শ্লোকঃ ২৮
তত্ত্ববিত্ত্ব মহাবাহো গুণকর্মবিভাগয়োঃ ।
গুণা গুণেষু বর্তন্ত ইতি মত্বা ন সজ্জতে ॥ ২৮ ॥
তত্ত্ববিৎ-তত্ত্বজ্ঞ, তু—কিন্তু, মহাবাহো – হে মহাবীর; গুণকর্ম-প্রকৃতির প্রভাব জনিত কর্ম; বিভাগয়োঃ — পার্থক্য; গুণাঃ— ইন্দ্রিয়সমূহ; গুণেষু — ইন্দ্রিয়-তর্পণে; বর্তন্তে—প্রবৃত্ত হন; ইতি—এভাবে; মত্বা—মনে করে; ন–না; সজ্জতে— আসক্ত হন।
গীতার গান
তত্ত্ববিৎ যে বিদ্বান বুঝে গুণকর্ম ।
গুণ দ্বারা কার্য হয় জানে সারমর্ম !!
অতএব গুণকাৰ্য না করে সজ্জন ।
প্রকৃতির গুণকার্য আসক্ত না হন ৷৷
অনুবাদঃ হে মহাবাহো ! তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি ভগবদ্ভক্তিমুখী কর্ম ও সকাম কর্মের পার্থক্য ভালভাবে অবগত হয়ে, কখনও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগাত্মক কার্যে প্রবৃত্ত হন না।
তাৎপর্যঃ যিনি তত্ত্ববেত্তা, তিনি পূর্ণ উপলব্ধি করেন যে, জড়া প্রকৃতির সংস্রবে তিনি প্রতিনিয়ত বিব্রত হয়ে আছেন। তিনি জানেন যে, তিনি হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এই জড়া প্রকৃতি তার প্রকৃত আলয় নয়। সচ্চিদানন্দময় ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে তিনি তাঁর প্রকৃত স্বরূপও জানেন। তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছেন যে, কোন না কোন কারণে তিনি দেহাত্মবুদ্ধিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তাঁর শুদ্ধ স্বরূপে তিনি হচ্ছেন ভগবানের নিত্যদাস এবং ভক্তি সহকারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় সমস্ত কর্ম করাই হচ্ছে তাঁর কর্তব্য। তাই তিনি কৃষ্ণভাবনাময় কার্যকলাপে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেন এবং তার ফলে স্বভাবতই তিনি আনুষঙ্গিক ও অনিত্য জড় ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপের প্রতি অনাসক্ত হয়ে পড়েন। তিনি জানেন যে, ভগবানের ইচ্ছার ফলেই তিনি জড় জগতে পতিত হয়েছেন, তাই এই দুঃখময় জড় জগতের কোন দুঃখকেই তিনি দুঃখ বলে মনে করেন না, পক্ষান্তরে তিনি তা ভগবানের আশীর্বাদ বলে মনে করেন। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, যিনি ভগবানের তিনটি প্রকাশ ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান সম্বন্ধে জানেন, তাঁকে বলা হয় তত্ত্ববিদ্, কারণ ভগবানের সঙ্গে তাঁর নিত্য সম্পর্কের কথা তিনি জানেন ।
শ্লোকঃ ২৯
প্রকৃতের্গুণসংমূঢ়াঃ সজ্জন্তে গুণকর্মসু ।
তানকৃৎস্নবিদো মন্দান্ কৃৎস্নবিন্ন বিচালয়েৎ ॥ ২৯ ॥
প্রকৃতেঃ—জড়া প্রকৃতির; গুণসংমূঢ়াঃ — গুণের প্রভাবে বিমূঢ় ব্যক্তিরা; সজ্জন্তে— প্রবৃত্ত হয়; গুণকর্মসু—প্রাকৃত কার্যকলাপে; তান্—সেই সকল; অকৃৎসবিদঃ— অল্পজ্ঞ ব্যক্তিগণকে; মন্দান—মন্দবুদ্ধি; কৃৎস্নবিত্—তত্ত্বজ্ঞ; ননা; বিচালয়েং— বিচলিত করেন।
গীতার গান
গুণকর্মে আসক্তি সে গুণেতে সংমূঢ় ।
প্রাকৃত নিজেকে মানে সেই কার্যে দৃঢ় ॥
ভবরোগী মূঢ় জনে না করি বঞ্চন ।
কর্মের যোজনা হতে ক্রমে জ্ঞান বল ।।
অনুবাদঃ জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে, অজ্ঞান ব্যক্তিরা জাগতিক কার্যকলাপে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু তাদের কর্ম নিকৃষ্ট হলেও তত্ত্বজ্ঞানী পুরুষেরা সেই মন্দবুদ্ধি ও অল্পজ্ঞ ব্যক্তিগণকে বিচলিত করেন না।
