কেমন আছেন প্রফেসর সাহেব?

আমি মনের বিরক্তি গোপন করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে বললাম, জী ভালো আছি।

ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, বসব খানিকক্ষণ?

জী বসুন। আমি অবশ্যি কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরুব।

আমাকে কি চিনতে পারছেন?

জী না।

ঐ যে মোড়ের সিগারেটের দোকানের সামনে আলাপ হলো। আপনি সিগারেট কিনছিলেন, আমি পান।

আমি ভদ্রলোককে চিনতে পারলাম না। মোড়ের পানের দোকানে সামান্য আলাপের পর সারাজীবন চিনে রাখব আমার স্মৃতিশক্তি এত ভালো নয়। ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, আমার নাম আলিমুজ্জামান। পোস্টাল সার্ভিসে ছিলাম, তিন বছর আগে রিটায়ার করেছি। এইটথ মে মঙ্গলবার। এখন ঘরেই থাকি, একটা বাগান করেছি।

ভালো, খুবই ভালো।

ভদ্রলোক সোফায় বসেছেন। কৌতূহলী চোখে চারদিক দেখছেন। বারবার আমার বইয়ের আলমিরায় তাঁর চোখ আটকে যাচ্ছে। আমি শঙ্কিত বোধ করছি। এখনই হয়তো বলবেন, আপনার তো অনেক বই, কয়েকটা নিয়ে যাই। পড়ে ফেরত দেব।

আমি এখন পর্যন্ত কাউকে দেখিনি যে বই পড়ে ফেরত দেয়। ইনিও দেবেন তা মনে হয় না। বই নেয়ার ছুতায় রোজ এসে বিরক্ত করবেন। আমি এমন কোনো মিশুক লোক না যে এই বুড়োমানুষটির সঙ্গ পছন্দ করব।

প্রফেসর সাহেব, আপনি কি ভূত-প্রেত এইসব বিশ্বাস করেন?

জী না, করি না।

শুনে ভালো লাগল। আজকাল শিক্ষিত লোক দেখি এইসব বিশ্বাস করে। মনটা খারাপ হয়। মানুষ চাঁদে যাচ্ছে সেটা বিশ্বাস করছে আবার ভূতও বিশ্বাস করছে। ফিজিক্সের এক প্রফেসরের হাতে দেখেছি চারটা পাথরের আংটি।

আমি চুপ করে রইলাম। আমার কাছ থেকে উত্তর না পেলে ভদ্রলোকের আলাপের উৎসাহ হয়তো কমে যাবে। তিনি বিদায় হবেন।

প্রফেসর সাহেব!

জী।

আপনি কি কো-ইনসিডেন্সে বিশ্বাস করেন?

আপনার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

কাকতালীয় ঘটনা।

আমি এখনও আপনার প্রশ্নটা বুঝতে পারছি না।

আরেকদিন আপনাকে বলব, আজ মনে হচ্ছে আপনি একটু বিরক্ত। তবে ঘটনাটা বলা শুরু করলে আপনার বিরক্তি কেটে যেত।

আমি ভদ্রলোকের কথায় সত্যিকার অর্থেই লজ্জিত বোধ করলাম। আমি বিরক্ত নিশ্চয়ই হয়েছি, কিন্তু সেই বিরক্তি উনি ধরে ফেলবেন তা বুঝতে পারিনি। রিটায়ার্ড মানুষ। একা একা থাকেন। কথা বলার সঙ্গী তো তাঁদেরই দরকার।

প্রফেসর সাহেব উঠি।

উঠবেন?

