বাবা সিলেটের আলতাফ আলী আর ডা. মালিকের নেতৃত্বে জাহাজী শ্রমিকের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে পুলিশের হাতে নাজেহাল হয়েছিলেন। বাড়িতে এসে ছয়-সাত মাস চাষ আবাদের কাজে নিয়োজিত থাকতেন। আবার ডাক এলে চলে যেতেন। আমার কৃষক-শ্রমিক বাবার জন্য আমি এখনো গৌরববোধ করি। জীবনে কারো কাছে তিনি হাত পাতেননি। বিধবা মা আর দুটি নাবালক ভাইকে নিয়ে নিজের ভাগ্য নিজে গড়েছেন, জায়গা-জমি যা খরিদ করেছেন-সবই তিনি ভাইয়ের নামে। আমাকে আর আমার একমাত্র ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বার বার সাবধান করে দিয়েছেন। শিক্ষিত লোকদের কুসংস্কার সমাজের বেশী ক্ষতি করে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন।
আরজ আলী মাতুব্বরের চেহারা এবং চিন্তা-চেতনার মধ্যে আমি আমার বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতাম।
অবসর গ্রহণ করার পর আমার বাবা কেমন যেন হয়ে গেলেন। গ্রামে থাকতে থাকতে কুসংস্কারের বেড়িতে আটকা পড়ে গেলেন। বাবা আগে যা বলতেন, এখন ঠিক তার বিপরীত কাজ করতে লাগলেন। আকাশের মতো বিশাল এবং মহাসমুদ্রের মতো গভীরহৃদয় বাবা ক্রমে ক্রমে সংকুচিত হয়ে নোয়াখালীর অন্তর্গত বামনী এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লেন। বুঝতে দেরি হল না, মহাসমুদ্রের তিমি ডাঙ্গায় আটকা পড়েছে। তাগা-তাবিজ-তুমার এবং ঝারফুঁকে একটু একটু বিশ্বাস করেন। হাতে তসবি এবং পাঞ্জেগানা নামাজ পড়েন। আজকাল ছেলেপিলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বেদাতি কাজকর্মে লিপ্ত বলে অভিযোগ করেন। যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট হলে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনেছেন বলে গৌরববোধ করতেন, নজরুলের গান তাঁর স্বকন্ঠে শুনেছেন বলে বর্ণনা করেছেন, সেই বাবা ঐসব হিন্দুয়ানী কবি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা অপছন্দ করতে শুরু করলেন।
বুঝলাম, আমার বাবা হারিয়ে গেছেন।
বরিশাল থেকে ঢাকা এসে, সময়ে সময়ে বাসের হাতল ধরে, সাভারে আমার বাসায় আসেন একজন অশীতিপর বৃদ্ধ। আত্মীয়-স্বজন – এমনকি একজন প্রাক্তন সহকর্মীও নন। সাবাভাবিকভাবে আমার বাবার মনে প্রশ্ন জাগে, লোকটি কে? একদিন জিজ্ঞেস করাতে, আমতা আমতা করে বললাম, তিন বরিশালের একজন কৃষিজীবী। শহর থেকে ছয়-সাত মাইল দূরে থাকেন। মনে হল, বাবার মন থেকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব গেল না। আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সঙ্গে খাতির হল কেমন করে?
আর কোনরূপ রাখঢাক না করে মাতুব্বর সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্কের পটভূমি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলাম। তাঁর জীবন ও মনন সম্পর্কে ধারণা দিলাম তাঁকে। বললাম, বাবা, তাঁর দুইখানা প্রধান গ্রন্থ থেকে আপনাকে পড়ে শোনাই? অনুমতি পেয়ে ‘সত্যের সন্ধান’ ও ‘সৃষ্টি-রহস্য’ থেকে বিশেষ বিশেষ অংশ পড়ে শোনাতে লাগলাম। বাবা মুগ্ধ হয়ে শুনলেন। একসময় চোখ দুটো ছানাবড়া করে বললেন, একজন শিক্ষাদীক্ষাহীন কৃষক এমন লেখা লিখলো?
