শ্লোকঃ ৪০

ইন্দ্রিয়াণি মনো বুদ্ধিরস্যাধিষ্ঠানমুচ্যতে ।

এতৈর্বিমোহয়ত্যেষ জ্ঞানমাবৃত্য দেহিনম্ ।। ৪০ ।। 

 ইন্দ্রিয়াণি — ইন্দ্রিয়গুলি; মনঃ —মন; বুদ্ধিঃ বুদ্ধি; অস্য—এই কামের; অধিষ্ঠানম্— অধিষ্ঠান; উচ্যতে—বলা হয়; এতৈঃ—এদের দ্বারা; বিমোহয়তি – বিমোহিত হয়; এষঃ—এই কাম; জ্ঞানম্ — জ্ঞান; আবৃত্য – আবৃত করে; দেহিনম্— দেহাভিমানী জীবকে।

গীতার গান

সেই কাম অধিষ্ঠিত ইন্দ্ৰিয়াদি মনে ।

বুদ্ধিতে বসিয়া আঁকে নিখিল ভুবনে ।।

বদ্ধ জীব সে কারণ দেহ অভিমানী ৷

স্বাতন্ত্র্যের ব্যবহার নাহি জানে জ্ঞানী ।।

অনুবাদঃ ইন্দ্রিয়সমূহ, মন ও বুদ্ধি এই কামের আশ্রয়স্থল। এই ইন্দ্রিয় আদির দ্বারা কাম জীবের প্রকৃত জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে তাকে বিভ্রান্ত করে।

তাৎপর্যঃ বদ্ধ জীবাত্মার দেহের ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশতে শত্রু অধিকার করে বসেছে, তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই সমস্ত অংশের কথা ইঙ্গিতে আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন, যাতে আমরা সেই শত্রুকে পরাভূত করতে পারি। ইন্দ্রিয় আদির সমস্ত কার্যকলাপের কেন্দ্র হচ্ছে মন, তাই মন হচ্ছে সমস্ত ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার বাসনার কেন্দ্রস্থল। তাই যখন আমরা ইন্দ্রিয় উপভোগের কথা শুনি, তখন স্বভাবতই মন ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির সকল প্রকার চিন্তাভাবনার আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে; ও তারই ফলে মন ও ইন্দ্রিয়গুলি হয়ে ওঠে কামপ্রবৃত্তির আধার। এর পরে, বুদ্ধি বিভাগটি হয় এই সমস্ত কামপ্রবৃত্তির রাজধানী। বুদ্ধি হচ্ছে আত্মার সব চাইতে অন্তরঙ্গ প্রতিবেশী। এই বুদ্ধি যখন কামের দ্বারা উন্মত্ত হয়ে ওঠে, তখন সে আত্মাতে অহঙ্কারের সঞ্চার করে, যার ফলে আত্মা জড় ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে জড়ের মাঝে তার স্বরূপ অন্বেষণ করে। জড় ইন্দ্রিয়-সুখকেই প্রকৃত সুখ বলে মনে করে আত্মা তখন তা উপভোগ করতে মত্ত হয়ে ওঠে। শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/৮৪/১৩) আত্মার এই আত্মবিস্মৃতিকে খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে

যস্যাত্মবুদ্ধিঃ কুণপে ত্রিধাতুকে

স্বধীঃ কলত্রাদিষু ভৌম ইজাধীঃ ।

যত্তীর্থবুদ্ধিঃ সলিলে ন কহিচিজ্‌

জন্যেভিজ্ঞেষু স এর গোখরঃ !!

“যে ত্রিধাতু সমন্বিত এই জড় দেহকে পরম প্রেমাস্পদ আত্মা, স্ত্রী-পুত্রাদিকে আত্মীয়, পার্থিব জন্মস্থানকে পূজনীয় মনে করে এবং তীর্থস্থানে গিয়ে কেবলমাত্র নদীতে মান সেরে চলে আসে, কিন্তু পারমার্থিক জ্ঞানসম্পন্ন সেখানকার মানুষদের সঙ্গে ভগবৎ-তত্ত্ব আলোচনা করে না, সে একটি গাধা অথবা গরু।”

শ্লোকঃ ৪১

তস্মাত্ত্বমিন্দ্রিয়াণ্যাদৌ নিয়ম্য ভরতর্ষভ ।

পাদ্মানং প্রজহি হোনং জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্ ॥ ৪১ ॥

তস্মাৎ— সেই হেতু; ত্বম্ — ভূমি; ইন্দ্রিয়াণি — ইন্দ্রিয়গুলি; আদৌ — প্ৰথমে; নিয়ম,— নিয়ন্ত্রিত করে; ভরতর্ষভ – হে ভরতশ্রেষ্ঠ; পাদ্মানম্ – পাপের প্রধান প্রতীক; জহি – বিনাশ কর; হি—অবশ্যই; এনম্—এই; জ্ঞান—জ্ঞান; বিজ্ঞান-আত্ম- তত্ত্ববিজ্ঞান; নাশনম্—নাশক।

