শ্লোকঃ ৭
যোগযুক্তো বিশুদ্ধাত্মা বিজিতাত্মা জিতেন্দ্রিয়ঃ ।
সর্বভূতাত্মভূতাত্মা কুর্বন্নপি ন লিপ্যতে ॥ ৭॥
যোগযুক্তঃ—নিষ্কাম কর্মযোগে যুক্ত; বিশুদ্ধাত্মা—শুদ্ধ চিত্ত; বিজিতাত্মা- আত্মসংযত, জিতেন্দ্রিয়ঃ— ইন্দ্রিয়জয়ী, সর্বভূতাত্মভূতাত্মা— সমস্ত জীবের প্রতি দয়াশীল; কুর্বন্নপি—কর্ম করেও; ন–না; লিপ্যতে—লিপ্ত হন।
গীতার গান
যোগযুক্ত বিশুদ্ধাত্মা জিত ষড় গুণ ।
জিতেন্দ্রিয় হয় সেই অত্যন্ত প্রবীণ ॥
সর্বভূত লাগি যেবা কর্মযোগ সাধে ।
বিষয়ের মধ্যে থাকে বিষয় না বাধে ॥
অনুবাদঃ যোগযুক্ত জ্ঞানী বিশুদ্ধ বুদ্ধি, বিশুদ্ধ চিত্ত ও জিতেন্দ্রিয় এবং তিনি সমস্ত জীবের অনুরাগভাজন হয়ে সমস্ত কর্ম করেও তাতে লিপ্ত হন না।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে যিনি মুক্তির পথে এগিয়ে চলেছেন, তিনি প্রতিটি জীবেরই অত্যন্ত প্রিয় এবং প্রতিটি জীবই তাঁর প্রিয়। কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করার ফলেই এটি সম্ভব। এই প্রকার ব্যক্তি কোন কিছুকেই শ্রীকৃষ্ণের থেকে ভিন্নরূপে দেখেন না। একটি গাছের ডালপালা যেমন গাছটি থেকে ভিন্ন নয়, তেমনই তিনিও দেখেন যে, প্রতিটি জীবও ভগবানের থেকে অভিন্ন। তিনি জানেন, গাছের গোড়ায় জল দিলে যেমন সমস্ত গাছটিকে জল দেওয়া হয় অথবা উদরকে খাদ্য দিলে যেমন সমস্ত দেহকেই খাদ্য দেওয়া হয়, তেমনই ভগবানের সেবা করার ফলে সমস্ত জীব-জগতের সেবা করা হয়। এভাবেই শ্রীকৃষ্ণের দাসত্ব করার মাধ্যমে তিনি সকলেরই দাসত্ব করে চলেছেন। তাই তিনি সকলেরই প্রিয় এবং সকলেই তাঁর অতি প্রিয়। যেহেতু তাঁর কার্যকলাপে সকলেই সন্তুষ্ট, তাই তার চেতনা পবিত্র ও নির্মল। যেহেতু তাঁর চেতনা পবিত্র ও নির্মল, তাই তাঁর মন সম্পূর্ণরূপে সংযত। আর তাঁর চিত্ত সংযত হবার ফলে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিও সংযত। তাঁর মন সর্বদাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিবদ্ধ, তাই তিনি কখনই ভগবানকে বিস্মৃত হন না। সুতরাং, তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি কৃষ্ণসেবা ব্যতীত জড় কার্যকলাপে নিযুক্ত হবার কোন সম্ভাবনা থাকে না। তিনি কৃষ্ণকথা ছাড়া আর কিছুই শোনেন না, তিনি কৃষ্ণপ্রসাদ ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করেন না এবং তিনি ভগবানের মন্দির ছাড়া অন্য কোথাও যেতে চান না। তাই, তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি সর্বতোভাবে সংযত। এভাবেই যাঁর ইন্দ্রিয় সংযত হয়েছে, তিনি কারও ক্ষতিসাধন করেন না। এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারে, “তা হলে অর্জুন কেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অন্যদের আঘাত দিলেন? তিনি কি ভগবৎ-চেতনাময় ছিলেন না?” সেই প্রশ্নের উত্তর ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেওয়া হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে অর্জুনকে অপরাধী বলে মনে হতে পারে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত ব্যক্তিরা স্বতন্ত্রভাবে চিরকাল বেঁচে থাকবে, কেন না আত্মাকে কখনই হত্যা করা যায় না। তাই, আত্মার পরিপ্রেক্ষিতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কেউই নিহত হয়নি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে কেবল তাদের পোশাকের পরিবর্তন হয়েছিল। তাই, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুন সত্যি সত্যিই যুদ্ধ করছিলেন না। সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশ পালন করছিলেন। এই ধরনের ভগবদ্ভক্ত কোন অবস্থাতেই কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হন না।