আমি বললাম, মাতুব্বর সাহেব স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। দীর্ঘ সত্তর বছর নিজে নিজে লেখাপড়া করে চারখানা বই লিখেছেন।
আমাকে আদেশের স্বরে বাবা বললেন, তোমাকে একটা কথা বলি, লোকটির সব কথার সঙ্গে সবাই হয়ত একমত হবে না, কিন্তু তাঁর কথার মধ্যে চিন্তা আছে, দর্শন আছে। রবীন্দ্রনাথ স্কুলে যাননি, নজরুল তোমাদের মতো এম. এ. পাশ করেননি, তবু তাঁদের সম্মান কত ওপরে!
আবার বললেন, গ্রাম্য কৃষক বলে অবহেলা করবে না। এতদূর থেকে অন্তরের টানে তোমার কাছে আসেন। তিনি বড়মাপের মানুষ। এমনিতেই মুসলমান সমাজে চিন্তাশীল মানুষের অভাব।
আনন্দে আমার মন উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, মনে হল অনেক দিন আমার হারানো বাবাকে এক ঝলকের জন্য পুনরায় আবিষ্কার করলাম।
একদিন দুপুরে বাসায় ফিরে দখি বাবা এবং আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব পাশাপাশি বসে আলাপ করছেন। দু’জনের আলোচনা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। উভয়ের চেহারা দেখে আমার তাই মনে হল।
দুপুরে খেতে বসার সময়ও দু’জন পাশাপাশি বসলেন। আমার বাবা অতি আন্তরিকতার সঙ্গে মাতুব্বর সাহেবের পাতে তরকারী তুলে দিচ্ছেন। খাওয়া শেষে বাবা বললেন, আপনি তো কিছুই খান না। নিন, দুধটুকু দিয়ে কলা মেখে আরেক মুঠ ভাত খান।
আমি মুচকি হাসলাম। আমার এই হাঁসির অর্থ দু’জনের কেউই জানলেন না। হঠাত মনে হল, আমার চোখের সামনে আমার দু’জন বাবা বসে আছেন।
আমার স্ত্রী অধ্যাপিকা হামিদা কাওসার সব সময় তাঁকে আমাদের অতি ঘনিষ্ঠ আপনজনের মতো গ্রহণ করতেন। তাঁর সেবা এবং যত্নের কোন সময় বিন্দুমাত্র ত্রুটি হতোনা। আমাদের বাসায় কাজী গোলাম কাদির সাহেবেরও একই রকম অভ্যর্থনা হতো। আমার পরিবার পরিজন সবার কাছে এঁরা দু’জন শুধুমাত্র বহিরাগত অতিথি হিসাবে পরিগণিত হতেন না। দীর্ঘ বিশ বছরের সম্পর্কে কখনো ছেদ পড়েনি। কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। মতান্তর ছিল বহু বিষয়ে, কিন্তু মনান্তর হয়নি মুহূর্তের জন্যও।
মাতুব্বর সাহেব একদিন অসুস্থ অধ্যক্ষ সাঈদুর রহমান সাহেবকে দেখতে গেলেন। সঙ্গে আমি। প্রথমে বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ডাক্তারের নিষেধ। পরে যখন খবর দেয়া হল, আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব এসেছেন সঙ্গে একজন বন্ধুকে নিয়ে – সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেলো। মাতুব্বর সাহেবকে কাছে পেয়ে ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে কথার অর্গল খুলে দিলেন। কিছুক্ষণ পর মাতুব্বর সাহেব আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অধ্যক্ষ সাঈদুর রহমান সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার বাড়িতে ঢুকতে ভূ করলো না?
আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে তিনি বললেন, আমার বাড়ির নাম ‘সংশয়’। এ বাড়িতে আসতে অনেকেই ভয় করে।
আমি বললাম, স্যার, আপনার বাড়িতে ঢুকতে আমার একটুও ভয় করেনি। কারণ যার সঙ্গে এসেছি তিনি আমার কাছে ‘সংশয়াতীত’ ব্যক্তি।
মাতুব্বর সাহেব মুচকি হেঁসে বললেন, এই অধ্যাপক শামসুল হকের কথা একদিন আপনাকে বলেছিলাম।
অধ্যক্ষ সাহেব স্মরণ করার চেষ্টা করে পরে বললেন, আপনি এর পর একা যখন খুশী আসবেন। আমি বললাম, ‘আপনি’ বললে, আসব না। আমি আপনার ছেলের বয়সী।
বললেন, সংশয়ের অর্থ বোঝ? সংশয় হল সব জ্ঞানের উৎস। আবার এসো-বলেই হাতের ওপর হাত রেখে আদর করে দিলেন।
আর কোন দিন অধ্যক্ষ সাঈদুর রহমান সাহেবের বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য হল না। আরজ আলী সাহেবকে একদিন বললাম, সাঈদুর রহমান সাহেবের সঙ্গে আপনার পরিচয় হল কেমন করে?
তিনি বললেন, সে অনেক কথা। আমি অনুরোধ করলাম সংক্ষেপে বলার জন্য। মাতুব্বর সাহেব বলতে লাগলেন, সম্ভবত পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে অথবা ষাট দশকের দিকে অথবা ষাট দশকের প্রথম দিকে মুলাদী যাচ্ছিলাম – জমি মাপার জন্য। দুই পাটির মধ্যে এক চোট মারপিট হয়ে গেছে। আরেক চোট খুনাখুনির পর্যায়ে যাবার আগে আমার কথা মনে পড়ল। উভয় তরফের আহ্বানে আমি চেইন আর কাগজ কলম নিয়ে নৌকাযোগে রওনা হলাম। নৌকার মধ্যে দেখলাম এক ভদ্রলোক একখানা বই পড়েছেন, নাম ‘মানবমনের আযাদী’। লেখক বিখ্যাত যৌনবিজ্ঞানী আবুল হাসনাত। আমি তাঁর কাছ থেকে বইখানির ঠিকানা এবং প্রাপ্তিস্থান লিখে নিলাম।
বাড়িতে ফিরে কয়েকদিন পর বইখানি যোগাড় করলাম। এই বইখানি আমাকে গভীরকভাবে নাড়া দেয়। ঠিক করলাম, তোপখানার হাসনাত সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আমার ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানির পাণ্ডুলিপি পড়তে দেবো।
মাতুব্বর সাহেব ঢাকা গিয়ে নিজে আর হাসনাত সাহেবের বাসায় গেলেন না। ডি. আই. টি-তে কর্মরত পুত্র খালেককে হাসনাত সাহেবের বাসায় পাণ্ডুলিপিসহ পাঠালেন। খালেক অতি সঙ্কোচের সঙ্গে তাঁর পিতার আকর্ষণহীন খাতায় লিখিত ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানি হাসনাত সাহেবের হাতে তুলে দিলেন। গ্রামের ‘অশিক্ষিত’ একজন কৃষকের লেখা হাসনাত সাহেবকে খুব বেশি আগ্রহী করে তুলতে পারল না। শুধু বললেন, কয়েকদিন পর এসে খবর নিও।
খালেক বলেছিলেন, আমার বাবা আপনার বই পড়েছেন এবং আপনার মতামত তাঁকে নাড়া দিয়েছে। তাতেও হাসনাত সাহেব আগ্রহী হলেন কিনা বোঝা গেলো না।
কয়েক সপ্তাহ পর খালেক আবার তাঁর বাবার লেখা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গেলেন। আবুল হাসনাত সাহেব তখনও পাণ্ডুলিপিটি ছুঁয়ে দেখেননি।
খালেকের মলিন মুখ দেখে সম্ভবত হাসনাত সাহেবের সহানুভূতি হল। বললেন, আগামীকাল বিকেলে এসো, দেখে রাখবো।
আরজ আলী সাহেব আমাকে বললেন, হাসনাত সাহেব প্রথম পরিচয়ে জিজ্ঞেস করলেন, লেখাটি আপনার নিজের? কি কাজ করেন?
