শ্লোকঃ ১৩

যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ ৷

ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ ॥ ১৩॥

যজ্ঞশিষ্ট — যজ্ঞাবশেষ, অশিনঃ — ভোজনকারী; সন্তঃ — ভক্তগণ; মুচ্যন্তে—মুক্ত হন; সর্ব—সর্ব প্রকার; কিল্বিষৈঃ – পাপ থেকে, ভুঞ্জতে ভোগ করে; তে–তারা; ভু— কিন্তু; অঘম্—পাপ; পাপাঃ – পাপীরা; যে—যারা; পচন্তি পাক করে; আত্মকারণাৎ— নিজের জন্য।

গীতার গান

যজ্ঞের সাধন করি অন্ন যেবা খায় ।

মুক্তির পথেতে চলে পাপ নাহি হয়।।

আর যেবা অন্ন পাক নিজ স্বার্থে করে ।

পাপের বোঝা ক্রমে বাড়ে দুঃখভোগ তরে ।।

অনুবাদঃ ভগবদ্ভক্তেরা সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন, কারণ তাঁরা যজ্ঞাবশিষ্ট অন্নাদি গ্রহণ করেন। যারা কেবল স্বার্থপর হয়ে নিজেদের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির জন্য অন্নাদি পাক করে, তারা কেবল পাপই ভোজন করে।

তাৎপর্যঃ যে ভগবদ্ভক্ত কৃষ্ণভাবনামৃত পান করেছেন, তাঁকে বলা হয় সম্ভ। তিনি সব সময় ভগবানের চিন্তায় মগ্ন। ব্রহ্মসংহিতাতে (৫/৩৮) তার বর্ণনা করে বলা হয়েছে-

প্রেমাঞ্জনচ্ছুরিতভক্তিবিলোচনেন সত্তঃ সদৈব হৃদয়েষু বিলোকয়ন্তি। যেহেতু সম্ভগণ সদাসর্বদাই পরম পুরুষোত্তম ভগবান গোবিন্দ (আনন্দ প্রদানকারী) অথবা মুকুন্দ (মুক্তিদাতা) অথবা শ্রীকৃষ্ণ (সর্বাকর্ষক পুরুষ)-এর প্রেমে মগ্ন থাকেন, সেই জন্য তাঁরা ভগবানকে প্রথমে অর্পণ না করে কোন কিছুই গ্রহণ করেন না। তাই, এই ধরনের ভক্তেরা শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, অর্চন আদি বিবিধ ভক্তির অঙ্গের দ্বারা সর্বক্ষণই যজ্ঞ অনুষ্ঠান করছেন এবং এই সমস্ত অনুষ্ঠানের ফলে তাঁরা কখনই জড় জগতের কলুষতার দ্বারা প্রভাবিত হন না। অন্য সমস্ত লোকেরা, যারা আত্মতৃপ্তির জন্য নানা রকম উপাদেয় খাদ্য প্রস্তুত করে খায়, শাস্ত্রে তাদের চোর বলে গণ্য করা হয়েছে এবং তাদের সেই খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে তারা প্রতি গ্রাসে গ্রাসে পাপও গ্রহণ করে। যে মানুষ চোর ও পাপী সে কি করে সুখী হতে পারে? তা কখনই সম্ভব নয়। তাই, সর্বতোভাবে সুখী হবার জন্য তাদের কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সংকীর্তন যজ্ঞ করার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে, এই পৃথিবীতে সুখ ও শান্তি লাভের কোন আশাই নেই ।

শ্লোকঃ ১৪

অন্নাদ্ ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ ।

যজ্ঞাদ ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ ৷৷ ১৪ ৷৷

অন্নাৎ—অন্ন থেকে; ভবন্তি — উৎপন্ন হয়; ভূতানি — জড় দেহ; পর্জন্যাৎ—বৃষ্টি ভবন্তি—উৎপন্ন – থেকে; অন্ন—অন্ন; সম্ভবঃ— উৎপন্ন হয়; যজ্ঞাৎ— যজ্ঞ থেকে; ভবতি—সম্ভব হয়; পর্জন্যঃ বৃষ্টি; যজ্ঞঃ— যজ্ঞ অনুষ্ঠান; কর্ম— শাস্ত্রোক্ত কর্ম; সমুদ্ভবঃ—উদ্ভব হয়। গীতার গান

