শ্লোকঃ ৭
যস্তিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জুন ।
কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগমসত্তঃ স বিশিষ্যতে ॥ ৭॥
যঃ – যিনি; তু— কিন্তু, ইন্দ্রিয়াণি — ইন্দ্ৰিয়সমূহ; মনসা — মনের দ্বারা; নিয়ম্য— সংযত করে; আরভতে আরম্ভ করেন; অর্জুন— হে অর্জুন; কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ- কর্মেন্দ্রিয়ের দ্বারা; কর্মযোগম্ — কর্মযোগ; অসক্তঃ — আসক্তি রহিত; সঃ – তিনি; বিশিষ্যতে—বিশিষ্ট হন।
গীতার গান
কিন্তু যদি নিজেন্দ্রিয় সংযত নিয়মে।
কর্মের আরম্ভ করে যথা যথা ক্রমে।।
বাতুল না হয় মর্কট বৈরাগ্য করি।
অন্তর্নিষ্ঠা হলে হয় সহায় শ্রীহরি।।
সেই হয় কর্মযোগ কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা ৷
আসক্তিরহিত কর্ম বিশেষ প্রকারা ॥
অনুবাদঃ কিন্তু যিনি মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে অনাসক্তভাবে কর্মযোগের অনুষ্ঠান করেন, তিনি পূর্বোক্ত মিথ্যাচারী অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ।
তাৎপর্যঃ সাধুর বেশ ধরে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন ও ভোগতৃপ্তির জন্য লোক ঠকানোর চাইতে স্বকর্মে নিযুক্ত থেকে জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধন করা শত-সহস্র গুণে ভাল। জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়া। স্বার্থগতি অর্থাৎ জীবনের প্রকৃত স্বার্থ হচ্ছে শ্রীবিষ্ণুর শ্রীচরণারবিন্দের আশ্রয় লাভ করা। সমগ্র বর্ণাশ্রম ধর্মের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সেই চরম গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাওয়া। কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কর্তব্যকর্ম করার ফলে একজন গৃহস্থও ভগবানের কাছে ফিরে যেতে পারে। আত্ম-উপলব্ধির জন্য শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে সংযত জীবনযাপন করে কেউ যখন কর্তব্যকর্ম করে, তখন আর তার কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ার কোন আশঙ্কা থাকে না, কারণ সে তখন আসক্তিরহিত হয়ে সম্পূর্ণ নিঃস্পৃহভাবে তার কর্তব্যকর্ম করে চলে। এভাবে সংযত ও নিঃস্পৃহ থাকার ফলে তার অন্তর পবিত্র হয় এবং ভগবানের সান্নিধ্য লাভ হয়। অজ্ঞ জনসাধারণের প্রতারণাকারী মর্কট বৈরাগী হবার চাইতে একজন ঐকান্তিক ব্যক্তি যে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে, সে অনেক উন্নত স্তরে অধিষ্ঠিত। যে-সমস্ত ভণ্ড সাধু লোক ঠকাবার জন্য ধ্যান করার ভান করে, তাদের থেকে একজন কর্তব্যনিষ্ঠ মেথরও অনেক মহৎ।
শ্লোকঃ ৮
নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিদ্ধ্যেদকর্মণঃ ॥ ৮ ॥
নিয়তম্—শাস্ত্রোক্ত; কুরু—কর; কর্ম—কর্ম; ত্বম্—তুমি; কর্ম—কাজ; জ্যায়ঃ— শ্রেয়; হি—অবশ্যই; অকর্মণঃ—কর্মত্যাগ অপেক্ষা; শরীরযাত্রা-দেহধারণ; অপি— এমন কি, চ—ও, তে— তোমার; ন–না; প্রসিদ্ধোৎ— সিদ্ধ হয়; অকর্মণঃ–কর্ম না করে।
গীতার গান
নিয়মিত কর্ম ভাল সেই অকর্ম অপেক্ষা
অনধিকারীর কর্মত্যাগ, পরমুখাপেক্ষা ॥
শরীর নির্বাহ যার নহে কর্ম বিনা ৷
কর্মত্যাগ তার পক্ষে হয় বিড়ম্বনা ৷৷
অনুবাদঃ তুমি শাস্ত্রোক্ত কর্মের অনুষ্ঠান কর, কেন না কর্মত্যাগ থেকে কর্মের অনুষ্ঠান শ্রেয়। কর্ম না করে কেউ দেহযাত্রাও নির্বাহ করতে পারে না।
তাৎপর্যঃ অনেক ভণ্ড সাধু আছে, যারা জনসমক্ষে প্রচার করে বেড়ায় যে, তারা অত্যন্ত উচ্চ বংশজাত এবং কর্ম-জীবনেও তারা অনেক সাফল্য লাভ করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনের জন্য তারা সব কিছু ত্যাগ করেছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই রকম ভণ্ড সাধু হতে নিষেধ করেছিলেন। পক্ষান্তরে, তিনি তাঁকে শাস্ত্র-নির্ধারিত ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করতে উপদেশ দিয়েছিলেন। অর্জুন ছিলেন গৃহস্থ ও সেনাপতি, তাই শাস্ত্র-নির্ধারিত গৃহস্থ-ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন করাই ছিল তাঁর কর্তব্য। এই ধর্ম পালন করার ফলে জড় বন্ধনে আবদ্ধ মানুষের হৃদয় পবিত্র হয় এবং ফলে সে জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয়। তথাকথিত ত্যাগীরা, যারা দেহ প্রতিপালন করবার জন্যই ত্যাগের অভিনয় করে, ভগবান তাদের কোন রকম স্বীকৃতি দেননি, শাস্ত্রেও তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এমন কি দেহ প্রতিপালন করবার জন্যও