শ্লোকঃ ১৯

তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর ।

অসক্তো হ্যাচরন কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ ॥ ১৯ ॥

তস্মাৎ—অতএব; অসক্তঃ- আসক্তি রহিত হয়ে; সততম্ – সর্বদা ; কার্যম—কর্তব্য; কর্ম—কর্ম; সমাচর—অনুষ্ঠান কর; অসক্তঃ – অনাসক্ত হয়ে; হি—অবশ্যই; আচরণ—অনুষ্ঠান করলে; কর্ম—কর্ম; পরম্—পরতত্ত্ব, আপ্নোতি — প্রাপ্ত হয়; পুরুষঃ —মানুষ।

গীতার গান

অতএব অনাসক্ত হয়ে কার্য কর ।

যুক্ত বৈরাগ্য সেই তাতে হও দৃঢ় ৷।

অনাসক্ত কার্য করে পরম পদেতে ।

যোগ্য হয় ক্রমে ক্রমে সে পদ লভিতে ।।

অনুবাদঃ অতএব, কর্মফলের প্রতি আসক্তি রহিত হয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন কর। অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলেই মানুষ পরতত্ত্বকে লাভ করতে পারে।

তাৎপর্যঃ নির্বিশেষবাদী জ্ঞানী মুক্তি চান, কিন্তু ভক্ত কেবল পরম পুরুষ ভগবানকে চান। তাই, সদ্গুরুর তত্ত্বাবধানে যখন কেউ ভগবানের সেবা করেন, তখন মানব-জীবনের পরম উদ্দেশ্য সাধিত হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করতে বললেন, কারণ সেটি ছিল তাঁর ইচ্ছা। সৎ কর্ম করে, অহিংসা ব্রত পালন করে ভাল মানুষ হওয়াটাই স্বার্থপর কর্ম, কিন্তু সৎ-অসৎ, ভাল-মন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিচার না করে ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করাটাই হচ্ছে বৈরাগ্য। এটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম; ভগবান নিজেই সেই উপদেশ দিয়ে গেছেন।

বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান, যাগ-যজ্ঞ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইন্দ্রিয় উপভোগ জনিত অসৎ কর্মের কুফল থেকে মুক্ত হওয়া। কিন্তু ভগবানের সেবায় যে কর্ম সাধিত হয়, তা অপ্রাকৃত কর্ম এবং তা শুভ ও অশুভ কর্মবন্ধনের অতীত। কৃষ্ণভক্ত যখন কোন কর্ম করেন, তা তিনি তাঁর ফলভোগ করার জন্য করেন না, তা তিনি করেন কেবল শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার জন্য। ভগবানের সেবা করার জন্য তিনি সব রকম কর্ম করেন, কিন্তু সেই সমস্ত কর্ম থেকে তিনি সম্পূর্ণ নিঃস্পৃহ থাকেন।

শ্লোকঃ ২০

কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ ।

লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি ৷৷ ২০ ॥

কর্মণা—কর্মের দ্বারা; এব— কেবল; হি—অবশ্যই; সংসিদ্ধিম্ — সিদ্ধি; আস্থিতাঃ- প্রাপ্ত হয়েছিলেন; জনকাদয়ঃ—জনক আদি রাজারা; লোকসংগ্রহম্ — জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জনা; এর অপিও; সংপশ্যন্—বিবেচনা করে; কর্তুম্—কর্ম করা; অইসি—উচিত।

গীতার গান

জনকাদি মহাজন কর্ম সাধ্য করি ৷

সিদ্ধিলাভ করেছিল আপনি আচরি ॥

তুমিও সেরূপ কর লোকশিক্ষা লাগি ৷

লাভ নাই কিছুমাত্র মর্কট বৈরাগী ৷৷

অনুবাদঃ জনক আদি রাজারাও কর্ম দ্বারাই সংসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অতএব, জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার কর্ম করা উচিত।