জী। আজকাল কোথাও বেশিক্ষণ বসি না। রিটায়ার্ড মানুষদের কেউ পছন্দ করে না। সবাই ভাবে সময় নষ্ট করার জন্যে গিয়েছি। তা ছাড়া মানুষদের সঙ্গ আমি নিজেও যে খুব পছন্দ করি তা না।

আপনি আসবেন, আপনার সঙ্গে গল্প করব। কোনো অসুবিধা নেই। আজ অবশ্যি একটু ব্যস্ত।

গল্পগুজব আমি তেমন পারি না। কো-ইনসিডেন্সের একটা ব্যাপার আমার জীবনে আছে— ঐ গল্পটা ছাড়া আমি কোনো গল্প জানি না। গল্পটা খুব ব্যক্তিগত, এই জীবনে অল্প কয়েকজনকে বলেছি। আপনাকে কেন জানি বলার ইচ্ছা করছিল।

অবশ্যই বলবেন।

আপনি যদি দয়া করে একটু বারান্দায় আসেন তাহলে আমার বাসাটা আপনাকে দেখাতাম, হঠাৎ কোনো একদিন চলে এলে ভালো লাগত!

আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোক হাত উঁচু করে দেয়াল দিয়ে ঘেরা একতলা একটি বাড়ি দেখালেন। পুরনো বাড়ি। দোতলার কাজ শুরু করা হয়েছিল শেষ হয়নি। বাড়ির সামনে দুটা জড়াজড়ি কাঁঠাল গাছ।

একদিন যদি আসেন আপনার ভালো লাগবে। আমার জীবনের কোইনসিডেন্সের ঘটনাটাও শুনবেন।

জী আচ্ছা একদিন যাব।

আমার নামটা আপনার মনে আছে তো?

জী আছে।

নামটা বলুন তো!

আমি দ্বিতীয়বার লজ্জা পেলাম। কারণ ভদ্রলোকের নাম কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।

ভদ্রলোকের স্বভাবও এমন বিচিত্র যে আমার লজ্জা বুঝতে পেরেও জবাবের জন্যে মাথা নিচু করে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

নামটা বোধহয় আপনার মনে পড়ছে না তা-ই না?

জী না।

মনে থাকার কথাও না। আনকমন নাম মানুষের মনে থাকে। আমার নাম খুবই কমন— আলিমুজ্জামান। একদিন আসবেন আমার বাসায় দয়া করে। ঘটনাটা বলব, শুনতে আপনার খারাপ লাগবে না।

জী আচ্ছা, আমি যাব। খুব শিগগিরই একদিন যাব।

এক বৃহস্পতিবার বিকেলে ভদ্রলোকের বাসায় উপস্থিত হলাম। গল্প শোনার আগ্রহে নয়, লজ্জা কাটানোর জন্যে। ভদ্রলোক ঐদিন আমাকে খুব লজ্জায় ফেলেছিলেন।

বাসায় ঢুকে আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। সাধারণ একটা বসার ঘর। বেতের কয়েকটা চেয়ার। দেয়ালজুড়ে বইয়ের আলমিরা। খুব কম করে হলেও হাজার পনেরো বই ভদ্রলোকের সংগ্রহে আছে। কারো ব্যক্তিগত সংগ্রহে এত বই থাকে আমার জানা ছিল না। নিজের অজান্তেই আমি বললাম–অপূর্ব!

ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন–বলেছিলাম না আমার বাসায় এলে আপনার ভালো লাগবে।

আপনার বইয়ের সংখ্যা কত?

ষোলো হাজারের কিছু বেশি। আমার শোবার ঘরেও বেশকিছু বই। আপনাকে দেখাব।

সব আপনার নিজের সংগ্রহ?

আমার বাবার সংগ্রহ অনেক আছে। বই কেনার বাতিক বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। খুব বইপাগল লোক ছিলেন। খুব বই পড়তেন। আমি তাঁর মতো পড়তে পারি না। অনেক বই আছে, আমি কিনে রেখেছি, এখনও পড়িনি।

এখন তো প্রচুর অবসর। এখন নিশ্চয় পড়ছেন।

আমার চোখের সমস্যা আছে। খুব বেশিক্ষণ একনাগাড়ে পড়তে পারি না। আমি খুব খুশি হব যদি আমার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আপনি পড়েন। বই তো পড়ার জন্যেই। আলমিরায় সাজিয়ে রাখার জন্যে না।

আপনি কি সবাইকে বই পড়তে দেন?

