শ্লোক ২৫

সত্তাঃ কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত ৷

কুর্যাদ বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুলোকসংগ্রহম্ ॥ ২৫ ৷৷

সত্তাঃ—আসক্ত হয়ে; কর্মণি—শাস্ত্রোক্ত কর্মে; অবিদ্বাংসঃ – অজ্ঞান মানুষেরা: যথা— যেমন: কুর্বন্তি—করে; ভারত— হে ভরতবংশীয়, কুর্যাৎ—কর্ম করবেন; বিদ্বান—জ্ঞানী ব্যক্তি; তথা — তেমন; অসক্তঃ – আসক্তি রহিত হয়ে; চিকীর্ষুঃ— পরিচালিত করতে ইচ্ছা করে; লোকসংগ্রহম্ — জনসাধারণকে।

গীতার গান

বিদ্বানের যে কর্তব্য অবিদ্বান সম ৷

বাহ্যত আসক্ত হয়ে কর্ম সমাগম ৷।

অন্তরে আসক্তি নাই লোকের সংগ্রহ।

বিদ্বানের হয় সেই কর্মেতে আগ্রহ ॥

অনুবাদঃ হে ভারত। অজ্ঞানীরা যেমন কর্মফলের প্রতি আসক্ত হয়ে তাদের কর্তব্যকর্ম করে, তেমনই জ্ঞানীরা অনাসক্ত হয়ে, মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য কর্ম করবেন।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত এবং কৃষ্ণভাবনা-বিমুখ অভক্তের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে তাদের মনোবৃত্তির পার্থক্য। কৃষ্ণভাবনার উন্নতি সাধনের পক্ষে যা সহায়ক নয়, কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত সেই সমস্ত কর্ম করেন না। অবিদ্যার অন্ধকারে আচ্ছন্ন মায়ামুগ্ধ জীবের কর্ম আর কৃষ্ণভাবনাময় মানুষের কর্মকে অনেক সময় আপাতদৃষ্টিতে একই রকম বলে মনে হয়, কিন্তু মায়াচ্ছন্ন মূর্খ মানুষ তার সমস্ত কর্ম করে নিজের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি করার জন্য, কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় মানুষ তার কর্ম করে শ্রীকৃষ্ণের তৃপ্তি সাধন করবার জন্য। তাই মানব-সমাজে কৃষ্ণভাবনাময় মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজন, কেন না তাঁরাই মানুষকে জীবনের প্রকৃত গন্তব্যস্থলের দিকে পরিচালিত করতে পারেন। কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জীব জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধির চক্রে পাক খাচ্ছে; সেই কর্মকে কিভাবে শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণে অর্পণ করা যায়, তা কেবল তাঁরাই শেখাতে পারেন।

শ্লোক ২৬

ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্ ।

জোষয়ে সর্বকর্মাণি বিদ্বান যুক্তঃ সমাচরন ।৷ ২৬ ।৷

ন—নয়; বুদ্ধিভেদম্—বুদ্ধিভ্ৰষ্ট; জনয়েৎ—জন্মানো উচিত; অজ্ঞানাম্—অজ্ঞ ব্যক্তিদের; কর্মসঙ্গিনাম্ — কর্মফলের প্রতি আসক্ত, জোষয়েৎ— নিযুক্ত করা উচিত; সর্ব—সমস্ত, কর্মাণি—কর্ম; বিদ্বান্—জ্ঞানবান; যুক্তঃ—যুক্ত হয়ে; সমাচরন— অনুষ্ঠান করে।

গীতার গান

বুদ্ধিভেদ নাহি করি মূঢ় কর্মীদের ।

অজ্ঞানী যে হয় তারা তাই হেরফের ।।

তাই সে সাজাতে হবে সর্বকর্ম মাঝে ।

আপনি আচরি সব অবিদ্যার সাজে ॥

অনুবাদঃ জ্ঞানবান ব্যক্তিরা কর্মাসক্ত জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের বুদ্ধি বিভ্রান্ত করবেন না। বরং, তাঁরা ভক্তিযুক্ত চিত্তে সমস্ত কর্ম অনুষ্ঠান করে জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের কর্মে প্রবৃত্ত করবেন।

