শ্লোকঃ ৩১
যে যে মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ ।
শ্রদ্ধাবন্তোহনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেঽপি কর্মভিঃ ॥ ৩১ ৷৷
যে—যাঁরা; মে—আমার; মতম্ – নির্দেশাবলী; ইদম্—এই; নিত্যম্ — সর্বদা অনুতিষ্ঠন্তি—নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠান করেন; মানবাঃ—মানুষেরা; শ্রদ্ধাবস্তঃ- শ্রদ্ধাবান; অনসূয়ন্তঃ—মাৎসর্য রহিত, মুচ্যন্তে—মুক্ত হন; তে—তাঁরা সকলে; অপি—এমন কি; কর্মভিঃ – কর্মের বন্ধন থেকে।
গীতার গান
আমার এমত কার্য অনুষ্ঠান করি ।
সর্ব কর্ম করে শুধু ভজিতে শ্রীহরি ॥
শ্রদ্ধাবান মোর ভক্ত অসূয়াবিহীন ।
কর্মফল মুক্ত হয় ভক্তিতে বিলীন ৷।
অনুবাদঃ আমার নির্দেশ অনুসারে যে-সমস্ত মানুষ তাঁদের কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান করেন এবং যাঁরা শ্রদ্ধাবান ও মাৎসর্য রহিত হয়ে এই উপদেশ অনুসরণ করেন, তাঁরাও কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হন।
তাৎপর্যঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে আদেশ করেছেন, তা বৈদিক জ্ঞানের সারমর্ম, তাই সন্দেহাতীতভাবে তা শাশ্বত সত্য। বেদ যেমন নিত্য, শাশ্বত, কৃষ্ণভাবনার এই তত্ত্বও তেমন নিত্য, শাশ্বত। ভগবানের প্রতি ঈর্ষান্বিত না হয়ে এই উপদেশের প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস থাকা উচিত। তথাকথিত অনেক দার্শনিক ভগবদ্গীতার ভাষ্য লিখেছেন, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস নেই। তাঁরা কোন দিনও গীতার মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন না এবং সকাম কর্মের বন্ধন থেকেও মুক্ত হতে পারবেন না। কিন্তু অতি সাধারণ কোন মানুষও যদি ভগবানের শাশ্বত নির্দেশের প্রতি দৃঢ় শ্রদ্ধাবান হয়, অথচ সমস্ত নির্দেশগুলিকে যথাযথভাবে পালন করতে অসমর্থ হয়, তবুও সে অবধারিতভাবে কর্মের অনুশাসনের বন্ধন থেকে মুক্ত হবে। ভক্তিযোগ সাধন করার প্রাথমিক পর্যায়ে কেউ হয়ত ভগবানের নির্দেশ ঠিক ঠিকভাবে পালন নাও করতে পারে, কিন্তু যেহেতু সে এই পন্থার প্রতি বিরক্ত নয় এবং যদি সে নৈরাশ্য ও ব্যর্থতা বিবেচনা না করে ঐকান্তিকতার সঙ্গে এই কার্যক্রমের অনুষ্ঠান করতে থাকে, তবে সে নিশ্চিতভাবে ধীরে ধীরে শুদ্ধ কাভাবনার পর্যায়ে অবশ্যই উন্নীত হবে।
শ্লোকঃ ৩২
যে ত্বেতদভ্যসূয়ন্তো নানুতিষ্ঠন্তি মে মতম্ ৷
সর্বজ্ঞানবিমূঢ়াংস্তান্ বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ ॥ ৩২ ॥
যে— যারা; তু— কিন্তু; এতৎ—এই; অভ্যসূয়ন্ত: মাৎসর্যবশত; ন–না; অনুতিষ্ঠন্তি—নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠান করে; মে—আমার; মতম্—নির্দেশ, সর্বজ্ঞান- সর্বপ্রকার জ্ঞানে; বিমূঢ়ান্—বিমূঢ়, তান্—তাদেরকে, বিদ্ধি — জানবে, নষ্টান্—বিনষ্ট; অচেতসঃ—কৃষ্ণভক্তিহীন।
গীতার গান
প্রকৃতিসদৃশ চেষ্টা করে গুণবান ৷
প্রকৃতির বশে সর্ব কার্য অনুষ্ঠান ৷৷