মানুষকে কর্ম করতে হয়। তাই, জড়-জাগতিক প্রবৃত্তিগুলিকে শুদ্ধ না করে, নিজের খেয়ালখুশি মতো কর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়। এই জড় জগতে প্রত্যেকেরই অবশ্য জড়া প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব করবার কলুষময় প্রবৃত্তি আছে অর্থাৎ ইন্দ্রিয়- তৃপ্তির বাসনা আছে। সেই কলুষময় প্রবৃত্তিগুলিকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। শাস্ত্র- নির্দেশিত উপায়ে তা না করে, কর্তব্যকর্ম ত্যাগ করে এবং অন্যের সেবা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তথাকথিত অতীন্দ্রিয়বাদী যোগী হবার চেষ্টা করা কখনই উচিত নয়।
শ্লোকঃ ৯
যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র লোকোঽয়ং কর্মবন্ধনঃ ৷
তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর ॥ ৯॥
যজ্ঞার্থাৎ-যজ্ঞ বা বিষ্ণুর জন্যই কেবল; কর্মণঃকর্ম: অন্যত্র — তা ছাড়া; লোকঃ —এই জগতে; অয়ম্—এই; কর্মবন্ধনঃ – কর্মবন্ধন; তৎ—তাঁর; অর্থম্ — নিমিত্ত; কর্ম—কর্ম; কৌন্তেয় – হে কুন্তীপুত্র; মুক্তসঙ্গঃ — আসক্তি রহিত হয়ে; সমাচর- অনুষ্ঠান কর।
গীতার গান
যজ্ঞেশ্বর ভগবানের সন্তোষ লাগিয়া ।
নিয়মিত কর্ম কর আসক্তি ত্যজিয়া ।।
আর যত কর্ম হয় বন্ধের কারণ ।
অতএব সেই কার্য কর নিবারণ।।
ভগবদ সন্তোষার্থ কর্মের প্রসঙ্গ।
যত কিছু আচরণ সব মুক্ত সঙ্গ।।
অনুবাদঃ বিষ্ণুর প্রীতি সম্পাদন করার জন্য কর্ম করা উচিত; তা না হলে কর্মই এই জড় জগতে বন্ধনের কারণ। তাই, হে কৌন্তেয়! ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই কেবল তুমি তোমার কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান কর এবং এভাবেই তুমি সর্বদাই বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।
তাৎপর্যঃ যেহেতু দেহ প্রতিপালন করবার জন্য প্রতিটি জীবকে কর্ম করতে হয়, তাই সমাজের বর্ণ ও আশ্রম অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন স্তরের জীবের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্ম নির্ধারিত করা হয়েছে, যাতে তাদের উদ্দেশ্যগুলি যথাযথভাবে সাধিত হয়। যজ্ঞ বলতে ভগবান শ্রীবিষ্ণু অথবা যজ্ঞানুষ্ঠানকে বোঝায়। তাই তাঁকে প্রীতি করার জন্যই সমস্ত যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা হয়। বেদে বলা হয়েছে— যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ। পক্ষান্তরে, নানা রকম আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যজ্ঞ করা আর সরাসরিভাবে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর সেবা করার দ্বারা একই উদ্দেশ্য সাধিত হয়। সুতরাং কৃষ্ণভাবনামৃত হচ্ছে যজ্ঞানুষ্ঠান, কেন না এই শ্লোকে তা প্রতিপন্ন হয়েছে। বর্ণাশ্রম ধর্মের উদ্দেশ্যও হচ্ছে ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে সন্তুষ্ট করা। বর্ণাশ্রমাচারবতা পুরুষেণ পরঃ পুমান্ । বিষ্ণুরারাধ্যতে (বিষ্ণু পুরাণ ৩/৮/৮)।
তাই বিষ্ণুকে সন্তুষ্ট করার জন্যই কেবল কর্ম করা উচিত। এ ছাড়া আর সমস্ত কর্মই আমাদের এই জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। সেই কর্ম ভালই হোক আর খারাপই হোক, সেই কর্মের ফল অনুষ্ঠাতাকে জড় বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। তাই, শ্রীকৃষ্ণকে (অথবা শ্রীবিষ্ণুকে) সন্তুষ্ট করার জন্য কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে কর্ম করতে হয়। এভাবেই যে ভগবানের সেবাপরায়ণ হয়েছে, সে আর কখনও জড় বন্ধনে আবদ্ধ হয় না— মুক্ত স্তরে বিরাজিত। এটিই হচ্ছে কর্ম সম্পাদনের মহৎ কৌশল এবং এই পন্থার শুরুর প্রারম্ভে দক্ষ পথ-প্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞানী শুদ্ধ ভক্তের তত্ত্বাবধানে অথবা স্বয়ং ভগবানের তত্ত্বাবধানে (যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তত্ত্বাবধানে অর্জুন করেছিলেন) গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে এই যোগ সাধন করতে হয়। ইন্দ্রিয়-তর্পণের জন্য কিছুই করা উচিত নয়, বরং সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য করা উচিত। এভাবেই অনুশীলনের ফলে শুধু যে কর্মফলের বন্ধন থেকেই মুক্ত থাকা যায়, তাই নয়—তা ছাড়া ভগবানের অপ্রাকৃত প্রেমভক্তির স্তরে ক্রমশ উন্নীত হওয়া যায়, যার ফলে তাঁর সচ্চিদানন্দময় পরম ধামে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