ইমাম বুখারী (রঃ) বলেন- আমাদিগকে মূসা ইবন ইসমাঈল, তাহাদিগকে ইবরাহীম ইব্ন সাদ, তাহাদিগকে ইবন শিহাব, উবায়দ ইব্ন সিবাক হইতে এই হাদীস শুনানঃ
“যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) বলেন- ইয়ামামার যুদ্ধের সময়ে আবূ বকর (রাঃ) আমাকে কাছে ডাকিয়া পাঠাইলেন। তখন উমর ফারূক (রাঃ) তাঁহার কাছে উপবিষ্ট ছিলেন। আবূ বকর (রাঃ) বলিলেন- ‘উমর ইবনুল খাত্তাব আমার কাছে আসিয়া জানাইল যে, রণাঙ্গণ খুবই উত্তপ্ত। কুরআনের হাফিজগণের এখন কঠিন সময়। আমার ভয় হয়, রাষ্ট্রের হাফিজগণ এরূপ শহীদ হইতে থাকিলে আমরা কুরআনের অনেকাংশ হারাইয়া ফেলিব। তাই আমি মনে করি, এখন কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলিত করার নির্দেশ দেওয়া যায়।’ আমি উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করিলাম- রাসূল (সাঃ) যাহা করেন নাই, আমরা তাহা কিরূপে করিতে পারি? উমর বলিলেন- আল্লাহর শপথ ! ইহা উত্তম কাজ। অতঃপর যতদিন এই ব্যাপারে আমার মন পরিষ্কার হয় নাই, ততদিন উমর আর আমার কাছে আসেন নাই। অবশেষে আমিও উমরের মতকে উত্তম ভাবিলাম। তখন আবূ বকর (রাঃ) ‘বলিলেন- “তুমি বিচক্ষণ যুবক ও সর্বাধিক অপবাদমুক্ত নির্দোষ ব্যক্তি। তুমি রাসূল (সাঃ)-এর ওহী লেখক ছিলে। সুতরাং তুমিই কুরআন সংগ্রহ করিয়া গ্রন্থরূপ দান কর।’ আল্লাহ্র কসম ! আমাকে যদি বলা হইত যে, একটি পাহাড় বহন করিয়া আরেকটি পাহাড়ের কাছে লইয়া যাও, তাহা হইলে তাহাও আমার কাছে এত ভারী মনে হইতে না, যাহা এই নির্দেশে মনে হইল।” আমি তাঁহাকেও প্রশ্ন করিলাম- ‘রাসূল (সাঃ) যাহা করেন নাই তাহা আপনারা কি করিয়া করিতেছেন?’ তিনিও জবাব দিলেন- আল্লাহর কসম ! ইহা উত্তম কাজ।’ তারপর যতদিন আমার বুঝ আসেনি, ততদিন আবূ বকর (রাঃ) আমার কাছে আসিতে লাগিলেন। অবশেষে আল্লাহ্ তা’আলা আবূ বকর ও উমরকে যেই বুঝ দান করিয়াছেন, আমাকেও তাহা দান করিলেন। অতঃপর আমি কুরআন সংগ্রহ ও গ্রন্থনা শুরু করিলাম। উহা গাছের বাকল, পাথরের টুকরা ও মানুষের অন্তরে গ্রথিত ছিল। আবূ খুযায়মা আনসারী (রাঃ)-এর কাছে সূরা তাওবার শেষাংশ পাইলাম (লাকাদ জাআকুম রসূলুম মিন আনফুসিকুম হইতে সূরা বারাআত সমাপ্ত)। এই সহীফা হযরত আবূ বকর (রাঃ)-এর ইন্তেকাল পর্যন্ত তাঁহার কাছেই ছিল। তারপর উহা হযরত উমর (রাঃ)-এর কাছে রক্ষিত থাকে।
ইমাম বুখারী (রঃ) এই হাদীসটি তাঁহার সংকলনে ভিন্ন প্রসঙ্গ বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম আহমদ, ইমাম তিরমিযী ও ইমাম নাসাঈ ভিন্ন সূত্রে যুহরী হইতে উহা বর্ণনা করেন। এই কাজটি নিঃসন্দেহে অতি উত্তম, মহৎ ও বিরাট কাজ। হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) ইহা সম্পন্ন করিয়া আল্লাহ্ দীনকে মজবুত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। আল্লাহ্ তাঁহাকে তাঁহার রাসূলের স্থলাভিষিক্ত করিয়াছেন। অন্য কেহ এই মর্যাদার যোগ্য হয় নাই। তিনিই যাকাত বিরোধীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তেমনি তিনিই জিহাদ পরিচালনা করেন মুরতাদদের বিরুদ্ধে এবং রোমক ও পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। তিনি অভিযান পরিচালনা করেন, দূত প্রেরণ করেন, সৈন্য প্রেরণ করেন, বিশৃঙ্খল অবস্থাকে সুশৃঙ্খল করেন ও বিক্ষিপ্ত কুরআনকে গ্রথিত করেন। ফলে সমগ্র কুরআনের অসংখ্য কারী ও হাফিজ সৃষ্টি হয়। অবশ্যই ইহা আল্লাহ্ পাকের নিম্ন বাণীর হুবহু বাস্তবায়ন মাত্র । তিনি বলেনঃ