অনুবাদঃ কিন্তু যারা অসূয়াপূর্বক আমার এই উপদেশ পালন করে না, তাদেরকে সমস্ত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত, বিমূঢ় এবং পরমার্থ লাভের সকল প্রচেষ্টা থেকে ভ্রষ্ট বলে জানবে।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনাময় না হওয়ার ক্ষতি সম্পর্কে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কর্মকর্তার নির্দেশ মানতে অবাধ্যতা করলে যেমন শাস্তি হয়, তেমনই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের নির্দেশ অমান্য করলেও নিশ্চয়ই শাস্তি আছে। অমান্যকারী লোক, তা সে যতই উচ্চ স্তরের হোক, তার কাণ্ডজ্ঞানহীন বুদ্ধি-বিবেচনার জন্য, তার নিজের স্বরূপ সম্পর্কে, এমন কি পরমব্রহ্মা, পরমাত্মা ও পরম পুরুষোত্তম ভগবানের স্বরূপ সম্পর্কেও সে অজ্ঞ। সুতরাং তার জীবনের পূর্ণতা লাভের কোনই আশা নেই।
শ্লোকঃ ৩৩
সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতেজ্ঞানবানপি ।
প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি ॥ ৩৩ ॥
সদৃশম্ — অনুরূপভাবে; চেষ্টতে — চেষ্টা করে; স্বস্যাঃ—স্বীয়; প্রকৃতেঃ – প্রকৃতির ৬: জ্ঞানবান্—জ্ঞানবান; অপি – যদিও, প্রকৃতিম্ — স্বভাবকে; যান্তি — অনুগমন পারেন: ভূতানি — সমস্ত জীব; নিগ্রহঃ — দমন: কিম্ — কি; করিষ্যতি করতে পারে।
গীতার গান
বহুকাল হতে যারা প্রকৃতির বশ।
নিগ্রহ করিতে নারে হইয়া বিবশ ॥
অনুবাদঃ আনবান ব্যক্তিও তাঁর স্বভাব অনুসারে কার্য করেন, কারণ প্রত্যেকেই ত্রিগুণজাত তার স্বীয় স্বভাবকে অনুগমন করেন। সুতরাং নিগ্রহ করে কি লাভ হবে ?
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনার অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত না হতে পারলে জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায়ে ( ৭/১৪) ভগবান সেই কথা প্রতিপন্ন করেছেন। তাই, এমন কি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষেও কেবলমাত্র ধারণাগত জ্ঞান অথবা দেহ থেকে আত্মাকে পৃথক করেও মায়ার বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। বহু তথাকথিত তত্ত্ববিদ্ আছে, যারা ভগবৎ-তত্ত্বদর্শন লাভ বলার অভিনয় করে, কিন্তু অন্তর তাদের সম্পূর্ণভাবে মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন। তারা সম্পূর্ণভাবে মায়ার গুণের দ্বারা আবদ্ধ। পুঁথিগত বিদ্যায় কেউ খুব পারদর্শী হতে পারে, কিন্তু বহুকাল ধরে মায়াজালে আবদ্ধ থাকার ফলে সে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। জীব সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে কেবল মাত্র ভাবনার প্রভাবে এবং এই কৃষ্ণচেতনা থাকলে সংসার ধর্ম পালন করেও জড় বানন থেকে মুক্ত হওয়া যায়। তাই, ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ না করে হঠাৎ ঘর- বাড়ি ছেড়ে, তথাকথিত যোগী অথবা কৃত্রিম পরমার্থবাদী সেজে বসলে কোনই লাভ হয় না। তার থেকে বরং নিজ নিজ আশ্রমে অবস্থান করে কোন তত্ত্ববেত্তার নির্দেশে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করার চেষ্টা করা উচিত। এভাবেই ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার ফলে মানুষ মায়ামুক্ত হতে পারে।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