আরজ আলী মাতুব্বর বাংলাদেশের এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। বরিশাল শহর থেকে এগারো কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে চরবাড়িয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত লামচরি গ্রামে ১৩৩৭ সনে তাঁর জন্ম। লামচরি গ্রামটি ছোট – আরজ আলীরা আরো ছোট। জমি-জিরেত সবই লাখোটিয়ার জমিদাররা নিলাম করে নিয়ে গেছে, বাকি যৎসামান্য যা ছিল তাও মহাজনের কাছে বন্ধক পড়ে। ছোট একটি ঝুপড়ি ঘরে কিশোর আরজ আলী তাঁর মা ও ছোট বোনকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেন। এর করুণ বিবরণ পাওয়া যাবে স্নেহভাজন আইয়ুব হোসেনের লেখা বাংলা একাডেমী প্রকাশিত আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনীগ্রন্থে।

আরজ আলী মাতুব্বর ছিয়াশি বছরের জীবনে প্রায় ৭০ বছর জ্ঞান সাধনা করেছেন। নিজের শ্রম, বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে তিনি তাঁর আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধন করেছেন। জমিদার ও মহাজনদের কাছ থেকে বন্ধককৃত জমিজমা উদ্ধার করেছেন। শুধু তাই নয়। নিজের প্রচেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছেন। কৈশোরের একটি ঘটনা তাঁকে সত্যসন্ধ করে তোলে। তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের ছবি তোলার দায়ে মৃতদেহ কেউ জানাজা পড়ে দাফন করতে রাজি হয়নি। শেষে বাড়ির কয়েকজন লোক মিলে তাঁর মায়ের সৎকার করেন।

আরজ আলী মাতুব্বর সামাজিক এই আঘাতের পর সত্য অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হন। ধর্মের নামে কুসংস্কার সত্য, না বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞান সত্য?

এই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরজ আলী বিপুলভাবে ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের গ্রন্থ অধ্যায়ন করেন। বাংলা ভাষায় লিখিত এবং প্রাপ্ত অধিকাংশ গ্রন্থাদি অধ্যায়ন তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় বাদ পড়েনি।

বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরী ছাড়াও বই. এম. কলেজ লাইব্রেরী এবং বিদ্বৎজনের পারিবারিক লাইব্রেরী ব্যবহার করার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহের কয়েক হাজার বই উনিশশো একষট্টি সালের সাইক্লোন ঘরসহ কীর্তনখোলা নদীতে নিক্ষিপ্ত হয়। আরজ আলী সাহেব বিমর্ষ হৃদয়ে আমার কাছে তার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, তিনি বই হারিয়ে পুত্রবিয়োগের শোক পেয়েছেন।

মাতুব্বর সাহেব পড়াশোনা করতেন প্রচুর, ভাবনা-চিন্তা করতেন আরো বেশি, বলতেন খুবই কম, লিখতেন আরো কম। তিনি তাঁর প্রয়োজনীয় বক্তব্য প্রকাশ করা ছাড়া বাহুল্য লেখা পছন্দ করতেন না। সেজন্য তাঁর লেখার পরিমাণ খুবই কম। ব্যক্তিগত জীবনে মৃদু ও মিষ্টভাষী ছিলেন। তাঁর মতের পরিপন্থী কোন বিষয়ের অবতারণায় তিনি সহজে উত্তেজিত হতেন না। মৃদুহেঁসে ধীরস্থিরভাবে যুক্তিসহকারে পরমত খন্ডন করতেন। এমনকি যুক্তিপূর্ণ হলে ভিন্নমত সহজভাবে গ্রহণ করতেন।

মাতুব্বর সাহেবের লেখার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম হাস্যরস আছে – যা তাঁর গম্ভীর লেখাকেও নির্ভর করেছে। জগত ও জীবন সম্পর্কে একটা সহজ ও প্রসন্ন দৃষ্টি লাভ করেছেন বলে তাঁর লেখার মধ্যে জ্বালাযন্ত্রনা বা বাহ্যিক বিক্ষোভ নেই। তিনি বলেছেন, জ্ঞানচর্চা ও জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছেন বলে মূঢ় গ্রামবাসীর ওপর থেকে তাঁর ক্ষোভ অপসৃত হয়ে গেছে। আরজ আলী মাতুব্বর দেখেছেন, উচ্চশিক্ষিত অনেক লোকের মধ্যে অপরিসীম কুসংস্কার ও অবৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনা বিরাজমান – কাজেই শিক্ষাবঞ্চিত সাধারণ মানুষ তো সংস্কারের নিগড়ে আবদ্ধ হবেই।

আরজ আলী মাতুব্বর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লেখনী ধরেছেন বৈজ্ঞানিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। তাঁর মতে, যা কিছু দুর্জ্ঞেয় ও রহস্যময়, তা সত্য নাও হতে পারে। সুতরাং তাঁর ওপর অহেতুক বিশ্বাস স্থাপন করে লাভ কি? চাঁদকে ঘিরে গড়ে ওঠা রহস্য একদিন বৈজ্ঞানিকগণ উদ্ঘাটন করলেন। সত্য বেরিয়ে এল।

মাতুব্বর সাহবে পরম যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন। সেইজন্য তিনি ‘সত্যের সন্ধান’ গ্রন্থের অপর শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘যুক্তিবাদ’। তাঁর মতে, ‘কোনো তত্ত্বমূলক বিষয়ে তো নয়ই, যুক্তিহীন (আন্দাজি) কথা বাজারেও চলে না।’ মাতুব্বর সাহেবের যুক্তিবাদী কথার জবাব না দিয়ে তাঁকে নেয়া হয়েছিল ‘পবিত্র হাজতখানায়’।

তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি বিজ্ঞানের প্রচার, প্রসার এবং প্রতিষ্ঠা চাচ্ছেন কেন? জবাব – কুসংস্কারমুক্ত মানুষের মঙ্গলের জন্য। আপনার ধর্ম কি? ছোট্ট জবাব – মানবতাবাদ। মানুষের মুক্তি এবং বিজ্ঞানের যুক্তি প্রতিষ্ঠার এক নম্বর বাধা, দীর্ঘদিনের সঞ্চিত কুসংস্কার।

আরজ আলী মাতুব্বরের মৃত্যুর খবরের সঙ্গে আরেকটি কবর যুক্ত হয়েছিল, তা হল, মরণের আগে তিনি তাঁর চক্ষু দুটি দান করে যান। দেহখানিও চিকিৎসা বিদ্যালয়ের ছাত্রদের শারিরবিদ্যা শেখার জন্য দান করেন। যে দু’টো চোখ দান করে যান, তা দিয়ে কোন অন্ধ ব্যক্তি হয়তো বাহ্যিক জগত দেখবেন। তিনি সত্যকে হয়তো কোনদিন দেখতে পাবেন না।

মাতুব্বর আরো দু’টো চোখ দান করে যান, যা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমগ্র জাতিকে চক্ষুষ্মান করবে – তা হল ‘সত্যের সন্ধান’ ও ‘সৃষ্টি-রহস্য’ গ্রন্থদ্বয়।

আরজ আলী মাতুব্বর মনে করেন, ধর্ম যুগে যুগে মানুষকে সুশৃঙ্খল করে শুভ ও মঙ্গলের পথে নিয়ে যেতে চেয়েছে। কাজেই ধর্মের একটি প্রগতিশীল ভূমিকা আছে। পৃথিবীতে এমন কোন ধর্ম নেই যা মানুষকে অমঙ্গলের পথে নিয়েছে। বরং মানুষের মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং সেবাপরায়ণতাই ধর্মের ধ্যেয়। ধৃ ধাতু থেকে ধর্ম – যা মানুষকে ধারণ করে, পোষণ করে। কিন্তু কালে কালে কুসংস্কারের কালোমেঘ ক্রমশ ধর্মকে আচ্ছন্ন করে এক শ্রেণীর মানুষকে মনুষ্যবিবর্জিত করে ফেলেছে। মাতুব্বরের সংগ্রাম এই মনুষ্যত্বহীন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।

মানুষের একটি বড় ধর্ম-জ্ঞানচর্চার ভেতর দিয়ে সত্যকে অনুধাবন করা। বিজ্ঞানচর্চা সত্যজ্ঞান লাভের একটি পদ্ধতি মাত্র, সেজন্য আরজ আলী মাতুব্বর বিজ্ঞানকে এত ভালোবেসেছেন। তাঁর মতে, দেশে যত বেশি বিজ্ঞানচর্চা হবে, দেশ থেকে তত বেশি কুসংস্কার বিদূরিত হবে। আমি তাঁর সঙ্গে কিঞ্চিত দ্বিমত পোষণ করে বললাম, সমাজে বিজ্ঞানচর্চা করেন, ,এমন লোকও ব্যক্তিগত জীবনে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। তিনি জবাবে বললেন, তাঁরা সত্যজ্ঞান লাভের জন্য বিজ্ঞানচর্চা করেন না, স্থুল স্বার্থ বা স্বীয় ভরণপোষণের জন্য বিজ্ঞান অধ্যায়ন করেন। তাই বলে বিজ্ঞানচর্চার ভেতর দিয়ে প্রকৃতি,  জগত এবং জীবনের রহস্য ভেদ করা থেমে থাকবে না। আজ যা কল্পনা, কাল তা সত্যে প্রমাণিত হলে আর কল্পনা থাকবে না।

মাতুব্বর সাহেব কথা বলতেন কম। কিন্তু যে-কোন মনোযোগী শ্রোতা বুঝতে পারতেন তাঁর কথার আড়ালে কি গভীর অধ্যয়ন ও অভিজ্ঞতা নিহিত আছে, এ যেন বরফশীলা। পাঁচ ভাগের চারভাগ পানির নিচে অদৃশ্য। তাঁর কথা শুনতে ক্লান্তিবোধ হতো না, এবং তিনি শুনতে অক্লান্ত ছিলেন।

তাঁর আরো অনেক গুণ ছিল হাতে বাঁশি বানিয়ে সুন্দর সুর তুলে বাজাতেন। বানাতেন ঢোল, খোল এবং তবলা। নিজে গান রচনা করে সঙ্গীসাথীসহ গেয়ে বেড়াতেন। এক সময় তিনি বয়াতিরূপে পরিগণিত হয়েছিলেন। তাঁর এক নিকটজনের বিয়েতে তাঁকে বরপক্ষের উপযুক্ত সম্মান না-দিয়ে বাজনদার ঢুলিদের সঙ্গে ঘরের বাইরে বেঞ্চে বসতে দেয়া হয়। মনের দুঃখে বিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান এবং তারপর থেকে আরজ আলী সাহেব আর কোনদিন গানবাদ্যচর্চা করেননি।

মাতুব্বর সাহেব নিজ হাতে একটি পাখা নির্মাণ করেন, যা কেরোসিন তেল দিয়ে চালানো হতো একষট্টির সাইক্লোনে তা ধ্বংস হয়ে যায়।

আরজ আলী সাহেব তাঁর সময়কার বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকদের তত্ত্বসহ জীবনের খুঁটিনাটি অবগত ছিলেন। দার্শনিকদের মধ্যে লিবনিজ, স্ফিনোজা, কান্ট, হেগেল, মার্কস, এঙ্গেলস, ব্র্যাডলি, বার্কলি প্রমুখের দর্শন সম্পর্কে ওয়াকেবহাল ছিলেন। এত সব জানলেন কি করে? জিজ্ঞেস করলে সলজ্জ হাঁসি হেঁসে বলতেন, বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরী, বি. এম. কলেজ লাইব্রেরী এবং অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির আমার অনেক কিছু জানার উৎস। সম্প্রতি আপনাদের মতো। বন্ধুদের কাছ থেকেও বই নিয়ে কম সাহায্য পাচ্ছি না।

কাজী গোলাম কাদির। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের কৃতী ছাত্র। অধ্যাপক হুমায়ুন কবির, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের স্নেহধন্য ছাত্র। হাই মাদ্রাসা থেকে পাশ করা। বি. এম. কলেজে কবি জীবনানন্দ দাশ ও ধীরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জীর প্রিয় ছাত্র। উনিশশ ছেচল্লিশ সালে এম. এ পাশ করে চাখার কলেজে দর্শনের অধ্যাপক হয়ে যোগদান করেন। আটচল্লিশ সালে বি. এম. কলেজে দর্শনের একটি পদ খালি হয়। তৎকালীন অধ্যক্ষ নীলরতন মুখার্জি নিজের ফাস্ট ক্লাস পাওয়া জামাতাকে চাকরি না দিয়ে মেধাবী ছাত্র  কাজীকে নিয়োগপত্র দেন। কাজী সাহেব অভিভূত হয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। অধ্যক্ষ বললেন, ঘরে গিন্নি, কন্যা এবং জামাতা সবাই নাখোশ। জামাতা ও কন্যা সমানে কলকাতার কলেজগুলোতে দরখাস্ত করছে। চাকরি পেলে এখান থেকে সটকে পড়বে। খামোকা আমার কলেজ ‘সাফার’ করে কেন। কাদির, শোনো, তোমাকে তো বাবা চাকরি দেইনি – তোমাকে গভীরভাবে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিয়েছি। এই কলেজকে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলা হয়। এর সুনাম রাখার দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পিত হবে।

কাজী গোলাম কাদির আজীবন পড়াশোনা করেছেন। কখনো কর্তব্যকর্মে অবহেলা করেননি। এমনকি অবসর গ্রহণ করার পরও জ্ঞানচর্চার অভ্যাস ত্যাগ করেননি। এমনকি অবসর গ্রহণ করার পরও জ্ঞানচর্চার অভ্যাস ত্যাগা করেননি। রাশভারি লোক। সহজে কেউ কাছে ঘেঁষত না। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার পিতৃবন্ধু আরজ আলী মাতুব্বরকে আত্মসাৎ করলেন কিভাবে? – ‘আমার বাবা, শ্বশুর এবং মাতুব্বর সাহেব তিন বন্ধু, হরিহর আত্মা।’

পিতৃবন্ধু স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এবং কাজী সাহেবের হবু শ্বশুরের বড় কন্যার বিয়ে। সন্ধ্যার পর রান্নাবান্নার বিরাট আয়োজন হচ্ছে। রন্ধনশিল্পী আরজ আলী মাতুব্বর।

শুনে আমি চমকে উঠলাম। মাতুব্বর সাহাবের সঙ্গে বিশ বছরের সম্পর্ক। কোনদিন আমার বাসায় মাছ-মাংস খাননি। আমি অবাক হওয়াতে কাজী সাহেব এই বলে আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে, বিটোফেন কানে শুনতেন না, তবুও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুরস্রষ্টাদের মধ্যে অনন্য। মাতুব্বর সাহেব মশলাপাতি হাতের আন্দাজে এমন ভাবে দিতেন যে, ব্যঞ্জন অত্যন্ত সুস্বাদু হতো। নিজে না-খেলে বুঝবেন না।

সৌভাগ্যবশত সেই সুযোগও আমার বরিশাল ছাড়ার আগে হয়েছিল। কাজী, আমি এবং আরো দুজন সহকর্মীসহ বরিশালের ডি.সি.র স্পীডবোট নিয়ে একদিন লামচরি হাজির হলাম। আগে ডালভাত খাওয়ার নিমন্ত্রণ ছিল। এমন তৃপ্তির সঙ্গে অনেকদিন খাইনি। রান্নার মান এবং বৈচিত্র দেখে বিস্মিত হয়ে গেলাম। মাতুব্বর সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে অন্দরমহলে এমন সুখাদ্য নির্মাণের জন্য ধন্যবাদ দিতে বললাম। তিনি মুচকি হেঁসে বললেন, আপনাদের শুভেচ্ছা অন্দরমহলে পাঠিয়ে দেবো, কিন্তু তা রান্নার জন্য নয়। ও কাজটি আমি স্বহস্তে করেছি। কারণ এ ব্যাপারে অন্য কারো ওপর নির্ভর করতে পারিনি।

কাজী সাহেবকে বললাম, স্যার, এ যে বাখ, বিটোফেন, মোৎসার্ট, শুবার্ট।

কাজী সাহেব বর্ণনা করলেন, শামিয়ানার নিচে বসে গল্প করছিলেন সমবয়সীদের সঙ্গে। একজন ছিপছিপে কালোমতো লোক এসে বললেন, আপনি কি ‘পেরপেসার’ কাজী গোলাম কাদির? কাজী সাহেব হ্যাঁ-সূচক জবাব দেয়ার পর তিনি বললেন, আপনার বাবা আমার বাল্যবন্ধু, তাঁর মুখে আপনার কথা শুনেছি। আসুন, আমরা একপাশে বসে একটু আলাপ-আলোচনা করি।

সে আলাপ-আলোচনা চলল পরদিন দশটা পর্যন্ত। অনেক লোক চারপাশে জড়ো হল। অনেক লোক ক্লান্ত হয়ে চলে গেল দশটা পর্যন্ত রুস্তম-সোহরাবের লড়াই চলল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কামারশালায় তৈরি সূক্ষ্ম এবং ধারালো তলোয়ার বনাম গ্রামের আনাড়ি কামারশালায় তৈরি ভারি লোহার তলোয়ার। সারারাত চলল তত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম ও সংস্কার নিয়ে তলোয়ারে-তলোয়ারে ঘর্ষণ।

সেদিন দুই অসমবয়সী নবপরিচিত বন্ধু উপলব্ধি করলেন, তাঁদের পরস্পরকে কতখানি প্রয়োজন। এ যে দুজনের কাছে দুজনের আবিষ্কার। যে-শামিয়ানার তলে বিয়ের মধ্য দিয়ে দুটো আত্মার মিলনের আয়জন হচ্ছে, সেই শামিয়ানার তল থেকে কাজী গোলাম কাদির তাঁর পিতৃবন্ধুকে ছিনতাই করলেন।

এরই মধ্যে আরজ আলী সাহেব ধর্মভিত্তিক সদ্যোজাত রাষ্ট্র পাকিস্থানে মুক্তবুদ্ধির অপরাধে ‘পবিত্র হাজতবাস’ খাটলেন। এসব কাজী সাহেব ও মাতুব্বর সাহেবের কাছে একাধিকবার শোনা। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্যে আইয়ুব হোসেনের ‘আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনীগ্রন্থে’র জীবনীগ্রন্থে’র শরণাপন্ন হওয়ার জন্য সুধী পাঠককে অনুরোধ করছি।

উনিশশো সাতষট্টি সালের সেপ্টেম্বর শেষ দিকে রাজশাহী কলেজ থেকে বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজে পদোন্নতি নিয়ে যোগদান করি। সম্পূর্ণ অচেনা জায়গা। অধ্যাপক হানিফ সাহেব তাঁর বাসায় নিয়ে তুললেন। কিছুদিন পর একটা টিনের বাসার বন্দোবস্ত হল। থাকি একলা, একটি সুদক্ষ চাকর নিয়ে – যে শিং-মাগুর মাছের লেজ, ঘাড় এবং মাথা আমার জন্যে রেখে বাকিটা স্বীয় গর্ভসাৎ করে। স্ত্রী শিক্ষাসফরে করাচী ও কাবুলে। বিকেল হলেই কলেজের টেনিস লন ও কলেজ ক্লাব আমাকে আকর্ষণ করে এর মধ্যে একটি অতি সামান্য ঘটনা সমবয়সী সহকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অনেক সহকর্মীর মধ্যে কেবল আমার উদ্দেশ্যে এককাপ চা পাঠিয়ে দেন কাজী গোলাম কাদির সাহেব। চায়ের মূল্য আট আনা, কিন্তু কাজী গোলাম কাদিরের এক কাপ চা অমূল্য। এটি বেশ কিছু দিন পর আরো বেশি করে পেলাম। পান্ডিত্য, মার্জিত রুচি, ধীরস্থির ভাব নিয়ে কাজী সাহেবদের মতো বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী জ্ঞানের অধিকারী মফস্বলের অধ্যাপকরা ডাইনোসরদের মতো বিলুপ্ত হয়ে গেলেন।

বি.এম. কলেজের পুরোনো দালানের স্টাফ রুমে তখনকার দনে শিক্ষকদের ক্লাব বসত। টেনিস খেলে প্রায় ঘর্মাক্ত কলেবরে দোতলায় বারান্দায় বসে অক্সফোর্ড পকেট সিরিজের ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ বইটি নাড়াচাড়া করছিলাম। তাসের আসর তখনো বসেনি। কাজী সাহেব পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, যে-ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন,  সেই চেয়ারে কে কে বসতেন, জানেন? আমার স্যারে কবি জীবনানন্দ দাশ। আর তাঁর এবং আমাদের স্যার ধীরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি। আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, দুঃখিত, স্যার, আমি জানতাম না। উনি বললেন, না, না, তাতে কি হয়েছে। সঙ্কোচ বোধ করার কিছু নেই। আমি আর আমার বন্ধু তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় পড়া জিজ্ঞেস করতে এখানে ঢুকে পড়তাম। তারকের লেখার হাত ছিল, সেই জন্য স্যাররা স্নেহ করতেন। তারকনাথ পরবর্তীকালে সাহিত্যজগতে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নামে খ্যাতি অর্জন করেন। আপনাকে এখানে ডেকে এনেছি অন্য কারণে। নিচে টেনিস লনের বেঞ্চে বসে যে-অধ্যাপক বন্ধুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তর্ক করছিলেন, তিনি শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতবিদ্বেষী নন-ঘোরতর পাকিস্থানপ্রেমিক। যাকগে ওসব লোকের সঙ্গে করতে যাবেন না নামাজ-রোজার ধার ধারে না – কুতর্কের ওস্তাদ। বলেই কাজী সাহেব পকেট থেকে একটি কাগজের রোল আমার হাতে তুলে দিয়ে একটু দূরে বাতির নিচে বসে পড়তে বললেন। আর বললেন, লেখাটি কাউকে দেখাবেন না – পড়া হয়ে গেলে আপনার মতামত জানাবেন।

এক বিঘত চওড়া এবং প্রায় এক হাত লম্বা সদাগর অফিসের হিসাবের খাতার মতো দেখতে। আমি ভাঁজ খুলে দেখলাম গ্রাম্য দলিল লেখকদের হাতের লেখার মতো হস্তাক্ষর। লেখার শিরোনাম ‘কুসংস্কার ও তার স্বরূপ’। লেখক আরজ আলী মাতুব্বর। লেখার শিরোনামে নতুনত্ব থাকলেও লেখকের নামের মধ্যে একটা গ্রাম্যতা নিহিত আছে।

আমি একটু অভক্তি নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর ঘাড় ফেরাতে পারলাম না। মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রায় বত্রিশ পৃষ্ঠা, মাঝারি রকমের হাতের লেখা। পড়া শেষ হলে আমার শরীর প্রায় ঘর্মাক্ত হয়ে গেল। আবার পড়া শুরু করলাম। আরম্ভটা অনেকটা এরকম – ‘সম্প্রতি লাহোরের এক বিজ্ঞানী সম্মেলনে পাকিস্থানের মহামান্য প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইউব খান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন – পাকিস্থানে বিজ্ঞানের প্রসারে সবচেয়ে বড় বাধা ধর্মীয় কুসংস্কার। মহামান্য প্রেসিডেন্টের এই উক্তি অত্যন্ত মূল্যবান, সঠিক এবং সময়োচিত। আসুন আমরা এখন উদাহরণসহ কুসংস্কারের স্বরূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখি।‘

আমার চাকরি হয়েছে মাত্র চার-পাঁচ বছর। ঐ বয়সে যত প্রগতিশীল হই না কেন – অন্তরের অন্তস্থলে কিঞ্চিৎ পিছুটান থাকে। জন্মসূত্রে কিছু সংস্কার থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু লেখাটি আমার সমগ্র সত্তার ভিত্তিমূলে নাড়া দিয়ে গেল।

লেখাটি দ্বিতীয়বার আধাআধি পড়ার আগে কাজী সাহেব আমার পাশে এসে বসলেন। বললেন, কেমন লাগল? আমি স্যারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে মনে মনে ভাবলাম, মফস্বল শহরের একজন প্রবীণ অধ্যাপকের মনে এত বৈপ্লবিক চিন্তা? সে সময় ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের ‘সিভিলাইজেশন’, পাক-ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর ড. ফজলুর রহমানের ‘ইসলাম’ বজলুর রহমানের ‘জিজ্ঞাসা’, এইচ.জি. ওয়েলস-এর ‘শর্ট হিস্ট্রি অব দি ওয়ার্ল্ড’, ভ্যান লুমের ‘স্টোরি অব ম্যানকাইন্ড’ নামক গ্রন্থগুলো একে একে বাজেয়াপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। পুণ্যবান ধার্মিকবৃন্দ উল্লিখিত গ্রন্থগুলোর বিরুদ্ধে মিছিল করে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। গ্রন্থগুলো দাহ করা হচ্ছিল – লেখকদের হাতের কাছে পাওয়া যায়নি, তাই রক্ষা পেয়েছেন তাঁরা।

স্যারকে বললাম, ছদ্মনাম নাহয় গ্রহণ করলেন, কিন্তু হাতের লেখাটা দেখছি আপনার নয়। লেখাটা সম্পর্কে আমার এই মুহূর্তে কিছু বলার সাহসও নেই, সামর্থ্যও নেই। লেখা আমি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি, আপনাকে আগামীকাল বিকেলে ফেরত দেবো। শুধু এটুয়কু বলব স্যার, আমার ভেতরে অনেক কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। সারারাত যতক্ষণ জেগে থাকব, ততক্ষণ আপনার ছদ্মনামের লেখাটি পড়তে থাকব।

এবার কাজী সাহেবের বিস্ময়ের পালা। বললেন, বলছেন কি? এটি আমার লেখা নয়। এটি লেখকের ছদ্মনামও নয়। তাঁর সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ করিয়ে দিলে বিশ্বাস হবে তো? আগামী সপ্তাহে দেখা করিয়ে দেবো। শর্ত – কারো কাছে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলবেন না, শুধু নবপরিচিত স্থানীয় বলবেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি কাজ করেন এবং লেখাপড়া কতটুকু? কাজী সাহেব বললেন, তিনি একজন কৃষক বয়স পয়ষট্টির ওপর, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া কিছুই নেই। নিজের চেষ্টায় প্রায় বিদ্যাসাগর এখন চলে যান – ক্লাবে কেউ নেই।

আমি বাসায় চলে এলাম। আর ভাবতে শুরু করলাম- কে এই লেখক, দেখতেই বা কেমন?

