শ্লোকঃ ৩৭

শ্রীভগবানুবাচ

কাম এষ ক্রোধ এর রজোগুণসমুদ্ভবঃ 1

মহাশনো মহাপাপ্যা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্ ॥ ৩৭ ॥

শ্রীভগবান্ উবাচ— পরমেশ্বর ভগবান বললেন; কামঃ —কাম; এফঃ —এই; ক্রোধঃ —ক্রোধ; এবঃ—এই; রজোগুণ — রজোগুণ; সমুদ্ভবঃ – উদ্ভূত হয়; মহাশনঃ— সর্বগ্রাসী; মহাপাত্মা— অত্যন্ত পাপী; বিদ্ধি — জানবে; এনম্—একে; ইহ—এই জড় জগতে, বৈরিণম্—প্রধান শত্রু।

গীতার গান

শ্রীভগবান কহিলেনঃ

কাম আর ক্রোধ হয় রজোগুণ দ্বারা ।

অভিভূত বদ্ধজীব ত্রিজগতে সারা ॥

জ্ঞানী জীব এই দুই মহা শত্রু জানে ৷

করে তাই গুণাতীত কার্য সাবধানে ॥

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন – হে অর্জুন! রজোগুণ থেকে সমুদ্ভূত কামই মানুষকে এই পাপে প্রবৃত্ত করে এবং এই কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী ও পাপাত্মক; কামকেই জীবের প্রধান শত্রু বলে জানবে।

তাৎপর্যঃ জীব যখন জড়া প্রকৃতির সংস্পর্শে আসে, তখন তার অন্তরের শাশ্বত কৃষ্ণপ্রেম রজোগুণের প্রভাবে কামে পর্যবসিত হয়। টক তেঁতুলের সংস্পর্শে দুধ যেমন দই হয়ে যায়, তেমনই ভগবানের প্রতি আমাদের অপ্রাকৃত প্রেম কামে রূপান্তরিত হয়। তারপর, কামের অতৃপ্তির ফলে হৃদয়ে ক্রোধের উদয় হয়; ক্রোধ থেকে মোহ এবং এভাবেই মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলে জীব জড় জগতের বন্ধনে স্থায়িভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই, কাম হচ্ছে জীবের সব চাইতে বড় শত্রু। এই কামই শুদ্ধ জীবাত্মাকে এই জড় জগতে আবদ্ধ হয়ে থাকতে অনুপ্রাণিত করে। ক্রোধ হচ্ছে তমোগুণের প্রকাশ; এভাবে প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের প্রভাবে কাম, ক্রোধ আদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ হয়। তাই, রজোগুণের প্রভাবকে তমোগুণে অধঃপতিত না হতে দিয়ে, যদি ধর্মাচরণ করার মাধ্যমে তাকে সত্ত্বগুণে উন্নীত করা যায়, তা হলে আমরা পারমার্থিক অনুশীলনের মাধ্যমে ক্রোধ আদি ষড় রিপুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি।

ভগবান তাঁর নিত্য-বর্ধমান চিদানন্দের বিলাসের জন্য নিজেকে অসংখ্য মূর্তিতে বিস্তার করেন। জীব হচ্ছে এই চিন্ময় আনন্দের আংশিক প্রকাশ। ভগবান তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ জীবকে আংশিক স্বাধীনতা দান করেছেন, কিন্তু যখন তারা সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে এবং ভগবানের সেবা না করে নিজেদের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করতে শুরু করে, তখন তারা কামের কবলে পতিত হয়। ভগবান এই গড় জগৎ সৃষ্টি করেছেন যাতে বদ্ধ জীব তার এই কামোন্মুখী প্রবৃত্তিগুলিকে পূর্ণ করতে পারে। এভাবে তার সমস্ত কামনা-বাসনাগুলিকে চরিতার্থ করতে গিয়ে জাব যখন সম্পূর্ণভাবে দিশাহারা হয়ে পড়ে, তখন সে তার স্বরূপের অন্বেষণ করতে শুরু করে।

