শ্লোকঃ ২৩
শকনোতীহৈব যঃ সোঢ়ুং প্রাক্ শরীরবিমোক্ষণাৎ ।
কামক্রোধোদ্ভবং বেগং স যুক্তঃ স সুখী নরঃ ॥ ২৩ ৷৷
শক্নোতি—সক্ষম; ইহ এব—এই শরীরে; যঃ – যিনি; সোটুম্—সহ্য করতে; প্রাক্—পূর্বে; শরীর—শরীর; বিমোক্ষণাৎ — ত্যাগ করার; কাম – কাম, ক্রোধ- ক্রোধ; উদ্ভবম্—উদ্ভূত; বেগম্—বেগ; সঃ – তিনি; যুক্তঃ – আত্ম-সমাহিত সঃ—তিনি; সুখী—সুখী; নরঃ—মানুষ।
গীতার গান
শরীর ছাড়িতে পূর্বে যে অভ্যাস করে ।
তাহার সুলভ সেই অন্যে কাঁদি মরে ॥
ষড়বেগ জয় করি গোস্বামী যে হয় ।
সুখী সেই নরনারী করে দিগ্বিজয় ।।
অনুবাদঃ এই দেহ ত্যাগ করার পূর্বে যিনি কাম, ক্রোধ থেকে উদ্ভূত বেগ সহ্য করতে সক্ষম হন, তিনিই যোগী এবং এই জগতে তিনিই সুখী হন।
তাৎপর্যঃ যদি কেউ আত্ম-উপলব্ধির পথে উন্নতি সাধনে প্রয়াসী হন, তবে তাঁকে জড় ইন্দ্রিয়ের বেগ দমন করবার চেষ্টা করতেই হবে। এই বেগ ছয় প্রকারের— বাচোবেগ, ক্রোধবেগ, মনোবেগ, উদরবেগ, উপস্থবেগ ও জিহ্বাবেগ। যিনি ইন্দ্রিয়ের এই সমস্ত বেগ ও মনকে বশ করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁকে বলা হয় গোস্বামী অথবা স্বামী। এই গোস্বামীরা কঠোর সংযমের সঙ্গে তাঁদের জীবন যাপন করেন এবং ইন্দ্রিয়ের সমস্ত বেগগুলিকে সর্বতোভাবে দমন করেন। জড় বাসনা যখন অতৃপ্ত থেকে যায়, তখন ক্রোধের সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে মন, চক্ষু ও বক্ষ উত্তেজিত হয়। তাই, এই জড় দেহটিকে ত্যাগ করার আগেই এই বেগগুলি দমন করার অভ্যাস করতে হয়। যিনি তা পারেন, তিনি হচ্ছেন আত্ম-তত্ত্ববিদ এবং আত্ম-উপলব্ধির স্তরে তিনি পরম সুখী। যোগীদের কর্তব্য হচ্ছে কাম ও ক্রোধকে বশ করার প্রাণপণ চেষ্টা করা।
শ্লোকঃ ২৪
যোহন্তঃসুখোহন্তরারামস্তথান্তর্জ্যোতিরেব যঃ ।
স যোগী ব্রহ্মনির্বাণং ব্রহ্মভূতোঽধিগচ্ছতি ॥ ২৪ ৷।
যঃ – যিনি; অন্তঃসুখঃ – অন্তরে সুখী; অন্তরারামঃ – আত্মাতেই ক্রীড়াশীল; তথা— এবং; অন্তর্জ্যোতিঃ–অন্তবর্তী আত্মাই যার লক্ষ্য; এব— নিশ্চিতরূপে; যঃ—যিনি; সঃ—তিনি; যোগী—যোগী; ব্রহ্মনির্বাণম্—ব্রহ্মনির্বাণ, ব্রহ্মভূতঃ—ব্রহ্মে অবস্থিত হয়ে, অধিগচ্ছতি – লাভ করেন।
গীতার গান
বাহিরের সুখ ছাড়ি যেবা অন্তর্মুখ ৷
অন্তরে রমণ করে অন্তর্জোতি রূপ ।।
ব্রহ্মভূত হয় সেই ব্রহ্মতে নির্বাণ ।
বহিরঙ্গা মায়া ছাড়ে পায় ভগবান ॥
