يَذْكُرُونَ الله الأ قليلاً.
(মুনাফিকগণ আল্লাহ্ তা’আলাকে প্রতারিত করে। অথচ তাহারা নিজদিগকে প্রতারিত করিতেছে। আর যখন তাহারা নামাযে দণ্ডায়মান হয়, তখন উদাসীনভাবে দণ্ডায়মান হয়। তাহারা লোক দেখানো ইবাদত করে। আর তাহারা আল্লাহকে সামান্যই স্মরণ করিয়া থাকে।)