গীতার গান

অন্ন খেয়ে জীব বাঁচে অন্ন যে জীবন ।

সেই অন্ন উৎপাদনে বৃষ্টি যে কারণ ॥

সেই বৃষ্টি হয় যদি যজ্ঞ কার্যে হয় ৷

সেই যজ্ঞ সাধ্য হয় কর্মের কারণ ॥

অনুবাদঃ অন্ন খেয়ে প্রাণীগণ জীবন ধারণ করে। বৃষ্টি হওয়ার ফলে অন্ন উৎপন্ন হয়। যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে বৃষ্টি উৎপন্ন হয় এবং শাস্ত্রোক্ত কর্ম থেকে যজ্ঞ উৎপন্ন হয়।

তাৎপর্যঃ শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ ভগবদ্গীতার ভাষ্যে লিখেছেন— যে ইন্দ্রাদ্যঙ্গতয়াবস্থিতং যজ্ঞং সর্বেশ্বরং বিষ্ণুমভার্চ্য তচ্ছেযমশন্তি তেন তদ্দেহযাত্রাং সম্পাদয়ন্তি, তে সন্ত সর্বেশ্বরস্য যজ্ঞপুরুষস্য ভক্তাঃ সর্বর্কি দ্বিষৈ রনাদি কালবিবৃদ্ধৈরাত্মানুভব- প্রতিবন্ধকৈনিখিলৈঃ পাপৈবিমুচ্যন্তে। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন যজ্ঞপুরুষ, অর্থাৎ সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা হচ্ছেন তিনিই। তিনি হচ্ছেন সমস্ত দেব-দেবীরও ঈশ্বর। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন সারা দেহের সেবা করে, ভগবানের অঙ্গস্বরূপ বিভিন্ন দেব-দেবীরাও তেমন ভগবানের সেবা করেন। ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ আদি দেবতাদের ভগবান নিযুক্ত করেছেন জড় জগৎকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য এবং বেদে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিভাবে যজ্ঞ করার মাধ্যমে এই সমস্ত দেবতাদের সন্তুষ্ট করা যায়। এভাবে সন্তুষ্ট হলে তাঁরা আলো, বাতাস, জল আদি দান করেন, যার ফলে প্রচুর পরিমাণে ফসল উৎপন্ন হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করা হলে ভগবানের অংশ-বিশেষ দেব-দেবীরাও সেই সঙ্গে পূজিত হন; তাই তাদের আর আলাদা করে পূজা করার কোন প্রয়োজন হয় না। এই কারণে, কৃষ্ণভাবনাময় ভগবানের ভক্তেরা ভগবানকে সমস্ত খাদ্যদ্রব্য নিবেদন করে তারপর তা গ্রহণ করেন। তার ফলে দেহ চিন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হয়। এভাবে খাদ্য গ্রহণ করার ফলে শুধু যে দেহের মধ্যে সঞ্চিত বিগত সমস্ত পাপ কর্মফল নষ্ট হয়ে যায় তাই নয়, জড়া প্রকৃতির সকল কলুষ থেকেও দেহ বিমুক্ত হয়। যখন কোন সংক্রামক ব্যাধি মহামারীরূপে ছড়িয়ে পড়ে, তখন রোগ প্রতিষেধক টীকা নিলে মানুষ তা থেকে রক্ষা পায়। সেই রকম, ভগবান বিষ্ণুকে অর্পণ করার পরে সেই আহার্য প্রসাদরূপে গ্রহণ করলে জাগতিক কলুষতার প্রভাব থেকে যথেষ্ট রক্ষা পাওয়া যায় এবং যাঁরা এভাবে অনুশীলন করেন, তাঁদের ভগবদ্ভক্ত বলা হয়। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় ব্যক্তি, যিনি কেবল কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রহণ করে জীবন ধারণ করেন, তিনি বিগত জড় সংক্রমণগুলিকে প্রতিরোধ করতে পারেন এবং এই সংক্রমণগুলি আত্ম-উপলব্ধির উন্নতির পথে বাধাস্বরূপ। পক্ষান্তরে, যে ভগবানকে নিবেদন না করে কেবল নিজের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি লাভের জন্য খাদ্য গ্রহণ করে, তার পাপের বোঝা বাড়তে থাকে এবং তার মনোবৃত্তি অনুসারে সে পরবর্তী জীবনে শুকর ও কুকুরের মতো নিকৃষ্ট পশুদেহ ধারণ করে, যাতে সমস্ত পাপকর্মের ফল ভোগ করতে পারে। এই জড় জগৎ‍ কলুষতাপূর্ণ, কিন্তু কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রহণ করলে সে কলুষমুক্ত হয় এবং সে তার শুদ্ধ সত্তায় অধিষ্ঠিত হয়। তাই যে তা করে না, সে ভবরোগের কলুষতার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যন্ত্রণা ভোগ করে।