اَّنانْحُننَّزْلَناالِّذْكَرواَّنالُهَلَحاِفُظوَن “নিশ্চয় আমি যিকর (কুরআন) অবতীর্ণ করিয়াছি এবং অবশ্যই আমি উহার সার্বক্ষণিক সংরক্ষক।”
কুরআন মজীদের উক্ত আয়াতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর উপরোক্ত কার্য এবং উহার ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী সুফলের প্রতিও ইঙ্গিত রহিয়াছে। তিনি যাবতীয় কল্যাণের দ্বার উন্মোচন ও সর্ববিধ অকল্যাণের দ্বার রুদ্ধ করেন।
উপরোল্লেখিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) হইতেছেন কুরআন মজীদের সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মহা ব্যবস্থাপক। তাঁহার ব্যবস্থাপনার ফলে কালামে পাক সর্বপ্রকারের বিকৃতির হাত হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র রহিয়াছে। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার প্রতি সন্তুষ্ট হউন এবং এজন্যে তাঁহাকে পুরস্কৃত করুন।
ওয়াকী’, ইব্ন যায়দ, কুবায়সা প্রমুখ ইমামগণ হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু হইতে ধারাবাহিকভাবে আব্দ খায়ের, ইসমাঈল ইব্ন আবদুর রহমান আস সুদ্দীয়্যুল কবীর ও সুফিয়ান ছাওরী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘হযরত আলী (রাঃ) বলেন-কুরআন মজীদ সংরক্ষণ কার্যে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) হইতেছেন মানুষের মধ্যে অধিকতম নেকী ও সওয়াবের প্রাপক। কারণ, তিনিই কুরআন মজীদকে সর্বপ্রথম সংগৃহীত ও একত্রিত করিবার ব্যবস্থা করেন।’ উক্ত হাদীসের উপরোক্ত সনদ সহীহ।
আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ তাঁহার রচিত ‘আল-মুসাহেফ’ গ্রন্থে বর্ণনা করিয়াছেনঃ হিশামের পিতা হইতে ধারাবাহিকভাবে হিশাম, আবাদাহ ও হারূন ইব্ন ইসহাকের মাধ্যমে আমার নিকট এই বর্ণনাটি পৌছিয়াছেঃ
‘নবী করীম (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-ই কুরআন মজীদকে সংগৃহীত ও একত্রিত করিবার ব্যবস্থা করেন। তৎকর্তৃক সংগৃহীত কুরআন মজীদের সংকলনটি ছিল সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ। ইয়ামামাহ অঞ্চলে অবস্থিত ‘মৃত্যু উদ্যান’ (বই)-এ (الموت حديقة) নামক স্থানে মুসায়লামাতুল কায্যাব ও তদীয় বনূ হানীফা গোত্রীয় লোকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক হাফিজুল কুরআন শহীদ হওয়ায় হযরত উমর (রাঃ) কুরআন মজীদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে সর্বপ্রথম সচেতন হন।’
ঘটনাটি নিম্নরূপঃ
নবী করীম (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর ভণ্ড নবী, সেরা মিথ্যুক মুসায়লামা প্রায় এক লক্ষ ইসলাম ত্যাগী লোককে নিজের দলে ভিড়াইয়া ইসলাম ও মুসলিম জাতিকে ধ্বংস করিয়া দিবার উদ্দেশ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করিল। তাহাকে দমন করিবার জন্য হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) হযরত খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে প্রায় তের হাজার মুজাহিদের একটি বাহিনী পাঠাইলেন। মুসলিম বাহিনীর মধ্যে বিপুল সংখ্যক লোক ইসলামী অনুপ্রেরণা হইতে বঞ্চিত অজ্ঞ ও অপরিশুদ্ধ ছিল। তাহাদের ঈমানের দুর্বলতার কারণে মুসলিম বাহিনী রণক্ষেত্রে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। ইসলামী প্রেরণায় অনুপ্রাণিত উচ্চ শ্রেণীর সাহাবীগণ সেনাপতি হযরত খালিদ (রাঃ)-কে উচ্চস্বরে বলিতে লাগিলেন- ‘হে খালিদ! আমাদিগকে মুক্ত করুন।’ অর্থাৎ ওই সকল দুর্বল ঈমানের অধিকারী ব্যক্তি হইতে আমাদিগকে পৃথক করিয়া ফেলুন। অতঃপর তাঁহারা দুর্বল ঈমানের লোকগুলি হইতে পৃথক হইয়া গেলেন। সংখ্যায় তাঁহারা মাত্র প্রায় তিন হাজার ছিলেন। তাঁহারা প্রকৃত ঈমানী শক্তি লইয়া মুসায়লামার বাহিনীর উপর আক্রমণ করিলেন। তুমুল যুদ্ধের পর আল্লাহর ফযলে মুসলমানগণ জয়ী হইলেন। যুদ্ধের সময়ে সাহাবীগণ “হে সূরা বাকারার ধারকগণ’ এই সম্বোধনে পরস্পরকে সম্বোধিত করিতেছিলেন। কাফিরগণ পরাজিত হইয়া রণক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিতে লাগিল। সাহাবীগণ তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া অনেককে হত্যা এবং অনেককে বন্দী করিয়া ফেলিলেন। সেরা মিথ্যুক মুসায়লামা নিহত হইল। তাহার দলবল ছত্রভঙ্গ হইয়া গেল এবং ইসলামে ফিরিয়া আসিল।
যুদ্ধ জয়ে মুসলমানদিগকে বিরাট মূল্য দিতে হইয়াছিল। এই যুদ্ধে প্রায় পাঁচশত হাফিজ সাহাবী শাহাদতবরণ করিলেন। এতদ্দর্শনে হযরত উমর (রাঃ) হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ)-কে কুরআন মজীদ সংগ্রহ ও সংকলন করিতে পরামর্শ প্রদান করিলেন। হযরত উমর (রাঃ)-এর আশংকা ছিল, ভবিষ্যৎ যুদ্ধসমূহে আরও হাফিজ সাহাবী শহীদ হইতে পারেন। এমতাবস্থায় কুরআন মজীদ সংগ্রহ ও একত্রিত না করিলে উহার কিয়দংশ বিনষ্ট ও হাতছাড়া হইয়া যাইতে পারে। লিপিবদ্ধ আকারে উহা সংরক্ষিত হইলে উহার প্রথম প্রচারক দলের তিরোধানেও উহা বিনষ্ট হইবে না। বিষয়টি যাহাতে যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা দৃঢ় ও মজবুত হয়, তজ্জন্য হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) এতদ্বিষয়ে হযরত উমর (রাঃ)-এর সহিত যথেষ্ট আলোচনা-পর্যালোচনা করিলেন। অতঃপর তিনি হযরত উমর (রাঃ)-এর সহিত ঐকমত্যে পৌছিলেন। অনুরূপভাবে হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও হযরত উমর ফারূক (রাঃ)-এর সহিত এতদ্বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করিলেন। অতঃপর তিনিও তাঁহাদের সহিত একমত হইলেন। উক্ত ঘটনা হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিতবহও বটে ।
হযরত হাসান বসরী (রঃ) হইতে ধারাবাহিকভাৱে ফুযালা, ইয়াযীদ ইব্ন মুবারক, আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন খাল্লাদ ও আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃ
“একদা হযরত উমর (রা) কুরআন মজীদের একটি আয়াত সম্বন্ধে কিছু মানুষের কাছে প্রশ্ন করিলেন। তাহারা বলিল, ‘আয়াতটি অমুক সাহাবীর স্মৃতিতে সংরক্ষিত ছিল। তিনি তো ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হইয়াছেন।’ হযরত উমর (রাঃ) বলিলেন— ‘ইন্না লিল্লাহি…. রাজিউন। অতঃপর তিনি সমগ্র কুরআন মজীদ সংগ্রহ ও একত্রিত করিতে আদেশ দিলেন। তদনুসারে উহা সংগৃহীত ও একত্রিকৃত হইল । এইরূপে হযরত উমর (রাঃ)-ই সমগ্র কুরআন মজীদ সর্বপ্রথম সংগৃহীত ও একত্রিত করিবার ব্যবস্থা করেন।”