গীতার গান

অতএব হে ভারত! প্রথমেতে কাম ।

নিয়মিত করি হও সম্পূর্ণ নিষ্কাম ৷৷

ভক্তির ধারণ সেই কাম জয় জন্য ৷

সে জ্ঞান বিজ্ঞাননাশী, নাহি পথ অন্য ॥

অনুবাদঃ অতএব, হে ভরতশ্রেষ্ঠ! তুমি প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান-নাশক পাপের প্রতীকরূপ এই কামকে বিনাশ কর।

তাৎপর্যঃ ভগবান প্রথম থেকেই অর্জুনকে ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করবার উপদেশ দিয়েছেন যাতে তিনি পরম শত্রু কামকে জয় করতে পারেন, কারণ এই কামের প্রভাবে জীব আত্মজ্ঞান বিস্মৃত হয়ে তার স্বরূপ ভুলে যায়। এখানে জ্ঞান বলতে সেই জ্ঞানকে বোঝানো হয়েছে, যে জ্ঞান আমাদের প্রকৃত স্বরূপের কথা মনে করিয়ে দেয়, অর্থাৎ যে জ্ঞান আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের আত্মাই হচ্ছে আমাদের প্রকৃত স্বরূপ—আমাদের জড় দেহটি একটি আবরণ মাত্র। বিজ্ঞান বলতে সেই বিশেষ জ্ঞানকে বোঝায়, যা ভগবানের সঙ্গে আমাদের নিত্য সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দেয়। এর ব্যাখ্যা করে শ্রীমদ্ভাগবতে (২/৯/৩১) বলা হয়েছে-

জ্ঞানং পরমগুহ্যং মে যদ বিজ্ঞানসমন্বিতম্ ।

সরহস্যং তদঙ্গং চ গৃহাণ গদিতং ময়া ॥

“আত্মজ্ঞান ও ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান পরম গোপনীয় ও গভীর রহস্যপূর্ণ, কিন্তু ভগবান যখন নিজে এই জ্ঞান বিশ্লেষণ করেন, তখন তা হৃদয়ঙ্গম করা যায়।” ভগবদ্গীতা আমাদেরকে আত্মতত্ত্ব সম্পর্কে সাধারণ ও বিশেষ জ্ঞান প্রদান করে। জীবেরা ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই তাদের ধর্ম হচ্ছে ভগবানের সেবা করা। এই উপলব্ধিকে বলা হয় কৃষ্ণভাবনামৃত। তাই, জীবনের শুরু থেকেই আমাদের উচিত কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া, যাতে আমরা সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণচেতনাময় হয়ে আমাদের জীবন সার্থক করে তুলতে পারি।

প্রতিটি জীবের অন্তরে যে ভগবৎ-প্রেম আছে, তারই বিকৃত প্রতিবিম্ব হচ্ছে কাম। কিন্তু জীবনের শুরু থেকেই যদি আমরা ভগবানকে ভালবাসতে শিখি, তা হলে আমাদের স্বাভাবিক ভগবৎ-প্রেম আর কামে পর্যবসিত হতে পারে না। ভগবৎ-প্রেম কামে বিকৃত হয়ে গেলে, তখন তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন। তা সত্ত্বেও কৃষ্ণভাবনা এমনই শক্তিশালী যে, এমন কি জীবনের শেষ পর্যায়েও যদি কেউ গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে ভগবদ্ভক্তির বিধি-নিষেধগুলি অনুশীলন করে, তবে সে কৃষ্ণপ্রেম ফিরে পায়। তাই, জীবনের যে কোন পর্যায়ে কৃষ্ণভাবনার অনুশীলন শুরু করা যায়। যখন আমরা কৃষ্ণভাবনার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে পারি, ভগবদ্ভক্তির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারি, জীবনের যে পর্যায়েই হোক, তখন থেকেই আমরা ভক্তিযোগের অনুশীলন করতে পারি এবং আমাদের পরম শত্রু কামকে কৃষ্ণপ্রেমে রূপান্তরিত করতে পারি। এটিই হচ্ছে মানব-জীবনের সর্বোত্তম পূর্ণতার স্তর।

শ্লোকঃ ৪২

ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ ।

মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতন্তু সঃ ॥

ইন্দ্রিয়াণি — ইন্দ্রিয়সমূহ; পরাণি – শ্রেয়; আহুঃ – বলা হয়; ইন্দ্রিয়েভ্যঃ- ইন্দ্রিয়গুলি অপেক্ষা; পরম্― শ্রেয়, মনঃ—মন; মনসঃ —মনের থেকে; তু—ও; পরা – শ্রেয়; বুদ্ধিঃ—বুদ্ধি; যঃ – যিনি; বুদ্ধেঃ বুদ্ধির থেকে, পরতঃ– শ্রেয়; তু কিন্তু; সঃ— তিনি।