এই অন্বেষণ থেকেই বেদান্ত-সূত্রের সূচনা, যেখানে বলা হয়েছে, অথাতো এমজিজ্ঞাসা—মানুষের কর্তব্য হচ্ছে পরমতত্ত্ব অনুসন্ধান করা। শ্রীমদ্ভাগবতে পরম- তন্নকে বর্ণনা করে বলা হয়েছে— জন্মাদ্যস্য যতোহন্বয়াদিতরতশ্চ, অর্থাৎ “সব কিছুর উৎস হচ্ছেন পরমব্রহ্ম।” সুতরাং কামেরও উৎস হচ্ছেন ভগবান। তাই, যদি তাই কামকে ভগবৎ-প্রেমে রূপান্তরিত করা যায়, অথবা কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, কিংবা সব কিছু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করা যায়, তা হলে কাম ও ক্রোধ উভয়ই অপ্রাকৃত চিন্ময়রূপ প্রাপ্ত হয়। এভাবেই কামের সঙ্গে সঙ্গে বিধিও ভগবদ্ভক্তিতে রূপান্তরিত হয়। শ্রীরামচন্দ্রের ভক্ত হনুমান শ্রীরামচন্দ্রকে ১% করবার জন্য রাবণের স্বর্ণলঙ্কা দগ্ধ করেছিলেন এবং এভাবেই তিনি তাঁর ক্রোধকে শত্রুনিধন কার্যে প্রয়োগ করেছিলেন। এখানেও ভগবদ্গীতায়, ভগবান শাকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর সমস্ত ক্রোধ শত্রুবাহিনীর উপরে প্রয়োগ করে ভগবানেরই সপ্তষ্টি বিধানের কাজে লাগাতে উৎসাহ দিচ্ছেন। এভাবে আমরা দেখতে পাই না, আমাদের কাম ও ক্রোধকে যখন আমরা ভগবানের সেবায় নিয়োগ করি, তখন তারা আর শত্রু থাকে না, আমাদের বন্ধুতে রূপান্তরিত হয়।

শ্লোকঃ ৩৮

ধূমেনাত্রিয়তে বহ্ন্যিথাদর্শো মলেন চ ।

যথোল্বেনাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্ ॥ ৩৮ ৷

দমেন — ধূমের দ্বারা; আব্রিয়তে – আবৃত; বহ্নিঃ—আগুন; যথা— যেমন; আদর্শঃ -দর্পণ; মলেন—ময়লার দ্বারা; চ–ও; যথা— যেমন; উবেন—জরায়ুর দ্বারা; আবৃতঃ—আবৃত থাকে; গর্ভঃ—গর্ভ; তথা — তেমন, তেন—কামের দ্বারা; ইদম্ এই আবৃতম্—আবৃত থাকে।

গীতার গান

ত্রিজগতে কাম মাত্র সর্ব আবরণ ।

আগুনেতে ধূম যথা ধূসর দর্শন ৷।

অথবা জরায়ু যথা গর্ভ আবরণ ।

অল্পাধিক এই সব কামের কারণ ॥

অনুবাদঃ অগ্নি যেমন ধূম দ্বারা আবৃত থাকে, দর্পণ যেমন ময়লার দ্বারা আবৃত থাকে অথবা গর্ভ যেমন জরায়ুর দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই জীবাত্মা বিভিন্ন মাত্রায় এই কামের দ্বারা আবৃত থাকে।

তাৎপর্যঃ জীবের শুদ্ধ চেতনা সাধারণত তিনটি আবরণের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে যায়। অগ্নি যেমন ধূমের দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে, দর্পণ যেমন ধূলোর দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে এবং গর্ভ যেমন জরায়ুর দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে, জীবের শুদ্ধ চেতনাও তেমন কামের আবরণে আচ্ছাদিত থাকে। কামকে যখন ধূমের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন আমরা বুঝতে পারি যে, ধূম আগুনকে ঢেকে রাখলেও যেমন আগুনের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়, তেমনই কামের অন্তরালে শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনা উপলব্ধি করা যায়। পক্ষান্তরে বলা যায়, জীবের অন্তরে যখন অল্প-বিস্তর কৃষ্ণভাবনার প্রকাশ দেখা যায়, তখন আমরা বুঝতে পারি যে, ধূমাচ্ছাদিত অগ্নির মতো জীবের ভগবদ্ভক্তি কামের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে আছে। আগুনের প্রভাবেই ধুমের উৎপত্তি হয়, কিন্তু আগুন জ্বালাবার প্রথম পর্যায়ে আগুনকে দেখা যায় না। তেমনই, কৃষ্ণভাবনার প্রাথমিক পর্যায়েও বিশুদ্ধ, নির্মল ভগবৎ-প্রেম প্রকট হয়ে ওঠে না। দর্পণের ধুলো পরিষ্কার করার পর যেমন আবার তাতে সব কিছুর প্রতিবিম্ব দেখা যায়, তেমনই, নানা রকম পারমার্থিক প্রচেষ্টার দ্বারা চিত্ত-দর্পণকে মার্জন করবার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে ভগবানের নাম সমন্বিত মহামন্ত্র উচ্চারণ করা। গর্ভের দ্বারা আচ্ছাদিত জরায়ুর সঙ্গে জীবের বদ্ধ অবস্থার তুলনার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, এই অবস্থায় জীব কত অসহায়। জঠরস্থ শিশু নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারে না। জীবনের এই অবস্থাকে গাছের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। গাছেরাও জীব, কিন্তু প্রবল কামের বশবর্তী হয়ে পড়ার ফলে তারা এমন অবস্থায় পতিত হয়েছে যে, তাদের চেতনা প্রায় সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত হয়ে গেছে। ধূলোর দ্বারা