তাৎপর্যঃ যারা অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন, তারা তাদের জড় সত্তাকে তাদের স্বরূপ বলে মনে করে, তার ফলে তারা জড় উপাধির দ্বারা ভূষিত হয়। এই দেহটি জড়া প্রকৃতির উপহার। এই জড় দেহের সঙ্গে যারা গভীরভাবে আসক্ত, তাদের বলা হয় মন্দ, অর্থাৎ তারা হচ্ছে আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান রহিত অলস ব্যক্তি। মূর্খ লোকেরা তাদের জড় দেহটিকে তাদের আত্মা বলে মনে করে; এই দেহটিকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তাদেরকে তারা আত্মীয় বলে স্বীকার করে, যে দেশে তারা জন্ম নিয়েছে অর্থাৎ যে দেশে তারা তাদের জড় দেহটি প্রাপ্ত হয়েছে, সেটি তাদের দেশ আর সেই দেশকে তারা পূজা করে এবং তাদের অনুকূলে কতকগুলি সংস্কারের অনুষ্ঠান করাকে তারা ধর্ম বলে মনে করে। সমাজসেবা, জাতীয়তাবাদ, পরমার্থবাদ আদি হচ্ছে এই ধরনের জড় উপাধি প্রাপ্ত ব্যক্তিদের কতকগুলি আদর্শ। এই সমস্ত আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তারা নানা রকম জাগতিক কাজে ব্যস্ত থাকে। তারা মনে করে, ভগবানের কথা হচ্ছে রূপকথা, তাই ভগবানকে নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো সময় তাদের নেই। এই ধরনের মোহাচ্ছন্ন মানুষেরা অহিংসা-নীতি আদি দেহগত হিতকর কার্যে ব্রতী হয়, কিন্তু তাতে কোন কাজ হয় না। পারমার্থিক জ্ঞান অর্জন করে যাঁরা তাঁদের প্রকৃত স্বরূপ আত্মাকে জানতে পেরেছেন, তাঁরা এই সমস্ত দেহসর্বস্ব মানুষদের কাজে কোন রকম বাধা দেন না, পক্ষান্তরে তাঁরা নিঃশব্দে তাঁদের পারমার্থিক কর্ম ভগবানের সেবা করে চলেন।
যারা অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন, তারা ভগবদ্ভক্তির মর্ম বোঝে না। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উপদেশ দিয়েছেন, তাদের মনে ভগবদ্ভক্তির সঞ্চার করার চেষ্টা করে অনর্থক সময় নষ্ট না করতে। কিন্তু ভগবানের ভক্তেরা ভগবানের চাইতেও বেশি কৃপালু, তাই তাঁরা নানা রকম দুঃখকষ্ট সহ্য করে, সমস্ত বিপদকে অগ্রাহ্য করে, সকলের অন্তরে ভগবদ্ভক্তির সঞ্চার করতে চেষ্টা করেন। কারণ, তাঁরা জানেন যে, মনুষ্যজন্ম লাভ করে ভগবদ্ভক্তি সাধন না করলে, সেই জন্ম সম্পূর্ণ বৃথা।
শ্লোকঃ ৩০
ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা ।
নিরাশীনির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ ॥ ৩০ ॥
ময়ি—আমাকে, সর্বাণি— সর্বপ্রকার; কর্মাণি – কর্ম; সংন্যস্য – সমর্পণ করে; অধ্যাত্ম — আত্মনিষ্ঠ, চেতসা – চেতনার দ্বারা; নিরাশীঃ – নিষ্কাম; নির্মম:– মমতাশূন্য; ভূত্বা—হয়ে; যুধ্যস্ব— যুদ্ধ কর; বিগতজ্বরঃ — শোকশূন্য হয়ে।
গীতার গান
অতএব তুমি পার্থ ছাড় অভিমান ।
তোমার সমস্ত শক্তি কর মোরে দান ।৷
কর্মফল আশা ছাড় নির্মম হইয়া ।
যুদ্ধ কর আশা ত্যজি মূঢ়তা ত্যজিয়া ৷৷
