শ্লোকঃ ৩৪
ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ ।
তয়োর্ন বশমাগচ্ছে তৌ হাস্য পরিপন্থিনৌ ৷। ৩৪ ॥
ইন্দ্রিয়স্য—সমস্ত ইন্দ্রিয়ের; ইন্দ্রিয়স্য অর্থে—ইন্দ্রিয়-বিষয়সমূহে; রাগ—আসক্তি; দ্বেষৌ— বিদ্বেষ; ব্যবস্থিতৌ – বিশেষভাবে অবস্থিত; তয়োঃ—তাদের; ন–নয়; বশম্—বশীভূত; আগচ্ছে— হওয়া উচিত; তৌ – তাদের; হি— অবশ্যই: অস্য— তার; পরিপন্থিনৌ–প্রতিবন্ধক।
গীতার গান
অতএব ইন্দ্রিয়ার্থে রাগ দ্বেষ ছাড়ি ।
বিষয়েতে রাগ দ্বেষ কিছু নাহি করি ॥
তাহার বশেতে নিজে কভু না রহিবা ৷
অনাসক্ত বিষয়েতে মাধবের সেবা ।।
অনুবাদঃ সমস্ত জীবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে আসক্তি অথবা বিরক্তি অনুভব করে, কিন্তু এভাবে ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের বশীভূত হওয়া উচিত নয়, কারণ তা পারমার্থিক প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক।
তাৎপর্যঃ যাদের মনে কৃষ্ণভাবনার উদয় হয়েছে, তাদের আর জড়-জাগতিক ইন্দ্ৰিয় উপভোগের বাসনা থাকে না। কিন্তু যাদের চেতনা শুদ্ধ হয়নি, তাদের কর্তব্য হচ্ছে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করা। তা হলেই পরমার্থ সাধনের পথে অগ্রসর হওয়া যায়। উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করে বিষয়ভোগ করার ফলে মানুষ জড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, কিন্তু শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করলে আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের দ্বারা আবদ্ধ হতে হয় না। যেমন, যোনিসম্ভোগ করার বাসনা প্রতিটি বদ্ধ জীবাত্মার মধ্যেই থাকে, তাই শাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিবাহ করে দাম্পত্য জীবন যাপন করতে। বিবাহিত স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে অবৈধ সঙ্গ করতে শাস্ত্রে নিষেধ করা হয়েছে এবং অন্য সমস্ত স্ত্রীলোককে মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু শাস্ত্রে এই সমস্ত নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও মানুষ তা অনুসরণ করতে চায় না, ফলে সে জড় বন্ধনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারে না। এই ধরনের বিকৃত বাসনাগুলি দমন করতে হবে, তা না হলে সেগুলি আত্ম-উপলব্ধির পথে দুরতিক্রম্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। জড় দেহটি যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ তার প্রয়োজনগুলিও মেটাতে হবে, কিন্তু তা করতে হবে শাস্ত্রের বিধি-নিষেধ অনুসরণ করার মাধ্যমে। আর তা সত্ত্বেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কোন রকম দুর্ঘটনা না ঘটে। রাজপথে যেমন দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে, তেমনই শাস্ত্রের বিধি-নিষেধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও পথভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে। বহুকাল ধরে এই জড়া প্রকৃতির সংসর্গের ফলে আমাদের ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করবার ইচ্ছা অত্যন্ত প্রবল। তাই, নিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করলেও প্রতি পদক্ষেপে অধঃপতিত হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই নিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রিয় উপভোগের আসক্তিও সর্বতোভাবে বর্জনীয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভালবেসে তার সেবার হলে, অচিরেই আমরা জড় সুখভোগ করার বাসনা থেকে মুক্ত হতে পারি। তাই, কোন অবস্থাতেই ভগবানের সেবা থেকে বিরত হওয়া উচিত নয়। ইন্দ্রিয়সুখ বর্জন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করা, তাই কোন অবস্থাতেই তা পরিত্যাগ করা উচিত নয়।
শ্লোকঃ ৩৫
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাত্ ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ ॥ ৩৫ ॥
শ্রেয়ান্― শ্রেষ্ঠ; স্বধর্মঃ—স্বধর্ম; বিগুণঃ – দোষযুক্ত, পরধর্মাৎ — অন্যের জন্য নির্দিষ্ট দাম থেকে; স্বনুষ্ঠিতাৎ— উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত; স্বধর্মে — স্বধর্মে; নিধনম্ — নিধন ; শ্রেয়ঃ—ভাল; পরধর্মঃ – অন্যের ধর্ম; ভয়াবহঃ — বিপজ্জনক।
গীতার গান
নিজ ধর্ম শ্রেয় জান পরধর্মাপেক্ষা ।
ভগবদ সেবা লাগি কর্মযোগ শিক্ষা ৷।
স্বধর্মে নিধন ভাল নহে পরধর্ম ।
ভাল করি বুঝ তুমি এই গূঢ় মৰ্ম ৷৷
