তোতা কাহিনী
বিজ্ঞান চেতনা উন্নয়নে ব্রতী একটি সংস্থার আমন্ত্রণপত্র পেলাম। সময়টা ২৭ ডিসেম্বর ২০০৫ সাল। সংস্থাটি দীর্ঘ ষোল বছর ধরে একটি সুন্দর প্রদর্শনীর আয়োজন করে চলেছে উত্তর কলকাতায়। সংস্থার কাজ-কর্মে শ্রদ্ধা রেখে-ই বলছি, আমন্ত্রণপত্রটির শেষ অংশে চোখ এবং মন দিলে বোধহয় কিছু ভ্রান্তি পাবেন। মগজধোলাই-এর শিকার হয়ে পড়েননি তো? আর তাইতেই কি লিখেছেন-
“ক্ষুদিরাম, কানাইলাল থেকে বিনয়-বাদল-দীনেশ-র মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছে সেই স্বাধীনতা আজ বিপন্ন। বিদেশী প্রভুদের হাতে দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের অবাধ অধিকার না দিলে পরিণাম : ইরাক। তাই বিজ্ঞানকর্মীদের চাই আর্কিমিডিসের মতন সঙ্কল্প। চাই নতুন শপথ : ‘বিজ্ঞান চাই, সঙ্গে যে চাই দেশকে ভালোবাসা’ ।”
এই আমন্ত্রণ পত্রের কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে মুক্তমনে আলোচনার অবকাশ আছে। (এক) “স্বাধীনতা আজ বিপন্ন”। অর্থাৎ স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে, ভারত এখনও স্বাধীন। তবে, স্বাধীনতা বিপন্ন। যে ভারতের অর্থনীতি থেকে বিদেশনীতি, কৃষিনীতি থেকে বাণিজ্যনীতি ঠিক করে দেয় আমেরিকার মতো দাদা দেশ, সে দেশকে কতটা স্বাধীন বলবো? পোয়াটাক্? নাকি সিকিটাক্? (দুই) “বিদেশী প্রভুদের হাতে সম্পদ লুণ্ঠনের অবাধ অধিকার না দিলে পরিণাম : ইরাক।” এইখানে স্বীকার করা হলো ভারতের বিদেশী প্রভু আছে। অর্থাৎ, ভারত পুরোপুরি স্বাধীন নয়। পাশাপাশি বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর ইরাকে থাবা বসানোর প্রতি শ্লেষ ও উষ্ম ঢাকা থাকেনি। কিন্তু ঢাকা তুলে দেখান হয়নি ভারতের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র। ভারত ও প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর দাদাগিরি করে। ভারতের প্রতিবেশী দেশ নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে ভারত কথায় কথায় দাদাগিরি করেছে। পূর্বপাকিস্তানে নাক গলিয়ে বাংলাদেশ তৈরি করেছে। শ্রীলঙ্কায় তামিল টাইগারদের অর্থ-অস্ত্র-প্রশিক্ষণ দিয়েছে। স্বাধীন সিকিমকে অঙ্গরাজ্য বানিয়ে ছেড়েছে। ভারত যখন ব্রিটিশদের অধীন, তখন করের বিনিময়ে স্বাধীনতা ভোগ করতো নাগাল্যান্ড মণিপুর, কাশ্মীর। ছলে-বলে-কৌশলে এইসব স্বাধীন দেশকে ভারত দখল করেছে । এরপর কী করে বলি, ভারত অ-সাম্রাজ্যবাদী দেশ? স্বাধীন দেশ নেপাল চিনের কাছ থেকে বন্দুক কিনেছে, শুধুমাত্র এই অপরাধে ১৯৮৮ সালে নেপাল অবরোধ করে ভারত। ১৮ মাস চলে অবরোধ। নেপাল ভয়ংকর রকমের আর্থিক সংকটে পড়ে। তখন নেপালের অবস্থা ছিল হুবহু অবরুদ্ধ বার্লিনের মতো।
যে কারণে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকাকে ধিক্কার জানাই, সেই
একই কারণে বা অপরাধের জন্যে সাম্রাজ্যবাদী ভারতকে
কেন ধিক্কার জানাবো না? একই কারণের জন্যে
দু’রকম ব্যবহার করলে তা হবে আমাদেরই
দ্বিচারিতা, ভণ্ডামী এবং বোধবুদ্ধির