যাকে আমরা মনেপ্রাণে কামনা করি – অথচ চোখে দেখি না, তাঁর একটা অবয়ব মনের মধ্যে আপনাতেই তৈরি হয়ে যায়।

একদিন সেই বিরল মুহূর্তটি এল। অক্টোবরের মাঝামাঝি। ক্লাস সেরে নতুন কলাভবন থেকে পুরনো ভবনের স্টাফ রুমে ঢুকে দেখি কাজী সাহেবের সঙ্গে পাশাপাশি ভিন্ন একটি ইজিচেয়ারে বসে আছেন আরেকজন লোক। আমাকে দেখে দু’জনে সোজা হয়ে বসলেন। আমি ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ছবিতে মধুসূদন, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ছাড়া এমন হৃদয়ভেদী চাহনি আর দেখিনি। আমি অবলীলায় বলে ফেললাম, আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব তো? কাজী সাহেব সাড়া দিয়ে বললেন, বলেছিলাম না মাতুব্বর সাহেব, নবীন অধ্যাপক বুদ্ধিদীপ্ত। আগে দেখা না হলে কি হবে, নামটি ঠিকই বলে দিলেন। আমি লজ্জায় মাথা নত করলাম।

গায়ের রং কাজী সাহেবের বিপরীত, শালপ্রাংশু দেহ। কোথাও কোন  রকম মেদবাহুল্য নেই। চেহারার মধ্যে একটা প্রকৃতিদত্ত মসৃণতা আছে। ঠিক তাঁর লেখার মতো বাহুল্যবর্জিত। বাঙ্গালী মনীষায় রবীন্দ্রনাথ, প্রথম চৌধুরীর পর সত্যজিৎ রায় ছাড়া খুব কম লোকের মধ্যে পরিমিতিবোধ আছে।

কাজী সাহেব বললেন, তাঁর শত্রুর অভাব নেই। হাজত খাটা মানুষ। আপনার হাতে তুলে দিলাম। গোপন করে রাখবেন। তাঁর লেখাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়বেন, এবং কিছু বলার থাকলে কেবল তাকে অথবা আমাকে বলবেন। বাইরের কোনো দায়িত্বহীন লোকের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধে আলাপ করবেন না।

তারপর থেকে আমাদের গোপন আলোচনা এবং জ্ঞানের বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে লাগলো। আমাদের বন্ধুত্ব গভীর থেকে সুগভীর হল। আলোচনা সভায় কাজী সাহেবের অনুমতিক্রমে শ্রদ্ধাভাজন সহকর্মী অধ্যাপক মুসা আনসারী এবং অধ্যাপক শরফুদ্দিন রেজা হাই অংশগ্রহণ করতেন। পরবর্তীকালে হাই সাহেব বদলী হয়ে ঢাকা চলে এলেও মাতুব্বর সাহেবকে বিভিন্নভাবে প্রভূত সাহায্য করেন।

কাজী সাহেব সংসারী এবং ব্যস্ত মানুষ। জ্ঞানচর্চার বাইরেও তাঁকে আত্মীয়-প্রতিবেশী ও অন্যান্য অনেকের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। মাঝে মাঝে সংক্ষেপে জিজ্ঞেস করতেন, কেমন? আমারও সংক্ষিপ্ত উত্তর, বেজায় গভীর। উনি বলতেন, গোপনীয়তা বাঞ্ছনীয়।

মোস্তাফিজুর রহমান মেহেদী মৃত্তিকাবিজ্ঞানের ছাত্র ছিল। একটু নাকউঁচু ভাব। বরিশাল USIS লাইব্রেরী প্রধান সুজাউল ইসলামের অফিসকক্ষে একদিন বসে আছি। আমানতগঞ্জের ধনাঢ্য কাঠ ব্যবসায়ী আজিজ বেপারীর সদ্য প্যারিস- ফেরত পুত্র মেহেদী আমাকে পেছন করে বসে ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আলাপ করছেন। একটু পরে আরেকজন অপরিচিত লোক এসে বসলেন। প্রথম লোকটির ওপর একটু ভাব জমলেও দ্বিতীয় লোকটি একটু বেশী প্রাণবন্ত, কথাবার্তার  মধ্যে বুদ্ধির দীপ্তি প্রকাশ পাচ্ছে বলে সহজেই আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। এক শ্রেণীর আনুষ আছে, যারা মুখ দিয়ে কথা বলেন, আমরা যাদের বলি চাপাবাজ। আরেক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা হৃদয় দিয়ে কথা বলেন, আমরা বলি হৃদয়বান – ভাবালু। আরেক প্রকারের মানুষ মস্তিষ্ক দিয়ে কথা বলেন, যাদের বুদ্ধিমান বলি।

নূর ভাই, এম. এ. হৃদয় এবং মস্তিষ্ক দিয়ে কথা বলেন। মুখখানা যেন হৃদয় ও মস্তিষ্কের চাকর।

আলাপ হল না। নূর ভাই চায়ের কাপটা রেখেই, ইনকাম ট্যাক্স কোর্টে মামলা আছে বলে চলে গেলেন। আলাপ-পরিচয় হল না বলে মনে দাগ পড়ে গেল।

মেহেদী উড টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা করে এসেছে। দুই বছরের প্যারিস জীবনে সমস্ত ইউরোপ ভ্রমণ করে বিভিন্ন যাদুঘর থেকে স্লাইড এনেছে, যা প্রজেক্টারে দেখার জন্য সুজাউল ইসলাম সাহেবকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কথা প্রসঙ্গে ডেনমার্কের সমুদ্র থেকে উত্থিত মৎস্যকুমারীর নাম ভুলে গিয়ে আমতা আমতা করছিল। আমি বললাম, ‘লিটল মারমেইড’। ভদ্রলোক একটু বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, আপনি জানেন কি করে? ওখানে গিয়েছিলেন নাকি? আমিও ঠ্যাটামি উত্তর দিলাম, সব জিনিস গিয়ে দেখা লাগে না। এমনিতে জানা যায়। না জানা থাকলে নিজের চোখে দেখলেও মনে থাকে না। সুজাউল ইসলাম সাহেব বললেন, শামসুল হক সাহেব, আপনার কাছে নিশ্চয়ই এ বিষয়ে বই আছে।

বললাম, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসেনের কালজয়ী গল্পের সংকলন আমার কাছে আছে।

মেহেদী আর আমি দু’জন দু’পথে চলে গেলাম।

দু’দিন পর দরজায় টোকা। খুলে দেখি মেহেদী সাহেব। বললেন, নিশ্চয় ক্ষমা শিক্ষকতার একটা বড় গুণ।

আমাদের বন্ধুত্ব দৃঢ় এবং গভীর হল। ততদিনে ‘সত্যের সন্ধান’ ও ‘সৃষ্টি-রহস্যে’র পান্ডুলিপি একাধিকবার পড়া হয়ে গেছে। এবং পান্ডুলিপিগুলো প্রায়ই আমার কাছে থাকে।

একদিন স্যারকে বললাম, মেহেদীর সঙ্গে মাতুব্বর সাহেবের পরিচয় করিয়ে দিলে কেমন হয়? লামচরি থেকে এতদূর পথ হেঁটে এসে, বয়স্ক মানুষ হাঁপিয়ে পড়েন। মাঝপথে আমানতগঞ্জে কিছুটা বিশ্রামের সুযোগ পেলে, ধীরে-সুস্থে আমাদের কাছে আসতে পারবেন। সহজে রিক্সায় চড়তে চান না। একটু হিসেবী মানুষও। কাজী সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাড়া দিলেন। আমি স্যারকে নিশ্চয়তা দেয়ার জন্যে বললাম, ছেলেটি ভালো এবং মুক্তবুদ্ধির। সারা ইউরোপে মিউজিয়াম দেখে ঘুরে বেড়িয়েছে, আসার সময় একখানা গাড়ী না এনে এক বস্তা স্লাইড এবং একখানা প্রজেক্টার মেশিন নিয়ে এসেছে। কাজের ফাঁকে স্লাইড দেখে। বাজে কাজে নেই। বই পড়ে এবং রুচিশীল ছেলে।

স্যার অনুমতি দিলেন, কিন্তু চোখে সেই নির্দেশ। যা করবেন, নিজ দায়িত্বে করবেন। আরজ আলী সাহেবের যাতে কোন ক্ষতি না হয়।

ঊনসত্তরের প্রথম দিকে বাংলা বোশেখ মাসের মাঝামাঝি। কালবৈশাখীর দাপট চারদিকে পুরোদমে। মেহেদীর কাঠের পাটাতনযুক্ত ডাকবাংলো প্যাটার্নের আবাস। দুপুরে খেয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। কীর্তনখোলা নদী থেকে খালের মতো সরু একটি জলাশয় এসে মেহেদীর বাংলো স্পর্শ করেছে। বেদের বহর পড়েছে। আমার পায়ের শব্দ পেয়ে না তাকিয়েই বলল, প্রজেক্টার খারাপ – কাজেই আজ কিছুই দেখা যাবে না। আমি বললাম, বিনা প্রজেক্টারে বাদ্যানী দেখছেন – তাইবা কম কি?

মেহেদী বলল, সমস্ত ইউরোপে আমাদের দেশের বাদ্যানীদের মতো দেহসৌষ্ঠব  আর দেখিনি।

আমি বললাম, আমি আপনার জন্য একটি প্রজেক্টার এনেছি – যার ভেতর দিয়ে দুনিয়া দেখলে, আপনার পরিচিত দুনিয়ার রং বদলে যাবে। বলে আরজ আলী মাতুব্বরের সামগ্রিক পরিচয় দিলাম। আর বললাম, কাজী গোলাম কাদির স্যার বলে দিয়েছেন, মাতুব্বরের পরিচয় আপনি, কাজী সাহেব এবং আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে।

মেহেদী জিজ্ঞেস করল, ইসাক মাতুব্বর সাহেবের তিনি কি হন? বললাম – চাচা।

ইসাক মাতুব্বর সাহেব শহরের একজন সম্মানিত এবং ধনাঢ্য ব্যক্তি। মেহেদীকে কাগজের মোড়কের মধ্যে ‘সত্যের সন্ধান’-এর পান্ডুলিপিটি দিয়ে আমি কাজের তাড়ায় চলে এলাম।

পরদিন ভরদুপুরে মেহেদী হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলো। বললো, এখনি চলুন মাতুব্বর সাহেবের বাড়িতে। বললাম, আপনার নতুন কেনা ডাটসন গাড়ী লামচরি পর্যন্ত নেয়া যাবে না। হেঁটে যেতে হবে। আমার স্পীড বোর্ড আছে, চলুন।

স্পীডবোডে লামচচি পৌঁছুলাম প্রায় সাড়ে তিনটায়। আমি বোটে বসে আছি, মেহেদী মাতুব্বর বাড়িতে রওয়ানা হল। কিছুক্ষন পর ফিরে এসে বলল, আমিনের কাজে দূরে গেছেন, ফিরবেন আগামীকাল। আপনার কথা বলে এসেছি।

এই ফাঁকে স্থানীয় একজন মধ্যবয়সী লোককে জিজ্ঞেস করলাম, মাতুব্বর সাহেব কেমন লোক? উত্তর এলো, উনি হাত না দিলে একশ খুন বাঁচে না।

বরিশালে জায়গা জমি নিয়ে খুনাখুনি লেগে থাকে। এরকম কোন কোন বিবাদের সময় মাতুব্বর সাহেবের ডাক পড়ে। উনি দুপক্ষের দলিলপত্র নিয়ে, চেইন ফেলে, অঙ্ক কষে, যার যার জমির সীমানা নির্ধারিত করে দিয়ে চলে যান। কারো দিকে ফিরে তাকান না, কারো কাছ থেকে একটা পয়সাও নেন না। মাতুব্বর সাহেবকে সবাই মানেন, সবাই শ্রদ্ধা করেন। এমনকি চরমোনাই’র পীর সাহেবরাও  জায়গা জমি সংক্রান্ত মাপজোকের দরকার হলে মাতুব্বর সাহেবকে ডাকেন। মাতুব্বর সাহেব কে এবং কি, তা জানা স্বত্বেও পীর সাহেবরা তাঁর সঙ্গে সৌজন্যপূর্ণ আচরণ করতেন।

মেহেদীর সঙ্গে মাতুব্বর সাহেবের পরিচয় করিয়ে দিলাম। মেহেদী আমার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলল, আপনি না হলে এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমার কোনদিন পরিচয় হতো না। অথচ আমার বাংলো থেকে তাঁর বাড়ির মোড় দেখা যায়। চিরদিনের কাছের মানুষটি চিরদিনের দূরের মানুষ হয়ে থাকতেন। মেহেদীর বাংলোতে আমাদের বহু তাত্ত্বিক বিতর্কের আসর বসতো। আমরা তাঁর পান্ডুলিপি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বিতর্কের অবতারণা করতাম। মুহূর্তের মধ্যে আমরা নীরব শ্রোতায় পর্যবসিত হয়ে যেতাম। তিনি যেন অর্বাচীন শিষ্যদের দুরূহ এবং গভীর বস্তুগুলো নেহাত সোজা ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন। অথচ কখনো তাঁর অহমিকা প্রকাশ পায়নি। অপূর্ব কন্ঠস্বর এবং বরিশালের গ্রাম্য সরল ভাষার গুণে তাঁর প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবন করতাম। মেহেদী একদিন আমাকে বলল, মাটির খবর এই মাটির মানুষটি এতো বেশি রাখেন যে, আমি মৃত্তিকাবিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও তাঁর কাছে লজ্জা পেয়ে যাই। আমি কাঠের ব্যবসা করি – অথচ উদ্ভিদবিদ্যার নাড়ী-নক্ষত্র তাঁর নখদর্পণে।

একদিন মেহেদী তাঁর গাড়িতে করে মাতুব্বর সাহেবকে আমার বাসায় নিয়ে এলো। চা পানের পর স্থীর হল, পচিশ কিলোমিটার দূরে বাবুগঞ্জ থানার দোয়ারিকায় বেড়াতে যাওয়া হবে। পথে মাতুব্বর সাহেবকে তালতলার কাছে তাঁর বাড়ি যাবার রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে।

দোয়ারিকার পথে রওনা দিলাম আমরা। মাতুব্বর সাহেব হঠাৎ মেহেদীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনার গাড়ীর কোথাও সামান্য গোলমাল আছে।

মেহেদীর আত্মশ্লাঘায় ঘা লাগলো। নতুন কেনা গাড়ী। বলল সে, গাড়ীর খবরও আপনি রাখেন নাকি?

