শ্লোকঃ ১৬
এবং প্রবর্তিতং চক্রং নানুবর্তয়তীহ যঃ ।
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি ৷ ১৬ ৷
এবম্—এই প্রকারে; প্রবর্তিতম্—বেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত; চক্রম্—চক্র; ন–করে না; অনুবর্তয়তি —গ্রহণ; ইহ – এই জীবনে; যঃ – যিনি; অঘায়ুঃ – পাপপূর্ণ জীবন; ইন্দ্রিয়ারামঃ —ইন্দ্রিয়াসক্ত; মোঘম্–বৃথা; পার্থ – হে পৃথাপুত্ৰ (অর্জুন); সঃ – সেই ব্যক্তি; জীবতি—জীবন ধারণ করে।
গীতার গান
সেই সে ব্রহ্মের চক্র আছে প্রবর্তিত ৷
সে চক্রে যে নাহি হয় বিশেষ বর্তিত।।
পাপের জীবন তার অতি ভয়ঙ্কর।
ইন্দ্রিয় প্রীতয়ে করে পাপ পরস্পর।।
অনুবাদঃ হে অর্জুন ! যে ব্যক্তি এই জীবনে বেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যজ্ঞ অনুষ্ঠানের পন্থা অনুসরণ করে না, সেই ইন্দ্রিয়সুখ-পরায়ণ পাপী ব্যক্তি বৃথা জীবন ধারণ করে।
তাৎপর্যঃ বৈষয়িক জীবন-দর্শন অনুযায়ী, অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা অর্থ উপার্জন করে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার যে অর্থহীন প্রচেষ্টা, তা অতি ভয়ংকর পাপের জীবন বলে ভগবান তা পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই, যারা জড়-জাগতিক সুখভোগ করতে চায়, তাদের এই সমস্ত যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা অবশ্য কর্তব্য। যারা তা করে না, তারা অত্যন্ত জঘনা জীবন যাপন করছে, কারণ তাদের পাপের বোঝা ক্রমশই বেড়ে চলেছে এবং তারা ক্রমশই অধঃপতিত হচ্ছে। প্রকৃতির নিয়মে এই মনুষ্য- জীবন পাওয়ার বিশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের মধ্যে একটিকে অবলম্বন করে আত্ম-উপলব্ধি করা। পাপ-পুণ্যের অতীত পরমার্থবাদীদের কঠোরভাবে শাস্ত্রোক্ত যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার কোন আবশ্যকতা নেই; কিন্তু যারা জড় বিষয়ভোগে লিপ্ত, তাদের এই সমস্ত যজ্ঞ করার মাধ্যমে পবিত্র হওয়া প্রয়োজন। মানুষ নানা ধরনের কর্মে লিপ্ত থাকতে পারে। কিন্তু ভগবানের সেবায় কর্ম না করা হলে সমস্ত কর্মই সাধিত হয় ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য; তাই পুণ্যকর্ম করে তাদের পাপের ভার লাঘব করতে হয়। যে সমস্ত মানুষ কামনা-বাসনার বন্ধনে আবদ্ধ, তারা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করতে চায়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই তাদের জন্য যজ্ঞের প্রবর্তন করেছেন, যাতে তারা তাদের আকাঙ্ক্ষিত ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করতে পারে, অথচ সেই কর্মফলের বন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে পড়ে। এই জগতের উন্নতি আমাদের প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে অলক্ষ্যে ভগবানের ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ তাঁর আজ্ঞাবাহক দেব-দেবীর উপর। তাই বেদের নির্দেশ অনুসারে যজ্ঞ করে দেব-দেবীদের তুষ্ট করা হলে পৃথিবীর সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, বিভিন্ন দেব-দেবীদের তুষ্ট করার জন্য যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তুষ্ট করা এবং এভাবেই যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে করতে জীবের অন্তরে কৃষ্ণভক্তির বিকাশ হয়। কিন্তু যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা সত্ত্বেও যদি অন্তরে কৃষ্ণভক্তির উদয় না হয়, তবে বুঝতে হবে, তা কেবল উদ্দেশ্যহীন নৈতিক আচার-অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছু নয়। তাই মানুষের কর্তবা হচ্ছে, বেদের নির্দেশগুলিকে কেবল নৈতিক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমিত না রেখে, তার মাধ্যমে কৃষ্ণভক্তি লাভের চেষ্টা করা।