অভাবের পরিচয়।
(তিন) “বিজ্ঞান চাই, সঙ্গে চাই দেশকে ভালোবাসা।” ‘দেশ’ বলতে এখানে কী বোঝানো হয়েছে? দেশের ভৌগোলিক অঞ্চলকে ভালোবাসা? দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রাণপণ করা? রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছিলেন,—
“দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, সে চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয় তবে দেশ প্রকাশিত। সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা ভূমির কথা যতই উচ্চকণ্ঠে রটান ততই জবাবদিহির দায় বাড়বে, প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দেশ তো উপাদান মাত্র, তা দিয়ে মানবিক সম্পদ কতটা গড়ে তোলা হল। মানুষের হাতে দেশের জল যদি যায় শুকিয়ে, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে উঠে মারীবীজে, শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্য কথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না। দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষে তৈরি।”
রবীন্দ্রনাথের একথা আমরা ভুলে থাকি। ভুলিয়ে রাখে রাষ্ট্রের মগজধোলাইয়ের রাজনীতি ।
রাষ্ট্র, সরকার ও সরকারের তাঁবেদার বুদ্ধিজীবীরা দেশের জনগণ থেকে সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্মী সকলেরই মগজধোলাই করে ঢুকিয়ে দিয়েছে— ভারত একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। মগজ-কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করে আরও ঢোকান হয়েছে—ভারত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এক মহান দেশ।
আমরা কি তোতাপাখির মতো শেখান বুলি কপচে যাবো?
মগজ-কম্পিউটার ও প্রোগ্রামিং
মগজ বা মস্তিষ্ক এক অনন্য কম্পিউটার। ছোটবেলা থেকেই আমাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কুসংস্কার-সুসংস্কার, প্রশ্নহীন মন-মুক্ত মন সবই প্রোগ্রামিং করে ঢোকান হতে থাকে। এই প্রোগ্রামিং-এর ওপর নির্ভর করেই মানুষের ব্যবহার, ব্যক্তিত্ব, ভাবনাচিন্তা, জ্ঞান, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, সাহস-ভয় ইত্যাদি ‘ফাংশন’ করতে থাকে। যতই বয়স বাড়ে ততই নতুন-নতুন বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক-অধ্যাপক ইত্যাদিরও প্রভাব মস্তিষ্কে পড়তে থাকে। আগের অনেক প্রোগ্রামিং মুছে যেতে থাকে নতুন প্রোগ্রামিং মানুষের ভাবনাচিন্তাকে চালিত করতে থাকে। যত বেশি করে নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান-সমাজনীতি-রাজনীতি-অর্থনীতি-শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি আত্মস্থ হতে থাকবে, ততই মস্তিষ্কচর্চা বৃদ্ধি পাবে। পুরোন, মান্ধাতার আমলের মূল্যবোধ মগজ থেকে বিদায় নেবে। ঢুকবে উন্নত চিন্তাধারা। একে নতুন প্রোগ্রামিং বলতে পারেন, বলতে পারেন মগজ ধোলাই।
রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে, গদিতে টিকে থাকতে, ব্যবসা-বাণিজ্যকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলতে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের মধ্যে একটা গাঁটছড়া দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে। আইন মেনেই যাতে টাকার পাহাড় গড়তে পারে শিল্পপতি বণিকরা, তার ব্যবস্থা করে দিতে হয় রাজনীতিকদের। কারণ ওদের টাকাতেই গদিতে বসা।
আমাদের মতো পিছিয়ে থাকা দেশে যেখানে শতকরা ৭০ ভাগ গরীব, সেখানে বিভিন্ন সহায়ক শক্তিদের দিয়ে গরীবদের মগজধোলাইয়ের কাজ আসছে। হাজার হাজার বছর ধরে শোষিত মানুষদের বুঝিয়ে আসা হচ্ছে—দারিদ্র তাদের পূর্বজন্মের কর্মফল, জন্মকালীন আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের ফল ইত্যাদি ।
কিন্তু এখানেই তো অবস্থাটা থেমে নেই। পাল্টা মগজধোলাই করে কিছু যুক্তিবাদী গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী শোষিতদের বোঝাচ্ছে—‘পূর্বজন্ম’, ‘ভাগ্য’ সব মিথ্যে। এসব হিজিবিজি ব্যাপার-স্যাপার তোমাদের মাথায় ঢুকিয়েছে ধান্দাবাজ বেওসায়ী-রাজনীতিক ও তাদের চামচারা ।
পাল্টা চাল হিসেবে এই বেয়াড়া মানুষদের ধরে ধরে জেলে পুরতে, হত্যা করতে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে দেগে দিচ্ছে সরকার ও তার হাতের মুঠোর মিডিয়ারা।
সাম্যকামীরা কৌশল পাল্টেছেন। ফলে বহু জায়গায় সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে অহিংসভাবে স্বয়ম্ভর গ্রাম, সমবায় গ্রাম তৈরি করা শুরু হয়েছে গত কয়েক বছর হলো। হতদরিদ্র মানুষগুলো সমবায় গড়ে চাষ করে ভাত-কাপড়-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা নিজেরাই করছে। প্রাণ ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য ছাড়া কেউ-ই অস্ত্র ব্যবহার করছে না।
যত বেশি বেশি করে এমন স্বয়ম্ভর গ্রাম হবে, ততই বেশি বেশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুস্থভাবে কায়েম হবে। ততই দুর্নীতিগ্রস্তরা ছিন্নমূল হবে। এও মগজধোলাই রাজনীতির বিরুদ্ধে পাল্টা মগজধোলাইয়ের রাজনীতি। এখানে সাম্য আসবে শান্তি ও গণতন্ত্রের হাত ধরে। অসাম্যের সমাজ কাঠামো ভাঙবেই।
মগজধোলাইয়ের রাজনীতির বিরুদ্ধে পাল্টা মগজধোলাইয়ের রাজনীতির একটা উদাহরণ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দের সংজ্ঞা নিয়ে চাপানউতোর। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী-ই ভারত নামের দেশটাকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ করেছিলেন। তিনি-ই আবার ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞাই পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাল্টা মগজধোলাই তাঁর অপচেষ্টাকেও পাল্টে দিয়েছিল। আসুন ফিরে দেখি ঘটনাটা।
মগজধোলাইয়ের চাপানউতোর