উপরোক্ত বর্ণনার সনদ বিচ্ছিন্ন। কারণ, সনদের প্রথম রাবী হযরত হাসান বসরী হযরত উমর (রাঃ)-এর সহিত সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারেন নাই। বর্ণনায় হযরত উমর (রাঃ)-কে যে কুরআন মজীদের সংগ্রহ ও সংকলনের ব্যবস্থাপক হিসাবে উল্লেখ করা হইয়াছে, উহার তাৎপর্য এই যে, তিনি উহার সংগ্রহ ও সংকলনের পরামর্শদাতা এবং প্রস্তাবক ছিলেন ।
অনুরূপ অর্থ ইয়াহিয়া ইব্ন আব্দুর রহমান ইব্ন হাতিম হইতে ধারাবাহিকভাবে আলকামা, মুহাম্মদ ইব্ন আমর, আমর ইব্ন তালহা লায়ছী, ইব্ন ওহাব, আবূ তাহের ও ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘কুরআন মজীদ একত্রিকরণের সময়ে হযরত উমর (রাঃ) দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্য ব্যতিরেকে কোন আয়াত বা কোন অংশই কাহারও নিকট হইতে গ্রহণ করিতেন না। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর পক্ষ হইতে তাঁহার প্রতি উক্তরূপ নির্দেশ ছিল।’ অনুরূপ অর্থে উরওয়াহ হইতে ধারাবাহিকভাবে তৎপুত্র হিশাম, ইব্ন আবূ যানাদ, ইব্ন ওহাব, আবূ তাহের ও আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেন।
‘ইয়ামামার যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক হাফিজ সাহাবী শহীদ হইলে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) আশংকা করিলেন যে, এইভাবে হাফিজ সাহাবী শহীদ হইলে কুরআন মজীদ বিনষ্ট হইতে পারে। অতএব তিনি হযরত উমর (রাঃ) ও হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ)-কে বলিলেন- দুইজন সাক্ষীসহ কুরআন মজীদের কোনো অংশ কেহ তোমাদের নিকট উপস্থাপন করিলে তোমরা উহা গ্রহণ করত লিখিয়া লইবে।’ উক্ত বর্ণনার সনদ বিচ্ছিন্ন হইলেও উহা গ্রহণযোগ্য ।
হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) বলেনঃ ‘আমি সূরা তওবা’র শেষাংশঃ
لَقْدجاَئُكْمرُسوٌلمْنأْنُفِسُكمالىاخرالسورة ‘আবূ খুযায়মা আনসারী (রাঃ)-এর নিকট পাইয়াছি। বর্ণনাস্তরে তাঁহাকে খুযায়মা ইব্ন ছাবিত বলা হইয়াছে। আল্লাহর রাসূল উক্ত সাহাবীর একক সাক্ষ্যকে দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের সমান মর্যাদা প্রদান করিয়াছেন। উক্ত আয়াতদ্বয় আমি অন্য কাহারও নিকট লিখিত আকারে পাই নাই ৷
‘একদা নবী করীম (সাঃ) জনৈক বেদুইনের নিকট হইতে একটি অশ্ব ক্রয় করেন। সে অশ্ব বিক্রয়ের কথা অস্বীকার করিয়া বসে। হযরত খুযায়মা (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর অনুকূলে বেদুইনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করেন। নবী করীম (সাঃ) তাঁহার সাক্ষ্যকে দুইজন সাক্ষীর সমতুল্য ধরিয়া উহা গ্রহণ করেন এবং কৃত অশ্বটি বেদুইনের নিকট হইতে স্বীয় অধিকারে আনয়ন করেন।’ ‘সুনান’ সংকলনসমূহের সংকলকগণ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কর্তৃক উপরোক্ত সাহাবীর একক সাক্ষ্যকে দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের মর্যাদা প্রদত্ত হইবার উপরোল্লেখিত ঘটনা রিওয়ায়েত করিয়াছেন। উহা একটি বিখ্যাত রিওয়ায়েত।