ফেরার পথে সার্ভিস সেন্টারে পরীক্ষা করে দেখা গেল, একটা স্ক্রু ঢিলে হওয়ায় সামান্য আওয়াজ হচ্ছিল। দক্ষ মেকানিক তা সেরে তুলল। মেহেদী লজ্জায় মাথা নত করে রাখলো। আস্তানায় ফেরার পর ব্যাপারটা সহজ করার জন্য বললাম, মাতুব্বর সাহেব যন্ত্রবিজ্ঞানের সহজ সূত্র জানেন বলে তাঁর কোন কিছু অজানা নয়।

মাতুব্বর সাহেব ধীরে ধীরে মোটরমেকারের সমস্ত যন্ত্রাংশের নাম বলতে এবং কোনটার কি কাজ বর্ণনা করতে লাগলেন। বললেন, এক সময় মোটর মেকানিজম শিখেছিলাম গাড়ীর ড্রাইভার হওয়ার জন্য। এ সম্পর্কে কিছু বইও যোগার করেছিলাম। পরে আর ড্রাইভার হওয়ার সুযোগ পেলাম না।

কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করলাম, মাতুব্বর সাহেব আমার এখানে কম আসছেন। কাজী সাহেবের ওখানেও আসছেন না। মনে মনে ঈর্ষাবোধ করলাম। নিশ্চয়ই মেহেদীর ওখানে সময় কাটিয়ে চলে যান।

একদিন দুপুরে খেয়েদেয়ে ছুটলাম আমানতগঞ্জের দিকে। দেখি মেহেদী ঘুমুচ্ছে। পায়ের শব্দ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠে বলল, মাতুব্বর সাহেব তো কিছুক্ষন আগে আপনার বাসার দিকে গেলেন, তাঁর মুখে শুনলাম, অনেকদিন ধরে বাবুরহাটে আমিনের কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য এদিকে আসতে পারেন নি।

মেহেদী সহ বাসায় ফিরে এলাম। কিছুক্ষন পর মাতুব্বর সাহেব এলেন। তাঁর প্রথম জিজ্ঞাসা, রকেটের উপর কোন বই আছে কিনা। আমরা কেউ সেই মুহূর্তে সাহায্য করতে পারলাম না।

মেহেদী উনিশশ সত্তরের প্রথম দিকে ঢাকা চলে এলো। পি. জি. হাসপাতালের সামনের ‘টিভোলী’ দোকানটির প্রথম মালিক মেহেদী। সৌখিন জিনিসপত্রের দোকান। আমাদের আমন্ত্রণ জানালো যেন মাতুব্বর সাহেব ও আমি ঢাকা এলে তাঁর দোকানে উঠি। দোকানের পেছন দিকে আমাদের জন্য বিশ্রামের জায়গা রাখা হয়েছে।

একাত্তরের শেষদিকে মেহেদীর ছোট ভাই, আমাদের ছাত্র, বারান্দায় ডেকে নিয়ে বলল, মেঝোভাইকে পাক-দুর্বৃত্ত বাহিনী দোকান থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। আচ্ছন্নের মতো সেই চেয়ারটায় বসে পড়লাম, যেখানটায় মাতুব্বর সাহেবের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই মাতুব্বর সাহেব লঞ্চঘাট থেকে সরাসরি আমার বৈদ্যপাড়ার বাসায় এলেন। ইচ্ছা – আমাকে নিয়ে কাজী সাহেবের সঙ্গে দেখা করেই মেহেদী সাহেবের ওখানে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটাবেন। শুভেচ্ছা বিনিময় এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের পারস্পারিক বিবরণ নেয়ার পর সেই দুঃসহ দুঃসবাদটি মাতুব্বর সাহেবকে দিলাম। উনি শক্ত মানুষ। কিন্তু তাঁকেও সে মুহূর্তে অত্যন্ত বিচলিত দেখলাম। চোখের পানি মুছে বললেন, ভাবতে পারিনি।

কিছু নীরব মুহূর্ত কেটে যাওয়ার পর আমরা কাজী সাহেবের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মেহেদীকে হারানোর বেদনা যে কি অপরিসীম, তা বোঝানোর ভাষা নেই।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ দেশের বিঘোষিত নীতি। সাহসে ভর করে একদিন কাজী গোলাম কাদির সাহেবকে বললাম, স্যার, এখন মাতুব্বর সাহেবের প্রথম বইটি (সত্যের সন্ধান) ছেপে দিতে চাই। স্যার ভুয়োদর্শী মানুষ। আমতা আমতা করে বললেন, ধর্মনিরপেক্ষতা তো আমরা পেয়েছি, কিন্তু — আচ্ছা, ব্যাপারটা আপনার ওপর ছেড়ে দিলাম।

আল আমিন প্রেসের জব্বার মিয়া সাহেবের সঙ্গে আলাপ করলাম। তিনি কাজী সাহেবের বড় ভায়রা ভাই। যার বিয়ে উপলক্ষে কাজী সাহেবের সঙ্গে মাতুব্বর সাহেবের আলাপ-পরিচয় হয়। জব্বার মিয়া মাতুব্বর সাহেবের বই ছাপতে এক কথায় রাজি হলেন। শুধু তাই নয়, বললেন, বইয়ের প্রুফও তিনি ভালো করে দেখে দেবেন। মাঝে মাঝে খবর নিই। জব্বার মিয়া বললেন, আমার কম্পোজিটরদের অভিমত, তারা এর আগে কখনো এতো সুন্দর বই আর ছাপে নি।

বই ছাপা প্রায় শেষ। এমন সময় কোন এক পীরের কাছ থেকে আদেশ এলো বইটি ছাপা বন্ধ করতে এবং যা ছাপা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে ফেলতে। কম্পোজিটরদের মধ্যে পীরের এবং স্থানীয় একটি মাদ্রাসার লোক ওঁত পেতে ছিল। এ্যাদ্দিন কিছু বলেনি বইটি ছাপার শেষ দেখার জন্যে। বইটির বেশ কিছু ‘অফ প্রিন্ট’ বাইরে চলে গেছে। জব্বার মিয়া সহ পরামর্শ করে বইয়ের কম্পোজ কপিগুলো রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন ভাগে কিছু আমার বাসায়, কিছু মাতুব্বর সাহেবের বড় ছেলে – পৌরসভার পাম্প ড্রাইভার মালেক মাতুব্বরের আস্তানায় লুকিয়ে রাখা হল।

পরদিন রাতের লঞ্চে ছাপানো অপূর্ণ প্রিন্টগুলো ঢাকার বর্ণমিছিল প্রেসে পাঠিয়ে দেয়া হল। প্রেসের মালিক তাজুল ইসলাম সাহেব অধ্যাপক শরফুদ্দিন রেজা হাই এবং আমার বিশিষ্ট শুভাকাঙ্ক্ষী এবং হৃদয়বান বন্ধু। আমাদের সুবাদে বইয়ের বাকী অংশগুলো ছেপে বাঁধাইয়ের বন্দোবস্ত করে দিলেন।

আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব চল্লিশখানা বাঁধাইকরা বই নিয়ে বরিশালগামী একটি বৃহদাকার লঞ্চে উঠলেন। দোতলার পাটাতনে একজন প্রবীণ ভদ্রলোক ঘুমোবার আয়োজন করছেন। তখন ভরদুপুর। মাতুব্বর সাহেব বইগুলো তাঁর হাওলায় রেখে খাওয়ার জন্যে নীচে গেলেন।  হোটেল থেকে ফিরে এসে দেখেন বইয়ের বোঁচকাটি নেই। রশিক চোর মনে করেছিল দামী কাপড়ের বান্ডিল। মাতুব্বর সাহেব আবার ফিরে গেলেন এবং কোনমতে পনের কপি বই বাঁধিয়ে সঙ্গে নিয়ে বরিশাল ফিরলেন।

প্রথমে আমার বাসায় এসে এক কপি বই আমাকে উপহার দিলেন। পরে আমরা দু’জন কাজী সাহেবের বাসায় গেলাম। কাজী সাহেব বই হাতে পেয়ে বেজায় খুশী হলেন, মাতুব্বর সাহেবকে অকুন্ঠ অভিনন্দন জানালেন। আদর করে আমার কাঁধে হাত বুলিয়ে দিলেন। সময়টা উনিশশ তিয়াত্তরের দোসরা ডিসেম্বর।

আরজ আলী সাহেবকে আমরা দু’জন প্রস্তাব দিলাম – ঢাকায় কাকে কাকে বই উপহার দিতে হবে। এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বনেরও পরামর্শ দেয়া হল।

চুয়াত্তরের কোন এক সময় মাতুব্বর সাহেবকে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার কিছু ছাত্র জোর করে রিক্সায় তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। তারা কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার ছলে মাতুব্বর সাহেবের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানোর মতলব আঁটছিল। অন্তত মাতুব্বর সাহেবের তাই ধারণা হয়েছিল। এমন সময় কাজী সাহেবের ছোট ভাই কাজী শামসুল হুদা দূর থেকে দেখতে পেয়ে বাঁশের লাঠি জোগার করে জোব্বাধারীদের ভাগিয়ে দিলেন, আর বলতে লাগলেন, একাত্তরে একবার জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেশ ছারখার করেছিস, এখন আবার বেরিয়েছিস।

কাজী শামসুলন হুদা এবং আমরাও ইতোমধ্যে লক্ষ্য করিনি যে, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে হিন্দু-মুসলমান কে কত জোরোশোরে ধর্মকর্ম করতে পারে তারই প্রতিযোগিতায় নেমে গেছি। দুর্গাপূজা-সরস্বতীপূজার ধুমধাড়াক্কার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাস্তার মাঝখানে ঘোড়ার লাদি ও গোবর পরিষ্কার করে শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে মহাধুমধামের সঙ্গে সিরাত ও কিরাত মাহফিল অনুষ্ঠান শুরু করে দিয়েছি। সরকারী উদ্যোগে ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থায় জাতীয় নেতার সগৌরব উপস্থিতি – আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতায় নতুন মাত্রা যোগ করে বুকের ভেতরটায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিল।

মাতুব্বর সাহেবকে বিপজ্জনক এলাকা পার করে দেয়ার জন্য কামাল নামক যে ছেলেটিকে মোতায়েন করেছিলাম, সেই ছেলেটি একদিন সটকে পড়লো। ছেলেটিকে প্রথম যখন অনুরোধ করেছিলাম তখন সে বলেছিল, স্যার, চিন্তা করবেন না। ওনাকে আমার বাপ-চাচা সবাই চেনেন। আপনার আর কাজী স্যারের বন্ধু। কার বাপের সাধ্য তাঁর গায়ে হাত তোলে। বলেই সে যে-অস্ত্র বের করে দেখালো, তাতে আমি আঁতকে উঠলাম। বেশ কিছুদিন পর তার সঙ্গে দেখা হলে বলল, স্যার, তাঁর মতবাদের সঙ্গে আমাদের ধর্মীয় মতবাদের মিল নেই। তাছাড়া বাড়ীর সবাই তাঁর সঙ্গে মেলামেশা করতে বারণ করেছে।

আরজ আলী মাতুব্বরকে আবার আড়াল করতে সচেষ্ট হলাম, স্যারের কাছে একটু লজ্জাও পেলাম। মনে হল সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী। আল আমিন প্রেসের মালিকের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, প্রেসের টাকার চিন্তা করবেন না – শুধু আপনারা সাবধান থাকবেন।

মাতুব্বর সাহেব শহরে আসা-যাওয়া কমিয়ে দিলেন।স্থলপথ ত্যাগ করে লঞ্চে আসা-যাওয়া শুরু করলেন।

এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। মানুষের কাছে আরজ আলী মাতুব্বর আর ‘ঘোড়ার লাদি ও গোবর’ পরিষ্কার করার চেয়ে খাদ্যবস্তু অধিকতর আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিলো। মাতুব্বর এ যাত্রা রক্ষা পেলেন।

এম. এ. নূর সাহেব যে কারণে বরিশাল গিয়েছিলেন, আমিও সেই একই কারণে বরিশাল গিয়েছিলাম – অর্থাৎ কারণটা বৈষয়িক। তবে পার্থক্য এখানে, আমি চাকুরী করতে গিয়েছিলাম, তিনি চাকুরী না করতে গিয়েছিলেন। তিনি আয়কর বিভাগের ডাকসাইটে, উকিল – স্বাধীন ব্যবসা। এখানে থেমে থাকলে জগত সংসারের পক্ষে তাঁকে লুফে নেয়ার অসুবিধা হতো না। তাঁর আরো কিছু ‘দোষ’ ছিল। সেই ‘দোষ’গুলো তাঁকে সাধারণ একজন আইনজ্ঞ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে। তিনি অক্লান্ত পাঠক, সংস্কৃতিসেবী, হৃদয়বান, বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব। ঢাকা থেকে যে কোনো বড় শিল্পী বরিশাল গেলে তাঁর আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন বলে আমাদের কাছে খবর আসত – মায় আমানত আলী-ফতেহ আলী, নাজাকাত আলী-সামামত আলী তাঁর বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। সকল শিল্পের গভীরে পৌঁছে অনুবাধন করার তাঁর আশ্চর্যজনক ক্ষমতা আছে। নূর ভাইয়ের বন্ধুত্ব কামনা করতাম আন্তরিকভাবে।

একদা সেই সুযোগ ঘটে গেলো। শাহেদা নূর ভাবী বাংলা বিভাগে এম. এ. প্রথম পর্বে ভর্তি হয়ে গেলেন। তাঁকে আমরা সবাই বয়োজ্যেষ্ঠতার কারণে সাধারণ ছাত্রী ভাবতাম না- বরং শ্রদ্ধা করতাম। অন্যান্য ছাত্রছাত্রী এবং বয়োকনিষ্ঠ শিক্ষকরা তাঁকে তমিজ করতেন।

তিনি এসে বললেন, আপনার বন্ধু নূর সাহেবের বসন্ত হয়েছে। মনে মনে ভাবলাম, তৌবা, এই বয়সে বসন্ত! তা মনের হোক আর দেহের হোক, বসন্তমাত্রই রোগ এবং ছোঁয়াচে।

অসুস্থ নূর ভাইয়ের পাশে বসে বললাম, যার মনে এবং দেহে চিরবসন্ত বিরাজমান, তাঁর আবার বিজ্ঞপ্তি-দেয়া বসন্ত কেন! তাঁকে ভরসা দিয়ে বললাম –  হাম, বসন্ত, হোস্টেলের সুপার এবং কলেজের অধ্যক্ষ একবার হয়ে গেলে ভবিষ্যতের জন্য আর ভয় থাকে না। তিনি বললেন, মশারির তলে শুয়ে, নিম পাতার ডাল দিয়ে বাতাস করে আর সময় কাটে না। বইটই কিছু থাকলে দিয়ে যাবেন।

অত্যন্ত সঙ্কোচ বোধ করে এবং কয়েকবার ইতস্তত করে ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানা লুকিয়ে নিয়ে তাঁর হাতে দিলাম। বললাম, বইখানা যাতে কেউ না দেখে – সাবধানে রাখবেন। কালকে এসে আপনার মতামত শুনবো।

পরদিন শাহেদা নূর ভাবী এসে বললেন, আপনার বন্ধুকে কি একটা বই দিয়ে এসেছেন – সারারাত ঘুমায়নি। কয়েকবার পড়েছে, আর আপন মনে বিড়বিড় করে কি কি বলছে। আপনাকে আজ যেতে বলেছে।

আমি বিকেলে যাওয়ার পর নূর ভাই উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আমি অনেক দিন এতো ভালো বই পড়িনি। এই লেখককে আমি দেখতে চাই – তাকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই হবে। আরজ আলী মাতুব্বরের পরিচয় প্রকাশ করার পর, তাঁর বই প্রকাশ নিয়ে যে বিপদ ঘটেছিল তা বর্ণনা করে বললাম – তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেয়া কঠিন। তিনি এখন শহরে কম আসেন এবং এলেও তাঁকে আড়াল করে রাখি।

রুগ্ন মানুষের মনে কষ্ট দিতে নেই। বললাম – নূরভাই, কথা দিচ্ছি না, তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।

কাজী গোলাম কাদির সাহেবের কাছে কথাটা পাড়লে তিনি প্রথমে বিতৃষ্ণ নয়নে তাকালেন। পরে বললেন, নূর সাহেব অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর বাসায় বৈশয়িক-অবৈষয়িক কারণে নানা রকমের মানুষ ওঠাবসা করেন। তাঁদের কারো চোখে পড়লে শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে পারবেন তো? ধর্মান্ধদের কুযুক্তির অর্থ খোঁজা যায়; কিন্তু শিক্ষিত লোকেরা যখন যুক্তিহীন হয়ে পড়ে, তখন আচরণ করে ম্যাজিস্ট্রেট ফজলুল করিমের মতো। আপনি তো সবই জানেন। একবার বই ছাপতে গিয়ে কি বিপত্তি না ঘটেছিল।

আমি স্যারকে অনুনয় করে বললাম, এ কাজটিও আমার ওপর ছেড়ে দিন। কোন অসুবিধা হবে না আশা করি।

সেই ব্রাক্ষ্ম মুহূর্তটি এলো। মাতুব্বর সাহেবকে একদিন ঘুরপথে নূর ভাইয়ের বাসায় নিয়ে হাজির হলাম। সময়টা দেখা করার জন্য অসময়। পরিচয় করিয়ে দেয়ার দরকার হল না। নূর ভাই বিস্ময়বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনার বইটি পড়ে আমি এতোই মুগ্ধ হয়েছি যে, আমি আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করেছি।

যে প্রশ্ন আমি নিজে জিজ্ঞেস করিনি, অন্যসূত্রে জেনেছি, তা-ই নূর ভাই করে বসলেন – মাতুব্বর সাহেব, আপনার জীবনে এমন কি ঘটনা ঘটেছে যা আপনাকে এ ধরণের চিন্তা-দর্শনে টেনে এনেছে?

মাতুব্বর সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। আমি আর নূর ভাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অপলক তাকিয়ে রইলাম। শক্ত মানুষটির চোখে দ্বিতীয়বারের মতো আবারো চোখের পানি দেখলাম। মাতুব্বর সাহেব তাঁর মৃত মায়ের ছবি তোলার ঘটনা আনুপূর্বিক বর্ণনা করলেন। এর বিস্মৃত বিবরণ আইয়ুব হোসেনের লেখা জীবনীগ্রন্থে পাওয়া যাবে।

নূর ভাইয়ের হৃদয় দ্রবীভূত হল। শিল্পীমনা মানুষ। সহজে আকুল হন। তিনি সেই সকল লোকদের একজন যারা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেন – মানুষের গুণের কদর করেন, অথচ নিজেরা খ্যাতির কাঙ্গাল নন বিন্দুমাত্রও। বনফুলের মতো। আপনাতে আপনি ফুটে নিঃশেষ হয়ে যান।

মাতুব্বর সাহেবকে তিনি বললেন, মাতুব্বর সাহেব, শামসুল হক সাহেবের মতো আমিও আপনার বন্ধু। আপনার যখন খুশি আপনি নিঃসঙ্কোচে আমার এখানে আসবেন। আজ থেকে আমরা পরস্পরের আপনজন। আপনার অন্য কোন বই থাকলে, তার প্রকাশনার দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার ওপর ছেড়ে দিন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

আমি বললাম, তাঁর ‘সৃষ্টি রহস্য’ নামে আরেকটি বইয়ের পান্ডুলিপি আমার হাতে আছে। আপনাকে পড়তে দেবো। এটি আকারে ‘সত্যের সন্ধান’ থেকে একটু বড় হবে।

নূর ভাই ‘সৃষ্টি-রহস্য’ প্রকাশনার খরচ অর্থাৎ সাড়ে ড হাজার টাকার সবটাই বহন করেন। এরই মধ্যে নূর ভাই ঢাকার লালমাটিয়ায় তাঁর নবনির্মিত বাড়িতে- বরিশাল ছেড়ে চলে আসেন। একদিন মাতুব্বর সাহেব গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, লালমাটিয়ার বাসায় দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর পকেটে হাত দিয়ে বইয়ের বিক্রয়লব্ধ তিন হাজার টাকা নূর ভাইকে দিতে গেলেন, অমনি নূর ভাই বলে উঠলেন – মাতুব্বর সাহেব, ওটা পকেটে রেখে দিন। আমি ফেরত নেয়ার জন্য ও টাকা দেইনি। আপনার মতো চিন্তাশীল ব্যক্তির কাজে ক’টি টাকা লেগেছে – এটাই সার্থকতা। বইটির উৎসর্গ করা হয়েছে এই বলে – ‘আমার পরম সুহৃদ মোহাম্মদ আলী নূর সাহেবকে’। দু’জনের মহৎ হৃদয়ের পরিচয়।

‘অনুমান’ নামক চটি বইটির প্রকাশনায় নূর ভাইয়ের বড় ভাই এক হাজার টাকা খরচ দিয়েছিলেন। তিনি ধর্মভীরু আলহাজ্ব ছিলেন- কিন্তু জ্ঞানতপস্বী মাতুব্বরের ভক্তও ছিলেন।

নূর ভাইকে ঠাট্টা করে কিছুদিন আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যে সময় মাতুব্বর সাহেবকে বই প্রকাশের জন্য সাড়ে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন, এ টাকায় তখন মীরপুরে পাঁচ কাঠা জায়গা কিনতে পারতেন। নূর ভাই উত্তর দেননি। যে মানুষটির মন-মানসিকতা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের চেয়েও অনেক বড়, তাঁর মন জয় করতে নূর ভাই না হয় কয়টি টাকা ব্যয় করলেনইবা। কাজেই আমার কথার উত্তর দেয়ার জন্য তিনি প্রয়োজন বোধ করেননি।

আমি বরিশাল থাকতে আরো দুটো ঘটনা মাতুব্বর সাহেবকে নাড়া দেয়। রোজার ঈদের পর একদিন কাজী সাহেব আমার জন্য জরুরী খবর পাঠালেন। বিকেল চারটা। গিয়ে দেখি মাতুব্বর সাহেব বসে আছেন। চিরাচরিত নিয়মে তিন ইঞ্চি লম্বা পাইপের ভেতর সিগারেট ঢুকিয়ে দিয়ে সুখটান দিচ্ছেন। আমাকে দেখে প্রসন্নতায় উজ্জ্বল হয় মুখ। পকেটে হাত দিয়ে একখানা ঈদ-সংখ্যা ইত্তেফাক বের মুচকি মুচকি হাঁসতে লাগলেন। দেখি আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি লেখা – ‘আরজ আলী মাতুব্বরের জীবন-জীজ্ঞাসা’। জোরে জোরে পড়ে আমাদের দ’জনকে শোনাতে লাগলেন। দু’বার তাঁর চোখে পানি দেখেছি। এবার দেখলাম, আনন্দের উদ্ভাস। একটি লেখা একজন গ্রন্থকারকে কতটুকু উদ্ধৃত করতে পারে তা প্রত্যক্ষ করলাম। প্রবন্ধটি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী’র আরণ্যক দৃশ্যাবলী গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

আরেকদিন কাজী সাহেবের বাসায় গিয়ে দেখি মাতুব্বর সাহেব বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন। যে ফজলুল করিম সাহেবের ওয়ারেন্টে কমিউনিস্ট আখ্যায়িত হয়ে মাতুব্বর সাহেব যৌবনের প্রথমদিকে ‘পবিত্র হাজতবাস’ করেছেন, সেই ফজলুল করিমের নাতি জনৈক শফিকুর রহমান এক লম্বা এবং উচ্ছ্বসিত চিঠি লিখে মাতুব্বর সাহেবকে ঢাকা গেলে তাঁর বাসাবোর বাসায় দেখা করতে বলেছেন। আরো বলেছেন, শফিকুর রহমান ‘সত্যের সন্ধান’ মুখখানি ফুটপাত থেকে উচ্চমূল্যে ক্রয় করেছেন।

আমরা বললাম, চুপচাপ থাকুন। ফাঁদও হতে পারে।

একমাস পর আরেক চিঠি, বেশ লম্বা। অনেক অনুনয়-বিনয়, ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদনান্তে লেখা হয়েছে, আপনার ঠিকানা পেলে আমি দেখা করবো। আপনার মতো আমিও মুক্তবুদ্ধিতে বিশ্বাস করি। মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিবাদের ওপর আমার প্রচুর বই আছে। আমি আমার নানার মতো নই।

আমরা শফিকুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিলাম এবং বললাম, সঙ্গে যাতে মাতুব্বর সাহেব তাঁর ভি.আই.পি-তে কর্মরত মেঝো ছেলেকে নিয়ে যান।