অনুবাদঃ স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। অধর্ম সাধনে যদি মৃত্যু হয়, তাও মঙ্গলজনক, কিন্তু অন্যের ধর্মের অনুষ্ঠান করা বিপজ্জনক।
তাৎপর্যঃ পরধর্ম পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হয়ে, স্বধর্ম আচরণ করাই মানুষের কর্তব্য। জড়া প্রকৃতির গুণ অনুসারে শাস্ত্র-নির্দেশিত ধর্মাচরণগুলি মানুষের দেহমনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্ধারিত হয়েছে। সদগুরু যে আদেশ দেন, তাই হচ্ছে পারমার্থিক কর্তব্য। এই কর্তব্য সম্পাদন করার মাধ্যমে আমরা শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত সেবা করে থাকি। কিন্তু জাগতিক অথবা পারমার্থিক যাই হোক না কেন, অন্যের ধর্ম অনুকরণ অপেক্ষা মৃত্যুকাল পর্যন্ত স্বধর্মে নিষ্ঠাবান থাকা প্রত্যেকের একান্ত কর্তব্য। জাগতিক স্তরের কর্তব্য এবং পারমার্থিক স্তরের কর্তব্য ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সেগুলি সম্পাদন করা সব সময় মঙ্গলজনক। মানুষ যখন জড়া প্রকৃতির দ্বারা কবলিত থাকে, তখন তার কর্তব্য হচ্ছে, তার বিশেষ অবস্থার জন্য নির্দিষ্ট বিধান পালন করা এবং কোন অবস্থাতেই অপরকে অনুকরণ করা উচিত নয় । যেমন, সত্ত্বগুণের দ্বারা প্রভাবিত ব্রাহ্মণ হচ্ছেন অহিংসা পরায়ণ, কিন্তু রজোগুণের দ্বারা প্রভাবিত ক্ষত্রিয় প্রয়োজন হলে হিংসার আশ্রয় নিতে পারেন। স্বধর্ম আচরণ করতে গিয়ে ক্ষত্রিয়কে যদি মৃত্যুবরণ করতে হয়, তাও ভাল, কিন্তু ব্রাহ্মণকে অনুকরণ করে অহিংসার আচরণ করা তার উচিত নয়। চিত্তবৃত্তির পরিশোধন করা সকলেরই কর্তব্য, কিন্তু তা সাধন করতে হয় ধীরে ধীরে- তাড়াহুড়ো করে নয়। তবে মানুষ যখন জড় গুণের প্রভাবমুক্ত হয়ে সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণচেতনা লাভ করেন, তখন তিনি যে কোন রকম আচরণ করতে পারেন, কিন্তু তার সেই সমস্ত কর্ম অনুষ্ঠিত হয় সদগুরুর নির্দেশ অনুসারে। কৃষ্ণভাবনার সেই পূর্ণ স্তরে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের মতো আচরণ করতে পারেন, ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের মতো আচরণ করতে পারেন। অপ্রাকৃত স্তরে জড় জগতের গুণ অনুসারে স্তর-বিভাগ নেই। যেমন, ক্ষত্রিয় হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণের মতো আচরণ করেছিলেন, আবার ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও পরশুরাম ক্ষত্রিয়ের মতো আচরণ করেছিলেন। তাঁরা অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাই তাঁরা এভাবে আচরণ করতে পারতেন। কিন্তু মানুষ যখন প্রাকৃত স্তরে থাকে, তখন জড়া প্রকৃতির গুণ অনুসারে তাকে তার স্বধর্ম আচরণ করে সম্যকভাবে কৃষ্ণচেতনা লাভ করতে হয়।
শ্লোকঃ ৩৬
অর্জুন উবাচ
অথ কেন প্রযুক্তোইয়ং পাপং চরতি পুরুষঃ ।
অনিচ্ছন্নপি বায়ে বলাদিব নিয়োজিতঃ ॥ ৩৬ ॥
অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন; অথ—তবে, কেন—কার দ্বারা; প্রযুক্তঃ—প্রেরিত হয়ে; অয়ম্—এই; পাপম্—পাপ; চরতি — আচরণ করে; পুরুষঃ- মানুষ, অনিচ্ছন—অনিচ্ছায়; অপি—যদিও, বায়ে– হে বৃষ্ণি বংশাবতংশ, বলাৎ— বলপূর্বক; ইব—যেন; নিয়োজিতঃ– নিয়োজিত।
গীতার গান
অর্জুন কহিলেনঃ
হে বায়ে কহ তুমি বুঝাইয়া মোরে ।
কি লাগি হয়েছে জীব যুক্ত পাপ ঘোরে ৷।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও হয় পাপে নিয়োজিত ৷
অবশ হইয়া করে পাপ সে গর্হিত ॥
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন – হে বায়ে! মানুষ কার দ্বারা চালিত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন বলপূর্বক নিয়োজিত হয়েই পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয় ?
তাৎপর্যঃ ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ জীব মূলত চিন্ময়, পবিত্র ও সমস্ত জড় কলুষ থেকে মুক্ত। তাই, সে জড় জগতের পাপের অধীন নয়। কিন্তু সে যখন জড় জগতের সংস্পর্শে আসে, তখন সে বিনা দ্বিধায় ইচ্ছাকৃতভাবে ও অনিচ্ছাকৃতভাবে নানা রকম পাপকার্যে লিপ্ত হয়। তাই, এখানে অর্জুন জীবদের এই বিকৃত স্বভাব সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণের কাছে যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, তা খুবই ন্যায়সঙ্গত। যদিও কখনও কখনও জীব পাপকর্ম করতে চায় না, তবুও সে পাপকর্ম করতে বাধ্য হয়। আমাদের দেহের মধ্যে অবস্থান করে পরমাত্মা কিন্তু আমাদের পাপকর্ম করতে অনুপ্রাণিত করেন না, কিন্তু তা সত্ত্বেও জীব পাপকার্যে লিপ্ত হয়। তার কারণ ভগবান পরবর্তী শ্লোকে বর্ণনা করেছেন।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