আবুল আলীয়া হইতে ধারাবাহিকভাবে রবী’ ও আবূ জা’ফর (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেন যে, আবুল আলীয়া বলেনঃ উক্ত আয়াতদ্বয় হযরত খুযায়মা ইব্ন ছাবিত (রাঃ)-এর সহিত হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) ও স্বীয় পাণ্ডুলিপি হইতে লোকদিগকে শুনাইয়াছিলেন।’
ইয়াহিয়া ইব্ন আবদুর রহমান ইব্ন হাতিম হইতে ধারাবাহিকভাবে মুহাম্মদ ইব্ন আমর ইব্ন আলকামা, আমর ইব্ন তালহা লায়ছী ও ইব্ন ওহাব বর্ণনা করিয়াছেন যে, ইয়াহিয়া বলেনঃ হযরত উসমান (রাঃ)-ও উক্ত আয়াতদ্বয়ের ব্যাপারে (হযরত খুযায়মা (রাঃ)-এর পক্ষে) সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিলেন।
উপরে বর্ণিত রিওয়ায়েতে হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ)-এর বক্তব্য নিম্নরূপে বর্ণিত হইয়াছেঃ
فتتبعت القرآن اجمعه من العسب واللخاف وصدور الرجال
কোনও কোনও রিওয়ায়েতে তাঁহার উক্তি এইরূপে বর্ণিত হইয়াছেঃ
فتتبعت القرآن اجمعه من الاكتاف والاقتاب وصدور الرجال
কোনও কোনও রিওয়ায়েতে তাঁহার উক্তি এইরূপে বর্ণিত হইয়াছেঃ
فتتبعت القرآن اجمعه من العسب والرقاع والاضلاع
রিওয়ায়েতে উল্লেখিত عسب শব্দটি হইতেছে عسيب শব্দের বহুবচন। আবূ নাসর ইসমাঈল ইব্ন হাম্মাদ জাওহারী বলেন- عسب শব্দটির সহিত سعف শব্দটির কিছুটা অর্থগত মিল রহিয়াছে। عسيب হইল খর্জুর বৃক্ষের শাখার গোড়ার অংশ যাহাতে পত্র থাকে না। পক্ষান্তরে سعفة হইল سعف শব্দের একবচন- খর্জুর বৃক্ষের শাখার অগ্রভাগ যাহাতে পত্র থাকে। اللخاف শব্দটি اللخفة শব্দের বহুবচন। اللخفة অর্থ চেপ্টা পাতলা পাথর।
সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর পবিত্র মুখে কুরআন মজীদের আয়াত শুনিয়া উহা উপরোক্ত বস্তুসমূহের উপর লিখিয়া রাখিতেন।
অনেক সাহাবী লেখাপড়া জানিতেন না। তাঁহারা এবং অক্ষর-জ্ঞান সম্পন্ন কেহ কেহ স্বীয় স্মৃতিতে কুরআন মজীদ ধরিয়া রাখিতেন। হযরত যায়দ (রাঃ) স্বীয় দায়িত্ব পালনে পশুর প্রশস্ত অস্থি, প্রশস্ত পাতলা প্রস্তর ফলক, প্রশস্ত খর্জুর শাখা এবং মানুষের স্মৃতি হইতে সমগ্র কুরআন মজীদ সংগ্রহ করেন। আরব জাতি ছিল আমানত রক্ষা ও উহা যথাস্থানে পৌঁছাইয়া দিবার কর্তব্যে নিষ্ঠাবান। বলাবাহুল্য, কুরআন মজীদ ছিল নবী করীম (সাঃ) কর্তৃক তাঁহাদের নিকট রক্ষিত সর্বশ্রেষ্ঠ আমানত ৷
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
يايها الرسول بِلِغْ ما انزل اليك من ربك অর্থাৎ ‘হে রাসূল। তোমার প্রভু হইতে যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে তাহা পৌঁছাও।’
আল্লাহ্র রাসূলও উহা লোকদের নিকট পৌঁছাইয়া দিয়া স্বীয় দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করিয়াছেন । তেমনি সাহাবায়ে কিরামও পরবর্তী লোকদের নিকট উহা পৌছাইয়া দিয়া তাঁহাদের নিকট রক্ষিত আমানত সম্পর্কিত কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করিয়াছেন।