মাতুব্বর সাহেব একদিন বাসাবোতে সকালের দিকে গেলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। জগন্নাথ কলেজে বি. এসসি. ক্লাসে পড়ে, একটি বাচ্চা ছেলে। দাঁড়ি-গোঁফ গজায়নি। অসম্ভব রকমের বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী ছেলে। তাঁর বইয়ের সংগ্রহ এবং অধ্যায়নের গভীরতা দেখে মাতুব্বর সাহেব খুবই মুগ্ধ হলেন। পরবর্তীতে ঢাকায় শফিকের সঙ্গে আমারও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মাতুব্বর সাহেব। তাঁকে আমার খুবই ভালো লেগেছিল। জানি না শফিকুর এখন কোথায় আছে। এক সময় সে মাতুব্বর সাহেবের আলোচনা প্রসঙ্গে ইংরেজীতে মানবতাবাদের ওপর একটি বড় প্রবন্ধ লিখে আমেরিকার আইকনোক্লাস্ট পত্রিকায় ছাপিয়েছিল। শফিক একজন শিল্পীকে দিয়ে মাতুব্বর সাহেবের এক আবক্ষ মূর্তি গড়েছিল। মাতুব্বর সাহেবের বন্ধুভাগ্য ভালোই বলতে হয়।

উনিশশ পচাত্তরের কোন এক সময় ঢাকা থেকে ফিরে মাতুব্বর সাহেব খুবই খুশিমনে বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরূল ইসলামের উদ্যোগে দর্শন ক্লাসে আত্মা ও প্রাণের ওপর একটি মনোজ্ঞ বক্তৃতার বন্দোবস্ত করেন। এই বক্তৃতা শুনে ছাত্র-ছাত্রীরা খুবই মুগ্ধ হন এবং নানা রকম কঠিন প্রশ্ন করেন। মাতুব্বর সাহেব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেসব প্রশ্নের উত্তর দেন। ক্লাসের পর ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে অভিনন্দন অভিভূত করেন।

ড. নুরুল ইসলামের নিকট আরেক কারণে আমরা কৃতজ্ঞ। তিনিই মাতুব্বর সাহেবের ‘সত্যের সন্ধান’ বইটি প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে পড়তে দিয়েছিলেন। ফলে তাঁর হাত দিয়ে বইটির ওপর অপূর্ব সুন্দর প্রবন্ধ বের হয়।

কুখ্যাত ‘পি. ও. নয় নম্বর’ ধারাবলে পচাত্তর সালে পদোন্নতি পাইনি। সারাজীবন বোর্ডের একখানা সিলেকশন এবং ব্যাকরণের ‘কৃৎ’ ও ‘ঘঞ’ প্রত্যয় মুখস্ত করে অধ্যাপনা জীবন সার্থক করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ পদোন্নতি পেয়ে বিভাগীয় প্রধানের চেয়ার অলঙ্কৃত করলেন, যেখানে অনার্স এবং এম. এ. কোর্স একসঙ্গে পড়ানো হয়। ডোবার মাছ সমুদ্রে পড়লে যে দশা হয়। নিজের অক্ষমতা ঢাকার জন্য চতুর্দিকে চোখ পাকিয়ে কথা বলা দেখে বুঝলাম – সরকারী কলেজের ভাত শেষ হয়ে এসেছে। আমার চার বছরের জুনিয়রগণও পদোন্নতি পেল।

আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক প্রফেসর রফিকুল ইসলাম এবং প্রফেসর মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান সাহেব মৌখিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে বললেন, তোমার কি এখনো শিক্ষা হয়নি? এখান থেকে সুযোগ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাও।

কাজেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উনিশশ ছিয়াত্তর সালের জুলাই মাসে যোগদান করি। পেছনে প্রায় চৌদ্দ বছরের কলেজ জীবন, অগণিত বন্ধু-বান্ধব, ছাত্র-ছাত্রী এবং শুভানুধ্যায়ী ফেলে আসি। কিন্তু আমার স্ত্রী থেকে যান বি.এম. কলেজে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে। তাঁকে তো সঙ্গে সঙ্গে বদলী করা যায়নি। সুতরাং বরিশালের সাথে সম্পর্ক তাৎক্ষণিক চুকে যায়নি। ছুটি হলেই বরিশাল ছুটতাম। কাজী সাহেব এবং মাতুব্বর সাহেবের সঙ্গে আগের মতোই দেখা-সাক্ষাত গল্প-সল্প হতো। মনে হতো না- বরিশাল ছেড়েছি।

ইতোমধ্যে আমার বিশিষ্ট বন্ধু অধ্যাপক আব্দুল হালিম এবং তাঁর স্ত্রী অধ্যাপিকা নুরন্নাহার বেগমের সঙ্গে মাতুব্বর সাহেবের পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। তাঁরা তাঁকে সব সময় সাদরে গ্রহণ করতেন এবং মাতুব্বর সাহেবের আগমন তাঁদের কাছে সর্বদা আনন্দদায়ক ছিল।

উনিশশ উনাশি সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমরা বরিশালের পাট চুকিয়ে চলে আসি। বিদায় দিনে একটু একটু বৃষ্টি ছিল, সকাল আটটায়-স্টীমার ছাড়বে। আমার এবং স্ত্রীর লটবহর স্টীমারে তোলা হয়ে গেছে। সহকর্মী এবং ছাত্ররা অনেকে বিদায় দিতে স্টীমার ঘাটে এসেছেন। একপাশে কাজী গোলাম কাদির সাহেব বিমর্ষ নয়নে দাঁড়িয়ে আছে।

বিদায় নিতে গিয়ে খুবই ভাবালু হয়ে পড়লাম। দোতলায় উঠে রেলিং ধরে সবার দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে রইলাম। হঠাত দেখি সুবর্ণকান্তি কাজী সাহেবের পাশে একটি কালো মানুষ কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি দ্রুত ছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। এবার বোধহয় চোখের পানি বাধ মানল না। আবার দ্রুত ফিরে এসে দেখি সিঁড়ির আর একটা তক্তা সরাতে বাকী।

জাহাজের প্রথম শ্রেণীর সামনে ডেকচেয়ারে বসে লামচরির দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। এক সময়ে বাতাসের পরশে চোখের পানি শুকিয়ে গেল। লামচরির মোড় ঘোরার সময় জাহাজের শেষ ভোঁ বেজে উঠলো। দীর্ঘদিনের স্মৃতিময় কর্মক্ষেত্র বরিশাল একসময় চোখের আড়ালে চলে গেলো।

বরিশাল থেকে বৈষয়িক দিক দিয়ে খালি হাতে ফিরলাম। পদোন্নতি এবং অর্থ কোনটাই হল না। কিন্তু অজস্র মানুষের ভালোবাসাও ছেড়ে এলাম। কীর্তনখোলা নদী, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, চারিদিকের সবুজ রূপ কোনটাই আর মনকে সান্ত্বনা দিল না। হঠাত অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘পথে-প্রবাস’র কথা মনে পড়ল। ‘ল্যুভ’ মিউজিয়মে কত অপূর্ব সুন্দর ছবি দেখলেন, ‘মোনালিসা’কে হার মানায়। কিন্তু ট্রেনে ইটালীর দিকে আসার সময় লেখকের মন থেকে সহ ছবি অপসৃত হয়ে শুধু ‘মোনালিসা’ চিরভাস্বর হয়ে রইল।

আমার মন থেকে সব ব্যথা দূর হয়ে গেলো। আমি কি পাইনি? একজন সুবর্ণকান্তি রূপবান মানুষ আর তাঁর পাশে দাঁড়ানো, বৃষ্টি-বাদলায় ছুটে আসা – কালো পাথরে খোদাই করা শালপ্রাংশু দেহ, মাইকেলাঞ্জেলোর ‘মোজেস’। মনে হল, জীবনের সবচেয়ে বড় সঞ্চয় কাজী গোলাম কাদির আর তাঁর হাতে বেয়ে পাওয়া আরজ আলী মাতুব্বর।

কাজী গোলাম কাদির সাহেবদের মতো বন্ধুদের প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যায়। কিন্তু মাতুব্বরের মতো বন্ধু – বাংলার ফসল প্রান্তরের ফসল।

বেশ ক’দিন থেকে মন খারাপ। কাজী সাহেব, মাতুব্বর সাহেবকে ছেড়ে আসার বেদনা – নতুন কর্মক্ষেত্রে মনের উড়ু-উড়ু ভাব। এর মধ্যে হঠাত একদিন বিভাগ থেকে টেলিফোন পেলাম – বরিশাল থেকে আমার একজন আত্মীয় এসেছেন। গিয়ে দেখি মাতুব্বর সাহেব। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি করে এলেন? বললেন, বাসের হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে। বাসায় নিয়ে এলাম। বিভাগের সহকর্মীরা আদর-আপ্যায়ন করেছিলেন। তাঁদের ধারণা হয়েছিল, এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার পিতৃদেব। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুতেই ঘুম পাড়াতে পারলাম না। তিনি দিনে ঘুমোন না। শ্রমিক মানুষ। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ঘুমোন। কথা আর ফুরোয় না।

ঢাকা শহরে এলে, অন্তত তিনদিনের জন্য এলে – একদিন আমার এখানে কাটান। এলে আমার ইজিচেয়ারে জোর করে বসিয়ে দিয়ে পাখা ছেড়ে দেই। প্রথমে চা-নাস্তা, পরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা – নদীর গতি পরিবর্তন, আবহাওয়ার ওপর তার প্রভাব, বন্যার পরিণাম, কেন বন্যার পর পলি পড়লে ফসল ভালো হয়, পলিতে কি গুণ থাকে, প্রতি বছর একই সময় ঝড়-বৃষ্টি বন্যা হয় না কেন, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিধারার বৈলক্ষণ্য কোন প্রভাব ফেলে কি না, এক এক এলাকায় মাটির গুণের তারতম্য কেন – তিনি বিশদভাবে সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে বলতেন- আমি যে সব কথা বলছি, তা সব আমার কথা নয়। অমুক অমুক বইতে পাবেন। আব্দুল জব্বারের ‘খ-গোল পরিচয়’ থেকে শুরু করে, আল-মূতীর লেখা, আব্দুল হালিমের বৈজ্ঞানিক রচনাবলী, এমনকি শাহজাহান তপনের প্রবন্ধবলীও মাতুব্বর সাহেবের জ্ঞানসীমানায় বিরাজ করতো। দুরূহ বিষয়গুলোকে অপূর্ব সহজ ভঙ্গিমায় অবলীলাক্রমে বর্ণনা করতেন, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মাঝে মাঝে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের ডেকে আনতাম। তাঁদের অনেকেই মাতুব্বর সাহেবের ভক্ত হয়ে ওঠেন। এঁদের অনেককে মাতুব্বর সাহেব বই উপহার দেন। তাঁরাও বাংলা লেখায় বিজ্ঞানের বা ধর্ম-দর্শনের বই তাঁকে উপহার হিসাবে প্রদান করেন। একবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি বক্তা হিসাবে আগত অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলাপ হয়। অধ্যাপক রায় তাঁর সঙ্গে আলাপ করে মুগ্ধ হ্ন। তাঁরা পরস্পরকে নিজেদের লেখা বই উপহার দেন।

দর্শনের যে কোন বিষয় সম্পর্কে সহজ-সরল ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আমার একটি ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের বরিশাল ছাড়ার মাস চারেক আগে রামকৃষ্ণ মিশনের সচিব, আমার প্রিয় ছাত্র মাণিকলাল চ্যাটার্জী গোটা বিশেক বইসহ একখানা আমন্ত্রণলিপি আমার নামে বাসায় রেখে যান। স্বামী বিবেকানন্দের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমাকে প্রধান বক্তন করা হয়েছে। সম্ভবত প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রবীণ এবং অবসরপ্রাপ্ত স্বামী অক্ষরানন্দ। বিশেষ অতিথি কলকাতা বেলুড় মঠের তরুণ স্বামী প্রেমানন্দ। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। উপনিষদ, বেদান্ত বা চার্বাক দর্শনের কিছুই জানি না। ভরসা মানিকলালের দেয়া বই আর কাজী গোলাম কাদির সাহেব। স্যারের কাছে সব খোলাসা করে বলাতে তিনি বললেন, এ আর এমন কি? এক মাস সময় হাতে আছে। বই পড়ুন আর সন্ধ্যার সময় হোস্টেল সুপারের অফিসে আসুন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বুঝিয়ে দেবোখন।

কাজী সাহেব আমাকে সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করে বোঝাতে লাগলেন। স্যার যত বোঝান, আমি তত অনুঝ হয়ে পড়ি। কতগুলো ভারী ভারী দার্শনিক শব্দ এবং উপমা আমার মস্তিষ্কের ভেতর কৈ মাছের মতো অবাধে বিচরণ করতে লাগল। তিনি মাঝে মাঝে পরীক্ষা নিলে আমি অবধারিতভাবে ফেল মারতে শুরু করলাম। পরে লজ্জা-শরমের তাড়নায় স্যারের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। এর মধ্যে একদিন দুপুরে মাতুব্বর সাহেব এসে হাজির। খাওয়া-দাওয়ার পর নানা কথার ঝুলি খুলে দিলাম। কথায় কথায় আমার দার্শনিক সঙ্কটের কথা বললাম। তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় দ্বৈতাদ্বৈত দর্শন, কালী দর্শন, উপনিষদ কি, বেদান্ত দর্শনের সঙ্গে বিবেকানন্দের জীবন দর্শনের সম্পর্ক কি? তিনি পরমপুরুষ রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্যত্ব কেন গ্রহণ করলেন ইত্যাদি বোঝাতে লাগলেন। শঙ্কর রামানুজের বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যার সঙ্গে বিবেকানন্দের ব্যাখ্যার পার্থক্য কোথায় – এটাও সংক্ষেপে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন। আমি তাঁর কথা শুনতে শুনতে কাগজে নোট নিতে লাগলাম।

সেই সময়ের জন্যে আমি আমার প্রয়োজনমাফিক উপাদান পেয়ে গেলাম। কাজী সাহেব মাঝে মাঝে প্রশ্ন করলে আমি ‘গুডবয়ে’র মতো উত্তর দিতে লাগলাম। কাজী সাহেব খুশী হয়ে বলতেন, বাহ এই তো পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। আসল গোমর কি ফাঁক করা যায়?