জী দিই।

তারা বই ফেরত দেয়?

অনেকেই দেয় না। সেইসব পরে কিনে ফেলি। আমার সংসার ছোট। একটামাত্র মেয়ে, স্ত্রী মারা গেছেন। সংসারের তুলনায় টাকা-পয়সা ভালোই আছে। বই কেনায় একটা অংশ ব্যয় করি। আপনি ঘুরে ঘুরে বই দেখুন, আমি চা নিয়ে আসছি।

চা লাগবে না।

কেন লাগবে না? চা খেতে খেতে গল্প করব। আমার ঘটনাটা আপনাকে বলব। আপনাকে বলার জন্যে আমি একধরনের আগ্রহ অনুভব করছি।

কেন বলুন তো?

আপনি বিজ্ঞানের মানুষ। আপনি শুনলে একটা ব্যাখ্যা হয়তো দাঁড় করাতে পারবেন। অবিশ্যি ব্যাখ্যার জন্যে আমি খুব ব্যস্তও না। প্রতিটি বিষয়ের পেছনে একটা কার্যকারণ যে থাকতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। আমরা কোত্থেকে এসেছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি— এই বিষয়গুলোর তো এখনও মীমাংসা হয়নি, কী বলেন প্রফেসর সাহেব…

অন্য সময় হলে এই ভদ্রলোকের কথায় আমি তেমন কোনো গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু যার বাড়িতে বইয়ের সংখ্যা ষোলো হাজার তাঁর কথা মন দিয়ে শুনতে হয়। তাঁর তুচ্ছতম কথাও আগ্রাহ্য করা যায় না।

ভদ্রলোকের গল্প সেই কারণেই অতি আগ্রহ নিয়ে শুনলাম। যেভাবে শুনেছি ঠিক সেইভাবে বলার চেষ্টা করছি। ভদ্রলোক গল্পের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে ইংরেজিতে বলা শুরু করেছেন। আমি তা করছি না। কোনোরকম ব্যাখ্যা বা টীকা-টিপ্পনীও দিচ্ছি না। পুরোটা পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি।

ভাই ঘটনাটা তা হলে বলা শুরু করি।

কিছু-কিছু মানুষ আছে পশুপ্রেমিক। কুকুর-বেড়াল, গরু-ভেড়া এইসব জস্তুর প্রতি তাদের অসাধারণ মমতা। রাস্তায় একজন ভিখিরি চিৎকার করে কাঁদলে সে ভিখিরির কাছে এগিয়ে যাবে না, কিন্তু একটা বিড়াল কুঁইকুই করে কাঁদলে ছুটে যাবে, বিড়ালটাকে পানি খাওয়াবে।

আপনাকে শুরুতেই বলে রাখি, আমি এরকম কোনো পশুপ্রেমিক না। কুকুর বেড়াল এইসব আমার অপছন্দের প্রাণী। একটা গরু বা ভেড়ার গায়ে আমি হাত দিতে পারি কিন্তু কুকুর বা বেড়ালের গায়ে হাত দিতে আমার ঘেন্না লাগে। তা ছাড়া ডিপথেরিয়া, জলাতঙ্ক এইসব অসুখ এদের মাধ্যমে ছড়ায় এটাও আমি সবসময় মনে রাখি।

যা-ই হোক, মূল গল্পে ফিরে যাই। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। শীতকাল। কলেজে প্র্যাকটিক্যাল শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তখন পড়ি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। আমাদের বাসা ঠাকুরপাড়ায়।

একদিন বাসায় ফিরছি। দিনটা মনে আছে, বুধবার। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। গায়ে গরম কাপড় ছিল না। প্রচণ্ড শীত লাগছে। বাসার কাছাকাছি এসে দেখি পাড়ার তিন-চারটা ছেলে কাগজ, শুকনো কাঠ এইসব জড়ো করে আগুন করছে। আমাদের সামনের বাসার নান্টুকেও দেখা গেল। মহা তঁাদড় ছেলে। তার হাতে একটা কুকুরছানা। ছানাটার গায়ে কাপড় জড়ানো—শুধু মুখ বের হয়ে আছে। কুকুরছানা আরামে কুঁইকুঁই করছে।

আমি বললাম, কী হচ্ছে রে নান্টু?

