শ্লোকঃ ১১
কায়েন মনসা বুদ্ধ্যা কেবলৈরিন্দ্রিয়ৈরপি ।
যোগিনঃ কর্ম কুর্বন্তি সঙ্গং ত্যক্ত্বাত্মশুদ্ধয়ে ৷৷ ১১ ৷৷
কায়েন— দেহের দ্বারা; মনসা — মনের দ্বারা; বুদ্ধ্যা-বুদ্ধির দ্বারা; কেবলৈঃ—বিশুদ্ধ; ইন্দ্রিয়ৈঃ—ইন্দ্রিয় দ্বারা; অপি—এমন কি, যোগিনঃ – কৃষ্ণভাবনাময় নিষ্কাম কর্মযোগীগণ; কর্ম—কর্ম; কুর্বন্তি —করেন; সঙ্গম্ — আসক্তি; ত্যক্ত্বা— পরিত্যাগ করে; আত্ম—আত্মা; শুদ্ধয়ে—শুদ্ধ করার জন্য।
গীতার গান
কায় মন বাক্যে সে যে যোগের সাধন ।
মন বুদ্ধি ইন্দ্রিয়াদি একত্রে বন্ধন ॥
যোগার্থে যে কার্য হয় বৈরাগ্য সে যুক্ত ।
সকল সময়ে জ্ঞানযোগী নিত্যযুক্ত ৷।
অনুবাদঃ আত্মশুদ্ধির জন্য যোগীরা কর্মফলের আসক্তি ত্যাগ করে দেহ, মন, বুদ্ধি, এমন কি ইন্দ্রিয়ের দ্বারাও কর্ম করেন।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করার জন্য শরীর, মন, বুদ্ধি অথবা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তা জীবকে জড় জগতের কলুষ থেকে মুক্ত করে। কৃষ্ণভাবনাময় কর্মের কোন জড় প্রতিক্রিয়া হয় না। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করার ফলে অনায়াসে সদাচার সাধিত হয়। ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে (পূর্ব ২/১৮৭) শ্রীল রূপ গোস্বামী তার বর্ণনা করে বলেছেন—
ঈহা যস্য হরের্দাসো কর্মণা মনসা গিরা ।
নিখিলাস্বপ্যবস্থাসু জীবন্মুক্তঃ স উচ্যতে ॥
“যিনি শরীর, মন, বুদ্ধি ও বাণী দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করেন, তিনি এই জড় জগতে অবস্থান করলেও, এমন কি তথাকথিত জড়-জাগতিক কর্মে ব্যাপৃত থাকলেও তিনি মুক্ত পুরুষ।” তাঁর কোন রকম মিথ্যা অহঙ্কার নেই এবং তিনি কখনই মনে করেন না তাঁর দেহটিই হচ্ছে তাঁর স্বরূপ, অথবা তিনি তাঁর দেহটির মালিক। তিনি জানেন যে, তাঁর স্বরূপ তাঁর দেহটি নয় এবং তাঁর দেহটি তাঁর সম্পত্তি নয়। তিনি শ্রীকৃষ্ণের এবং তাঁর দেহটিও শ্রীকৃষ্ণের। যখন তিনি তাঁর দেহ, মন, বুদ্ধি, বাণী, জীবন, ধন আদি সবই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিবেদন করেন, তৎক্ষণাৎ তিনি সর্বতোভাবে কৃষ্ণগত প্রাণ। যে মিথ্যা অহঙ্কারের প্রভাবে মানুষ মনে করে, তার দেহটি হচ্ছে তার স্বরূপ, কৃষ্ণভাবনায় তন্ময় থাকার ফলে তিনি সেই অহঙ্কার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হন। এটিই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃতের পূর্ণ বিকশিত অবস্থা।
শ্লোকঃ ১২
যুক্তঃ কর্মফলং ত্যক্ত্বা শান্তিমাপ্নোতি নৈষ্ঠিকীম্ ।
অযুক্তঃ কামকারেণ ফলে সক্তো নিবধ্যতে ॥ ১২ ৷৷
যুক্তঃ—যোগযুক্ত; কর্মফলম্ –কর্মের ফল; ত্যক্ত্বা— পরিত্যাগ করে; শান্তিম্ — শান্তি; আপ্নোতি লাভ করেন; নৈষ্ঠিকীম্ — নিষ্ঠাসম্পন্ন; অযুক্তঃ —সকাম কর্মী; কামকারেণ—কামনাপূর্বক প্রবৃত্ত হওয়ায়; ফলে — কর্মফলে; সত্তঃ – আসক্ত; নিবধ্যতে—আবদ্ধ হয় ।
গীতার গান
কর্মফল ত্যজি যুক্ত বৈরাগ্য সাধন ।
নৈষ্ঠিকী শান্তি সে, নহে সংসার বন্ধন ।।
ফল্গু বৈরাগ্য যে কামকারী ফল ।
ফলকার্যে নিবন্ধন তাই সে দুর্বল ৷।
অনুবাদঃ যোগী কর্মফল ত্যাগ করে নৈষ্ঠিকী শান্তি লাভ করেন; কিন্তু সকাম কর্মী কর্মফলের প্রতি আসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলে কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত ও দেহাত্ম বুদ্ধিসম্পন্ন বৈষয়িক মানুষের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে যে, কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্ত এবং দেহাত্ম-বুদ্ধিসম্পন্ন বিষয়ী তার কর্মফলের প্রতি আসক্ত। যে মানুষ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্ত এবং তাঁর প্রীতি উৎপাদনের জন্য সমস্ত কর্ম করেন, তিনি অবধারিতভাবে মুক্ত পুরুষ; কারণ, তিনি কখনই কর্মফলের আশায় উৎকণ্ঠিত হন না। