ঈশ্বরপুজো নিয়ে, উপাসনা-ধর্ম নিয়ে, ভারতের সাধক-সাধিকাদের জীবনী (?) ও নীতি-উপদেশ নিয়ে বাংলা ভাষায় বইয়ের অভাব নেই। আজও, একবিংশ শতাব্দীতে পা দিয়েও আমরা ‘সাধক-সাধিকা’ বলতে, সাহিত্য-সংগীত-বিজ্ঞান বা ক্রীড়া সাধনার মত বাস্তব সাধনার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের বুঝি না। যা নেই, তার সাধনায় মত্ত অথবা মত্তের ভানকারীদের বুঝি। তাঁদের নামে ভক্তি গদগদ হই। আমরা রামকৃষ্ণ, লোকনাথের ছবির সামনে ধূপ জ্বালি, পুজো করি। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনােেথর ছবির সামনে ধূপ জ্বালি না, পুজো করি না। এই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের সংস্কৃতির মূল ধারা।

আমরা ক’জন জানি—প্রাচীন ভারতীয় দর্শন মূলত নিরীশ্বরবাদী দর্শন। কথাটা অনেকের কাছে নতুন শোনালেও এটাই একশো ভাগ সত্যি। আমরা সত্যিটা ভুলতে বসেছি মিথ্যের লাগাতার প্রচারে। আমাদের কাছে সত্য ধরা পড়ে না জিজ্ঞাসু মনের অভাবে, ‘সবজান্তা’ ভণ্ডামির কারণে। আমরা ‘ইগো’য় ঠাসা কুয়োর ব্যাঙ হয়ে বাঁচতে ভালোবাসি।

এখনও ‘আমাদের বাংলা ভাষা অনেক ভাষার তুলনায় কম সমৃদ্ধ। এখনও আমরা ‘ধর্ম’ বলতে প্রধানত উপাসনা-ধর্মকেই বুঝি। ‘Property’ (বৈশিষ্ট্য বা গুণ) এবং ‘Religion’ (ঈশ্বর নির্ভর উপাসনা-ধর্ম বা উপাসনা-ধর্ম)-এর মত দুটি স্পষ্ট বিভাজন সমৃদ্ধ ভাষাগুলোতে উপস্থিত। কিন্তু বাংলা ভাষায় অনুপস্থিত। ফলে ‘ধর্মের বই’ বলতে আমরা উপাসনা-ধর্মের বইকেই বুঝি। উপাসনা-ধর্ম নিয়ে যে’সব বই-পত্তর বাজারে চলছে, তার প্রায় সবই উপাসনা-ধর্মগুরুদের লেখা। এইসব বই তন্ত্র, যোগ, পূজা-পদ্ধতি, উপদেশময়। মারণ-উচ্চাটন, বশীকরণের মত বিষয় নিয়েও পুরানো পুঁথি-পত্তর নতুন করে ছাপছেন কোনও কোনও প্রকাশক। ‘ধর্মগ্রন্থ’-এর ক্রেতারা সাধারণভাবে ঈশ্বর- বিশ্বাসী মানুষ। এইসব ‘ধর্মগ্রন্থ’গুলোর আরও একটি বৈশিষ্ট্য আছে ; যত গুরু, তত মত। প্রাচীন মুনি ঋষিদের বেলায়ও বিভিন্ন দেব-দেবীর জন্ম বৃত্তান্ত থেকে কর্ম-কাণ্ড নিয়ে মতপার্থক্যের শেষ ছিল না। তাই থেকে ‘নানা মুনির নানা মত’ প্রবাদের উৎপত্তি।

উপাসনা-ধর্মকে সমাজ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করে কিছু বাংলা বই লেখা হয়েছে। বইগুলোতে কিছু প্রসঙ্গ এসেছে কিছু প্রসঙ্গ আসেনি। সব প্রসঙ্গ নিয়ে গভীরভাবে জানা ও তাকে সহজ বাংলায় তুলে ধরা এক জন্মের কাজ নয়, একজন মানুষের কাজ নয়। কিছু গবেষক নতুন নতুন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকপাত করে কাজটাকে সম্পূর্ণ রূপ দিতে পারেন। রামায়ণ, মহাভারতের মতো মহাকাব্য থেকে বেদ—সবই সৃষ্টি হয়েছে বহু মানুষের কয়েক’শো বছরের পরিশ্রমের ফল হিসেবে।

ইতিহাসধর্মী ও দর্শনধর্মী বইয়ের ভীড়ে এমন বইয়ের সংখ্যাই আবার বেশি, যেগুলোর গভীর গবেষণার ছিটে-ফোঁটা নেই। আকাডেমিক প্রয়োজন মেটাবার কোনও দায় নেই। বিশ্লেষণের চেষ্টা নেই। আছে সত্য-বিকৃতির ধারাবাহিক অনুকরণ