মাতুব্বর সাহেব জবাবে বললেন যে, লেখাটি তাঁর নিজ হাতের এবং তিনি একজন কৃষক। আবুল হাসনাত সাহেব প্রসঙ্গক্রমে বললেন, আপনার বইটির কয়েক পাতা পড়ার পর শেষ হওয়া পর্যন্ত পায়চারি করে পড়েছি। আমার সঙ্গে চলুন, আমাদের একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেবো। আপনার লেখার যেখানে যেখানে দাগ দিয়েছি-সেই অংশগুলো পড়ে শোনাবেন।
মাতুব্বর সাহেবকে তিনি কোথায় এক বিরাট ড্রইংরুমে নিয়ে গেলেন তাঁর মনে পড়ে না। অনেক জ্ঞানী-গুণী উপবিষ্ট। সেই মলিনবেশ গ্রামের কৃষককে নিয়ে হাসনাত সাহেব তাঁদের ‘মিলন সঙ্ঘের’ ঘরোয়া আলোচনা অনুষ্ঠানে যখন প্রবেশ করলেন, সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আরজ আলী মাতুব্বর ভয় পেয়ে গেলেন।
হাসনাত সাহেব সবাইকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, আজ আমাদের নির্ধারিত আলোচ্যসূচী বাদ দিয়ে একটি নতুন এবং বিস্ময়কর বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। আমি সঙ্গে করে যে ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছি, তিনি বরিশাল শহরের কাছে লামচ্রিউ গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক। নিজের প্রচেষ্টায় তিনি প্রায় চল্লিশ বছর লেখাপড়া করে একখানা বই লিখেছেন। বইয়ের নাম রেখেছেন ‘সত্যের সন্ধান’। আরজ আলী মাতুব্বর স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। মাতুব্বর সাহেব আপনি আপনার বইয়ের অংশবিশেষ সবাইকে পড়ে শোনান।
মাতুব্বর সাহেব তাঁর আকর্ষণীয় কন্ঠে, বরিশালের আঞ্চলিক উচ্চারণে ‘সত্যের সন্ধান’ পড়তে লাগলেন। সমস্ত ড্রইংরুম মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর গ্রন্থপাঠ শুনতে লাগলেন। পাঠ শেষ করে তিনি বসে পড়লেন। কারো মুখে কথা নেই। হঠাত সবাই উঠে এসে তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি করে প্রস্তাব করলেন মাতুব্বর সাহেব ‘মিলন সংঘে’র অবৈতনিক সদস্য হবেন। এবং প্রতি সভার আগে তাঁকে চিঠি লেখা হবে। তিনি এক একবার এক একজনের অতিথি হয়ে ঢাকা শহরে অবস্থান করবেন। এভাবে তিনি অনেকের মতো অধ্যক্ষ সাঈদুর রহমানেরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। তখনকার সামাজিক পরিবেশে তাঁরা প্রত্যেকেই মাতুব্বর সাহেবকে বই ছাপতে নিষেধ করেছিলেন।
অধ্যক্ষ সাঈদুর রহমান সাহেব ও আবুল হাসনাত সাহেব ছাড়া শিল্পী আবুল কাসেম ও তৎকালীন পাবলিক সার্ভিস কমিশন চেয়ারম্যান বারী মালিকের সঙ্গেও মাতুব্বর সাহেবের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মিলন সঙ্ঘের সভা করে বরিশাল ফিরে তাঁর বন্ধুদের সম্বন্ধে আমাদের কাছে গল্প করতেন।
আরজ আলী মাতুব্বর সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘ বিশ বছরের। এই সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য। আমার কোন আত্মীয়ের সঙ্গেও এত দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠতা ছিল না। একই রকমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদিরের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গেও আমার শেষ দেখা হয় তাঁর মৃত্যুর এক মাস আগে, তাঁর মেঝো কন্যার লালমাটিয়ার বাসায়। দুপুরে কাজী সাহেব সহ শেষ খাওয়া হয় এম. এ. নূর সাহেবের বাসায়।
