শ্লোকঃ ২২
ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন ।
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কৰ্মণি ॥ ২২ ।।
মে—আমার; পার্থ—হে পৃথাপুত্র; অস্তি— আছে; কর্তব্যম্ — কর্তব্য; ত্রিষু-তিন; লোকেষু — জগতে, কিঞ্চন— কোন; ন–না, অনবাপ্তম্ — অপ্রাপ্ত; অবাপ্তব্যম্ — প্রাপ্তব্য; বর্তে —যুক্ত আছি; এর — অবশ্যই; চ—ও; কর্মণি— শাস্ত্রোক্ত কর্মে।
গীতার গান
আমার কর্তব্য নাই ত্রিভুবন মাঝে ।
পার্থ তুমি জান কেবা সমতুল্য আছে ৷।
প্রাপ্তব্য বলিয়া কিছু কোথা নাহি মোর ৷
তথাপি দেখহ আমি কর্তব্যে বিভোর ॥
অনুবাদঃ হে পার্থ। এই ত্রিজগতে আমার কিছুই কর্তব্য নেই। আমার অপ্রাপ্ত কিছু নেই এবং প্রাপ্তব্যও কিছু নেই। তবুও আমি কর্মে ব্যাপৃত আছি।
তাৎপর্যঃ বৈদিক শাস্ত্রে পুরুষোত্তম ভগবানের বর্ণনা করে বলা হয়েছে—
তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরং
তং দেবতানাং পরমং চ দৈবতম্ ।
পতিং পতীনাং পরমং পরস্তাদ
বিদাম দেবং ভুবনেশমীডাম্ ॥
ন তস্য কার্যং করণং চ বিদ্যতে
ন তৎ সমশ্যাভাধিকশ্চ দৃশ্যতে ।
পরাসা শক্তিবিবিধৈব ক্রয়তে
স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ !!
“ভগবান হচ্ছেন ঈশ্বরদেরও পরম ঈশ্বর এবং দেবতাদেরও পরম দেবতা। সকলেই তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন। তিনিই সকলকে ভিন্ন ভিন্ন শক্তি দান করেন; তাঁরা কেউ পরমেশ্বর নয়। তিনি সমস্ত দেবতাদের পূজ্য এবং তিনি হচ্ছেন সমস্ত পতিদের পরম পতি। তিনি হচ্ছেন এই জড় জগতের সমস্ত অধিপতি ও নিয়ন্তার অতীত, সকলের পূজ্য। তাঁর থেকে বড় আর কিছুই নেই, তিনি হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ।
“তাঁর দেহ সাধারণ জীবের মতো নয়। তাঁর দেহ এবং তাঁর আত্মার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তিনি হচ্ছেন পূর্ণ, তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি অপ্রাকৃত। তাঁর প্রতিটি ইন্দ্ৰিয়ই যে-কোন ইন্দ্রিয়ের কর্ম সাধন করতে পারে। তাই তাঁর থেকে মহৎ আর কেউ নেই, তাঁর সমকক্ষও কেউ নেই। তাঁর শক্তি অসীম ও বহুমুখী, তাই তাঁর সমস্ত কর্ম স্বাভাবিকভাবেই সাধিত হয়ে যায়।” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬/৭-৮) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত ঐশ্বর্যের অধীশ্বর এবং তিনিই হচ্ছেন পরমতত্ত্ব, তাই তাঁর কোন কর্তব্য নেই। কর্মের ফল যাদের ভোগ করতে হয়, তাদের জন্যই কর্তব্যকর্ম করার নির্দেশ দেওয়া আছে। কিন্তু এই ত্রিভুবনে যাঁর কোন কিছুই কামা নেই, তাঁর কোন কর্তব্যকর্মও নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভগবান কুরুক্ষেত্রের
যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করেছেন, কেন না দুর্বলদের রক্ষা করা ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য। যদিও তিনি শাস্ত্রের বিধি-নিষেধের অতীত, কিন্তু তবুও তিনি শাস্ত্রের নির্দেশ লঙ্ঘন করেন না।
শ্লোকঃ ২৩
যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্ত্রিতঃ ।
মম বর্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ ॥ ২৩ ৷৷