অনুবাদঃ অতএব, হে অর্জুন! অধ্যাত্মচেতনা সম্পন্ন হয়ে তোমার সমস্ত কর্ম আমাকে সমর্পণ কর এবং মমতাশূন্য, নিষ্কাম ও শোকশূন্য হয়ে তুমি যুদ্ধ কর।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে স্পষ্টভাবে ভগবদ্গীতার উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে ভগবান আদেশ করছেন যে, সম্পূর্ণভাবে ভগবৎ-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কর্তব্যকর্ম করে যেতে হবে। সৈনিকেরা যেমন গভীর নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে তাদের কর্তব্যকর্ম করে, মানুষের কর্তব্য হচ্ছে ঠিক তেমনভাবে ভগবানের সেবা করা। ভগবানের আদেশকে কখনও কখনও অত্যন্ত কঠোর বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁর আদেশ পালন করাই হচ্ছে মানুষের ধর্ম। তাই, শ্রীকৃষ্ণের উপর নির্ভরশীল হয়ে তা আমাদের পালন করতেই হবে, কেন না সেটিই হচ্ছে জীবের স্বরূপ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা না করে মানুষ যদি সুখী হতে চেষ্টা করে, তবে তার সে চেষ্টা কোন দিনই সফল হবে না। ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করাই হচ্ছে জীবের কর্তব্য এবং সেই জন্য তাকে যদি সব কিছু ত্যাগ করতেও হয়, তবে তা-ই বিধেয়। ভাল- মন্দ, লাভ-ক্ষতি, সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা না করে ভগবানের আদেশ পালন করাই হচ্ছে আমাদের কর্তব্য। সেই জন্যই শ্রীকৃষ্ণ যেন সামরিক নেতার মতোই অর্জুনকে যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অর্জুনের পক্ষে সেই নির্দেশ যাচাই করার কোন পথ ছিল না; তাঁকে সেই নির্দেশ মানতেই হয়েছিল। ভগবান হচ্ছেন সমস্ত আত্মার আত্মা, তাই, নিজের সুখ-সুবিধার কথা বিবেচনা না করে যিনি সম্পূর্ণভাবে পরমাত্মার উপর নির্ভরশীল, অথবা পক্ষান্তরে, যিনি সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময়, তিনিই হচ্ছেন অধ্যাত্মচেত। নিরাশীঃ মানে হচ্ছে, ভৃত্য যখন প্রভুর সেবা করে, তখন সে কোন কিছুর আশা করে না। খাজাঞ্চী লক্ষ লক্ষ টাকা গণনা করে, কিন্তু তার এক কপর্দকও সে নিজের বলে মনে করে না, কারণ সে জানে যে, সেই টাকা তার মালিকের। ঠিক তেমনই, এই জগতের সব কিছুই ভগবানের, তাই তাঁর সেবাতে সব কিছু অর্পণ করাই হচ্ছে আমাদের কর্তব্য। আমরা যদি তা করি, তা হলে আমরা ভগবানের যথার্থ ভৃত্য হতে পারি। তা হলেই আমাদের জন্ম সার্থক হয় এবং আমরা পরম শান্তি লাভ করতে পারি। সেটি হচ্ছে ময়ি অর্থাৎ ‘আমাকে’ কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য। কেউ যখন এই প্রকার কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে কর্ম করে, তখন নিঃসন্দেহে সে কোন কিছুর উপর মালিকানা দাবি করে না। এই মনোবৃত্তিকে বলা হয় নির্মম, অর্থাৎ ‘কোন কিছুই আমার নয়। ভগবানের এই কঠোর নির্দেশ পালন করতে যদি আমরা অনিচ্ছা প্রকাশ করি—যদি আমরা আমাদের তথাকথিত আত্মীয়-স্বজনের মায়ায় আবদ্ধ হয়ে ভগবানের নির্দেশকে অবজ্ঞা করি, তবে তা মূঢ়তারই নামান্তর। এই বিকৃত মনোবৃত্তি ত্যাগ করা অবশ্যই কর্তব্য। এভাবেই মানুষ বিগতত্ত্বর অর্থাৎ শোকশূন্য হতে পারে। গুণ ও কর্ম অনুসারে প্রত্যেকেরই কোন না কোন বিশেষ কর্তব্য আছে এবং কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই কর্তব্য সম্পাদন করা প্রত্যেকের কর্তব্য। এই ধর্ম আচরণ করার ফলে আমরা জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