শ্লোকঃ ২০

ন প্রহৃষ্যেৎ প্রিয়ং প্রাপ্য নোদ্বিজেৎ প্রাপ্য চাপ্রিয়ম্ ।

স্থিরবুদ্ধিরসংমূঢ়ো ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মণি স্থিতঃ ॥ ২০ ॥

ন—না; প্রহৃষ্যেৎ—হর্ষে উৎফুল্ল হন; প্রিয়ম্ — প্রিয় বস্তু; প্রাপ্য – লাভ করে; ন – না; উদ্বিজেৎ— বিচলিত হন; প্রাপ্য – লাভ করে; চ–ও; অপ্রিয়ম্ — অপ্রিয় বস্তু; স্থিরবুদ্ধিঃ— স্থির বুদ্ধিসম্পন্ন; অসংমূঢ়ঃ — মোহশূন্য; ব্রহ্মবিৎ — ব্রহ্মজ্ঞানী; ব্রহ্মণি— ব্রহ্মে; স্থিতঃ—অবস্থিত।

গীতার গান

প্রিয় বস্তু প্রাপ্য হলে উঠে না নাচিয়া।

অপ্রিয় প্রাপ্তিতে কভু মরে না কাঁদিয়া ॥

স্থির বুদ্ধি ব্রহ্মবিদ অসংমূঢ় মতি ৷

ব্রহ্মেতে নিয়ত বাস নাম ব্ৰহ্মস্থিতি ॥

অনুবাদঃ যে ব্যক্তি প্রিয় বস্তুর প্রাপ্তিতে উৎফুল্ল হন না এবং অপ্রিয় বস্তুর প্রাপ্তিতে বিচলিত হন না, যিনি স্থিরবুদ্ধি, মোহশূন্য ও ভগবৎ-তত্ত্ববেত্তা, তিনি ব্রহ্মেই অবস্থিত।

তাৎপর্যঃ এখানে আত্মজ্ঞানী মহাপুরুষের বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর প্রথম লক্ষণ হচ্ছে যে, তিনি মোহাচ্ছন্ন হয়ে তাঁর দেহটিকে তাঁর যথার্থ স্বরূপ বলে ভুল করেন না। তিনি সুনিশ্চিত ভাবেই জানেন যে, তিনি তাঁর দেহ নন। তাঁর প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এক অণুসদৃশ অংশ। সেই কারণে, দেহাত্মবুদ্ধির দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে তিনি জড়-জাগতিক লাভ অথবা ক্ষতিতে আনন্দিত বা দুঃখিত হন না। মনের এই দৃঢ়তাকে বলা হয় স্থিরবুদ্ধি। তাই, কখনই তিনি তাঁর জড় দেহটিকে আত্মা বলে ভুল করেন না, অথবা দেহটিকে নিত্য বলে মনে করে আত্মার অবহেলা করেন না। এই জ্ঞানের প্রভাবে তিনি পরমতত্ত্ব উপলব্ধির পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন; অর্থাৎ তিনি ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবানকে জানতে পারেন। তিনি তাঁর স্বরূপ সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অবগত হন, তাই তিনি ভগবানের সঙ্গে সর্বতোভাবে এক হয়ে যাবার ভ্রান্ত প্রচেষ্টা করেন না। এই হচ্ছে ব্রহ্ম-উপলব্ধি অথবা আত্ম- উপলব্ধি। এই স্থিরমতি ভাবনার স্তরকেই বলা হয় কৃষ্ণভাবনা ।

শ্লোকঃ ২১

বাহ্যস্পর্শেষসক্তাত্মা বিন্দত্যাত্মনি যৎ সুখম্ ৷

স ব্রহ্মযোগযুক্তাত্মা সুখমক্ষয়মশ্নুতে  ৷৷ ২১ ৷৷

বাহ্যস্পর্শে—বিষয়সুখে; অসত্তাত্মা—অনাসক্ত-চিত্ত ব্যক্তি; বিন্দতি—অনুভব করেন আত্মনি—আত্মায়; যৎ—যা; সুখম্ – সুখ; সঃ – তিনি; ব্রহ্ম — ব্রহ্মে; যোগযুক্তাত্মা— যোগযুক্ত হয়ে; সুখম্ —সুখ; অক্ষয়ম্—অন্তহীন; অশ্বতে— ভোগ করেন।

গীতার গান

বাহ্যস্পর্শ সুখ যাহা নাই যে আসক্তি ৷

আত্মানন্দে সেবানন্দী আত্মাতে বিন্দতি ॥

সেই ব্রহ্মযোগ যুক্ত আত্মা পায় ৷

অক্ষয় সুখেতে মগ্ন সর্বদা সে রয় ॥

অনুবাদঃ সেই প্রকার ব্রহ্মবিৎ পুরুষ কোন রকম জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি আকৃষ্ট হন না, তিনি চিগত সুখ লাভ করেন। ব্রহ্মে যোগযুক্ত হয়ে তিনি অক্ষয় সুখ ভোগ করেন।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত মহাভাগবত শ্রীযামুনাচার্য বলেছেন—