দর্শন, সমাজ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন কিছু দিকে আলোকপাত করতেই বইটি লেখায় হাত দিয়েছি। আদিম যুগে এক সময় মানুষের মধ্যে ঈশ্বর-বিশ্বাস, উপাসনা- ধর্মে বিশ্বাস ছিল না। এইসব বিশ্বাস এক একটি অঞ্চলে, নানা সময়ে, বিভিন্নভাবে সূচিত হয়েছে। বৈচিত্রময় ও অসম-বিকাশের পৃথিবীতে নানা উপাসনা-ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাসও বৈচিত্র্যভরা। নানা উপাসনা-ধর্মের এই বিবর্তন বা বিকাশ ধারা এবং ভারতবর্ষে প্রাক বৈদিক যুগ থেকে নানা ধর্মের বিকাশ ও হিন্দু-ধর্মের পাঁচটি তন্ত্র ধারা নিয়ে এই বইটিতে আলোচনা ও বিেেশ্লষণ করেছি। আলোচনায় বৈদিক সাহিত্যে চিহ্নিত ‘আস্তিক্যবাদ’ ও ‘নাস্তিক্যবাদ’ যেমন এসেছে, তেমন-ই এসেছে তন্ত্র, তন্ত্রের শাখা-প্রশাখা। বিভিন্ন তন্ত্র পদ্ধতির পাশাপাশি স্বভাবতই এসেছে ‘বশীকরণ’, ‘মারণ-উচ্চাটন’ ইত্যাদির মত রহস্যময় নানা প্রসঙ্গ ও তার বিশ্লেষণ। সচেষ্ট থেকেছি বইটির প্রামাণ্যতা বজায় রাখতে। আন্তরিক থেকেছি তন্ত্রের বিভিন্ন আকর গ্রন্থ থেকে তন্ত্রের প্রয়োগ-বিধি ও তন্ত্র-তত্ত্বের রহস্য উন্মোচন করতে।

মাত্র দিন দু’য়েক আগের ঘটনা। এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন এই বঙ্গের এক বিদূষী সাহিত্যিক। তিনি বললেন, আমি ধর্ম-টর্ম তেমন মানি না। তবে হিন্দু-আধ্যাত্মবাদ যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দর্শন, এটা মানি।

দর্শন কী? আধ্যাত্মবাদ কী? হিন্দু ধর্ম কী? এসবের অ আ ক খ না জেনেই কত সাবলিলভাবে কথাগুলো বলে গেলেন! প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, অতএব ওজনদার ‘বুদ্ধিজীবী’, সুতরাং যে কোনও বিষয়ে বলার অধিকার আছে। না জানলেও আছে। যিনি সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন, তিনি হাত-টাত নেড়ে কথা বলছিলেন। সুন্দরী এবং ঝক্‌ঝকে কথা-বার্তা, ভালো অ্যাঙ্কার। নিম্নমেধার এই অ্যাঙ্কারের বাচনভঙ্গীর ঝলকানি যত, অজ্ঞতাও ততটাই প্রকট।

বাঙালী সাহিত্যিক-শিল্পী-অভিনেতা-খেলোয়াড় প্রত্যেককেই প্রচার মাধ্যমগুলো ‘বুদ্ধিজীবী’ ছাপ মেরে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের কর্মক্ষেত্রের বাইরের যে কোনও বিষয়ে যা খুশি মতামত প্রকাশের অধিকার জন্মেছে। দুঃখের কথা—এটাই পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালি ‘বুদ্ধিজীবী দের মূল রোগ। এই বঙ্গে এমন বুদ্ধিজীবীরাই সংখ্যায় বেশি।

‘প্রাজ্ঞ’ সাজা যায় না। ‘প্রজ্ঞা’ গড়ে তোলার ব্যাপার। জিজ্ঞাসা ও গতিময়তার পথে একটু একটু করে গড়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বড় শত্রু এইসব বুদ্ধিজীবীরা—যাঁরা ধর্মেও আছেন, প্রগতিতেও আছেন। এমন ভণ্ড বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক লড়াই জরুরি। ‘বুদ্ধিজীবী’দের অধ্যাত্মবাদী গোলা-গোলা কথার বিরুদ্ধে কামানের গোলা দাগতে এই বইটি কাজে লাগলে আমি খুশি হবো। খু-উ-ব খুশি।

উষ্ণ অভিনন্দন প্রতিটি পাঠক-পাঠিকাকে। একটি অনুরোধ—উত্তর পেতে জবাবি খাম পাঠাবেন।

প্রবীর ঘোষ

৭২/৮ দেবীনিবাস রোড

কলকাতা ৭০০ ০৭৪

১ ডিসেম্বর, ২০০২

error: Content is protected !!