বক্তৃতা দেয়ার সেই শুভক্ষণটি এলো। মঞ্চের মাঝখানে বসলাম। ডানদিকে বৃদ্ধ স্বামী, বামদিকে তরুণ স্বামী। আমার পোষাক এবং চেহারার জন্য চেহারার জন্য স্বামীদ্বয় বিরসবদন। তাঁদের গেরুয়া বসন। মাঝখানে আমার অবস্থা যৌতুকবিহীন পাত্রীর মতো। একজন স্বামী পরলোকগত। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসে জীবিত স্বামীদ্বয়কে নিয়ে মনে হল সংকটে পড়লাম।

সে যাক, অবশেষে সভাপতি শ্রদ্ধাভাজন জয়ন্ত দাশগুপ্ত আমাকে বক্তৃতা দেয়ার জন্য মাইকের সামনে আহ্বান করলেন। সভাপতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্বোধন করে বললাম, আমার প্রিয় সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে আজকে মঠে বন্দী করা হয়েছে – তিনি তো মঠের সন্ন্যাসী নন, তিনি মাঠের সন্ন্যাসী। বলেই তাঁর জীবনদর্শন, বিশ্বমানবতার প্রতি আহ্বান, শিকাগোর বক্তৃতার উদ্ধৃতি ইত্যাদি বর্ণনা করে প্রায় একঘণ্টা বক্তৃতা করলাম। স্বামী দু’জন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। একজন বেলুড় মঠে আমন্ত্রণ জানালেন। আমার যৌতুক দেয়া হয়ে গেলো বুঝি!

বাসায় সারারাত ঘুমের মধ্যেও চোখে ভেসে উঠল আরজ আলী মাতুব্বরের চেহারা। কাজী সাহেব অত্যন্ত উচ্চমার্গ থেকে বলতেন বলে মানসিক প্রস্তুতি না থাকার কারণে তাঁকে বুঝে উঠতাম না। আর মাতুব্বর সাহেব কঠিন বিষয়কে সহজ করে বলার অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর বলার ভঙ্গি, চলার ভঙ্গি এবং লেখার ভঙ্গি তাঁর জীবনাচরণের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।

আরজ আলী মাতুবব্বর সাহেব মৃত্যুর দু’মাস আগেও বাসায় এসেছিলেন। তাঁর শরীর এবং চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, মাতুব্বর সাহেব, আপনাকে বড্ড দুর্বল দেখাচ্ছে। একা চলাফেরা না করে সঙ্গে কাউকে নেবেন।

উত্তরে তিনি বললেন, একটু দুর্বলতা বোধ করছি, কিন্তু মনোবল হারাইনি।

অনেকের মতো আমি নিজেও নিজেকে বার বার প্রশ্ন করেছি। দীর্ঘ বিশ বছর যাবত তিনি আমার কাছে আসতে সমান আকর্ষণ বোধ করেছেন। দু’জনের বয়সের পার্থক্য দুস্তর। তবু পরস্পরের কাছে মনের ভাব প্রকাশে অসুবিধা হয়নি। আমরা দু’জনেই বয়স এবং শিক্ষা-দীক্ষার অভিমান ভুলে গিয়েছিলাম।

তিনি দশটি সন্তানের জনক ছিলেন। তবুও মনে হয় আরেকটি সন্তানের ক্ষুধা তাঁর অন্তরের অন্তরালে লুকিয়ে ছিল। যে সন্তানের কাছে তিনি তাঁর অপরিসীম বৈদগ্ধকে উন্মোচিত করতে পারেন।

আমি মাতুব্বর সাহেবের একাদশ সন্তান ছিলাম।

উনিশশ’ বিরাশি সালে আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমার বাবা আমার সঙ্গে থাকতেন। বাবার জীবন সংগ্রামমুখর। তাঁর বাবার মৃত্যু হয় তাঁর দাদার বর্তমানে। সুতরাং ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক বাবা এবং দুই নাবালক ভাই ‘লা-মো’রম’ অর্থাৎ দাদার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। সুতরাং সর্বহারা বিধবা মা এবং দু’টি ভাইকে বাঁচানোর জন্যে বাবা দূর সম্পর্কের এক সারেং আত্মীয়ের হাত ধরে কলকাতার খিদিরপুরে গিয়ে জাহাজে চাকুরীর নলী করেন। নলী এক রকমের ‘সারভিস বুক’। তখন তাঁর বয়স আঠার বছর। স্থানীয় স্কুলে ষষ্ঠ শেণী পর্যন্ত পড়েছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধ তখন মন্থরগতি হয়ে এসেছিল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টীম নেভিগেশন কোম্পানীতে অনেক লোকের দরকার। সুতরাং বাবার চাকুরী তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো। বেতন মাসে সতের টাকা, খাওয়া-দাওয়া, জামা-কাপড় সবই যিনি পয়সায়। এত বড় সফলতায় বাবার শুভাকাঙ্ক্ষীরা সুখী, বাকীরা বেজার।  বাবা এসব গল্প রসিয়ে রসিয়ে বলতেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর বাবা বিদেশী জাহাজে চাকুরী করেছেন। সারা পৃথিবীর সবগুলো সামুদ্রিক বন্দর স্পর্শ করেছেন। সঙ্গে থাকতো একখানা বিশ্ব ইতিহাস, মোটা একখানা ভূগোল, আর আকারের একখানা ভূচিত্রাবলী। সারা পৃথিবীর মানচিত্র বাবার নখদর্পণে। বাবা ছোটবেলায় আমাকে বলশেভিক বিল্পবের ইতিহাস শোনাতেন। কিভাবে একটি দেশ পুরনো ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলে শ্রমিকভোস্টক পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বলেছেন, সারা বছর বন্দরটি বরফে ঢাকা থাকে। বরফ কাটা জাহাজে কত কত বন্দরে তাঁদের জাহাজ নিয়ে প্রবেশ করতে হয়েছে। মানবজাতির জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির প্রত্যক্ষ ফসল নিজের চোখে দেখে এসে স্বদেশবাসীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মূঢ়তা নিয়ে আফসোস করতেন। বলতেন, এদেশকে জাগাতে হলে দেশের মানুষকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে গণশিক্ষা দিতে হবে  এবং ব্যাপকভাবে বিজ্ঞানচর্চা করতে হবে। বাবার কাছে দেশ-বিদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কাহিনী শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যেতাম।

বাবা সিলেটের আলতাফ আলী আর ডা. মালিকের নেতৃত্বে জাহাজী শ্রমিকের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে পুলিশের হাতে নাজেহাল হয়েছিলেন। বাড়ীতে এসে ছয়-সাত মাস চাষ আবাদের কাজে নিয়োজিত থাকতেন। আবার ডাক এলে জাহাজে চলে যেতেন। আমার কৃষক-শ্রমিক বাবার জন্য আমি এখনো গৌরববোধ করি। জীবনে কারো কাছে তিনি হাত পাতেননি। বিধবা মা আর দুটি নাবালক ভাইকে নিয়ে নিজের ভাগ্য নিজে গড়েছেন, জায়গা-জমি যা খরিদ করেছেন- সবই তিন ভাইয়ের নামে। আমাকে আর আমার একমাত্র ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বার বার সাবধান করে দিয়েছেন। শিক্ষিত লোকদের কুসংস্কার সমাজের বেশী ক্ষতি করে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন।

আরজ আলী মাতুব্বরের চেহারা এবং চিন্তা-চেতনার মধ্যে আমি আমার বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতাম।

অবসর গ্রহণের পর আমার বাবা কেমন যেন হয়ে গেলেন। গ্রামে থাকতে থাকতে কুসংস্কারের বেড়িতে আটকা পড়ে গেলেন। বাবা আগে যা বলতেন, এখন ঠিক তাঁর বিপরীত কাজ করতে লাগলেন। আকাশের মতো বিশাল এবং মহাসমুদ্রের মতো গভীরহৃদয় বাবা ক্রমে ক্রমে সঙ্কুচিত হয়ে নোয়াখালীর অন্তর্গত বামনী এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লেন। বুঝতে দেরি হল না, মহাসমুদ্রের তিমি ডাঙ্গায় আটকা পড়েছে। তাগা-তাবিজ-তুমার এবং ঝাড়ফুঁকে একটু একটু বিশ্বাস করেন। হাতে তসবি এবং পাঞ্জেগানা নামাজ পড়েন। আজকাল ছেলে-পিলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বেদাতি কাজকর্মে লিপ্ত বলে অভিযোগ করেন। যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট হলে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনেছেন বলে গৌরববোধ করতেন, নজরুলের গান তাঁর স্বকন্ঠে শুনেছেন, সেই বাবা ওই সব হিন্দুয়ানী কবি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা অপছন্দ করতে শুরু করলেন।

বুঝলাম, আমার বাবা হারিয়ে গেছেন।

বরিশাল থেকে ঢাকা এসে, সময়ে সময়ে বাশের হাতল ধরে, সাভারে আমার বাসায় আসেন একজন অশীতিপর বৃদ্ধ। আত্মীয়-স্বজন নন – এমনকি একজন প্রাক্তন সহকর্মীও নন, স্বাভাবিকভাবে আমার বাবার মনে প্রশ্ন জাগে, লোকটি কে? একদিন জিজ্ঞেস করাতে, আমতা আমতা করে বললাম, তিনি বরিশালের একজন কৃষিজীবী। শহর থেকে ছয় সাত মাইল দূরে থাকেন। মনে হল, বাবার মন থেকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব গেল না। আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সঙ্গে খাতির হল কেমন করে?

আর কোনরূপ রাখঢাক না করে মাতুব্বর সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্কের পটভূমি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলাম। তাঁর জীবন ও মনন সম্পর্কে ধারণা দিলাম তাঁকে। বললাম, বাবা, তাঁর দুইখানা প্রধান গ্রন্থ থেকে আপনাকে পড়ে শোনাই? অনুমতি পেয়ে ‘সত্যের সন্ধান’ ও ‘সৃষ্টি রহস্য’ থেকে বিশেষ বিশেষ অংশ পড়ে শোনাতে লাগলাম। বাবা মুগ্ধ হয়ে শুনলেন। এক সময় দুটো ছানাবড়া করে বললেন, একজন শিক্ষাদীক্ষাহীন কৃষক এমন লেখা লিখলো?

আমি বললাম, মাতুব্বর সাহেব স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। দীর্ঘ সত্তর বছর নিজে নিজে লেখাপড়া করে চারখানা বই লিখেছেন।

আমাকে আদেশের স্বরে বাবা বললেন, তোমাকে একখানা কথা বলি, লোকটির সব কথার সঙ্গে হয়তো একমত হবে না, কিন্তু তাঁর কথার মধ্যে চিন্তা আছে, দর্শন আছে। রবীন্দ্রনাথ স্কুলে যাননি, নজরুল তোমাদের মতো এম. এ. পাশ করেননি, তবু তাঁদের সম্মান কত ওপরে!