আমরা জানি, ভারত একটা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি আমাদের সংবিধানের সংশোধনী বিলে ঢুকে পড়লো কোনও সংজ্ঞা ছাড়াই। সালটা ১৯৭৫। দেশের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে হেরে গেলেন। ফলে পদত্যাগ করতে-ই হয়। প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়বো? ই………… আরকী? গণতান্ত্রিক ভারতের ডিক্টেটর প্রধানমন্ত্রী দেশে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করলেন। বিরোধী দল থেকে নিজের দলের বেচাল নেতাদের জেলে পুরে দিলেন। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ঢি ঢি পড়ে গেল। শ্রীমতী গান্ধীর পাশে শুধু সোভিয়েত-জোট এই ‘সমাজতান্ত্রিক’ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ জোটকে সন্তুষ্ট করতেই ৪২ তম সংবিধান সংশোধনী বিলে ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দুটি ঢুকিয়ে দিলেন শ্রীমতী গান্ধী। কিন্তু শব্দ দুটির কী সংজ্ঞা–সংবিধানে তার উল্লেখ রাখলেন না। যুক্তি দেখালেন, ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রগুলোতে শব্দ দুটির সংজ্ঞা এতই স্পষ্ট যে আবার করে সংজ্ঞা উল্লেখের কোনও প্রয়োজন নেই।
তারপরেই শ্রীমতী গান্ধী সব ধর্মস্থানগুলোতে মাথা ঠেকিয়ে ধর্মের রাজনীতিতে নামলেন। মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, গুরুদ্বার এবং বিভিন্ন ধর্মমতের বিখ্যাত ধর্মগুরুদের আশ্রমে শ্রদ্ধা চড়িয়ে সেই ধর্মমতের লোকদের ভোট টানার চেষ্টায় মাতলেন। পাশাপাশি আইনবিদ, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা, নীতিবেত্তা প্রভৃতিদের ময়দানে নামালেন। তাঁরা মানুষের মধ্যে একটা কথা নানাভাবে ঢুকিয়ে দিলেন যে—‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র মানে, রাষ্ট্র সব ধর্মকেই সমানভাবে দেখবে, সমানভাবে পেট্রোনাইজ করবে। ধর্মস্থানে দান করলে আয় করদাতা বাড়তি সুবিধে পাবে। মুসলিম ধর্মের মানুষ হজে যাবে সরকারি খরচে। ধর্মীয় ট্রাস্টগুলো যত বড় ধনীই হোক, করের আওতায় আসবে না। এমনি গাদাগুচ্ছের সুযোগ-সুবিধে করে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার এক নতুন সংজ্ঞা মানুষের মনে গেঁথে দিলেন।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ (Secular )
শব্দের সংজ্ঞা দেওয়া আছে। তাতে স্পষ্ট বলা আছে
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি ও
শিক্ষানীতি হবে সম্পূর্ণ ধর্মবর্জিত।
রাষ্ট্রনায়কগণ কোনও ভাবে-ই
প্রকাশ্যে ধর্ম-আচরণ
করতে পারবেন না।
যখন ব্যাপক মগজধোলাইয়ের কল্যাণে ভারতীয়রা ধর্মনিরপেক্ষতার অপ-সংজ্ঞাকেই সংজ্ঞা বলে ধরে বসে আছেন, তখন যুক্তিবাদী সমিতি পাল্টা প্রচারে নামে। আমাদের প্রচারে সামিল করতে পেরেছিলাম আইনি বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, নীতিবেত্তা, সাহিত্যিক, অভিনেতা, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার মানুষদের। অসামান্য সাফল্য পেয়েছি। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দের সঠিক সংজ্ঞা আজ বিজেপি ছাড়া সমস্ত রাজনৈতিক দল-ই গ্রহণ করেছে।