খাদ্য-শস্য, শাক-সবজি, ফল-মূলই হচ্ছে মানুষের প্রকৃত আহার্য, আর পশুরা মানুষের উচ্ছিষ্ট ও ঘাস-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে। যে সমস্ত মানুষ আমিষ আহার করে, তাদেরও প্রকৃতপক্ষে গাছপালার উপরই নির্ভর করতে হয়, কারণ যে পশুমাংস তারা আহার করে, সেই পশুগুলি গাছপালা ও অন্যান্য উদ্ভিদের দ্বারাই পুষ্ট। এভাবেই আমরা বুঝতে পারি যে, প্রকৃতির দান মাঠের ফসলের উপর নির্ভর করেই আমরা প্রকৃতপক্ষে জীবন ধারণ করি, বড় বড় কলকারখানায় তৈরি জিনিসের উপরে নির্ভর করে নয়। আকাশ থেকে বৃষ্টি হবার ফলে ক্ষেতে ফসল হয়। এই বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করেন ইন্দ্র, চন্দ্র, সূর্য আদি দেবতারা। এঁরা সকলেই হচ্ছেন ভগবানের আজ্ঞাবাহক ভৃত্য। তাই, যজ্ঞ করে, ভগবানকে তুষ্ট করলেই তাঁর ভৃত্যেরাও তুষ্ট হন এবং তাঁরা তখন সমস্ত অভাব মোচন করেন। এই যুগের জন্য নির্ধারিত যজ্ঞ হচ্ছে সংকীর্তন যজ্ঞ, তাই অন্ততপক্ষে খাদ্য সরবরাহের অভাব-অনটন থেকে রেহাই পেতে গেলে, সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে এই যজ্ঞ অনুষ্ঠান এই সংকীর্তন যজ্ঞ করলে মানুষের খাওয়া-পরার আর কোন অভাব থাকবে না।

শ্লোকঃ ১৫

কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্ ।

তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ ॥ ১৫ ॥

কর্ম—কর্ম; ব্রহ্ম – বেদ থেকে; উদ্ভবম্—উদ্ভূত, বিদ্ধি — জানবে; ব্রহ্ম – বেদ; অক্ষর – পরব্রহ্ম (পরমেশ্বর ভগবান) থেকে, সমুদ্ভবম্ — সম্যকরূপে উদ্ভূত; তস্মাৎ—অতএব; সর্বগতম — সর্বব্যাপক; ব্রহ্ম — ব্রহ্ম; নিত্যম্ — নিত্য; যজ্ঞে – যজ্ঞে; প্রতিষ্ঠিতম্—প্রতিষ্ঠিত।