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, দ্বৈত ধারণাযুক্ত হয়ে, অর্থাৎ পরতত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত না হয়ে কর্ম করার ফলে কর্মফলের প্রতি উৎকণ্ঠার উদয় হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরতত্ত্ব পরমেশ্বর। কৃষ্ণভাবনায় তাই দ্বৈতভাব নেই। বিশ্বচরাচরের যা কিছু আছে, তা সবই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শক্তিজাত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম মঙ্গলময়। তাই, কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে যে কার্যকলাপ সাধিত হয়, তা পারমার্থিক কর্ম; তা অপ্রাকৃত এবং জড় জগতের কলুষের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। তাই কৃষ্ণভক্ত শান্ত। কিন্তু যারা সর্বক্ষণ ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য লাভ-ক্ষতির হিসাব করছে, তারা কখনই শান্তি পেতে পারে না। এটিই কৃষ্ণভাবনামৃতের রহস্য—শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধ-রহিত কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই এবং এই সত্য উপলব্ধিই পরম শান্তি ও অভয় দান করে।
শ্লোকঃ ১৩
সর্বকর্মাণি মনসা সংন্যস্যাস্তে সুখং বশী ।
নবদ্বারে পুরে দেহী নৈব কুর্বন্ন কারয়ন ॥ ১৩॥
সর্ব— সমস্ত কর্মাণি – কর্ম; মনসা – মনের দ্বারা; সংন্যস্য – ত্যাগ করে; আস্তে- থাকেন; সুখম্—সুখে; বশী—সংযত, নবদ্বারে নয়টি দ্বারবিশিষ্ট; পুরে—নগরে; দেহী — দেহধারী জীব; ন–না; এব – অবশ্যই; কুর্বন্—করেন; ন–না; কারয় — করান।
গীতার গান
বাহ্যে সর্বকার্য করে অন্তরে সন্ন্যাস ।
সর্বকার্যে সুষ্ঠু করি সুখেতে নিবাস ।।
নবদ্বার যুক্ত দেহ থাকি সেই পুরে ।
নিজে কিছু নাহি করে না করায় পরে ॥
অনুবাদঃ বাহ্যে সমস্ত কার্য করেও মনের দ্বারা সমস্ত কর্ম ত্যাগ করে জীব নবদ্বার -বিশিষ্ট দেহরূপ গৃহে পরম সুখে বাস করতে থাকেন; তিনি নিজে কিছুই করেন না এবং কাউকে দিয়েও কিছু করান না।
তাৎপর্যঃ দেহধারী জীবাত্মা নয়টি দ্বারবিশিষ্ট একটি নগরে বাস করে। দেহরূপী নগরটির কার্য প্রকৃতির বিশেষ গুণের প্রভাবে আপনা থেকেই সাধিত হয়। জীবাত্মা যদিও স্বেচ্ছায় এই দেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে, কিন্তু তবুও যদি সে ইচ্ছা করে, তবে এর থেকে মুক্ত হতে পারে। তার দিবা স্বরূপের কথা ভুলে যাওয়ার ফলে সে তার জড় দেহটিকে তার স্বরূপ বলে মনে করে নানা রকম দুঃখকষ্ট ভোগ করে। কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রভাবে তার যথার্থ স্বরূপকে পুনরুজ্জীবিত করার ফলে সে তার দেহবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে। জীব যখন কৃষ্ণভক্তে পরিণত হয়, তখন তাঁর দেহগত সমস্ত কর্ম থেকে সে মুক্ত হয়। এই ধরনের নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করে যখন তার মনোবৃত্তির পরিবর্তন হয়, তখন সে মহানন্দে এই নবদ্বার- বিশিষ্ট নগরীতে বাস করে। এই নয়টি দ্বারবিশিষ্ট নগরীর বর্ণনা করে বলা হয়েছে—
নবদ্বারে পুরে দেহী হংসো লেলায়তে বহিঃ ।
বশী সর্বসা লোকস্য স্থাবরস্য চরস্য চ ।।
“পরমেশ্বর ভগবান যিনি জীবাত্মার দেহে বাস করছেন, তিনিই হচ্ছেন বিশ্বচরাচরের অধীশ্বর। দেহের নয়টি দ্বার হচ্ছে—দুটি চোখ, দুটি নাক, দুটি কান, মুখ, উপস্থ ও পায়ু। বদ্ধ অবস্থায় জীব তার দেহকে তার স্বরূপ বলে পরিচয় দেয়, কিন্তু যখন সে তার অন্তরে অধিষ্ঠিত পরমাত্মার সঙ্গে তার পরিচয় খুঁজে পায়, তখন দেহে থাকলেও সে পরমাত্মার মতোই মুক্ত হয়।” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১৮) সেই জন্য, কৃষ্ণভাবনাময় মানুষ জড় দেহের বাহা ও আভ্যন্তরীণ এই দুই প্রকার কর্ম থেকেই মুক্ত।