বিষয়টাকে এভাবে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি—শ্রীমতি গান্ধী বিভিন্ন পেশার মানুষদের সাহায্যে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে ছিলেন। দেশবাসীর মগজধোলাই করে ‘ব্লেন’ নামক প্রাকৃতিক কম্পিউটারে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কিছু ‘প্রোগ্রামিং’ করে দিয়েছিলেন। যুক্তিবাদী সমিতি বহু মেধার সাহায্য নিয়ে সেই ‘প্রোগ্রামিং’ মুছে নতুন প্রোগ্রামিং ঢুকিয়ে দেয় ।
শ্রীমতি গান্ধী মগজধোলাই করেছিলেন। আমরাও পাল্টা মগজধোলাই করেছি। দুটোই শেষপর্যন্ত মগজ ধোলাই ।
আদিম সামজ থেকেই দেহমিলন ছিল একটা জৈবিক প্রবৃত্তি বা সহজাত প্রবৃত্তির যান্ত্রিক প্রয়োগ মাত্র। এক’শ দেড়শ বছর আগেও এমন চিন্তাভাবনার দ্বারাই বেশিরভাগ মানুষ চালিত হতো। ‘পতি দেবতা’। যখন ইচ্ছে হবে, যেমনভাবে খুশি পতি দেবতা পত্নীকে ভোগ করতো। বা বলতে পারি ধর্ষণ করতো। ব্যাপারটা পত্নীর কেমন লাগছে—এটা নিয়ে সমাজ মাথা ঘামাতো না। পত্নীর সহজাত যৌনপ্রবৃত্তিকে অবদমিত রাখাই ছিল অভ্যাস ।
যান্ত্রিক শারীরিক মিলন সুখকর ও প্রেমময় হয়েছে মস্তিষ্কে একটু একটু করে প্রেম-বোধ তৈরি হওয়ার মধ্য দিয়ে। পুরুষদের মস্তিষ্কের পুরুষতান্ত্রিক প্রোগ্রামিং দীর্ঘ সময় ধরে একটু একটু করে মুছে সাফ হয়েছে। প্রেমের, মূল্যবোধের বা ধারণার নতুন প্রোগ্রাম গ্রহণ করছে বেশ কিছু মস্তিষ্ক। এইসব মস্তিষ্কের কাছে ‘প্রেম’-ই ঈশ্বর, আদর্শ, একগামী এবং এতেই প্রেমের সার্থকতা। উত্তেজক প্রেমও রইলো; তবে যান্ত্রিকতার বদলে শারীরিক মিলনে যুক্ত হলো বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, আনন্দ ও সক্রিয় সহযোগিতা। স্বামী-স্ত্রীর প্রেমহীন ধর্ষকাম দেহমিলন ‘নৈতিক’ এবং প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক না থাকলে তাদের সুস্থ মিলন ও ‘অনৈতিক’
এমন একটা চিন্তা বহুজন মেনে নিয়েছে। কিন্তু সকলে নয়। তাদের কাছে দেহমিলনের পূর্বশর্ত ‘প্রেম’। প্রাচীন মূল্যবোধ ভাঙছে।
এসবই তো এক প্রোগ্রামিং হটিয়ে আর এক প্রোগ্রামিং-এর কার্যকর হওয়ার ইতিহাস
মা-বাবাকে ঈশ্বরের চেয়েও বড় আসনে বসাবার সামাজিক বোধ তৈরি করেছে শত শত বছরের চলে আসা মূল্যবোধ। ভাই-বোন-এর জন্য আত্মীয় গোষ্ঠীর জন্য জীবন লড়িয়ে দেওয়ার মূল্যবোধ আমাদের মস্তিষ্কে শিশুকাল থেকে প্রোগ্রামিং করা আছে। এ-সবই করেছেন সমাজপতীরা, বুদ্ধিজীবীরা এবং মা-বাবা-আত্মীয়-পরিজন। ধর্মগুরুরা, ধর্মগ্রন্থগুলো তাদের উপদেশাবলীতে বলেছে—ঈশ্বর ক্রুদ্ধ হলে রক্ষা করেন গুরু। কিন্তু গুরু ক্রুদ্ধ হলে রক্ষা করার সাধ্য ঈশ্বরেরও নেই। গুরুরা পূজ্য হয়েছেন ।
এইসব সামাজিক বোধ শত শত বছর ধরে চলতে চলতে বর্তমানে এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছে যে আপাত্যস্নেহ, মা-বাবার প্রতি প্রশ্নাতীত শ্রদ্ধা, ভাইবোনের প্রতি প্রশ্নাতীত ভালোবাসা, গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা—এসবই আমাদের চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমরা ভাবতে শুরু করেছি, যে এইসব-ই নাড়ির বন্ধন, সহজাত প্রবৃত্তি