তাৎপর্যঃ জনক রাজা আদি মহাজনেরা ছিলেন ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞানী, তাই বেদের নির্দেশ অনুসারে নানা রকম যাগ-যজ্ঞ করার কোন বাধ্যবাধকতা তাঁদের ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকশিক্ষার জন্য তাঁরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সমস্ত বৈদিক আচার অনুষ্ঠান করতেন। জনক রাজা ছিলেন সীতাদেবীর পিতা এবং শ্রীরামচন্দ্রের শ্বশুর। ভগবানের অতি অন্তরঙ্গ ভক্ত হবার ফলে তিনি চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন, কিন্তু যেহেতু তিনি মিথিলার (ভারতবর্ষের অন্তর্গত বিহার প্রদেশের একটি অঞ্চলের) রাজা ছিলেন, তাই তাঁর প্রজাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি শাস্ত্রোক্ত কর্মের অনুষ্ঠান করেছিলেন। তেমনই, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর চিরন্তন সখা অর্জুনের পক্ষে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করার কোনও দরকার ছিল না, কিন্তু সদুপদেশ ব্যর্থ হলে হিংসা অবলম্বনেরও প্রয়োজন আছে, এই কথা সাধারণ মানুষকে বোঝাবার জন্যই তাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে, শান্তি স্থাপন করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল, এমন কি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেও বহু চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু দুরাত্মারা যুদ্ধ করতেই বদ্ধপরিকর। এই রকম অবস্থায় যথার্থ কারণে হিংসার আশ্রয় নিয়ে তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়াটা অবশ্যই কর্তব্য। যদিও কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তের জড় জগতের প্রতি কোন রকম স্পৃহা নেই, কিন্তু তবুও তিনি সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্য কর্তব্যকর্মগুলি সম্পাদন করেন। অভিজ্ঞ কৃষ্ণভক্ত এমনভাবে কর্ম করেন, যাতে সকলে তাঁর অনুগামী হয়ে ভগবদ্ভক্তি লাভ করতে পারে। সেই কথা পরবর্তী শ্লোকে বলা হয়েছে।

শ্লোকঃ ২১

যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ ।

স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে ॥ ২১ ৷৷

যৎ যৎ- যেভাবে যেভাবে; আচরতি — আচরণ করেন; শ্রেষ্ঠঃ—শ্ৰেষ্ঠ ব্যক্তি; তৎ তং—সেই সেভাবেই; এব—অবশ্যই; ইতরঃ — সাধারণ; জনঃ—মানুষ; সঃ— তিনি; যৎ—যা; প্রমাণম্—প্রমাণ; কুরুতে—স্বীকার করেন; লোকঃ-সারা পৃথিবী; তৎ- তা, অনুবর্ততে—অনুসরণ করে।

গীতার গান

শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাহা করে লোকের আদর্শ ।

ইতর জনতা যাহা করে হয় হর্ষ ॥

শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাহা কিছু প্রামাণ্য স্বীকারে ।

তাহাই স্বীকার্য হয় প্রতি ঘরে ঘরে ॥

অনুবাদঃ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যেভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরা তার অনুকরণ করে। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন, সমগ্র পৃথিবী তারই অনুসরণ করে।

তাৎপর্যঃ সাধারণ মানুষদের এমনই একজন নেতার প্রয়োজন হয়, যিনি নিজের আচরণের মাধ্যমে তাদেরকে শিক্ষা দিতে পারেন। যে নেতা নিজেই ধূমপানের প্রতি আসক্ত, তিনি জনসাধারণকে ধূমপান থেকে বিরত হতে শিক্ষা দিতে পারেন না। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, শিক্ষা দেওয়া শুরু করার আগে থেকেই শিক্ষকের সঠিকভাবে আচরণ করা উচিত। এভাবেই যিনি শিক্ষা দেন, তাঁকে বলা হয় আচার্য অথবা আদর্শ শিক্ষক। তাই, জনসাধারণকে শিক্ষা দিতে হলে শিক্ষককে অবশ্যই শাস্ত্রের আদর্শ অনুসরণ করে চলতে হয়। কেউ যদি শাস্ত্ৰ-বহির্ভূত মনগড়া কথা শিক্ষা দিয়ে শিক্ষক হতে চায়, তাতে কোন লাভ তো হয়ই না, বরং ক্ষতি হয়। মনুসংহিতা ও এই ধরনের শাস্ত্রে ভগবান নিখুঁত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার শিক্ষা দিয়ে গেছেন এবং এই সমস্ত শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে সমাজকে গড়ে তোলাই হচ্ছে মানুষের কর্তব্য। এভাবেই নেতাদের শিক্ষা এই ধরনের আদর্শ শাস্ত্র অনুযায়ী হওয়া উচিত। যিনি নিজের উন্নতি কামনা করেন, তাঁর আদর্শ নীতি অনুসরণ করা উচিত, যা মহান আচার্যেরা অনুশীলন করে থাকেন। শ্রীমদ্ভাগবতেও বলা হয়েছে, পূর্বতন মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জীবনযাপন করা উচিত, তা হলেই পারমার্থিক জীবনে উন্নতি লাভ করা যায়। রাজা, রাষ্ট্রপ্রধান, পিতা ও শিক্ষক হচ্ছেন স্বাভাবিকভাবেই নিরীহ জনগণের পথপ্রদর্শক। জনসাধারণকে পরিচালনা করার মহৎ দায়িত্ব তাঁদের উপর নাস্ত হয়েছে। তাই তাঁদের উচিত, শাস্ত্রের বাণী উপলব্ধি করে, শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জনসাধারণকে পরিচালিত করে, এক আদর্শ সমাজ গড়ে তোলা। এটি কোন কঠিন কাজ নয়, কিন্তু এর ফলে যে সমাজ গড়ে উঠবে, তাতে প্রতিটি মানুষের জীবন সার্থক হবে।

error: Content is protected !!