গীতার গান

কর্ম যাহা বেদবাণী নহে মনোধর্ম ।

বেদবাণী ভগবদুক্তি অক্ষরের কারণ ॥

অতএব কর্ম হয় ঈশ্বরসাধনা ।

সর্বগত ব্রহ্মনিত্য যজ্ঞেতে স্থাপনা ॥

অনুবাদঃ যজ্ঞাদি কর্ম বেদ থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং বেদ অক্ষর বা পরমেশ্বর ভগবান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব সর্বব্যাপক ব্রহ্ম সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন।

তাৎপর্যঃ যজ্ঞার্থাৎ কর্মণঃ অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তুষ্ট করার জন্যই যে কর্ম করা প্রয়োজন, সেই কথা এই শ্লোকটিতে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যজ্ঞপুরুষ শ্রীবিষ্ণুর সন্তুষ্টির জন্যই যখন আমাদের কর্ম করতে হয়, তখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে বেদের নির্দেশ অনুসারে সমস্ত কর্ম সাধন করা। বেদে সমস্ত কর্মপদ্ধতির বর্ণনা করা হয়েছে। যে কর্ম বেদে অনুমোদিত হয়নি, তাকে বলা হয় বিকৰ্ম বা পাপকর্ম । তাই, বেদের নির্দেশ অনুসারে সমস্ত কর্ম করাটাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ, তাতে কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত থাকা যায়। সাধারণ অবস্থায় যেমন মানুষকে রাষ্ট্রের নির্দেশ অনুসারে চলতে হয়, তেমনই ভগবানের নির্দেশে তাঁর পরম রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিচালিত হওয়াই মানুষের কর্তব্য। বেদের সমস্ত নির্দেশগুলি সরাসরি ভগবানের নিঃশ্বাস থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে— অস্য মহতো ভূতস্য নিশ্বসিতমেতদ্ যদ্ ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহ থর্বাঙ্গিরসঃ । “ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ – এই সব কয়টি বেদই ভগবানের নিঃশ্বাস থেকে উদ্ভূত হয়েছে।” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/৫/১১) ভগবান সর্বশক্তিমান, তিনি নিঃশ্বাসের দ্বারাও কথা বলতে পারেন। ব্রহ্মসংহিতাতে বলা হয়েছে, সর্ব শক্তিমান ভগবান তাঁর যে কোন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সব কয়টি ইন্দ্রিয়ের কাজ করতে পারেন। অর্থাৎ, ভগবান তাঁর নিঃশ্বাসের দ্বারা কথা বলতে পারেন, তাঁর দৃষ্টির দ্বারা গর্ভসঞ্চার করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে, ভগবান জড়া প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং তার ফলে সমস্ত বিশ্ব-চরাচরে প্রাণের সঞ্চার হয়। জড়া প্রকৃতির গর্ভে জীব সৃষ্টি করার পর, এই সমস্ত বদ্ধ জীবেরা যাতে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর কাছে ফিরে আসতে পারে, সেই জন্যই তিনি বৈদিক জ্ঞান দান করেন। আমাদের মনে রাখা উচিত, এই জড় জগতে প্রতিটি বদ্ধ জীবই জড় সুখভোগ করতে চায়। কিন্তু বৈদিক নির্দেশাবলী এমনভাবে রচিত হয়েছে যে, আমরা যেন আমাদের বিকৃত বাসনাগুলিকে পরিতৃপ্ত করতে পারি, তারপর তথাকথিত সুখভোগ পরিসমাপ্ত করে ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে পারি। জড় জগতের দুঃখময় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য ভগবান জীবকে এভাবে করুণা করেছেন। তাই, প্রতিটি জীবের কর্তব্য হচ্ছে কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সংকীর্তন যজ্ঞ করা। যারা বৈদিক নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করতে পারে না, তারা যদি কৃষ্ণচেতনা বা কৃষ্ণভক্তি লাভ করতে পারে, তবে তারাও বৈদিক যজ্ঞের সমস্ত সুফলগুলি প্রাপ্ত হয়।

error: Content is protected !!