আবার একদল যখন বোঝাতে শুরু করলো-খারাপ, নোংরা অপরাধী মানুষরাও কারও না কারও মা-বাবা। ‘মা-বাবা’ বলেই প্রশ্নাতীত শ্রদ্ধা জানানো অনৈতিক। শ্রদ্ধেয়কে শ্রদ্ধা জানাবে, অশ্রদ্ধেয়কে অশ্রদ্ধা। আরও বোঝালো- সাম্যের সমাজ গড়তে আন্তরিক হতে গেলে জন্ম-সম্পর্কে ভাই-বোন-আত্মীয়দের প্রতি স্নেহ-প্রেম-আবেগে লাগাম পড়াতে-ই হবে। নতুবা স্বজনপোষণের দুর্নীতি জাঁকিয়ে বসবে। মনে রাখতে হবে—এক দুর্নীতি-ই বহু দুর্নীতিতে ঢুকতে উৎসাহিত করে। গত শতকে কিছু দেশ সাম্যের সমাজ গড়ার দিকে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। সে সব দেশের সমস্ত নাগরিকদের জীবিকা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, লেখাপড়া ইত্যাদির পূর্ণ দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। গোটা দেশের নাগরিকদের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল ভ্রাতৃত্ববোধ। সমাজতন্ত্র পূর্ণ প্রতিষ্ঠার আগেই সেসব দেশের সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়লো। এই পতনের অন্যতম কারণ ছিল স্বজনপোষণ।
আত্মীয়-প্রেম বা গোষ্ঠী-প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে ন্যায়-অন্যায় বোধকে ভুলে যাওয়ার প্রবণতাকে মগজ থেকে বিদায় করতে হবে। তারপর নতুন জাতীয়তাবোধকে ব্রেন-কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করে দিতে হবে।
আমেরিকার তৈরি ‘মস্তিষ্ক-যুদ্ধ’ (brain-war) পরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হলোঃ (১) যারা শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। (২) মনে রাখতে হবে, উন্নতিশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে যেখানে শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষ গরীব, সেখানে সবাইকে ভালোমতো বাঁচতে দেওয়ার ব্যবস্থা করা অসম্ভব। এইসব গরীব মানুষগুলো যাতে নিজেদের নানা দাবিদাওয়ার কথা তুলতে না পারে, সেটা দেখা খুবই জরুরি। নতুবা দেশ শাসন করা কোনও শাসকগোষ্ঠীর পক্ষেই অসম্ভব। (৩) উচ্চবিত্ত মানুষদের ‘ক্যারিয়ারিস্ট’ করার আন্তরিক চেষ্টা করতে হবে রাষ্ট্রকে। শতকরা ১০ ভাগ এগিয়ে থাকা মেধার (উচ্চমেধা বলছি না) মানুষদের জন সমস্ত সুখ-সুবিধা দাও। সাজান ফ্ল্যাট-গাড়ি-বিদেশী মদে ডুবিয়ে রাখা। ক্যারিয়ারিস্ট শেষ পর্যন্ত শুধু নিজের কথা-ই ভাবে। প্রথমের দিকে তার চিন্তা থেকে সমাজ বাদ যায়। থাকে শুধু মা-বাবা ভাই-বোন। তারপর শুধুই ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’। রাষ্ট্র এদের বিষয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। ওরা সরকারের সব সময়ের বিশ্বস্ত সঙ্গী। তরুণ মধ্যবিত্তদের ডুবিয়ে রাখতে হবে নিরন্তন উত্তেজনার মধ্যে। নেশা, নাচ-গান-যৌনতা ইত্যাদি বিষয়ে উত্তেজিত রাখ। এই মধ্যবিত্তদের জন্যেই খবরের কাগজ থেকে টি ভি চ্যানেলে গঠনমূলক খবরের চেয়ে নেতিবাচক খবরে জোর দিতে হবে। যুদ্ধ, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি উত্তেজক খবরে মাতিয়ে রাখো। আর এক শ্রেণীর অতি-নিরীহ মধ্যবিত্তদের মজিয়ে রাখতে প্রচার মাধ্যমগুলিতে নিয়ে এসো ভাগ্য ও ধর্মের বাণী, প্রবচণ ও যোগ। একটা কথা ভুললে চলবে না, মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকেই কিছু বিবেক উঠে আসে, যারা বঞ্চিত মানুষদের মগজধোলাই করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত করে।
মনে রাখতে হবে নেতৃত্ব ছাড়া কখনই আন্দোলন বা বিপ্লব সংগঠিত হয় না। আর সংগঠকদের কাজ প্রায় সর্বক্ষেত্রেই মধ্যবিত্তরা-ই পালন করে আসছে।
(৪) যারা শোষিত-বঞ্চিত মানুষদের ঘুম ভাঙাচ্ছে, তাদেরকে ‘দেশদ্রোহী’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘উগ্রপন্থী’ ইত্যাদি বলে দেগে দিতে হবে। (৫) প্রচার করতে হবে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা প্রেমীরাই দেশপ্রেমী। (৬) দেশের শোষিত বঞ্চিত মানুষদের জন্য যারা প্রেম দেখায়, তাদের এনকাউন্টারে শেষ করে দিয়ে প্রচার করতে হবে তারা কী ভয়ঙ্কর রকমের উগ্রপন্থী। (৭) এজন্যে কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্য সমস্ত রকমভাবে বাকি দেশবাসীদের মগজধোলাইয়ের জন্য সম্ভাব্য সব পথ-ই গ্রহণ করতে হবে।
গত ষাট বছরে ভারতের রাজনীতিতে চোরচোট্টা-গুণ্ডা-বদমাইসরাই রাজ করছে—স্বীকার করতেই হবে। ভারতে দুর্নীতি আজ সর্বব্যাপী—স্বীকার করছি। এ অবস্থা ভাল হওয়া অসম্ভব- স্বীকার করলাম না।
ভারতের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়েছে—মানে-ই এক সময় এর
থেকে অনেক ভালো অবস্থায় ছিল। খারাপ হয়েছে একটু একটু
করে। তবে আবার একটু একটু করে ভালো
কেন করা যাবে না? নিশ্চয়-ই করা যাবে।
শুধু সঠিক পরিকল্পনাই পারে
অবস্থাকে পাল্টাতে পারে।
তাত্ত্বিক-ভাবে আপাতত এইটুকু পর্যন্ত আমরা এক মত হলাম তো? নিশ্চয়ই হলাম। পরের কথায় পরে। মগজধোলাইয়ের রাজনীতি বোঝার আগে মগজ বা মস্তিষ্ককে জানাটা জরুরি। কারণ,
মস্তিষ্ক আমাদের প্রতিটি আচরণ, মূল্যবোধ, সূক্ষ্মাতিসূ মগজধোলাইয়ের
পদ্ধতি চিনে নেওয়া পাল্টা মগজধোলাই করে উচ্চ আদর্শকে
ঢুকিয়ে দেওয়া, মগজকে জীবিতকাল পর্যন্ত সক্রিয় রাখা,
প্রয়োজনে মস্তিষ্ককে বিশ্রাম নিতে সঠিক মেডিটেশন
পদ্ধতিকে কাজে লাগানো—এসব নিয়েই
এই গ্রন্থটি লেখা।
মস্তিষ্ক নিয়ে আমাদের টুকরো টুকরো জ্ঞান আসলে সত্য জানার চেয়ে বিভ্রান্তি-ই বেশি আনে। একটা প্রচার বর্তমানে চলছে, পৃথিবীর যে কোনও অসুখ যোগে সেরে যায়। নখে নখ ঘষলে চুল গজায়। পায়ের বুড়ো আঙুল টিপলে হার্টের অসুখ সেরে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এই মিথ্যে প্রচার অবশ্যই প্রাণঘাতী প্রচার। যোগ ব্যায়াম করলে অবশ্যই সুস্থ থাকা যায়। কিন্তু একটা অ্যাকসিডেন্ট হলে, স্ট্রোক হলে আপনি যদি আধুনিক চিকিৎসার সাহায্য না নিয়ে যোগীর সাহায্য নেন, তা হবে চরম বোকামো । এই সত্যকে জানতে আমরা কতটুকু চেষ্টা করেছি? আসলে কোনও চেষ্টা না করে প্রচার মাধ্যমগুলোর প্রচারকেই গিলে খেয়েছি এবং যোগের সব রোগ সারাবার ক্ষমতার পক্ষে জয়গানে মাতোয়ারা হয়েছি। এটাও যে রাষ্ট্রের মগজধোলাইয়ের রাজনীতির-ই অংশ, তা বুঝিনি। দুঃখ হয়, যখন দেখি তথাকথিত মগজবানরা যোগ নিয়ে হাস্যকর বিবৃতি দিচ্ছেন। শুধু দুঃখ নয়, ভয়ও হয়।
