শ্লোকঃ ১৪
ন কর্তৃত্বং ন কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ ৷
ন কর্মফলসংযোগং স্বভাবস্ত প্রবর্ততে ॥ ১৪॥
লোকসা—জীবের; ন—না; কর্তৃত্বম্—কর্তৃত্ব; ন–না; কর্মাণি – কর্মসমূহ, লোকসা — জীবের; সৃজতি — সৃষ্টি করে, প্রভুঃ দেহরূপ নগরীর প্রভু; ন–না; কর্মফল — কর্মের ফল; সংযোগম্—সংযোগ; স্বভাবঃ—জড়া প্রকৃতির গুণ; তু—কিন্তু; প্রবর্ততে—প্রবৃত্ত হয়।
গীতার গান
অনাদি কর্মফলে ভবার্ণব জলে ৷
আছে পড়ে বা না হয় তাঁহার সৃজন ॥
কর্মফল যেবা যোগ যাহা করে ভোগ।
স্বভাব সে কার্য হয় নাম ভবরোগ ॥
অনুবাদঃ দেহরূপ নগরীর প্রভু জীব কর্ম সৃষ্টি করে না, সে কাউকে দিয়ে কিছু করায় না এবং সে কর্মের ফলও সৃষ্টি করে না। এই সবই হয় জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাবে।
তাৎপর্যঃ ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায় অনুসারে, জীব ভগবানের মতোই পরা প্রকৃতি-সম্ভূত। এই পরা প্রকৃতি ভগবানের অন্য প্রকৃতি অপরা থেকে ভিন্ন। কোন না কোনভাবে এই উৎকৃষ্ট পরা প্রকৃতির অংশ জীবাত্মা অনাদিকাল ধরে অপরা প্রকৃতির সংসর্গে আছে। জীবাত্মা তার কর্ম অনুসারে ক্ষণস্থায়ী এক-একটি দেহ প্রাপ্ত হয়ে সেই দেহে বাস করে। এভাবেই দেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সে বদ্ধদশা প্রাপ্ত হয়। সে তখন অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে সেই জড় দেহটিকেই তার প্রকৃত স্বরূপ বলে মনে করতে শুরু করে এবং সেই দেহগত কর্মের ফল ভোগ করতে থাকে। জন্ম-জন্মান্তরের সঞ্চিত অজ্ঞতার পরিণামে তাকে এই দেহজাত দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে সে দেহাত্মবুদ্ধি পরিত্যাগ করে এবং বুঝতে শেখে যে, সে তার দেহ নয়, সেই মুহূর্তেই সে তার দেহের বন্ধন থেকে – তার কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। যতক্ষণ সেই দেহরূপ নগরীতে সে বাস করে, ততক্ষণ সে মনে করে যে, সে-ই হচ্ছে তার দেহটির অধীশ্বর। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে তার দেহের অধীশ্বরও নয় এবং তার কর্মফলের কর্তাও নয়। সে হচ্ছে ভবসমুদ্রে নিমজ্জমান, জীবন-সংগ্রামে বিধ্বস্ত, অণুসদৃশ জীব। ভব-সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গগুলি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করবার কোন শক্তিই তার নেই। চিন্ময় কৃষ্ণভাবনামৃতরূপী তরণীর আশ্রয় গ্রহণ করলে সে এই ভবসমুদ্র পার হতে পারে—সমস্ত দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে পারে।
শ্লোকঃ ১৫
নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ ।
অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ ॥ ১৫ ॥
ন—না; আদত্তে—গ্রহণ করেন; কস্যচিৎকারও; পাপম্—পাপ; ন–না; চ– ও; এব—অবশ্যই; সুকৃতম্—পুণ্য; বিভুঃ — পরমেশ্বর ভগবান; অজ্ঞানেন—অজ্ঞানের দ্বারা; আবৃতম্ –আবৃত; জ্ঞানম্—জ্ঞান; তেন—তার দ্বারা; মুহ্যন্তি – মোহিত হয়; জন্তুবঃ—জীবসমূহ।
গীতার গান
ঈশ্বরের দত্ত নহে সেই পাপ পুণ্য ৷
পাপ পুণ্য যাহা কিছু নিজ ইচ্ছা জন্য ৷৷
অজ্ঞানজনিত সেই ভোগ ইচ্ছা করে ।
পাশে থাকি মায়া তারে জাপটিয়া ধরে ॥
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান জীবের পাপ অথবা পুণ্য কিছুই গ্রহণ করেন না। অজ্ঞানের দ্বারা প্রকৃত জ্ঞান আবৃত হওয়ার ফলে জীবসমূহ মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