তাৎপর্যঃ বেদৈশ্চ সর্বৈরহমের বেদ্যঃ। সেটিই হচ্ছে বেদের শেষ কথা । বেদের সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান, যাগ-যজ্ঞ আদি, এমন কি জড় কার্যকলাপের সমস্ত নির্দেশাদির একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা। যেহেতু বদ্ধ জীবেরা তাদের জড় ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির অতীত কোন কিছু জানে না, তাই তারা সেই উদ্দেশ্যে বেদ অধ্যয়ন করে। কিন্তু বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের বিধি-নিষেধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে সকাম কর্ম ও ইন্দ্রিয়-তর্পণের মাধ্যমে মানুষ ক্রমান্বয়ে কৃষ্ণভাবনায় উন্নীত হয়। তাই কৃষ্ণ-তত্ত্ববেত্তা কৃষ্ণভক্ত কখনই অপরের কার্যকলাপ ও বিশ্বাসে বাধা দেন না। পক্ষান্তরে, তিনি তাঁর কার্যকলাপের মাধ্যমে শিক্ষা দেন, কিভাবে সমস্ত কর্মের ফল শ্রীকৃষ্ণের সেবায় উৎসর্গ করা যেতে পারে। অভিজ্ঞ কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত এমনভাবে আচরণ করেন, যার ফলে ইন্দ্রিয়-তর্পণে রত দেহাত্ম-বুদ্ধিসম্পন্ন অজ্ঞ লোকেরাও উপলব্ধি করতে পারে, তাদের কি করা কর্তব্য। যদিও কৃষ্ণভাবনাহীন অজ্ঞ লোকদের কাজে বাধা দেওয়া উচিত নয়, তবে অল্প উন্নতিপ্রাপ্ত কৃষ্ণভক্ত বৈদিক ধর্মানুষ্ঠানের বিধির অপেক্ষা না করে সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত হতে পারে। এই ধরনের ভাগ্যবান লোকের পক্ষে বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের আচরণ করার কোন প্রয়োজনীয়তা থাকে না, কারণ শ্রীকৃষ্ণের সেবা করলে আর কোন কিছুই করার প্রয়োজনীয়তা থাকে না। ভগবৎ-তত্ত্ববেত্তা সদগুরুর নির্দেশ অনুসারে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করলে সর্বকর্ম সাধিত হয়।

শ্লোকঃ ২৭

প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ ।

অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে ॥ ২৭ ॥

প্রকৃতেঃ—জড়া প্রকৃতির, ক্রিয়মাণানি — ক্রিয়মাণ; গুণৈঃ গুণের দ্বারা; কর্মাণি— সমস্ত কর্ম; সর্বশঃ—সর্বপ্রকার; অহঙ্কার-বিমূঢ় — অহঙ্কারের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন; আত্মা— আত্মা; কর্তা–কর্তা; অহম্—আমি; ইতি—এভাবে; মন্যতে—মনে করে।

গীতার গান

বিদ্বান মূর্খেতে হয় এই মাত্র ভেদ ৷

প্রকৃতির বশ এক অন্য সে বিচ্ছেদ ।৷

প্রকৃতির গুণে বশ কার্য করি যায় ৷

অহঙ্কারে মত্ত হয়ে নিজে কর্তা হয় ৷৷

আপনার পরিচয় প্রকৃতির মানে ।

দেহে আত্মবুদ্ধি করে অসত্যের ধ্যানে ॥

অনুবাদঃ অহঙ্কারে মোহাচ্ছন্ন জীব জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ দ্বারা ক্রিয়মাণ সমস্ত কার্যকে স্বীয় কার্য বলে মনে করে ‘আমি কর্তা’—এই রকম অভিমান করে।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত ও দেহাত্ম-বুদ্ধিসম্পন্ন বিষয়ী, এদের দুজনের কর্মকে আপাতদৃষ্টিতে একই পর্যায়ভুক্ত বলে মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে এক অসীম ব্যবধান রয়েছে। যে দেহাত্মবুদ্ধিসম্পন্ন, সে অহঙ্কারে মত্ত হয়ে নিজেকেই সব কিছুর কর্তা বলে মনে করে। সে জানে না যে, তার দেহের মাধ্যমে যে সমস্ত কর্ম সাধিত হচ্ছে, তা সবই হচ্ছে প্রকৃতির পরিচালনায় এবং এই প্রকৃতি পরিচালিত হচ্ছে ভগবানেরই নির্দেশ অনুসারে। জড়-জাগতিক মানুষ বুঝতে পারে না যে, সে সর্বতোভাবে ভগবানের নিয়ন্ত্রণাধীন। অহঙ্কারের প্রভাবে বিমূঢ় যে আত্মা, সে নিজেকে কর্তা বলে মনে করে ভাবে, সে স্বাধীনভাবে কর্ম করে চলেছে, তাই সমস্ত কৃতিত্ব সে নিজেই গ্রহণ করে। এটিই হচ্ছে অজ্ঞানতার লক্ষণ। সে জানে না যে, এই স্থূল ও সূক্ষ্ম দেহটি পরম পুরুষোত্তম ভগবানের নির্দেশে জড়া প্রকৃতির সৃষ্টি এবং সেই জন্যই কৃষ্ণভাবনায় অধিষ্ঠিত হয়ে তার দৈহিক ও মানসিক সমস্ত কাজই শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োগ করতে হবে। দেহাত্ম- বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ভুলে যায় যে, ভগবান হচ্ছেন হৃষীকেশ, অর্থাৎ তিনি হচ্ছেন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের নিয়তা। বহুকাল ধরে তার ইন্দ্রিয়গুলি অপব্যবহারের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার ফলে মানুষ বাস্তবিকপক্ষে অহঙ্কারের দ্বারা বিমোহিত হয়ে পড়ে এবং তারই ফলে সে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তার নিত্য সম্পর্কের কথা ভুলে যায়।

error: Content is protected !!