যদি ——যদি; হি— অবশ্যই; অহম্ –আমি; ন–না; বর্তেয়ম্—প্রবৃত্ত হই; জাতু – কখনও; কর্মণি—শাস্ত্রোক্ত কর্মে; অতন্দ্রিতঃ– অনলস হয়ে; মম — আমার; বর্জ্জ— পথ; অনুবর্তন্তে—অনুসরণ করবে; মনুষ্যাঃ— সমস্ত মানুষ; পার্থ—হে পৃথাপুত্ৰ সর্বশঃ—সর্বতোভাবে।
গীতার গান
আমি যদি কর্ম ত্যজি অতন্দ্রিত হয়ে।
মম বর্ম সবে অনুগমন করয়ে।।
অনুবাদঃ হে পার্থ ! আমি যদি অনলস হয়ে কর্তব্যকর্মে প্রবৃত্ত না হই, তবে আমার অনুবর্তী হয়ে সমস্ত মানুষই কর্ম ত্যাগ করবে।
তাৎপর্যঃ পারমার্থিক উন্নতি লাভের জন্য সুশৃঙ্খল সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয় এবং এভাবে সমাজকে গড়ে তোলবার জন্য প্রতিটি সভ্য মানুষকে নিয়ম ও শৃঙ্খলা অনুসরণ করে সুসংযত জীবন যাপন করতে হয়। এই সমস্ত নিয়মকানুনের বিধি-নিষেধ কেবল বদ্ধ জীবেদের জন্য, ভগবানের জন্য নয়। যেহেতু তিনি ধর্মনীতি প্রবর্তনের জন্য অবতরণ করেছিলেন, তাই তিনি শাস্ত্র-নির্দেশিত সমস্ত বিধির অনুষ্ঠান করেছিলেন। ভগবান এখানে বলছেন, যদি তিনি এই সমস্ত বিধি-নিষেধের আচরণ না করেন; তবে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সকলেই যথেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে। শ্রীমদ্ভাগবত থেকে আমরা জানতে পারি, এই পৃথিবীতে অবস্থান করার সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঘরে-বাইরে সর্বত্র গৃহস্থোচিত সমস্ত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করেছিলেন।
শ্লোকঃ ২৪
উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্যাং কর্ম চেদহম্ ।
সঙ্করস্য চ কর্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ ॥ ২৪ ৷।
উৎসীদেয়ঃ—উৎসন্ন হবে; ইমে— এই সমস্ত; লোকাঃ — সমস্ত লোক; ন–না; কুর্যাম্ -করি; কর্ম—শাস্ত্রোক্ত কর্ম; চেৎ – যদি; অহম্ – আমি; সঙ্করসা- বর্ণসঙ্করের; চ–এবং; কর্তা–কর্তা; স্যাম্—হব; উপহন্যাম্—বিনষ্ট হবে; ইমাঃ –এই সমস্ত প্রজাঃ—জীব।
গীতার গান
ফল এই হবে সবাই উচ্ছন্ন যাবে ৷
আমার দর্শিত পথ দেখার অভাবে ॥
বিধি আর কিছু নাহি রবে ধরাতলে ৷
বিনষ্ট হইবে এই প্রজারা সকলে ॥
অনুবাদঃ আমি যদি কর্ম না করি, তা হলে এই সমস্ত লোক উৎসন্ন হবে। আমি বর্ণসঙ্কর সৃষ্টির কারণ হব এবং তার ফলে আমার দ্বারা সমস্ত প্রজা বিনষ্ট হবে।
তাৎপর্যঃ বর্ণসঙ্কর হবার ফলে অবাঞ্ছিত মানুষে সমাজ ভরে ওঠে এবং তার ফলে সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা ব্যাহত হয়। এই ধরনের সামাজিক উপদ্রব রোধ করবার জন্য শাস্ত্রে নানা রকমের বিধি-নিষেধের নির্দেশ দেওয়া আছে, যা অনুসরণ করার ফলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই শান্তিপ্রিয় এবং সুস্থ মনোভাবাপন্ন হয়ে ভগবদ্ভক্তি লাভ করতে পারে। ভগবান যখন এই পৃথিবীতে অবতরণ করেন, তখন তিনি জীবের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সাধনের জন্য এই সমস্ত শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধের তাৎপর্য ও তাদের একান্ত প্রয়োজনীয়তার কথা মানুষকে বুঝিয়ে দেন। ভগবান হচ্ছেন সমস্ত জগতের পিতা, তাই জীব যদি বিপথগামী হয়ে পথভ্রষ্ট হয়, পক্ষান্তরে ভগবানই তার জন্য দায়ী হন। তাই, মানুষ যখন শাস্ত্রের অনুশাসন না মেনে যথেচ্ছাচার করতে শুরু করে, তখন ভগবান নিজে অবতরণ করে পুনরায় সমাজের শাস্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। তেমনই