অনুবাদঃ যিনি আত্মাতেই সুখ অনুভব করেন, যিনি আত্মাতেই ক্রীড়াযুক্ত এবং আত্মাই যাঁর লক্ষ্য, তিনিই যোগী। তিনি ব্রহ্মে অবস্থিত হয়ে ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ আত্মায় যে সুখ আস্বাদন করেনি, সে অনিত্য সুখভোগের বাহ্য ক্রিয়াগুলি কিভাবে পরিত্যাগ করবে? জীবন্মুক্ত পুরুষ যথার্থ অনুভুতিতে সুখ আস্বাদন করেন। তাই, তিনি এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে চিন্ময় চেতনার সাহায্যে জীবনের ক্রিয়াগুলিকে উপভোগ করতে পারেন। এই ধরনের যুক্ত পুরুষ কখনই বাহ্য জাগতিক সুখের আকাঙ্ক্ষা করেন না। এই অবস্থাকে ব্রহ্মভূত বলে, তখন ভগবৎ-ধামে ফিরে যাওয়া সুনিশ্চিত হয়।
শ্লোকঃ ২৫
লভন্তে ব্রহ্মনির্বাণম্ ঋষয়ঃ ক্ষীণকল্মষাঃ ৷
ছিন্নদ্বৈধা যতাত্মানঃ সর্বভূতহিতে রতাঃ ॥ ২৫ ॥
লভস্তে—লাভ করেন; ব্রহ্মনির্বাণম্ — ব্রহ্মনির্বাণ; ঋষয়: — ঋষিগণ, ক্ষীণকৰ্ম্মযাঃ— নিষ্পাপ; ছিন্ন—ছিন্ন করে; দ্বৈধাঃ – দ্বিধা; যতাত্মানঃ – সংযতচিত্ত; সর্বভূত— সমস্ত জীবের; হিতে–কল্যাণে; রতাঃ—রত ।
গীতার গান
নিষ্পাপ হইয়া ঋষি ব্রহ্মেতে নির্বাণ।
সর্বভূত হিতে রত ছিন্ন দ্বিধাজ্ঞান ৷।
অনুবাদঃ সংযতচিত্ত, সমস্ত জীবের কল্যাণে রত এবং সংশয় রহিত নিষ্পাপ ঋষিগণ ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ যিনি সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময়, তিনিই কেবল পারেন সমস্ত জীবের মঙ্গল সাধন করতে। মানুষ যখন বুঝতে পারেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সর্ব কারণের কারণ, তখন সেভাবেই ভাবিত হয়ে তিনি যে কর্ম করেন, সেই কর্ম সকলেরই মঙ্গল সাধন করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে পরম ভোক্তা, পরম ঈশ্বর, পরম বন্ধু, সেই কথা ভুলে যাওয়ার ফলেই মানুষ নানাভাবে কষ্ট পায়। তাই, সমস্ত মানব- সমাজে এই চেতনাকে পুনর্জাগরিত করাই হচ্ছে সবচেয়ে কল্যাণকর কর্ম। ব্রহ্মনির্বাণ স্তর লাভ না করলে, এই পরম পবিত্র কর্ম সম্পাদন করা যায় না। কৃষ্ণভক্তের মনে শ্রীকৃষ্ণের পরম ঈশ্বরত্ব সম্পর্কে কোন সংশয় থাকে না। তাঁর মনে কোন সংশয় থাকে না, কারণ তিনি সম্পূর্ণরূপে পাপমুক্ত। এটিই হচ্ছে দিব্য ভগবৎ-প্রেমের প্রকাশ।
যে মানুষ কেবলমাত্র মানব সমাজের জাগতিক কল্যাণ সাধন করার কাজে রত, সে প্রকৃতপক্ষে কারওই কল্যাণ সাধন করতে পারে না। বাহ্যিক দেহ ও মনের সাময়িক উপশম কখনই শান্তি দিতে পারে না। জীবন-সংগ্রামের সমস্ত দুঃখ-কষ্টের যথার্থ কারণ হচ্ছে, ভগবানের সঙ্গে জীবের নিত্য সম্পর্কের চরম বিস্মৃতি। মানুষ যখন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর নিত্য সম্পর্কের কথা পূর্ণরূপে অবগত হন, তখন তিনি জড় জগতের বন্ধন থেকে যথার্থই মুক্তি লাভ করেন, এমন কি জড় দেহের মধ্যে অবস্থান করলেও তিনি তখন মুক্ত।