বিদায় হজ্জে আরাফাতের ময়দানে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এবং সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ)-এর মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রশ্নোত্তর এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। আরাফাতের ময়দানে সাহাবীদের বৃহত্তম সমাবেশে মানব ইতিহাসের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা প্রদান শেষে নবী করীম (সাঃ) সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলিলেন- তোমরা আমার সম্বন্ধে নিশ্চয় জিজ্ঞাসিত হইবে ৷ তোমরা তখন কি উত্তর দিবে? তাঁহারা আরয করিলেন- আমরা সাক্ষ্য প্রদান করিব, আপনি নিশ্চয় পৌছাইয়া দিয়াছেন, স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন করিয়াছেন এবং মঙ্গলকর উপদেশ প্রদান করিয়াছেন। নবী করীম (সাঃ) আকাশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন- “প্রভু হে ! সাক্ষী থাকিও ! প্রভু হে ! সাক্ষী থাকিও !! প্রভু হে ! সাক্ষী থাকিও !!!” ইমাম মুসলিম হযরত জাবির (রাঃ) হইতে উপরোক্ত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
নবী করীম (সাঃ) স্বীয় উম্মতকে আদেশ দিয়াছেন- উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট কুরআন-সুন্নাহ তথা দীন ইসলামকে পৌঁছাইয়া দেয়। তিনি আরও বলিয়াছেন— তোমরা আমার পক্ষ হইতে একটি আয়াত হইলেও পৌছাইয়া দাও। অর্থাৎ তোমাদের কাহারও নিকট যদি একটি আয়াত ব্যতীত কিছুই না থাকে, তথাপি সে যেন উহা মানুষের নিকট পৌঁছাইয়া দেয়।
সাহাবায়ে কিরাম রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর উপরোক্ত আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছেন । তাঁহারা কুরআন মজীদকে কুরআন মজীদ হিসাবে এবং পবিত্র সুন্নাহকে পবিত্র সুন্নাহ হিসাবে মানুষের নিকট পৌঁছাইয়া দিয়াছেন। তাঁহারা একটিকে অন্যটির সহিত মিলাইয়া ফেলেন নাই। কুরআন মজীদ এবং পবিত্র সুন্নাহ যাহাতে পরস্পর মিলিয়া না যায়, তজ্জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) সাহাবীদিগকে নির্দেশ দিয়াছিলেন, তোমাদের মধ্য হইতে কেহ আমার নিকট হইতে কুরআন মজীদ ভিন্ন অন্য কিছু লিখিয়া লইয়া থাকিলে সে যেন উহা মুছিয়া ফেলে। উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর উপরোক্ত আদেশের তাৎপর্য কোনক্রমে ইহা হইতে পারে না যে, তিনি পবিত্র সুন্নাহকে হিফাজত করা হইতে বিরত থাকিতে সাহাবীদিগকে আদেশ করিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে কুরআন মজীদকে পবিত্র সুন্নাহ হইতে পৃথক রাখিবার উদ্দেশ্যই নবী করীম (সাঃ) উপরোক্ত আদেশ দিয়াছিলেন। নবী করীম (সাঃ)-এর আদেশের ফলে কুরআন মজীদের কোন অংশ উহার সংকলন হইতে যেমন বাদ পড়ে নাই, তেমনি পবিত্র সুন্নাহর কোন অংশ উহার সংকলনে প্রক্ষিপ্ত হইতে পারে নাই। এই জন্য সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর প্রাপ্য ৷
নবী করীম (সাঃ)-এর উপরোক্ত উদ্দেশ্য পরিপূরণের জন্যই হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) এবং হযরত উমর (রাঃ) কুরআন মজীদ সংগ্রহ ও সংকলন করিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর জীবদ্দশায় কুরআন মজীদের উপরোক্ত সংকলন তাঁহার নিকট সংরক্ষিত ছিল। তাঁহার ইন্তেকালের পর উহা হযরত উমর (রাঃ)-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল। হযরত হাফসা (রাঃ) হযরত উমর (রাঃ)-এর নিকট রক্ষিত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারিণী হিসাবে উহা হিফাজত করিয়াছিলেন। তাঁহার নিকট হইতে উহা হযরত উসমান (রাঃ) গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে আমরা ইনশা আল্লাহ্ শীঘ্রই আলোচনা করিতেছি।