মাসরূক হইতে ধারাবাহিকভাবে ইবরাহীম, আমর, শু’বা, হাফস ইবন উমর ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ একদা আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর কথা আলোচনা করিতেছিলেন। তিনি বলিলেন- আমি তাঁহাকে (হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-কে) সর্বদা ভালবাসিয়া যাইব। কারণ, নবী করীম (সাঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছিঃ ‘তোমরা চারিটি লোকের নিকট হইতে কুরআন মজীদ গ্রহণ কর (১) আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (২) সালিম (৩) মু’আয ইব্ন জাবাল এবং (৪) উবাই ইবন কা’ব।’ উক্ত হাদীস ইমাম বুখারী(র) সাহাবায়ে কিরামের সদগুণাবলী ( مناقب) সম্পর্কিত পরিচ্ছেদের একাধিক স্থানে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম ও ইমাম নাসায়ী উহা উপরোক্ত রাবী মাসরূক হইতে উপরোক্ত ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং ওয়ায়েল হইতে ধারাবাহিকভাবে আ’মাশ প্রমুখ রাবীর অধঃস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন । হাদীসে প্রশংসিত সাহাবী চতুষ্টয়ের মধ্য হইতে হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) এবং আবূ হুযায়ফা-এর মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম হযরত সালিম (রাঃ) ছিলেন প্রথম যুগের মুহাজির সাহাবা। হযরত সালিম (রাঃ) ছিলেন নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে একজন। মদীনায় নবী করীম (সাঃ)-এর আগমনের পূর্বে তিনি নামাযে ইমামতি করিতেন। উক্ত সাহাবী চতুষ্টয়ের মধ্য হইতে হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রাঃ) এবং হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) ছিলেন আনসার সাহাবা। তাঁহাদের স্থান ছিল নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে ।
শাকীক ইবন সালমাহ হইতে ধারাবাহিকভাবে আ’মাশ, হাফস, উমর ইব্ন হাফস ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ শাকীক বলেন- একদা হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রাঃ) আমাদের সম্মুখে বক্তৃতা প্রদান করিতে গিয়া বলিলেন, ‘আল্লাহ্র কসম ! আমি নিশ্চয় স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর পবিত্র মুখ হইতে কুরআন মজীদের সত্তরোর্ধ্ব সূরার শিক্ষা লাভ করিয়াছি।(১) আল্লাহর কসম ! নবী করীম (সাঃ)-এর সাহাবীগণ জানেন যে, ‘তাহাদের মধ্যে যাহারা আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী, আমি তাহাদের অন্যতম। কিন্তু আমি তাহাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি নহি।’ রাবী শাকীক বলেন- বক্তৃতা শেষ হইবার পর আমি লোকদের মজলিসে বসিয়া পড়িলাম । তাহারা কি বলে, তাহা শ্রবণ করা আমার উদ্দেশ্য ছিল । কিন্তু শহাকেও হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর উপরোক্ত কথার বিরোধিতা করিতে শুনিলাম না ।