শ্লোকঃ ১৭
যত্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ ।
আত্মনোব চ সন্তুষ্টস্তস্য কার্যং ন বিদ্যতে ॥১৭ ॥
যঃ – যে; তু— কিন্তু; আত্মরতিঃ – আত্মারাম; এব—অবশ্যই; স্যাৎ—থাকেন; আত্মতৃপ্তঃ—আত্মতৃপ্ত; চ–এবং মানবঃ — মানুষ; আত্মনি – আত্মাতে; এব—কেবল; চ—এবং; সন্তুষ্টঃ— সন্তুষ্ট; তস্য— তাঁর; কার্য কর্তব্যকর্ম; ন– নেই; বিদ্যতে— বিদ্যমান।
গীতার গান
আর যে বুঝিয়াছে আত্মতত্ত্বসার
কার্য কর্ম কিছু নাই করিবার তার ॥
পূর্ণজ্ঞানে ভগবানে ভক্তি করে যেই
আত্মতৃপ্ত আত্মজ্ঞানী তুষ্ট আত্মাতেই ॥
অনুবাদঃ কিন্তু যে ব্যক্তি আত্মাতেই প্রীত, আত্মাতেই তৃপ্ত প্রপ্ত এবং আত্মাতেই সন্তুষ্ট, তাঁর কোন কর্তব্যকর্ম নেই।
তাৎপর্যঃ যিনি সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময় এবং কৃষ্ণসেবা প্রায় যিনি সম্পূর্ণভাবে মগ্ন, তাঁর অন্য কোন কর্তব্য নেই। কৃষ্ণভক্তি লাভ করার ফলেলে তাঁর অন্তর সম্পূর্ণভাবে কলুষমুক্ত হয়ে পবিত্র হয়েছে। হাজার হাজার যজ্ঞ অনুষ্ঠানুষ্ঠানেও যে ফল লাভ করা যায় না, কৃষ্ণভক্তির প্রভাবে তা মুহূর্তের মধ্যে সাধিত হয়। এভাবে চেতনা শুদ্ধ হলে জীব পরমেশ্বরের সঙ্গে তাঁর নিত্যকালের সম্পর্ক।পর্ক উপলব্ধিই করতে পারেন। তখন ভগবানের কৃপায় তাঁর কর্তব্যকর্ম স্বয়ং জ্ঞানায়োলোকিত হয় এবং তাই তিনি আর বৈদিক নির্দেশ অনুসারে কর্তব্য-অকর্তব্যের গাভী ণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকেন না। এই রকম কৃষ্ণভক্ত জীবের আর জড় বিষয়াসক্তি থা থাকে না এবং কামিনী-কাঞ্চনের প্রতি তাঁর আর কোন মোহ থাকে না।
শ্লোকঃ ১৮
নৈব তস্য কৃতেনার্থো নাকৃতে তেনেহ কশ্চন ৷
ন চাস্য সর্বভূতেষু কশ্চিদর্থনা এব্যপাশ্রয়ঃ ॥ ১৮ ॥
ন—নেই; এব—অবশ্যই; তস্য—তাঁর; কৃতেন-নি – কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠানের দ্বারা; অর্থঃ —প্রয়োজন; ন—নেই; অকৃতেন—কর্তব্যকর্মী-র্ম না করলেও; ইহ—এই জগতে; কশ্চন—কোন কারণ; ন–নেই; চ–ও; অসাস্য—এর; সর্বভূতেষু — সমস্ত প্রাণীর মধ্যে; কশ্চিৎ—কেউই; অর্থ—প্রয়োজন; বাত পাশ্রয়ঃ—আশ্রয় গ্রহণ।
গীতার গান
অর্থানর্থ বিচারাদি আত্মভূত তৃপ্ত নহে ৷
কর্তব্যাকর্তব্য যাহা কিছু হু বেদশাস্ত্ৰ কহে ৷।
সে নহে কাহার ঋণী নিজার্থ সাধনে ৷
সর্বস্ব হয়েছে পূর্ণ শরণ্য শরণে ৷।
অনুবাদঃ আত্মানন্দ অনুভবকারী ব্যক্তির এই জগতে ধর্ম অনুষ্ঠানের কোন প্রয়োজন নেই এবং এই প্রকার কর্ম না করারও কোন কারণ নেই। তাকে অন্য কোন প্রাণীর উপর নির্ভর করতেও হয় না।
তাৎপর্যঃ যে মানুষ তাঁর স্বরূপ উপলব্ধি করে জানতে পেরেছেন যে, তিনি হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাস, তিনি আর সামাজিক কর্তব্য-অকর্তব্যের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেন না। কারণ, তিনি তখন বুঝতে পারেন, শ্রীকৃষ্ণের সেবা করাটাই হচ্ছে একমাত্র কর্তব্যকর্ম। অনেকে আত্মজ্ঞান লাভ করার নাম করে কর্মবিহীন আলস্যপূর্ণ জীবন যাপন করে। কিন্তু পরবর্তী শ্লোকে ভগবান আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, নিষ্কর্মা, অলস লোকেরা কৃষ্ণভক্তি লাভ করতে পারে না। কারণ, কৃষ্ণভক্তি মানে হচ্ছে কৃষ্ণসেবা, শ্রীকৃষ্ণের দাসত্ব করা, তাই কৃষ্ণভক্ত একটি মুহূর্তকেও নষ্ট হতে দেন না। তিনি প্রতিটি মহূর্তকে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করেন। অন্যান্য দেব- দেবীদের পূজা করাটাও কর্তব্য বলে ভগবানের ভক্ত মনে করেন না। কারণ, তিনি জানেন, কেবল ভগবানের সেবা করলেই সকলের সেবা করা হয়।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