তাৎপর্যঃ সংস্কৃত বিভু শব্দটির অর্থ হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান, যিনি অনন্ত জ্ঞা শ্রী, যশ, বীর্য, ঐশ্বর্য ও বৈরাগ্যে পরিপূর্ণ। তিনি সর্বদাই আত্মতৃপ্ত। পাপ ও পুণ্য তাঁকে কখনই স্পর্শ করতে পারে না। তিনি কোন জীবের জন্যই কোন বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি করেন না। কিন্তু অজ্ঞানতার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে জীব বিভিন্ন পরিস্থিতির কামনা করে এবং তার ফলে তার কর্ম ও কর্মফলের প্রবাহ শুরু হয়। জীব ভগবানের পরা প্রকৃতিজাত, তাই তার স্বরূপে সে পূর্ণজ্ঞানে অধিষ্ঠিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার শক্তি সীমিত হওয়ার ফলে সে অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ভগবান সর্ব শক্তিমান, কিন্তু জীব তা নয়। ভগবান বিভু, কিন্তু জীব অণুসদৃশ। জীবাত্মার স্বাধীনভাবে ইচ্ছা করার স্বাতন্ত্র্য আছে, কিন্তু কেবলমাত্র সর্ব শক্তিমান ভগবানের দ্বারাই তার সেই ইচ্ছা পরিপূর্ণ হয়। জীব যখন তার কামনা-বাসনার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন সেই কামনা-বাসনাগুলিকে পূর্ণ করতে ভগবান তাকে অনুমোদন করেন। কিন্তু তাদের বিশেষ বাসনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কর্ম ও কর্মফলের জন্য ভগবান কোন অবস্থাতেই দায়ী নন। বিভ্রান্ত হয়ে জীব তাই তার জড় দেহটিকেই তার স্বরূপ বলে মনে করে এবং অনিত্য সুখ ও দুঃখ ভোগ করতে থাকে। পরমাত্মারূপে ভগবান প্রতিটি জীবের নিত্য সহচর। ফুলের কাছে গেলে যেমন তার গন্ধ পাওয়া যায়, তেমনই আমাদের খুব কাছে আছেন বলে ভগবান আমাদের অন্তরের সমস্ত কামনা-বাসনাগুলির কথা জানেন। কামনা- বাসনাগুলি হচ্ছে জীবের বন্ধনের সূক্ষ্ম রূপ। জীব যেভাবে কামনা করে, ভগবান ঠিক সেভাবেই তার যথাযোগ্য পূর্তি করেন। তাই, ইচ্ছা পূরণ করার কোন শক্তিই জীবের নেই, কিন্তু ভগবান হচ্ছেন সর্ব শক্তিমান বাঞ্ছাকল্পতরু। তিনি সর্বতোভাবে নিরপেক্ষ, তাই তিনি অণু স্বাতন্ত্র্য-বিশিষ্ট জীবের ইচ্ছায় হস্তক্ষেপ করেন না। কিন্তু কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়ার ইচ্ছা করেন, তখন ভগবান তাঁর প্রতি বিশেষভাবে যত্নপরায়ণ হন এবং তাঁকে এমনভাবে উৎসাহিত করেন, যার ফলে তিনি তাকে পেয়ে শাশ্বত সুখ আস্বাদন করতে পারেন।
বৈদিক মন্ত্রে বলা হয়েছে, এষ উ হোব সাধু কর্ম কারয়তি তং যমেভ্যো লোকেভ্য উন্নিনীযতে। এষ উ এবাসাধু কর্ম কারয়তি যমধো নিনীয়তে — “ভগবান জীবকে সৎকর্মে প্রবৃত্ত করেন যাতে তার উন্নতি সাধন হয়। তিনি জীবকে অসৎ কর্মে প্রবৃত্ত করেন যাতে সে নরকগামী হয়।” (কৌষীতকী উপনিষদ ৩/৮) অজ্ঞো জন্তুরনীশোহয়মাত্মনঃ সুখদুঃখয়োঃ ঈশ্বরপ্রেরিতো গচ্ছেৎ স্বর্গং বাশ্বভ্রমের চ
“সুখ-দুঃখের উপর জীব সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। বায়ু যেমন মেঘকে চালিত করে, তেমনই ভগবানের ইচ্ছার ফলে জীব স্বর্গে অথবা নরকে গমন করে।”
তাই, দেহধারী জীব অনন্তকাল ধরে কৃষ্ণবিমুখ হয়ে থাকার বাসনা করে এবং সেটিই তার মোহাচ্ছন্ন হবার কারণ। তাই সে সচ্চিদানন্দময় হলেও, যেহেতু তার সত্তা ক্ষুদ্র ও বদ্ধ, তাই সে তার স্বরূপ বিস্মৃত হয়— সে ভুলে যায় যে, সে ভগবানের নিত্যদাস এবং এভাবেই সে অবিদ্যার দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলে সে বলে যে, তার ভব-বন্ধনের জন্য ভগবানই দায়ী । এই কথার বিরোধিতা করে বেদান্ত-সূত্রে (২/১/৩৪) বলা হয়েছে, বৈষম্যনৈর্ঘণ্যে ন সাপেক্ষত্বাৎ তথ্য হি দর্শয়তি— “ভগবান কাউকে ঘৃণা করেন না অথবা ভালবাসেন না, যদিও সেই রকম মনে হয়।”
শ্লোকঃ ১৬
জ্ঞানেন তু তদজ্ঞানং যেষাং নাশিতমাত্মনঃ ।
তেষামাদিত্যবজজ্ঞানং প্রকাশয়তি তৎ পরম্ ॥ ১৬ ॥
জ্ঞানেন—জ্ঞানের দ্বারা; তু— কিন্তু; তৎ- সেই অজ্ঞানম্ –অজ্ঞান, যেষাম্—যাঁদের নাশিতম্—বিনাশ হয়; আত্মনঃ— জীবের; তেষাম্—তাঁদের; আদিত্যবৎ—উদীয়মান সূর্যের মতো; জ্ঞানম্—জ্ঞান; প্রকাশয়তি — প্রকাশ করে; তৎ— সেই; পরম্— অপ্রাকৃত পরমতত্ত্বকে।