নান্টু দাঁত বের করে হাসল। অন্য একজন বলল, নান্টু কুকুরকে কম্বল পরিয়েছে। শীত লাগে তো এইজন্যে। দলের বাকি সবাই হোহো করে হেসে উঠল। ছেলেগুলির বয়স দশ থেকে এগারোর মধ্যে। এই বয়সের বালকরা সবসময় খুব আনন্দে থাকে। নানা জায়গা থেকে আনন্দের উপকরণ সংগ্রহ করে। কুকুরকে কাপড় দিয়ে মোড়া হয়েছে এতেই তাদের আনন্দের সীমা নেই।

মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি হচ্ছে আনন্দে অংশগ্রহণ করা। আমি ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম আমার এগিয়ে যাওয়াটা কেউ তেমন পছন্দ করছে না। মুখ-চাওয়াচাওয়ি করছে। হয়তো তারা চায় না ছোটদের খেলায় বড়রা অংশগ্রহণ করুক। নান্টুকে খুবই বিরক্ত মনে হলো।

ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ানোমাত্র কেরোসিনের গন্ধ পেলাম। হয়তো বাসা থেকে কেরোসিন এনে কেরোসিন ঢেলে আগুন করেছে। বালকরা কায়দাকানুন করতে খুব ভালোবাসে।

কেরোসিন দিয়েছিস নাকি?

কেউ কোনো জবাব দিল না। নান্টুর মুখ কঠিন হয়ে গেল। আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। নান্টু বলল, আপনি চলে যান। তার গলা কঠিন। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তাকিয়ে দেখি নান্টুর কোলের কুকুরছানা ভিজে চুপচুপ করছে। বুকটা ধক করে উঠল। এরা ছানাটার গায়ের কাপড় কেরোসিন দিয়ে চুবিয়েছে নাকি? নতুন কোনো খেলা? একে আগুনে ছেড়ে দেবে না তো? শিশুরা মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠে। আমি কড়া গলায় বললাম, এই নান্টু, তুই কুকুরটার গায়ে কেরোসিন ঢেলেছিস?

নান্টু কঠিন মুখে বলল, তাতে আপনার কী?

কেন কেরোসিন ঢালবি?

নান্টু কিছু বলল না। অন্য একজন বলল, কুকুরটা আগুনের মধ্যে ছাড়বে। এর গলায় ঘুঙুর বাঁধা আছে। আগুনে ছাড়লে এর গায়ে আগুন লাগবে আর সে দৌড়াবে। ঘুঙুর বাজবে। যত তাড়াতাড়ি দৌড়াবে তত তাড়াতাড়ি ঘুঙুর বাজবে। এইটাই মজা।

আমি হতভম্ব, এরা বলে কী! ছেলেটার কথা শেষ হবার আগেই নান্টু কুকুরছানাটা আগুনে ফেলে দিল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। কুকুরছানা দৌড়াল না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। হয়তোবা মানুষের নিষ্ঠুরতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।

আমি আগুনের উপর লাফিয়ে পড়লাম। আমার শার্টে আগুন ধরে গেল। প্যান্টে আগুন ধরে গেল। এইসব কিছুই গ্রাহ্য করলাম না। আমার একমাত্র চিন্তা বাচ্চাটাকে আগুন থেকে বের করতে হবে।

আলিমুজ্জামান সাহেব থামলেন।

আমি বললাম, বের করতে পেরেছিলেন?

হ্যাঁ।

বাচ্চাটা বেঁচেছিল?