গীতার গান

বদ্ধজীব জড়বুদ্ধি ইন্দ্রিয় প্রধান।

ইন্দ্রিয়াধিপতি মন কর্মের বিধান ।।

মন হতে পরবুদ্ধি তারপর আত্মা ।

অতএব কর সেবা সেই পরমাত্মা ।।

অনুবাদঃ স্থুল জড় পদার্থ থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয়; ইন্দ্রিয়গুলি থেকে মন শ্রেয়; মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়; আর তিনি (আত্মা) সেই বুদ্ধি থেকেও শ্রেয়।

তাৎপর্যঃ কামের নানাবিধ কার্যকলাপের নির্গম পথ হচ্ছে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি। কামের সঞ্চয় হয় আমাদের দেহে, কিন্তু ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ হয়। তাই, সামগ্রিকভাবে জড় দেহের থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয়। আমাদের অন্তরে যখন উচ্চস্তরের চেতনার বিকাশ হয় অথবা কৃষ্ণচেতনার বিকাশ হয়, তখন এই সমস্ত নির্গম পথগুলি বন্ধ হয়ে যায়। অন্তরে কৃষ্ণভাবনার উন্মেষ হলে পরমাত্মা বা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে আত্মা তার নিত্য সম্পর্ক অনুভব করে, তাই তখন আর তার জড় দেহের অনুভূতি থাকে না। দেহগত কার্যকলাপগুলি হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপ, তাই ইন্দ্রিয়গুলি নিষ্ক্রিয় হলে, দেহও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু সেই অবস্থায় মন সক্রিয় থাকে, যেমন নিদ্রিত অবস্থায় আমরা স্বপ্ন দেখি। কিন্তু মনেরও ঊর্ধ্বে হচ্ছে বুদ্ধি এবং বুদ্ধিরও ঊর্ধ্বে হচ্ছে আত্মা। তাই, আত্মা যখন পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন বুদ্ধি, মন ও ইন্দ্রিয়গুলি স্বাভাবিকভাবে পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ঠিক এভাবেই কঠোপনিষদেও বলা হয়েছে যে, ইন্দ্রিয় থেকে ইন্দ্রিয় উপভোগের সামগ্রীগুলি শ্রেয়, কিন্তু ইন্দ্রিয় উপভোগের সামগ্রীগুলি থেকে মন শ্রেয়। তাই, মন যদি সর্বতোভাবে নিরন্তর ভগবানের সেবায় নিয়োজিত থাকে, তখন ইন্দ্রিয়গুলির বিপদগামী হবার আর কোন সুযোগ থাকে না। এই মানসিক প্রবৃত্তির কথা পূর্বেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পরং দৃষ্টা নিবর্ততে। মন যদি ভগবানের অপ্রাকৃত সেবায় মগ্ন থাকে, তা হলে নিম্নগামী প্রবৃত্তিগুলিতে আকৃষ্ট হওয়ার কোন সম্ভাবনাই তার আর থাকে না। কঠোপনিষদে আত্মাকে মহান্ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই আত্মা হচ্ছে— ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়, ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির ঊর্ধ্বে। তাই, আত্মার স্বরূপ সরাসরি উপলব্ধি করতে পারলে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায় । বুদ্ধি র আত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হয়ে, মনকে কৃষ্ণচেতনায় নিযুক্ত করাই। সকলের তা হলেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। পরমার্থ সাধনে কর্তব্য। নবীন ভক্তকে সাধারণত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সমস্ত বিষয় থেকে দূরে থাকতে উপদেশ দেওয়া হয়, কেন না তার ফলে ইন্দ্রিয়গুলি ধীরে ধীরে সংযত হয়। তা ছাড়া, বুদ্ধি দিয়েও মনকে তার সঙ্কল্পে দৃঢ় করতে হয়। বুদ্ধির দ্বারা যদি আমরা কৃষ্ণভাবনার মাধ্যমে ভগবানের চরণ কমলে আত্মনিবেদন করি, তা হলে মন ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হয়ে একাগ্র হয়, তখন ইন্দ্রিয়ের প্রলোভনগুলি আর মনকে বিচলিত করতে পারে না। ইন্দ্রিয়গুলি তখন বিষদাঁতহীন সাপের মতো 1 নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কিন্তু আত্মা যদিও বুদ্ধি, মন ও ইন্দ্রিয়ের অধীশ্বর, তবুও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আশ্রয় গ্রহণ না করলে, যে কোন মুহূর্তে মনের প্রভাবে বিচলিত হয়ে আত্মা অধঃপতিত হতে পারে।

error: Content is protected !!