গীতার গান
অতএব জ্ঞান উপজিলে মায়া নাশ ।
আত্মার স্বরূপ তথা স্বতঃই প্রকাশ ।
সূর্যের প্রকাশে যথা অন্ধকার যায় ।
জ্ঞানের প্রকাশে তথা অজ্ঞানের ক্ষয় ॥
অনুবাদঃ জ্ঞানের প্রভাবে যাঁদের অজ্ঞান বিনষ্ট হয়েছে, তাঁদের সেই জ্ঞান অপ্রাকৃত পরমতত্ত্বকে প্রকাশ করে, ঠিক যেমন দিনমানে সূর্যের উদয়ে সব কিছু প্রকাশিত হয়।
তাৎপর্যঃ যারা শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে গেছে তারা অবশ্যই মোহাচ্ছন্ন, কিন্তু যারা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত তাঁরা কখনই মোহাচ্ছন্ন হন না। ভগবদ্গীতাতে বলা হয়েছে— সর্বং জ্ঞানপ্লবেন, জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি এবং ন হি জ্ঞানেন সদৃশম্। জ্ঞান সর্বদাই অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন। এই জ্ঞানের স্বরূপ কি? শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়ার ফলেই পূর্ণ জ্ঞান লাভ করা যায়, যে কথা সপ্তম অধ্যায়ের ঊনবিংশতি শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে— বহূনাং জন্মনামতে জ্ঞানবান্মাং প্রপদ্যতে। বহু বহু জন্মের পরে জ্ঞানী যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হন, অথবা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হন, তখন তাঁর কাছে সমস্ত তত্ত্ব প্রকাশিত হয়, যেমন দিনের বেলায় সূর্যের আলোতে সব কিছু প্রকাশিত হয়। জীব নানাভাবে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধৃষ্টতাপূর্বক সে যখন নিজেকে ভগবান বলে মনে করে, তখন সে মায়ার অন্তিম ফাঁদে পতিত হয়। জীব যদি ভগবান হয়, তা হলে সে মায়ার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয় কিভাবে? যদি তা সম্ভব হয়, তা হলে বুঝতে হবে যে, অজ্ঞান বা শয়তান ভগবানের চেয়েও বেশি ক্ষমতাশালী। যথার্থ জ্ঞান কৃষ্ণভাবনাময় মহাপুরুষের কাছ থেকেই লাভ করা যায়। তাই, এই রকম যথার্থ সদগুরুর অনুসন্ধান করে তাঁর কাছে কৃষ্ণভাবনামৃতের শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করতে হয়। সূর্য যেমন অন্ধকার দূর করে, কৃষ্ণভাবনামৃত তেমন সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞানতা দূর করতে পারে। কেউ জ্ঞান লাভের ‘মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারে যে, সে তার দেহ নয়, সে তার জড় দেহের অতীত, তবুও সে আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। কিন্তু সে যদি কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত সদ্গুরুর শরণাগত হতে যত্নবান হয়, তা হলে সে সব কিছুই ভালভাবে জানতে পারে। কেবলমাত্র ভগবানের প্রতিনিধির সান্নিধ্য লাভ হলেই ভগবান ও ভগবানের সঙ্গে আমাদের নিত্য সম্পর্কের কথা জানা যায়। ভগবানের প্রতিনিধি কখনও দাবি করেন না যে, তিনি ভগবান, কিন্তু তাঁকে ভগবানের মতোই সম্মান করা হয়, কারণ তিনি ভগবৎ-তত্ত্ব জানেন। ভগবান ও জীবের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, তা জানা উচিত। ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের দ্বাদশ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই জন্য বলেছেন, প্রত্যেক জীব স্বতন্ত্র এবং ভগবানও স্বতন্ত্র। অতীতে তাদের সকলেরই পৃথক স্বরূপ ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতে মুক্তির পরেও থাকবে। রাত্রির অন্ধকারে যেমন সব কিছুই এক বলে মনে হয়, কিন্তু দিনের বেলায় সূর্যোদয় হলে প্রতিটি বস্তু তাদের যথার্থ রূপে প্রতিভাত হয়। জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হলে তেমনই সব কিছুর স্বরূপ উপলব্ধি হয়। পারমার্থিক জীবনে স্বতন্ত্রভাবে স্বরূপ উপলব্ধিই হচ্ছে যথার্থ জ্ঞান।