মৃত্যুর এক বছর আগে থেকে মাতুব্বর সাহেব কিভাবে একটি পাঠাগার করবেন, স্থানীয় মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি দেবেন, নিজের চোখ দুটো দান করবেন এবং দেহখানি শরীরবিদ্যা শেখার জন্য মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের জন্য রেখে যাবেন ইত্যাদি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করতেন। তাঁর জীবনে ষাট বছর পর্যন্ত যা কিছু উপার্জন করেছেন, তা উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যাবেন। ষাট বছর বয়সের পর আর যা আয় করেছেন, তার সবটুকু জনহিতকর কাজে ব্যয় করার জন্য বরিশালের কমিশনারকে চেয়ারম্যান করে একটি ট্রাস্টি বোর্ডের হাতে দিয়ে যাবেন। মাতুব্বর সাহেব তাঁর কথামত কাজ করে গেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে পাঠাগারের গুরুত্ব যে কোন অংশে কম নয়, তা তিনি একাধিকবার ব্যক্ত করে গেছেন। সেইজন্য তিনি কোন স্কুল প্রতিষ্ঠা না করে পাঠাগার নির্মাণ করে গেছেন। পাঠাগারি তাঁর ব্যক্তিগত জ্ঞানচর্চার উৎস। তাই তাঁর পাঠাগারের প্রতি অপরিসীম দুর্বলতা ছিল।
জীবনে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করে গেছেন। তা ধরে রাখতে পারিনি। তখন তো ভাবতে পারিনি, একদিন আমাকে তাঁর ন্সম্বন্ধে কথা বলতে হবে।
তিনি বলতেন, ‘সত্যের সন্ধান’ মদিয়ে আমি কুসংস্কারের ডালপালা ছেঁটে দিয়েছি। আর ‘সৃষ্টি-রহস্য’ দিয়ে কুসংস্কারের মূলশুদ্ধ উপড়ে দিয়েছি।
তাঁর সঙ্গে আমার কোনদিন মতান্তর হয়নি, কিন্তু মাঝে মাঝে মতান্তর হয়েছে। আমি বলতাম, আপনি যে সংস্কারমুক্ত বৈজ্ঞানিক সমাজ কল্পনা করছেন, তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। একটা সমাজ বা দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রন করে তার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রূপরেখা।
মাতুব্বর সাহেব বলতেন, একটা দেশের সমাজ অশিক্ষা ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত হলে সে দেশের রাজনীতিও স্বচ্ছ হবে।
মাতুব্বর সাহেব জিততে পারেন নি। বিশিষ্ট কথাশিল্পী হাসনাত আব্দুল হাই সাহেবের অসাধারণ উপন্যাস ‘একজন আরজ আলী’তে এই চিত্র সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। চরমোনাই পীর সাহেবের সঙ্গে তাঁর ভক্তদের কথোপকথন স্মরণ করলে পাঠক সমস্ত ব্যাপারটি সুন্দর ভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন।
কুসংস্কার-অশিক্ষায় ‘লামচরি’ গ্রামখানি ছোট; কিন্তু সত্যসন্ধানী আরজ আলী মাতুব্বর অনেক বড়। বিগত বছরগুলোতে ‘লামচরি’ গ্রামখানি বড় হতে হতে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল গিলে ফেলেছে। এখন আরজ আলী মাতুব্বরের মতো একজন যুক্তিবাদী সংস্কারমুক্ত সত্য ও বিজ্ঞানপ্রেমী মানবতাবাদীর বড়ই প্রয়োজন।
মুহম্মদ শামসুল হক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়