না বাঁচেনি। বাঁচার কথাও না। আমার গায়ে থার্ড ডিগ্রি বার্ন হয়ে গেল। কুমিল্লা মেডিক্যালে কিছুদিন থাকলাম, তারপর আমাকে পাঠানো হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। দুমাসের ওপর হাসপাতালে থাকতে হবে। এক পর্যায়ে ডাক্তাররা আমাকে বাঁচানোর আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। সেই সময় বার্ন-এর চিকিৎসার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। স্কিন গ্রাফটিং হতো না। অল্পতেই শরীরে ইনফেকশন হয়ে যেত। যা-ই হোক, বেঁচে গেলাম, তবে সেই বছর পরীক্ষা দিতে পারলাম না।

আলিমুজ্জামান নিশ্বাস নেবার জন্যে থামামাত্র আমি বললাম, আপনি একজন অসাধারণ মানুষ!

মোটেই না। আমাকে বোকা বলতে পারেন। সামান্য একটা কুকুরছানার জন্যে নিজের জীবন যেতে বসেছিল। তখন সবাই আমার বোকামির কথাটা আলোচনা করত। আমার নিজেরও মাঝে মাঝে মনে হয়েছে হয়তো বোকামিই করেছি। একজন মানুষের জীবন কুকুরের জীবনের চেয়ে অবশ্যই মূল্যবান।

আপনার গল্প শুনে মুগ্ধ হয়েছি।

এটা কিন্তু গল্প না। এটা গল্পের ভূমিকা, মূল গল্প এখন বলব।

ঢাকা থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছি। শরীর তখনও খুব দুর্বল। ডাক্তার বলে দিয়েছে প্রচুর রেস্ট নিতে। শুয়েবসেই দিন কাটছে। আমার ঘর দোতলায়। মাথার কাছে বিরাট জানালা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শুয়ে থাকতে খুব খারাপ লাগে না।

এক রাতের কথা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ফকফকে জ্যোৎস্না। এই জ্যোৎস্নায় অদ্ভুত একটা দৃশ্য চোখে পড়ল। রাজ্যের কুকুর এসে জড়ো হয়েছে বাসার সামনে। কেউ কোনো সাড়াশব্দ করছে না বা ছোটাছুটি করছে না। সবকটা মূর্তির মতো বসে আছে। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ব্যাপারটা কী?

একসঙ্গে এতগুলি কুকুর আমি আগে কখনো দেখিনি। এদের এইজাতীয় আচরণের কথাও শুনিনি। আমাকে তাকাতে দেখে এরা সবাই মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল।

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখি হঠাৎ তাদের মধ্যে একধরনের চাঞ্চল্য দেখা গেল। এরা একে একে চলে গেল। যেন ওদের কোনো গোপন অনুষ্ঠান ছিল, অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে, এখন চলে যাচ্ছে।

এই ব্যাপার মাঝে মাঝে ঘটতে লাগল। নির্দিষ্ট কোনো সময় না। মাসে একবার কিংবা দুমাসে একবার এরকম হয়।

এরকম একটা ঘটনা চাপা থাকার কথা নয়। সবাই জেনে গেল। অনেকেই দুপুর রাতে কুকুরের দল দেখতে আসত। খবরের কাগজেও ঘটনাটা উঠেছিল। দৈনিক আজাদে হেডলাইন ছিল— কুকুরের কাণ্ড।

আমার ছোট বোন আমাকে খুব খ্যাপাত। সে বলত কুকুরের জন্যে তুমি জীবন দিতে যাচ্ছিলে— কাজেই তারা তোমাকে তাদের রাজা বানিয়েছে। তুমি হচ্ছ কুকুর-রাজা।