যদবধি মম চেতঃ কৃষ্ণপদারবিন্দে

নবনবরসধামন্যুদ্যতং রস্তুমাসীৎ ।

তদবধি বত নারীসঙ্গমে অর্যমানে

ভবতি মুখবিকারঃ সুষ্ঠু নিষ্ঠীবনং চ ।।

“যখন থেকে আমি ভগবদ্ভক্তি লাভ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পদারবিন্দের সেবায় রত হয়ে নব নব রস আস্বাদন করছি, তখন থেকে নারীসঙ্গমের কথা মনে হলে সেই চিন্তার উদ্দেশ্যে আমি থুতু ফেলি এবং ঘৃণায় আমার মুখ বিকৃত হয়।” ব্রহ্মযোগী বা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত ভক্ত ভগবানের প্রেমময় সেবায় এতই তন্ময় থাকেন যে, তখন আর ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করবার বাসনার প্রতি তাঁর লেশমাত্র রুচি থাকে না। জড় জগতে স্ত্রীসঙ্গ করাটাই হচ্ছে পরম সুখ। সমগ্র বিশ্ব এরই মোহে চালিত হচ্ছে। দেহসর্বস্ব বিষয়ী লোকেরা কিন্তু এর অনুপ্রেরণা ছাড়া কোন কাজই করতে পারে না। কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় নিয়োজিত ভক্ত কামসুখ পরিহার করেও দ্বিগুণ উৎসাহে কর্ম করতে পারেন। সেটিই হচ্ছে পরমার্থ উপলব্ধির পরীক্ষা। পরমার্থ উপলব্ধি ও কাম উপভোগ সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। জীবন্মুক্ত কৃষ্ণভক্ত কোন রকম ইন্দ্রিয়-সুখের প্রতি আকৃষ্ট হন না।

শ্লোকঃ ২২

যে হি সংস্পর্শজা ভোগা দুঃখযোনয় এর তে ।

আদ্যন্তবন্তঃ কৌন্তেয় ন তেষু রমতে বুধঃ ॥ ২২ ৷৷

যে—যে সমস্ত; হি—অবশ্যই; সংস্পর্শজাঃ– জড় ইন্দ্রিয়ের সংযোগ-জনিত, ভোগাঃ — ভোগসমূহ; দুঃখ -দুঃখ; যোনয়ঃ – কারণ; এব— অবশ্যই; তে— সেই সমস্ত আদি—আদি; অন্তবন্তঃ — অন্তবিশিষ্ট; কৌন্তেয় – হে কুন্তীপুত্র; ন–না; তেষু – তাতে; রমতে—প্রীতি লাভ করেন; বুধঃ — বিবেকী ব্যক্তি।

গীতার গান

স্পর্শ সুখে যে আনন্দ তাহা দুঃখময় ।

ভোগ নহে ভোগী সেই জানিহ নিশ্চয় ৷।

সেই সুখে আদি অন্তে শুধু দুঃখ হয় ৷

বুদ্ধিমান ব্যক্তি যেই না তাতে রময় ॥

অনুবাদঃ বিবেকবান পুরুষ দুঃখের কারণ যে ইন্দ্রিয়জাত বিষয়ভোগ তাতে আসক্ত হন না। হে কৌন্তেয়! এই ধরনের সুখভোগ আদি ও অন্তবিশিষ্ট। তাই, জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাতে প্রীতি লাভ করেন না।

তাৎপর্যঃ জড় ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের সংযোগের ফলে ইন্দ্রিয়-সুখানুভূতির উদয় হয়। কিন্তু এই ইন্দ্রিয়গুলি অনিত্য, কারণ দেহটিই অনিত্য। জীবন্মুক্ত পুরুষ কখনও অনিত্য বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন না। অপ্রাকৃত আনন্দের স্বাদ পাবার পরে, কিভাবে তিনি অনিত্য জড় সুখভোগের প্রয়াসী হতে পারেন ? পদ্ম পুরাণে বলা হয়েছে—

রমন্তে যোগিনোহনন্তে সত্যানন্দে চিদাত্মনি

ইতি রামপদেনাসৌ পরং ব্রহ্মাভিধীয়তে ॥

‘যোগীরা পরমতত্ত্বে রমণ করে অনন্ত চিদানন্দ আস্বাদন করেন। তাই, সেই পরম- ব্রহ্মকে রাম বলা হয়।”

শ্রীমদ্ভাগবতেও (৫/৫/১) বলা হয়েছে—

নায়ং দেহো দেহভাজাং নৃলোকে

কষ্টান্ কামানহতে বিড়ভুজাং যে।

তপো দিবাং পুত্রকা যেন সত্ত্বং

শুদ্ধোদ্যস্মাদ ব্রহ্মসৌখ্যং ত্বনন্তম্ ॥

“হে পুত্রগণ! মনুষ্য শরীর প্রাপ্ত হয়ে জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করার কোন প্রয়োজন নেই। বিষ্ঠাহারী শূকরেরা এই সুখ লাভ করে থাকে। বরং, এই জীবনে তোমাদের তপশ্চর্যার অনুশীলন করা উচিত, যার প্রভাবে তোমরা শুদ্ধ হবে, পবিত্র হবে এবং তার ফলে অনন্ত চিন্ময় আনন্দ লাভ করবে।”

তাই, যথার্থ যোগী ইন্দ্রিয়-সুখের প্রতি আকৃষ্ট হন না, যা হচ্ছে অপ্রতিহত ভবরোগের কারণ। জীবের ভোগাসক্তি যত বেশি হয়, ততই সে জাগতিক ক্লেশের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

error: Content is protected !!