শ্লোকঃ ১৭
তদ্বুদ্ধয়স্তদাত্মানস্তন্নিষ্ঠাস্তৎপরায়ণাঃ ।
গচ্ছন্ত্যপুনরাবৃত্তিং জ্ঞাননিৰ্ধূতকল্মষাঃ ৷৷ ১৭ ৷৷
তদ্বুদ্ধয়ঃ—যাঁর বুদ্ধি পরমেশ্বর ভগবানে স্থির হয়েছে, তদাত্মানঃ —যাঁর মন পরমেশ্বর ভগবানে একাগ্র হয়েছে: তন্নিষ্ঠাঃ – কেবল ভগবানেই নিষ্ঠাসম্পন্ন; তৎপরায়ণাঃ— যিনি সম্পূর্ণরূপে তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করেছেন; গচ্ছন্তি লাভ করেন; অপুনরাবৃত্তিম্—মুক্তি; জ্ঞান—জ্ঞানের দ্বারা; নিৰ্ধত — বিধৌত; কল্মষাঃ — কলুষ।
গীতার গান
সেই জ্ঞান অনুকূলে বুদ্ধি নিষ্ঠা যার ।
আত্মজ্ঞান পরায়ণ সংসার উদ্ধার ॥
অনুবাদঃ যাঁর বুদ্ধি ভগবানের প্রতি উন্মুখ হয়েছে, মন ভগবানের চিন্তায় একাগ্র হয়েছে, নিষ্ঠা ভগবানে দৃঢ় হয়েছে এবং যিনি ভগবানকে তাঁর একমাত্র আশ্রয় বলে গ্রহণ করেছেন, জ্ঞানের দ্বারা তাঁর সমস্ত কলুষ সম্পূর্ণরূপে বিধৌত হয়েছে এবং তিনি জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছেন।
তাৎপর্যঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরতত্ত্ব। সম্পূর্ণ ভগবদ্গীতা শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তার কথা ঘোষণা করছে। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রেও সেই একই কথা বলা হয়েছে। তত্ত্ববিদেরা পরতত্ত্বকে ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবানরূপে জানেন। ভগবান হচ্ছেন পরতত্ত্বের শেষ কথা। তাঁর ঊর্ধ্বে আর কিছু নেই। ভগবানও বলছেন, মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়— “ হে অর্জুন! আমার থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউই নয়।” নির্বিশেষ ব্রহ্ম সম্বন্ধেও শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ব্ৰহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহম্—আমিই নির্বিশেষ ব্রহ্মের আশ্রয়। সুতরাং, সর্বতোভাবে শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরাৎপর তত্ত্ব। যাঁর মন, বুদ্ধি, নিষ্ঠা ও আশ্রয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণতেই নিত্য কেন্দ্রীভূত, অর্থাৎ যিনি পূর্ণরূপে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত, তিনি নিঃসন্দেহে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ণজ্ঞানে পরম সত্যকে উপলব্ধি করেন। কৃষ্ণভক্ত পূর্ণরূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অচিন্ত ভেদাভেদ- তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারেন। এই দিব্যজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে তিনি অবিচলিতভাবে মুক্তির পথে এগিয়ে চলেন।
শ্লোকঃ ১৮
বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গৰি হস্তিনি।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ ॥ ১৮ ॥
বিদ্যা—বিদ্যা, বিনয়—বিনয়; সম্পন্নে – সম্পন্ন; ব্রাহ্মণে—ব্রাহ্মণে; গবি —গাভীতে; হস্তিনি—হাতিতে; শুনি — কুকুরে; চ এবং; এব—অবশ্যই; শ্বপাকে—চণ্ডালে; চ—এবং; পণ্ডিতাঃ—পণ্ডিতেরা; সমদর্শিনঃ —সমদর্শী।
গীতার গান
সমদর্শী হয় সে জ্ঞানের প্রভাবে
বিদ্যাবিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণে বা গবে ॥
হস্তী বা কুকুর বা সে নীচ বা চণ্ডাল ।
সমদর্শী জ্ঞানী দেখে সবাই সমান ॥