রাষ্ট্র নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে ভোগবাদ ও ভাববাদে মাতিয়ে রাখতে অতি যত্নবান। একই সঙ্গে মগজধোলাইয়ের কাজে মগজওয়ালাদের কাজে লাগাতে উচিত মূল্য ধরে দিতে একটুও কার্পণ্য করছে না। রাষ্ট্র মনে করে, প্রত্যেকের সততার-ই একটা মূল্য আছে। কারও মূল্য দশ লাখ, কারও বা দশ কোটি। কারণ মগজওয়ালাকেও মগজ বেচেই সম্পদ-সম্মান ইত্যাদি কিনতে হবে।
তারপরও কোটিতে গুটিক মানুষ আছেন যাঁরা এখনও মগজ বেচেননি। তাঁরাই রাষ্ট্রের মগজ ধোলাই পদ্ধতির বিরুদ্ধে পাল্টা মগজধোলাইয়ে নিত্য-নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করবেন, এই প্রত্যয় রাখি।
প্রবীর ঘোষ
৭২/৮ দেবীনিবাস রোড
কলকাতা – ৭০০ ০৭৪
১ জানুয়ারি, ’০৬
প্রথম পর্বঃ মনের নিয়ন্ত্রণ
অধ্যায়ঃ এক
♦ বুদ্ধি, স্মৃতি, প্রতিভা নিয়ে বিভ্রান্তি বেচে খাচ্ছে অনেকে
অধ্যায়ঃ দুই
♦ প্রচুর পড়েন মানে-ই মস্তিষ্কচর্চা করেন?
অধ্যায়ঃ তিন
♦ স্মৃতি-শক্তি ও প্রতিভা এক নয়
অধ্যায়ঃ চার
♦ জ্ঞান (wisdom) ও শিক্ষা (education) এক নয়
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ মস্তিষ্ক ও তার কিছু বৈশিষ্ট্য
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ পাভলভ-তত্ত্বে মস্তিষ্কের ‘ছক’ বা type
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
♦ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কত কিছু পাল্টে যায়
অধ্যায়ঃ নয়
♦ অলজাইমারস সৃষ্টিশীল মেধায় ভয়ঙ্কর অসুখ
অধ্যায়ঃ দশ
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ জিন বা বংশগতি-ই ঠিক করে মেধা-বুদ্ধি?
অধ্যায়ঃ বারো
♦ বংশগতি গবেষণা ও স্নায়ুবিজ্ঞানের অগ্রগতি
অধ্যায়ঃ তেরো
♦ মানবগুণ বিকাশে পরিবেশের প্রভাব
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
অধ্যায়ঃ পনেরো
♦ মগজধোলাই-এর প্রয়োজনীয়তা বেড়েই চলেছে
দ্বিতীয় পর্বঃ ধ্যাণ-যোগ-সমাধি মেডিটেশন
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ ‘রজনীশ’ এক শিক্ষিত যোগী, বিতর্কিত নাম
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !
অধ্যায়ঃ সাত
♦ শ্রীমাতাজী নির্মলা দেবীর সহজযোগ
অধ্যায়ঃ আট
♦ রিল্যাক্সেশন, মেডিটেশন নিয়ে বাংলাদেশের যোগী মহাজাতক
অধ্যায়ঃ নয়
♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব
অধ্যায়ঃ দশ
♦ ‘মেডিটেশন’, ‘রিলাক্সেশন’, বা ‘স্বসম্মোহন’
অধ্যায়ঃ এগারো
“মনের নিয়ন্ত্রণ যোগ-মেডিটেশন” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