আলকামাহ হইতে ধারাবাহিকভাবে ইবরাহীম, আ’মাশ, সুফিয়ান, মুহাম্মদ ইব্ন কাছীর ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ আলকামা বলেন- একদা আমরা হিমস্ নগরে অবস্থান করিতেছিলাম । সেখানে একদিন হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) সূরা ইউসুফ তিলাওয়াত করিলেন । জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল— ইহা কি এইরূপেই নাযিল হইয়াছে? হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) বলিলেন- আমি নবী করীম (সাঃ)-কে (উহা) পড়িয়া শুনাইয়াছি।(২) লোকটি বলিল- ‘আপনি সঠিক পড়াই পড়িয়াছেন।’ লোকটির মুখে হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) মদের গন্ধ পাইলেন । তিনি বলিলেন— ‘তুমি একদিকে মদ্য পান করো আর অন্যদিকে আল্লাহর কিতাবকে অবিশ্বাস করিতে সাহস করিতেছ?’, অতঃপর তিনি (মদ্য পানের শাস্তিস্বরূপ) লোকটিকে দোররা মারিলেন ।
মাসরূক হইতে ধারাবাহিকভাবে মুসলিম, আ’মাশ, হাফস, উমর ইব্ন হাফস ও ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ ‘একদা হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) বলিলেন- যে সত্তা ভিন্ন কোন মা’বূদ নাই, সেই সত্তার কসম ! কুরআন মজীদের প্রতিটি সূরার অবতীর্ণ হইবার স্থান সম্বন্ধে আমি অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী। কুরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের শানেনুযূল সম্বন্ধে আমি অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী। আমি যদি জানিতে পারিতাম, কুরআন মজীদ সম্বন্ধে আমার চাইতে অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী কোন ব্যক্তি রহিয়াছে, তবে তাহার নিকট উষ্ট্রযান পৌছিলে আমি উহাতে আরোহণ করিয়া তাহার নিকট পৌঁছিতাম ।’
হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) নিজের সম্বন্ধে উপরে বর্ণিত যে কথা বলিয়াছেন, তাহা সত্য ও বাস্তব। নিজের সম্বন্ধে প্রয়োজনবোধে এইরূপ প্রশংসামূলক তথ্য প্রকাশ করা কাহারও পক্ষে অন্যায় বা অসমীচীন নহে। এইরূপে হযরত ইউসুফ (আঃ) নিজের সম্বন্ধে মিশরের অধিপতির নিকট প্রশংসামূলক তথ্য প্রকাশ করিয়া বলিয়াছিলেনঃ
اجْعَلْنِي عَلَى خَزَائِنِ الْأَرْضِ – إِنِّى حَفِيظٌ عَلِيمٌ
(আমাকে যমীনে উৎপন্ন পণ্যদ্রব্যের দায়িত্বে নিয়োজিত করুন; আমি নিশ্চয় রক্ষণাবেক্ষণের কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন ও এতদসম্বন্ধীয় জ্ঞানের অধিকারী।)
হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর প্রশংসায় নবী করীম (সাঃ)-এর এই বাণীই যথেষ্ট যে, নবী করীম (সাঃ) বলেন- ‘তোমরা চার ব্যক্তির নিকট হইতে কুরআন মজীদ শিক্ষা করিও ।’ অতঃপর নবী করীম (সাঃ) সর্বপ্রথম হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর নাম উল্লেখ করিয়াছেন । হযরত উমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ইবরাহীম, আ’মাশ, সুফিয়ান, মুসআব ইব্ন মাকদাম ও আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলেন- ‘কুরআন মজীদ যেইরূপে নাযিল হইয়াছে, যে ব্যক্তি উহাকে ঠিক সেইরূপে অবিকৃত অবস্থায় পড়িতে চাহে, সে যেন উহা ইব্ন উম্মে আব্দ (আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ)-এর কিরাআত অনুযায়ী পড়ে।’ ইমাম আহমদও উক্ত হাদীস উপরোক্ত রাবী আ’মাশ হইতে উপরোক্ত ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং আবূ মুআবিয়া প্রমুখ রাবী এই ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন । ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত রিওয়ায়েত দীর্ঘ এবং উহাতে একটি ঘটনা উল্লেখিত রহিয়াছে। ইমাম তিরমিযী এবং ইমাম নাসায়ীও উহা উপরোক্ত রাবী আবূ মুআবিয়া হইতে উপরোক্ত ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং অন্যরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন । ইমাম দারে কুতনী উহাকে সহীহ হাদীস নামে আখ্যায়িত করিয়াছেন। আমি (ইব্ন কাছীর) উহাকে ‘মুসনাদে উমর’ নামক হাদীস সংকলনে উল্লেখ করিয়াছি। ‘মুসনাদে আহমদ’ সংকলনে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতেও বর্ণিত হইয়াছেঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘কুরআন মজীদ যেইরূপে নাযিল হইয়াছে, যে ব্যক্তি উহাকে ঠিক সেইরূপে অবিকৃত অবস্থায় পড়িতে চাহে, সে যেন উহা ইব্ন উম্মে আব্দ-এর কিরাআত অনুযায়ী পড়ে ৷
কাতাদাহ হইতে ধারাবাহিকভাবে হুমাম, হাফস্, ইবন উমর ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ কাতাদা বলেন- একদা আমি হযরত আনাস ইবন মালিক (রাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম, নবী করীম (সাঃ)-এর যুগে কে কে কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াত একত্রিত (মুখস্থ) করিয়াছিলেন? তিনি বলিলেন- ‘চার ব্যক্তি। তাঁহারা সকলেই আনসার সাহাবীঃ (১) উবাই ইবন কা’ব (২) মু’আয ইব্ন জাবাল (৩) যায়দ ইব্ন ছাবিত এবং (৪) আবূ যায়দ।’ ইমাম মুসলিম উহা উপরোক্ত রাবী হুমাম হইতে উপরোক্ত ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং অন্যরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম বুখারী বলেন- হযরত আনাস ইব্ন মালিক (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ছুমামাহ, হুসাইন ইব্ন ওয়াকিদ এবং ফযলও উহা বৰ্ণনা করিয়াছেন। হযরত আনাস ইবন মালিক (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ছুমামাহ ও ছাবিত, আবদুল্লাহ্ ইব্ন মুছান্না, মুআল্লা ইব্ন আসাদ ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরতঃ আনাস (রাঃ) বলেন- ‘নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় চারজন সাহাবী ভিন্ন অন্য কোন সাহাবী কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াত সংগ্রহ করেন নাই। তাঁহারা হইতেছেনঃ (১) আবূ দারদা (২) মু’আয ইব্ন জাবাল (৩) যায়দ ইব্ন ছাবিত এবং (৪) আবূ যায়দ। আমরা তাঁহার উত্তরাধিকারী।’
উপরে বর্ণিত হাদীস দ্বারা বাহ্যত প্রতীয়মান হয় যে, নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় উপরোক্ত চারজন সাহাবী ভিন্ন অন্য কোন সাহাবী কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াত সংগ্রহ করেন নাই । প্রকৃত তথ্য এই যে, একাধিক মুহাজির সাহাবীও নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াত সংগ্রহ ও একত্র করেন নাই । এই কারণেই উক্ত হাদীসে শুধু আনসার সাহাবীদের নাম উল্লেখিত হইয়াছে। তাঁহারা হইতেছেনঃ (বুখারী ও মুসলিম উভয় কর্তৃক বর্ণিত রিওয়ায়েত অনুযায়ী) (১) হযরত উবাই ইবন কা’ব (শুধু বুখারী কর্তৃক বর্ণিত রিওয়ায়েত অনুয়ায়ী এইস্থলে অবশ্য হযরত আবূ দারদা) (২) হযরত মু’আয ইব্ন জাবাল (রাঃ) (৩) হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) এবং (৪) হযরত আবূ যায়দ (রাঃ)। উক্ত সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবূ যায়দ (রাঃ) ভিন্ন অন্য সকলে মশহুর ও সুপরিচিত। উক্ত হাদীস ভিন্ন অন্য কোন হাদীসে তাঁহার নাম উল্লেখিত হয় নাই। তাঁহার নাম কি? সে সম্বন্ধে ইতিহাসকারদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে । ঐতিহাসিক ওয়াকিদী বলেন- তাঁহার নাম কয়েস ইবন সাকান ইবন কয়েস ইব্ন জাউরা ইব্ন হারাম ইব্ন জুনদুব ইব্ন আমের ইবন গানাম ইব্ন আদী ইব্ন নাজ্জার।’ ঐতিহাসিক ইব্ নুমায়ের বলেন- তাঁহার নাম হইতেছে সা’দ ইব্ন উবায়দ ইব্ন নু’মান ইব্ন কয়েস ইবন আমর ইব্ন যায়দ ইব্ন উমাইয়া। তিনি ‘আওস’ গোত্রের লোক ছিলেন।’ কেহ কেহ বলেন— ‘তাঁহারা স্বতন্ত্র নামের স্বতন্ত্র দুই ব্যক্তি। উভয়ই নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াত একত্রিত করেন।’
ইমাম আবূ উমর ইব্ন আবদুল বার উহা বর্ণনা করিয়াছেন। তবে উহা সঠিক বলিয়া মনে হয় না। পক্ষান্তরে, ঐতিহাসিক ওয়াকিদী তাঁহার যে নাম-পরিচয় উল্লেখ করিয়াছেন, উহাই সঠিক । ওয়াকিদী কর্তৃক উল্লেখিত পরিচয়ে দেখা যায়- তিনি ‘খাযরাজ’ গোত্রের লোক ছিলেন । উহাই নির্ভুল। কারণ হযরত আনাস (রাঃ) বলিয়াছেন- ‘আমরা তাঁহার উত্তরাধিকারী।’ আর হযরত আনাস (রাঃ) যে খাযরাজ গোত্রের লোক, তাহা নিশ্চিত। এমনকি কোন কোন রিওয়ায়েতে বর্ণিত হইয়াছে যে, হযরত আনাস (রাঃ) বলেন- ‘তিনি আমার জনৈক পিতৃব্য ছিলেন।’ হযরত আনাস (রাঃ) হইতে কাতাদাহ বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত আনাস (রাঃ) বলেন— ‘একদা আওস ও খাযরাজ এই দুই গোত্রের লোকেরা পরস্পর পরস্পরের কাছে গৌরব প্রকাশ করিবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হইল । আওস গোত্রের লোকেরা বলিল- আমাদের গোত্রে এমন শহীদ রহিয়াছেন, যাহাকে ফেরেশতাগণ গোসল দিয়াছিলেন। তিনি হইতেছেন- হানযালা ইব্ন আবূ আমের। আমাদের গোত্রে এমন লোকও রহিয়াছেন, যাহাকে মৌমাছির ঝাঁক শত্রু হইতে রক্ষা করিয়াছিল (حمته الدبر) । তিনি হইতেছেন আসিম ইব্ন ছাবিত। আমাদের গোত্রে এমন লোকও রহিয়াছেন, যাহার মৃত্যুতে আল্লাহ্ তা’আলার আরশ কাঁপিয়া উঠিয়াছিল । তিনি হইতেছেন- সা’দ ইব্ন মু’আয। আমাদের গোত্রে এমন লোকও রহিয়াছেন, যাহার একার সাক্ষ্যকে দুইজনের সাক্ষ্যের সমান মূল্য দেওয়া হইয়াছিল। তিনি হইতেছেন খুযায়মা ইব্ন ছাবিত ।’ এবার খাযরাজ গোত্রের লোকেরা বলিল- ‘আমাদের গোত্রে এমন চারজন লোক রিহিয়াছেন, যাহারা নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াত সংগ্রহ ও একত্র করিয়াছিলেন । তাঁহারা হইতেছেন (১) উবাই ইবন কা’ব (২) মু’আয ইব্ন জাবাল ( ৩ ) যায়দ ইব্ন ছাবিত এবং (৪) আবূ যায়দ।’ উক্ত রিওয়ায়েত সহ সকল রিওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আবূ যায়দের গোত্র পরিচয় সম্বন্ধে ওয়াকিদী যাহা বলিয়াছেন, তাহাই সঠিক ও নির্ভরযোগ্য। একাধিক ঐতিহাসিক বর্ণনা করিয়াছেন যে, উক্ত আবূ যায়দ বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিবার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছিলেন। যুহরী হইতে মূসা ইব্ন উকবা বৰ্ণনা করিয়াছেন যে, যুহরী বলেন- আবূ যায়দ কায়স ইন সাকান ‘জিসরে আবূ উবায়দ’-এর যুদ্ধে পনের হিজরীর শেষ দিকে শহীদ হন।