আমার বাবা পরের বছর বদলি হয়ে পাবনা চলে গেলেন। আমিও বাবার সাথে গেলাম। সেখানেও একই কাণ্ড–এক মাস দুমাস পরপর হঠাৎ রাজ্যের কুকুর বাসার সামনে এসে জড়ো হয়, মূর্তির মতো চুপচাপ বসে থাকে। একবার আমার চোখ পড়ামাত্র মাথা নিচু করে চলে যায়। যেখানে গিয়েছি এই কাণ্ড ঘটছে। যেন কোনো-এক অদ্ভুত উপায়ে কুকুররা আমার খবর পৌছে দিয়েছে। শুধু তা-ই না, আমার মনে হয় কুকুররা আমাকে পাহারা দেয়। আমি যখন রাস্তায় হাঁটি, একটা-দুটা কুকুর সবসময় আমার সঙ্গে থাকে।

আজ আমার বয়স সাতষট্টি। তবে কুকুরের সভা আগের মতো ঘনঘন হয় না। ছমাসে, এক বছরে একবার হয়। তবে হয়। কুকুরের ভাষা আমি জানি না। জানলে জিজ্ঞেস করতাম–তোমরা কী চাও? এইসব কেন তোমরা কর?

ব্যাপারটা কি আপনার পছন্দ হয় না?

না, পছন্দ হয় না। একদিন দুদিনের ব্যাপার হলে হয়তো পছন্দ হতো। একদিন দুদিনের ব্যাপার তো নয়। দিনের পর দিন ঘটছে।

ভবিষ্যতে আবারও হবে বলে কি আপনার ধারণা?

হ্যাঁ হবে। আজ রাতেও হতে পারে। আপনি দেখতে চান?

বলতে বলতে আলিমুজ্জামান সাহেবের চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল। যেন তিনি প্রচণ্ড রাগ করছেন। যেন এই মুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠবেন।

আমি বললাম, আপনি মনে হয় পুরো ব্যাপারটায় খুব আপসেট। এত আপসেট হবার কিছু নেই। পশুরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে— এতে রাগ হবার কী আছে! কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অধিকার নিশ্চয়ই পশুদেরও আছে।

এটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোনো ব্যাপার নয়। এটা একটা ভৌতিক ব্যাপার। সুপার ন্যাচারাল ব্যাপার।

এর মধ্যে সুপার ন্যাচারালের অংশ কোনটি?

পুরো ব্যাপারটিই সুপার ন্যাচারাল। এই অংশটি আপনাকে বলিনি বলে আপনি বুঝতে পারছেন না।

বলুন শুনি।

যে-কুকুরছানাটিকে আমি বাঁচাতে চেয়েছিলাম সেই কুকুরছানাটি দলটার মধ্যে সবসময় থাকে। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া একটা কুকুর। গলায় ঘুঙুর বাঁধা। কুকুরছানাটা মাথা দোলায় আর ঘুঙুরের শব্দ হয়।

আপনি ছাড়া অন্যরাও কি এই কুকুরছানাটা দেখে?

না, আর কেউ দেখতে পায় না। শুধু আমি দেখতে পাই। দেখুন ভাই, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র না। আমার বিষয় ইতিহাস। তবু অবৈজ্ঞানিক কোনোকিছু আমি আমার জীবনে গ্রহণ করিনি। ভূত-প্রেত, ঝাড়-ফুক, পীরফকির কিছুই না, অথচ সেই আমাকে কিনা সারাজীবন একটি অতিপ্রাকৃত বিষয় হজম করে যেতে হচ্ছে।

আমি বললাম, আবার কখনো এরকম কিছু হলে আপনি দয়া করে আমাকে খবর দেবেন। তিনি জবাব দিলেন না।

আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম, তার পাঁচ মাস পর রাত দুটোয় টেলিফোন বেজে উঠল। আলিমুজ্জামান সাহেব টেলিফোন করেছেন। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ওরা এসেছে। আপনি কি আসবেন?

শ্রাবণ মাসের রাত। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ির বাইরে পা দিলেই এক-হাঁটু পানি। এমন দুর্যোগের রাতে কোথাও যাবার প্রশ্নই ওঠে না। আমি টেলিফোন নামিয়ে বিছানায় চাদরের নিচে ঢুকে পড়লাম।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x