আবার বললেন, গ্রাম্য কৃষক বলে অবহেলা করবে না। এতোদূর থেকে অন্তরের টানে তোমার কাছে আসেন। তিনি বড়মাপের মানুষ। এমনিতেই মুসলমান সমাজে চিন্তাশীল মানুষের অভাব।

আনন্দে আমার মন উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, মনে হল অনেক দিন আমার হারানো বাবাকে এক ঝলকের জন্য পুনরায় আবিষ্কার করলাম।

একদিন দুপুরে বাসায় ফিরে দেখি বাবা এবং আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব পাশাপাশি বসে আলাপ করছেন। দু’জনের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উভয়ের চেহারা দেখে আমার তাই মনে হল।

দুপুরে খেতে বসার সময়ও দু’জন পাশাপাশি বসলেন। আমার বাবা অতি আন্তরিকতার  সঙ্গে মাতুব্বর সাহেবের পাতে তরকারী তুলে দিচ্ছেন। খাওয়া শেষে বাবা বললেন, আপনি তো কিছুই খান না। নিন, দুধটুকু দিয়ে কলা মেখে আরেক মুঠ ভাত খান।

আমি মুচকি হাসলাম। আমার এই হাঁসির অর্থ দু’জনের কেউই জানলেন না। হঠাত মনে হল, আমার চোখের সামনে আমার দুজন বাবা বসে আছেন।

আমার স্ত্রী অধ্যাপিকা হামিদা কাওসার সবসময় তাঁকে আমাদের অতি ঘনিষ্ঠ আপনজনের মতো গ্রহণ করতেন। তাঁর সেবা এবং যত্নের কোন সময় বিন্দুমাত্র ত্রুটি হতো না। আমাদের বাসায় কাজী গোলাম কাদির সাহেবেরও একই রকম অভ্যর্থনা হতো। আমার পরিবার-পরিজন সবার কাছে এঁরা দু’জন শুধুমাত্র বহিরাগত অতিথি হিসাবে হতেন না। দীর্ঘ বিশ বছরের সম্পর্কে কখনো ছেদ পড়েনি। কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। মতান্তর ছিল বহু বিষয়ে, কিন্তু মনান্তর মুহূর্তের জন্যও।

মাতুব্বর সাহেব একদিন অসুস্থ অধ্যক্ষ সাঈদূর রহমান সাহেবকে দেখতে গেলেন। সঙ্গে আমি। প্রথমে বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ডাক্তারের নিষেধ। পরে যখন খবর দেয়া হল, আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব এসেছেন সঙ্গে একজন বন্ধুকে নিয়ে – সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেলো। মাতুব্বর সাহেবকে কাছে পেয়ে ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে কথার অর্গল খুলে দিলেন। কিছুক্ষন পর মাতুব্বর সাহেব আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অধ্যক্ষ সাঈদুর রহমান সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার বাড়িতে ঢুকতে ভয় করলো না?

আমি জিজ্ঞাসা চোখে তাকাতে তিনি বললেন, আমার বাড়ির নাম ‘সংশয়’। এ বাড়িতে আসতে অনেকেই ভয় করে।

আমি বললাম, স্যার, আপনার বাড়িতে ঢুকতে আমার একটুও ভয় করেনি। কারণ যার সঙ্গে এসেছি তিনি আমার কাছে ‘সংশয়াতীত’ ব্যক্তি।

মাতুব্বর সাহেব মুচকি হেঁসে বললেন, এই অধ্যাপক শামসুল হকের কথা একদিন আপনাকে বলেছিলাম।

অধ্যক্ষ সাহেব স্মরণ করার চেষ্টা করে পরে বললেন, আপনি এর পর একা যখন খুশি আসবেন। আমি বললাম, ‘আপনি’ বললে আসবো না। আমি আপনার ছেলের বয়সী।

বললেন, সংশয়ের অর্থ বোঝ? সংশয় হল সব জ্ঞানের উৎস। আবার এসো – বলেই হাতের ওপর হাত রেখে আদর করে দিলেন।

আর কোন দিন অধ্যক্ষ সাইদূর রহমানের বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য হল না। আরজ আলী সাহেবকে একদিন বললাম, সাঈদূর রহমান সাহেবের সঙ্গে আপনার পরিচয় হল কেমন করে?

তিনি বললেন, সে অনেক কথা। আমি অনুরোধ করলাম সংক্ষেপে বলার জন্য। মাতুব্বর সাহেব বলতে লাগলেন, সম্ভবত পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে অথবা ষাট দশকের প্রথম দিকে মুলাদী যাচ্ছিলাম – জমি মাপার জন্য। দুই পার্টির মধ্যে একচোট মারপিট হয়ে গেছে। আরেক চোট খুনাখুনি পর্যায়ে যাবার আগে আমার কথা মনে পড়ল। উভয় তরফের আহ্বানে আমি চেইন আর কাগজ নিয়ে নৌকাযোগে রওয়ানা হলাম। নৌকার মধ্যে দেখলাম এক ভদ্রলোক একখানা বই পড়ছেন, নাম ‘মানবমনের আযাদী’। লেখক বিখ্যাত যৌনবিজ্ঞানী আবুল হাসনাত। আমি তাঁর কাছ থেকে বইখানির ঠিকানা এবং প্রাপ্তিস্থান লিখে নিলাম।

বাড়িতে ফিরে কয়েকদিন পর বইখানি যোগার করলাম। এই বইখানি আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ঠিক করলাম, তোপখানার ঠিকানায় হাসনাত সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আমার ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানির পান্ডুলিপি পড়তে দেবো।

মাতুব্বর সাহেব ঢাকা গিয়ে নিজে আর হাসনাত সাহেবের বাসায় গেলেন না। ডি. আই. টি- তে কর্মরত পুত্র খালেককে হাসনাত সাহেবের বাসায় পান্ডুলিপি সহ পাঠালেন। খালেক অতি সঙ্কোচের সঙ্গে তাঁর পিতার আকর্ষণহীন খাতায় লিখিত ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানি হাসনাত সাহেবের হাতে তুলে দিলেন। গ্রামের ‘অশিক্ষিত’ একজন কৃষকের লেখা হাসনাত সাহেবকে খুব বেশী আগ্রহী করে তুলতে পারল না। শুধু বললেন, কয়েকদিন পর এসে খবর নিও।

খালেক বলেছিলেন, আমার বাবা আপনার বই পড়েছেন এবং আপনার মতামত তাঁকে নাড়া দিয়েছে। তাতেও হাসনাত সাহেব আগ্রহী হলেন কিনা বোঝা গেলো না।

কয়েক সপ্তাহ পর খালেক আবার তাঁর বাবার লেখা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গেলেন। আবুল হাসনাত সাহেব তখনো পান্ডুলিপি ছুঁয়ে দেখেননি।

খালেকের মলিন মুখ দেখে সম্ভবত হাসনাত সাহেবের সহানুভূতি হল। বললেন, আগামীকাল বিকেলে এসো, দেখে রাখবো।

আরজ আলী সাহেব আমাকে বললেন, হাসনাত সাহেব প্রথম পরিচয়ে জিজ্ঞেস করলেন, লেখাটি আপনার নিজের? কি কাজ করেন?

মাতুব্বর সাহেব জবাবে বললেন যে, লেখাটি তাঁর নিজ হাতের এবং তিনি একজন কৃষক।

আবুক হাসনাত সাহেব প্রসঙ্গক্রমে বললেন, আপনার বইটি কয়েক পাতা পড়ার পর শেষ হওয়া পর্যন্ত পায়চারি করে পড়েছি। আমার সঙ্গে চলুন, আমাদের একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেবো। আপনার লেখার যেখানে যেখানে দাগ দিয়েছি – সেই অংশগুলো পড়ে শোনাবেন।

মাতুব্বর সাহেবকে তিনি কোথায় এক বিরাট ড্রইংরুমে নিয়ে গেলেন তাঁর মনে পড়ে না। অনেক জ্ঞানী- গুণী উপবিষ্ট। সেই মলিনবেশ গ্রামের কৃষককে নিয়ে হাসনাত সাহেব তাঁদের ‘মিলন সঙ্ঘের ঘরোয়া আলোচনা অনুষ্ঠানে যখন প্রবেশ করলেন, সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আরজ আলী মাতুব্বর ভয় পেয়ে গেলেন।

হাসনাত সাহেব সবাইকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, আজ আমাদের নির্ধারিত আলোচ্যসূচী বাদ দিয়ে একটি সম্পূর্ণ নতুন এবং বিস্ময়কর বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। আমি সঙ্গে করে যে ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছি, তিনি বরিশাল শহরের কাছে লামচরি গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক। নিজের প্রচেষ্টায় তিনি প্রায় চল্লিশ বছর লেখাপড়া করে একখানা বই লিখেছেন। বইয়ের নাম রেখেছেন ‘সত্যের সন্ধান’। আরজ আলী মাতুব্বর স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। মাতুব্বর সাহেব, আপনি আপনার বইয়ের অংশবিশেষ সবাইকে পড়ে শোনান।

মাতুব্বর সাহেব তাঁর আকর্ষণীয় কন্ঠে, বরিশালের আঞ্চলিক উচ্চারণে ‘সত্যের সন্ধান’ পড়তে লাগলেন। সমস্ত ড্রইংরুম মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর গ্রন্থপাঠ শুনতে লাগলেন। পাঠ শেষ করে তিনি বসে পড়লেন। কারো মুখে কথা নেই। হঠাত সবাই উঠে এসে তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি করে প্রস্তাব করলেন মাতুব্বর সাহেব ‘মিলন সঙ্ঘের’ অবৈতনিক সদস্য হবেন। এবং প্রতি সভার আগে তাঁকে চিঠি লেখা হবে। তিনি এক একবার এক একজনের অতিথি হয়ে ঢাকা শহরে অবস্থান করবেন। এভাবে তিনি অনেকের মতো অধ্যক্ষ সাইদূর রহমানেরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। তখনকার সামাজিক পরিবেশে তাঁরা প্রত্যেকেই মাতুব্বর সাহেবকে বই ছাপতে নিষেধ করেছিলেন।

অধ্যক্ষ সাঈদূর রহমান সাহেব ও আবুল হাসনাত সাহেব ছাড়া শিল্পী আবুল কাসেম ও তৎকালীন পাবলিক সার্ভিস কমিশন চেয়ারম্যান বারী মালিকের সঙ্গেও মাতুব্বর সাহেবের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মিলন সঙ্ঘের সভা করে বরিশাল ফিরে তাঁর বন্ধুদের সম্বন্ধে আমাদের কাছে গল্প করতেন।

আরজ আলী মাতুব্বর সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘ বিশ বছরের। এই সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য। আমার কোন আত্মীয়ের সঙ্গেও এতো দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠতা ছিলনা। একই রকমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদিরের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গেও আমার শেষ দেখা হয় তাঁর মৃত্যুর একমাস আগে, তাঁর মেঝো কন্যার লালমাটিয়ার বাসায়। দুপুরে কাজী সাহেব সহ শেষ খাওয়া হয় এম. এ. নূর সাহেবের বাসায়।

মৃত্যুর এক বছর আগে থেকে মাতুব্বর সাহেব কিভাবে একটি পাঠাগার করবেন, স্থানীয় মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি দেবেন, নিজের চোখদুটি দান করবেন এবং দেহখানি শারীরবিদ্যা শেখার জন্য মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের জন্য রেখে যাবেন ইত্যাদি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করতেন। তাঁর জীবনের ষাট বছর পর্যন্ত যা কিছু উপার্জন করেছেন, তা উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যাবেন। ষাট বছর বয়সের পর আর যা আয় করেছেন, তাঁর সবটুকু জনহিতকর কাজে ব্যয় করার জন্য বরিশালের ডেপুটি কমিশনারকে চেয়ারম্যান করে একটি ট্রাস্টি বোর্ডের হাতে দিয়ে যাবেন। মাতুব্বর সাহেব তাঁর কথামতো কাজ করে গেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে পাঠাগারের গুরুত্ব যে কোন অংশে কম নয়, তা তিনি একাধিকবার ব্যক্ত করে গেছেন। সেইজন্য তিনি কোন স্কুল প্রতিষ্ঠা না করে পাঠাগার নির্মাণ করে গেছেন। পাঠাগারই তাঁর ব্যক্তিগত জ্ঞানচর্চার উৎস। তাই তাঁর পাঠাগারের প্রতি অপরিসীম দুর্বলতা ছিল।

জীবনে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করে গেছেন। তা ধরে রাখতে পারিনি। তখন তো ভাবতে পারিনি, একদিন আমাকে তাঁর সম্বন্ধে কথা বলতে হবে।

তিনি বলতেন, ‘সত্যের সন্ধান’ দিয়ে আমি কুসংস্কারের ডালপালা ছেঁটে দিয়েছি। আর ‘সৃষ্টি-রহস্য’ দিয়ে কুসংস্কারের মূলশুদ্ধ উপড়ে দিয়েছি।

তাঁর সঙ্গে আমার কোনদিন মনান্তর হয়নি, কিন্তু মাঝে মাঝে মতান্তর হয়েছে। আমি বলতাম, আপনি তো সংস্কারমুক্ত বৈজ্ঞানিক সমাজ কল্পনা করছেন, তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। একটা সমাজ বা দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে তাঁর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রূপরেখা।

মাতুব্বর সাহেব বলতেন, একটা দেশের সমাজ অশিক্ষা ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত হলে সে দেশের রাজনীতিও স্বচ্ছ হবে।

মাতুব্বর সাহেব জিততে পারেন নি। বিশিষ্ট কথাশিল্পী হাসনাত আবুল হাই সাহেবের অসাধারণ উপন্যাস ‘একজন আরজ আলী’তে এই চিত্র সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। চরমোনাই পীর সাহেবের সঙ্গে তাঁর ভক্তদের কথোপকথন স্মরণ করলে পাঠক সমস্ত ব্যাপারটি সুন্দরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন।

কুসংস্কার-অশিক্ষায় লামচরি গ্রামখানি ছোট; কিন্তু সত্যসন্ধানী আরজ আলী মাতুব্বর অনেক বড়। বিগত বছরগুলোতে ‘লামচরি’ গ্রামখানি বড় হতে হতে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল গিলে ফেলেছে। এখন আরজ আলী মাতুব্বরের মতো একজন যুক্তিবাদী সংস্কারমুক্ত সত্য ও বিজ্ঞানপ্রেমী মানবতাবাদীর বড়ই প্রয়োজন।

মুহম্মদ শামসুল হক

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x