মুহাজির সাহাবীদের মধ্যেও যে এমন সব ব্যক্তি ছিলেন, যাঁহারা নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াত সংগ্রহ ও একত্র করিয়াছিলেন। তাহার প্রমাণ এই যে, নবী করীম (সাঃ) মৃত্যুশয্যায় শায়িত থাকা অবস্থায় নামাযে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-কে মুহাজির ও আনসার সকল সাহাবীগণের ইমাম বানাইবার প্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন- ‘সাহাবীদের জামাআতের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের কিরাআতে অধিকতর অগ্রগামী, সে-ই তাহাদের ইমাম হইবে।’ উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) কুরআন মজীদের কিরাআতে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে অধিকতর অগ্রগামী ছিলেন । শায়খ আবুল হাসান আলী ইবন ইসমাঈল আশআরী এতদসম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন উপরোক্ত আলোচনা উহা হইতে গৃহীত হইয়াছে। শায়খের বক্তব্য ও প্রতিপাদ্য বিষয় অখণ্ডণীয় যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। হাফিজ ইব্ন সামআনী এ সম্বন্ধে একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিয়াছেন। ‘মুসনাদে শায়খাইন’ নামক হাদীস সংকলনে এই বিষয়ে আমি সুবিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি।
মুহাজির সাহাবীদের মধ্যে যাহারা নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াতসমূহ একত্রিত করিয়াছিলেন, হযরত উসমান (রাঃ) এবং হযরত হযরত আলী (রাঃ)-ও তাহাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। হযরত উসমান (রাঃ) এক রাকাআতে সমগ্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিয়াছিলেন। আমি অচিরেই উহা আলোচনা করিব। কথিত আছে, কুরআন মজীদ যে তারতীবে নাযিল হইয়াছিল, হযরত আলী (রাঃ) উহা সেই তারতীবে সংকলন করিয়াছিলেন। এ সম্বন্ধে পূর্বেই আলোচনা করিয়াছি। নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় যে সকল মুহাজির সাহাবা কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াতসমূহ সংকলন করিয়াছিলেন, হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) তাঁহাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইতিপূর্বে বর্ণিত হইয়াছে যে, হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) বলিয়াছেন- ‘কুরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের অবতরণস্থল ও অবতরণের উপলক্ষ সম্বন্ধে আমি অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী। যদি আমি জানিতে পারিতাম যে, আল্লাহ্ কিতাব সম্বন্ধে আমার চাইতে অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী কেহ রহিয়াছেন, তবে তাহার নিকট উষ্ট্রযানে যাওয়া সম্ভবপর হইলে আমি তাঁহার নিকট গমন করিতাম।’
নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় যে সকল মুহাজির সাহাবা কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াতসমূহ একত্রিত করিয়াছিলেন, হযরত আবূ হুযায়ফা (রাঃ)-এর আযাদকৃত গোলাম হযরত সালিম (রাঃ) তাঁহার স্থান ছিল অতি ঊর্ধ্বে। তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হন। যে সকল মুহাজির সাহাবী নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াতসমূহ একত্রিত করিয়াছিলেন, হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-ও তাঁহাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন । তিনি ছিলেন নবী করীম (সাঃ)-এর চাচাতো ভাই। তাঁহার পিতা হযরত আব্বাস (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর পিতৃব্য ছিলেন। তাঁহার পিতামহ এবং নবী করীম (সাঃ)-এর পিতামহ একই ব্যক্তি- আবদুল মুত্তালিব। তিনি ছিলেন জ্ঞানের সমুদ্র এবং কুরআন মজীদের ব্যাখ্যাতা । ইতিপূর্বে মুজাহিদ হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি বলেন- ‘আমি দুইবার হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-কে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিয়া শুনাইয়াছি। প্রতিটি আয়াত তিলাওয়াত করিবার পর আমি থামিয়া গিয়া তৎসম্বন্ধে তাঁহার নিকট প্রশ্ন করিতাম।’ যে সকল মুহাজির সাহাবা নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াতসমূহ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রাঃ) ছিলেন তাঁহাদের অন্যতম। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন আমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ইয়াহিয়া ইব্ন হাকীম ইব্ন সাফওয়ান, আবদুল্লাহ্ ইব্ন আবূ মালীকাহ ও ইন্ন জুরায়জ এই ঊর্ধ্বতন অভিন্ন সনদাংশে এবং পৃথক পৃথক অধস্তন সনদাংশে ইমাম নাসায়ী এবং ইমাম ইব্ন মাজাহ বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রাঃ) বলেনঃ আমি কুরআন মজীদের সূরা ও আয়াতসমূহ একত্রিত করিয়া উহা প্ৰতি রাত্রিতে তিলাওয়াত করিতাম । একদা এই সংবাদ নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট পৌছিলে তিনি আমাকে বলিলেন- ‘উহা এক মাসে একবার তিলাওয়াত কর।’ অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন আমর (রাঃ) আলোচ্য হাদীসের অবশিষ্টাংশ বর্ণনা করিয়াছেন।(১)
হযরত উমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ), সাঈদ ইব্ন যুবায়র, হাবীব ইব্ন আবূ ছাবিত, সুফিয়ান, ইয়াহিয়া, সাদাকা ইব্ন ফযল ও ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত উমর (রাঃ) বলিয়াছেন- আলী (রাঃ) হইতেছেন বিচারকার্যে আমাদের মধ্যে যোগ্যতম ব্যক্তি ও উবাই (রাঃ) হইতেছেন কিরাআতে আমাদের মধ্যে যোগ্যতম
ব্যক্তি । আর আমরা নিশ্চয় উবাই কর্তৃক পঠিত কিছু কিরাআত পরিত্যাগ করিব। এদিকে উবাই কিন্তু বলিয়া থাকেন- ‘আমি উহা স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর পবিত্র মুখ হইতে গ্রহণ করিয়াছি; সুতরাং কোনক্রমেই উহা পরিত্যাগ করিব না।’ অথচ স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُفْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِّنْهَا أَوْ مِثْلِهَا –
‘যদি আমি কোন আয়াত রহিত বা বিস্তৃত করিয়া দেই, তবে আমি উহা অপেক্ষা অধিকতর কল্যাণকর অথবা উহার সমকক্ষ আয়াত তদস্থলে স্থাপন করিঃ
ইহা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বিজ্ঞ ব্যক্তিও কখনো কখনো এইরূপ কথা বলিয়া থাকেন- যাহাকে তিনি সঠিক ও নির্ভুল মনে করিলেও উহা প্রকৃতপক্ষে ভ্রান্ত ও অবাস্তব হইয়া থাকে। এই প্রসঙ্গে ইমাম মালিকের কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেন- ‘এই কবরের অধিবাসী (নবী করীম সাঃ) ভিন্ন কাহারো প্রতিটি কথাই গ্রহণযোগ্য নহে; বরং এই কবরের অধিবাসী ভিন্ন অন্য যে কোন ব্যক্তির কোনও কথা গ্রহণযোগ্য এবং কোনও কথা প্রত্যাখ্যানযোগ্য হইয়া থাকে। অর্থাৎ একমাত্র নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতিটি কথাই গ্রহণযোগ্য; অন্য কাহারো প্রতিটি কথা সেইরূপ নহে।
অতঃপর ইমাম বুখারী (রঃ) সূরা ফাতিহাসহ বিভিন্ন সূরার ফযীলত বর্ণনা করিয়াছেন। আমি প্রতিটি সূরার তাফসীরের সহিত উহার ফযীলত বর্ণনা করিয়াছি। অতএব এখানে উহার বর্ণনা প্রদান হইতে বিরত রহিলাম।