শ্লোকঃ ৮-৯
নৈব কিঞ্চিৎ করোমীতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিৎ ।
পশ্যন্ শৃণ্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন্নশ্নন গচ্ছন্ স্বপন শ্বসন ॥ ৮ ॥
প্রলপন্ বিসৃজন্ গৃহ্নন্নুন্মিষন্নিমিষন্নপি ৷
ইন্দ্ৰিয়াণীন্দ্ৰিয়ার্থেষু বর্তন্ত ইতি ধারয়ন্ ॥ ৯॥
ননা; এব—অবশ্যই; কিঞ্চিৎ— কোন কিছু, করোমি—করি; ইতি—এভাবে; যুক্তঃ —চিন্ময় চেতনায় যুক্ত; মন্যেত—মনে করেন; তত্ত্ববিৎ—তত্ত্বজ্ঞ, পশ্যন্ –দর্শন; শৃণ্বন্—শ্রবণ; স্পৃশন্—স্পর্শ, জিঘ্রন্—ঘ্রাণ; অশ্নন্— ভোজন; গচ্ছন্—গমন ; স্বপন্—স্বপ্ন; শ্বসন্—শ্বাস গ্রহণ; প্রপন্—প্রলাপ; বিসৃজন — ত্যাগ; গৃহুন্—গ্রহণ; উন্মিষন্—উন্মীলন; নিমিষন্—নিমীলন; অপি—সত্ত্বেও; ইন্দ্রিয়াণি—ইন্দ্রিয়সমূহ; ইন্দ্রিয়ার্থে—ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে, বর্তন্তে — প্রবৃত্ত হয়; ইতি—এভাবে; ধারয় —ধারণা করে।
গীতার গান
সে যোগী চিন্তয়ে সদা হয়ে তত্ত্ববিৎ ।
সর্বকার্য করি কিন্তু করি না কিঞ্চিৎ ॥
দেখি শুনি স্পর্শ করি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে ।
স্বপনে গমনে কিংবা ভোজনে বিলাসে ॥
প্রলাপন করি কিংবা ভোগে বা সে ত্যাগে.
উন্মীলন নিমীলন কিংবা নিদ্রা যায় জাগে ।।
জড়কার্যে জড়েন্দ্রিয় সতত সে জানে ৷
নিজ কার্য আত্মতত্ত্ব সর্বদা সে ধ্যানে ।।
অনুবাদঃ চিন্ময় চেতনায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তি দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, ভোজন, গমন, নিদ্ৰা ও নিঃশ্বাস আদি ক্রিয়া করেও সর্বদা জানেন যে, প্রকৃতপক্ষে তিনি কিছুই করছেন না। কারণ প্রলাপ, ত্যাগ, গ্রহণ, চক্ষুর উন্মেষ ও নিমেষ করার সময় তিনি সব সময় জানেন যে, জড় ইন্দ্রিয়গুলিই কেবল ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়েছে, তিনি নিজে কিছুই করছেন না।
তাৎপর্যঃ যিনি কৃষ্ণভাবনাময় তাঁর অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে পবিত্র, তাই তিনি কর্তা, কর্ম, অধিষ্ঠান, প্রচেষ্টা ও দৈব—এই পাঁচটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণের দ্বারা সাধিত কর্মের সঙ্গে কোনভাবে সংযুক্ত নন। তার কারণ হচ্ছে, তিনি সর্বক্ষণ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে প্রেমভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করছেন। আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হয়, তিনি তাঁর দেহ ও ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তাঁর কর্ম করছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর যথার্থ স্থিতি সম্বন্ধে সচেতন, যা হচ্ছে পারমার্থিক কার্যকলাপ। জড় চেতনায় ইন্দ্রিয়গুলি ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি সাধনের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে, কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় ইন্দ্রিয়গুলি শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয়ের সন্তুষ্টি বিধান করার সেবায় প্রবৃত্ত হয়। তাই, কৃষ্ণভক্তকে আপাতদৃষ্টিতে ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপে নিয়োজিত বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি সর্বদাই মুক্ত। দর্শন ও শ্রবণাদি হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপ এবং এগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান আহরণ করা, সেই রকম গমন, প্রলাপন ও মলত্যাগাদিও ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপ এবং এগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্ম করা। কৃষ্ণভক্ত কোন অবস্থাতেই ইন্দ্রিয়ের এই সমস্ত কর্মের দ্বারা প্রভাবিত হন না। ভগবানের সেবা ছাড়া তিনি আর কোন কর্মই করতে পারেন না। কারণ তিনি জানেন, তিনি হচ্ছেন ভগবানের নিত্যদাস।
শ্লোকঃ ১০
ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ ।
লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা ॥ ১০ ॥
ব্রহ্মণি—পরমেশ্বর ভগবানকে; আধায়—সমর্পণ করে; কর্মাণি—সমস্ত কর্ম: সঙ্গম্— আসক্তি, ত্যক্ত্বা— ত্যাগ করে; করোতি — অনুষ্ঠান করেন; যঃ– যিনি; লিপ্যতে– প্রভাবিত হন; ন–না; সঃ— তিনি; পাপেন — পাপের দ্বারা; পদ্মপত্রম্—পদ্মপাতা; ইব― মতো; অন্তসা—জল দ্বারা।
গীতার গান
ব্রহ্মণি নিবিষ্ট কার্য নিঃসঙ্গ যে করে ।
বিষয় প্রভাবে সেই তাহাতে না ডরে ॥
অতএব পাপ পুণ্যে নাহি তারে লেপে ।
সেই পদ্মপত্র জলে জানি বা সংক্ষেপে ৷৷
অনুবাদঃ যিনি সমস্ত কর্মের ফল পরমেশ্বর ভগবানকে অর্পণ করে অনাসক্ত হয়ে কর্ম করেন, কোন পাপ তাঁকে কখনও স্পর্শ করতে পারে না, ঠিক যেমন জল পদ্মপাতাকে স্পর্শ করতে পারে না।
তাৎপর্যঃ এখানে ব্রহ্মণি শব্দটির অর্থ হচ্ছে কৃষ্ণভাবনায়। জড় জগৎ হচ্ছে প্রকৃতির তিনটি গুণের অভিব্যক্তি—তাকে বলা হয় ‘প্রধান’। বৈদিক মন্ত্র— সর্বং হোতদ ব্ৰহ্ম ( মাণ্ডুক্য উপনিষদ ২), তস্মাদেতদ্ ব্রহ্ম নামরূপমন্নং চ জায়তে (মুণ্ডক উপনিষদ ১/১/৯) এবং ভগবদ্গীতার শ্লোক মম যোনিমহদ ব্রহ্ম (গীতা ১৪/৩) বর্ণনা করে যে, এই জগতে সব কিছুই ব্রহ্মের প্রকাশ। এই প্রকাশ যদিও ভিন্নরূপে হয়, কিন্তু তা মূল কারণ থেকে অভিন্ন। ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে, সব কিছুই পরমব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। তাই, তিনি হচ্ছেন সব কিছুর অধীশ্বর। যিনি এই সত্যকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং সেই উপলব্ধির ফলে সব কিছুই ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করেছেন, তিনি কোন অবস্থাতেই পাপ-পুণ্য কর্মফলের বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ হন না। পাপ অথবা পুণ্য কোন কর্মফলই তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি জানেন, কোন বিশেষ কর্ম সাধন করার জন্যই ভগবান তাঁকে তাঁর জড় শরীরটি দান করেছেন, তাই ভগবানের সেবাতেই তিনি সেটি নিয়োজিত করেন। তখন তা সব রকম কলুষ থেকে মুক্ত, ঠিক যেমন জলে থাকলেও পদ্মপাতাকে জল কখনও স্পর্শ করতে পারে না। গীতাতেও (৩/৩০) ভগবান বলেছেন, ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংনাসা— “সমস্ত কর্ম আমার (শ্রীকৃষ্ণের) কাছে সমর্পণ কর।” সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যে জীব কৃষ্ণভাবনাশূন্য, তার দেহ ও ইন্দ্রিয়কে তার স্বরূপ মনে করে সে কর্ম করে, কিন্তু যিনি কৃষ্ণভাবনাময় তিনি জানেন, তাঁর দেহটি শ্রীকৃষ্ণের সম্পত্তি, তাই তিনি তা সর্বতোভাবে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করেন।