আমাদের মনে রাখতে হবে, ভগবানের পদাঙ্ক অনুসরণ করাই আমাদের কর্তব্য, ভগবানকে অনুকরণ করা কোন অবস্থাতেই আমাদের উচিত নয়। অনুসরণ করা আর অনুকরণ করা এক পর্যায়ভুক্ত নয়। ভগবান তাঁর শৈশবে গোবর্ধন পর্বত তুলে ধরেছিলেন, কিন্তু তাঁকে অনুকরণ করে আমরা গোবর্ধন পর্বত তুলতে পারি না। কোন মানুষের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। ভগবানের সমস্ত লীলাই অসাধারণ, তাঁর লীলা অনুকরণ করে ভগবান হবার চেষ্টা করা মূর্খতারই নামান্তর। তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, তাঁকে অনুসরণ করে আমাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া, কোন অবস্থাতেই তাঁর অস্বাভাবিক লীলার অনুকরণ করা আমাদের কর্তব্য নয়। শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/৩৩/৩০-৩১) বলা হয়েছে—
নৈতৎ সমাচরেজ্জাতু মনসাপি হানীশ্বরঃ ।
বিনশাত্যাচরন্থৌট্যাদা থারুদ্রোহ কিজং বিষম্ ॥
ঈশ্বরাণাং বচঃ সত্যং তথৈবাচরিতং ক্বচিৎ ।
তেষাং যৎ স্ববচোযুক্তং বুদ্ধিমাংস্তৎ সমাচরেৎ !!
“ভগবান এবং তাঁর শক্তিতে শক্তিমান ভক্তদের নির্দেশ সকলের অনুসরণ করা কর্তব্য। তাঁদের দেওয়া উপদেশ আমাদের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সাধন করে এবং যে মানুষ বুদ্ধিমান, সে যথাযথভাবে এই সমস্ত উপদেশগুলিকে পালন করে। কিন্তু আমাদের সব সময় সতর্ক থাকা উচিত যাতে আমরা কখনও তাঁদের অনুকরণ না করি। দেবাদিদেব মহাদেবকে অনুকরণ করে বিষ পান করা আমাদের কখনই উচিত নয়।”
আমাদের সর্বদা ঈশ্বরের পদ বিবেচনা করা উচিত, অথবা যাঁরা অসীম ক্ষমতাশালীরূপে চন্দ্র ও সূর্যের গতি প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এই প্রকার শক্তি ছাড়া, কারও অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন ঈশ্বরদের অনুকরণ করা উচিত নয়। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে তাঁদের অনুসরণ করা। সমুদ্র মন্থনের সময় যে বিষ উঠেছিল, তা পান করে মহাদেব জগৎকে রক্ষা করেছিলেন, কিন্তু কোন সাধারণ মানুষ যদি তার এক কণা বিষও পান করে, তবে তার মৃত্যু অবধারিত। কিছু মূর্খ লোক আছে, যারা নিজেদের মহাদেবের ভক্ত বলে প্রচার করে এবং মহাদেবের বিষ খাওয়ার অনুকরণ করে গাঁজা আদি মাদকদ্রব্য পান করে। তারা জানে না, এর মাধ্যমে তাদের মৃত্যুকে তারা ডেকে আনছে। তেমনই, কিছু ভণ্ড কৃষ্ণভক্তও দেখা যায়, যারা নিজেদের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি করবার জন্য ভগবানের অতি অন্তরঙ্গ লীলা—রাসলীলার অনুকরণ করে। তারা ভেবেও দেখে না, ভগবানের মতো গোবর্ধন পর্বত তোলবার ক্ষমতা তাদের নেই। তাই শক্তিমানকে অনুকরণ না করে তাঁকে অনুসরণ করাটাই হচ্ছে আমাদের কর্তব্য। আমাদের শিক্ষা দেবার জন্য ভগবান যে সমস্ত উপদেশ দিয়ে গেছেন, তা পালন করলেই আমাদের পরমার্থ সাধিত হবে। কিন্তু তা না করে, যদি আমরা নিজেরাই ভগবান সাজতে চাই, তা হলে আমাদের অধঃপতন অবধারিত। আজকের জগতে বহু অবতারের দেখা মেলে— লোক ঠকাবার জন্য অনেক ভণ্ড নিজেদের ভগবানের অবতার বলে প্রচার করে, কিন্তু সর্ব শক্তিমান ভগবানের সর্ব শক্তিমত্তার কোন চিহ্নই তাদের মধ্যে দেখা যায় না।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