আচ্ছাদিত দর্পণকে পশু-পক্ষীর সঙ্গে তুলনা করা যায়, আর ধূমাচ্ছাদিত অগ্নির মনুষ্য শরীর প্রাপ্ত হলে জীব তার সুপ্ত ধূমাচ্ছাদিত আগুনকে খুব সাবধানতার সঙ্গে

সঙ্গে মানুষের তুলনা করা যায়। কৃষ্ণচেতনাকে জাগিয়ে তুলতে পারে। হাওয়া দিতে থাকলে, তা যেমন এক সময়ে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, তেমনই খুব সন্তর্পণে ভক্তিযোগ অনুশীলন করার ফলে মানুষ তার অন্তরে ভগবদ্ভক্তির আগুন জ্বালিয়ে তুলতে পারে। এভাবেই মনুষ্য জন্মের যথার্থ সদ্ব্যবহার করার ফলে জীব জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে। মনুষ্যজন্ম লাভ করার ফলে জীব তার শত্রু কাম প্রবৃত্তিকে দমন করতে পারে আর তা সম্ভব হয় সদগুরুর তত্ত্বাবধানে কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করার মাধ্যমে।

শ্লোকঃ ৩৯

আবৃতং জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা ।

কামরূপেণ কৌন্তেয় দুপূরেণানলেন চ ॥ ৩৯ ॥

আবৃতম্—আবৃত; জ্ঞানম্—শুদ্ধ চেতনা; এতেন—এর দ্বারা; জ্ঞানিনঃ—জ্ঞানীর; নিত্যবৈরিণা—চিরশত্রুর দ্বারা, কামরূপেণ –কামরূপ; কৌন্তেয় – হে কুন্তীপুত্র; দুষ্পরেণ—অপূরণীয়; অনলেন—অগ্নির দ্বারা; চ–ও;

গীতার গান

এই নিত্য বৈরী করে জ্ঞান আবরণ ৷

জীব তাহে বদ্ধ হয় নহে সাধারণ ॥

কাম হয় দুষ্প্ররণ অগ্নির সমান ।

অতএব কাম লাগি হও সাবধান ।।

অনুবাদঃ কামরূপী চির শত্রুর দ্বারা জীবের শুদ্ধ চেতনা আবৃত হয়। এই কাম দুর্বারিত অগ্নির মতো চিরঅতৃপ্ত।

তাৎপর্যঃ মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে যে, ঘি ঢেলে যেমন আগুনকে কখনও নেভানো যায় না, তেমনই কাম উপভোগের দ্বারা কখনই কামের নিবৃত্তি হয় না। জড় জগতে সমস্ত কিছুর কেন্দ্র হচ্ছে যৌন আকর্ষণ, তাই জড় জগৎকে বলা হয় “মৈথুনাগার’ অথবা যৌন জীবনের শিকল। আমরা দেখেছি, অপরাধ করলে মানুষ কারাগারে আবদ্ধ হয়; তেমনই, যারা ভগবানের আইন অমান্য করে, তারাও যৌন জীবনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে এই মৈথুনাগারে পতিত হয়। ইন্দ্রিয়-তৃপ্তিকে কেন্দ্র করে জড় সভ্যতার উন্নতি লাভের অর্থ হচ্ছে, বদ্ধ জীবদের জড় অস্তিত্বের বন্দীদশার মেয়াদ বৃদ্ধি করা। তাই, এই কাম হচ্ছে অজ্ঞানতার প্রতীক, যার দ্বারা জীবদের এই জড় জগতে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করার সময় সাময়িকভাবে সুখের অনুভূতি হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই তথাকথিত সুখই হচ্ছে জীবের পরম শত্রু।

error: Content is protected !!