অনুবাদঃ জ্ঞানবান পণ্ডিতেরা বিদ্যা-বিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গাভী, হস্তী, কুকুর ও চণ্ডাল সকলের প্রতি সমদর্শী হন।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভক্ত কখনই জাতি অথবা কুলের মধ্যে পার্থক্য বিচার করেন না। সমাজ- ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একজন ব্রাহ্মণ একজন চণ্ডালের থেকে আলাদা হতে পারে, অথবা একটি কুকুর, একটি গরু, একটি হাতি জাতিগতভাবে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞানীর দৃষ্টিতে এই দেহজাত ভেদগুলি নিরর্থক। কারণ, সকলেই ভগবানের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। তিনি দেখেন, সমস্ত জীবের অন্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর আংশিক প্রকাশ পরমাত্মারূপে বিরাজ করছেন। পরতত্ত্বের এই উপলব্ধি হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে ভগবান সকলকেই সমানভাবে কৃপা করেন, কারণ তিনি প্রতিটি জীবকেই তাঁর সখা বলে মনে করেন এবং জীবের অবস্থা নির্বিশেষে পরমাত্মা রূপে সর্বদাই তার সঙ্গে বিরাজ করেন। চণ্ডাল এবং ব্রাহ্মণের দেহ ভিন্ন হলেও ভগবান তাদের উভয়ের সঙ্গেই পরমাত্মা রূপে বিরাজমান। জড়া প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন গুণের প্রভাবে জড় দেহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু দেহমধ্যস্থ জীবাত্মা ও পরমাত্মা একই চিন্ময় গুণসম্পন্ন। গুণগতভাবে এক হলেও জীবাত্মা এবং পরমাত্মার আয়তন ভিন্ন, কারণ জীবাত্মা কেবল একটি দেহে থাকতে পারে, কিন্তু পরমাত্মা প্রত্যেক দেহে বিরাজ করেন। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত কৃষ্ণভক্ত এই তত্ত্ব সম্পূর্ণভাবে অবগত। তাই, তিনি প্রকৃত জ্ঞানী এবং সমদৃষ্টিসম্পন্ন। জীবাত্মা ও পরমাত্মার সাদৃশ্য হচ্ছে যে, উভয়েই সচ্চিদানন্দময়; আর তাদের বৈসাদৃশ্য হচ্ছে যে, জীবাত্মা অণুচৈতন্য আর পরমাত্মা সর্বদেহে বিরাজমান বিভুচৈতন্য।
শ্লোকঃ ১৯
ইহৈব তৈৰ্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ ৷
নির্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ ॥ ১৯ ৷৷
ইহ—এই জীবনে; এব—অবশ্যই; তৈঃ—তাঁদের দ্বারা; জিতঃ– বিজিত; সর্গঃ- জন্ম ও মৃত্যু; যেযাম্—যাঁদের; সাম্যে – সমভাবে; স্থিতম্—স্থিত; মনঃ – মন; নির্দোষম্—নির্দোষ: হি—অবশ্যই; সমম্—সমভাব; ব্রহ্ম — ব্রহ্ম; তস্মাৎ—সেই হেতু; ব্রহ্মণি—ব্রহ্মে; তে—তারা; স্থিতাঃ —অবস্থিত। স্থিতাঃ—অবস্থিত।
গীতার গান
জীবন্মুক্ত সেই জ্ঞানী সাধারণ নয় ।
সেই সাম্যস্থিত মনে সংসার যে ক্ষয় ।।
সমতা নির্দেশ ব্রহ্ম তাহে ব্রহ্মস্থিতি ৷
ব্রহ্মজ্ঞানী যেই তার সেই হয় রীতি ॥
অনুবাদঃ যাঁদের মন সাম্যে অবস্থিত হয়েছে, তাঁরা ইহলোকেই জন্ম ও মৃত্যুর সংসার জয় করেছেন। তাঁরা ব্রহ্মের মতো নির্দোষ, তাই তাঁরা ব্রহ্মেই অবস্থিত হয়ে আছেন।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে যে মনের সাম্যস্থিতির কথা বলা হয়েছে, তা আত্ম-উপলব্ধির লক্ষণ। যাঁরা এই স্থিতি প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁরা জড় বন্ধন, বিশেষ করে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছেন বলে বুঝতে হবে। যতক্ষণ জীব তার দেহটিকে তার স্বরূপ বলে মনে করে, ততক্ষণ সে জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু আত্ম- উপলব্ধির ফলে যখন সে সব কিছুর প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন হয়, তখন সে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। পক্ষান্তরে, তখন আর তাকে এই জড় জগতে জন্মগ্রহণ করতে হয় না, দেহত্যাগ করার পর সে ভগবৎ-ধামে প্রবিষ্ট হয়। রাগ ও দ্বেষ থেকে মুক্ত হবার ফলে ভগবান সম্পূর্ণ নির্দোষ। তেমনই, জীবও যখন রাগ ও দ্বেষ থেকে মুক্ত হয়, তখন সেও নির্দোষ হয় এবং ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করার যোগ্যতা লাভ করে। এই ধরনের লোকেরা জীবন্মুক্ত। তাদের লক্ষণ পরবর্তী শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে।