শ্লোকঃ ৪
সাংখ্যযোগৌ পৃথগ্ বালাঃ প্রবদন্তি ন পণ্ডিতাঃ ৷
একমপ্যাস্থিতঃ সম্যগুভয়োর্বিন্দতে ফলম্ ॥ ৪ ॥
সাংখ্য—জড় জগতের বিশ্লেষণমূলক তত্ত্ব; যোগৌ— যোগকে; পৃথক্ পৃথক বালাঃ — অল্পজ্ঞ, প্রবদন্তি – বলে; ন–না, পণ্ডিতাঃ —পণ্ডিতেরা; একম্—একটিতে; অপি—ও; আস্থিতঃ—অবস্থিত হলে; সম্যক্—পূর্ণরূপে; উভয়োঃ—উভয়ের; বিন্দতে—লাভ হয়; ফলম্ — ফল।
গীতার গান
সাংখ্যযোগ কর্মযোগ যেবা পৃথক বলে ।
পণ্ডিত সে নহে কভু বালকের ছলে ॥
উভয় কার্যের মধ্যে যে কোন সে এক ৷
উভয়ের ফল প্রাপ্তি হইবে সম্যক্ ॥
অনুবাদঃ অল্পজ্ঞ ব্যক্তিরাই কেবল সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে পৃথক পৃথক পদ্ধতি বলে প্রকাশ করে, পণ্ডিতেরা তা বলেন না। উভয়ের মধ্যে যে-কোন একটিকে সুষ্ঠুরূপে আচরণ করলে উভয়ের ফলই লাভ হয়।
তাৎপর্যঃ সাংখ্য-দর্শনের উদ্দেশ্য হচ্ছে জড় জগতের বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে আত্মার অস্তিত্ব উপলব্ধি করা। জড় জগতের আত্মা হচ্ছেন শ্রীবিষ্ণু বা পরমাত্মা। ভক্তিযোগে যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা হয়, তখন পরমাত্মারও সেবা সাধিত হয়। একটি প্রক্রিয়া হচ্ছে গাছের মূল খুঁজে বার করা, আর অন্যটি হচ্ছে সেই মূলে জলসিঞ্চন করা। সাংখ্য-দর্শনের যথার্থ শিক্ষার্থী জড় জগতের মূল শ্রীবিষ্ণুকে জানতে পেরে পূর্ণ জ্ঞানযুক্ত হয়ে তাঁর সেবায় প্রবৃত্ত হন। তাই, এই দুটি পদ্ধতিতে কোনও ভেদ নেই, কারণ এদের উভয়েরই উদ্দেশ্য হচ্ছেন শ্রীবিষ্ণু। তাই, পরম লক্ষ্যকে যারা জানে না, তারাই কেবল বলে যে, সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগের উদ্দেশ্য এক নয়। কিন্তু যিনি যথার্থ জ্ঞানী তিনি জানেন, এই সমস্ত বিভিন্ন পদ্ধতির উদ্দেশ্য হচ্ছে এক।
শ্লোকঃ ৫
যৎ সাংখ্যৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদ্ যোগৈরপি গম্যতে ।
একং সাংখ্যং চ যোগং চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি ॥ ৫ ॥
যৎ—যা; সাংখ্যৈঃ—সাংখ্য-দর্শনের দ্বারা; প্রাপ্যতে – লাভ হয়; স্থানম্—স্থান; তৎ— তা; যোগৈঃ — নিষ্কাম কর্মযোগের দ্বারা; অপি—ও; গম্যতে—প্রাপ্ত হওয়া যায়; একম্—এক; সাংখ্যম্—সাংখ্য; চ—এবং, যোগম্ — কর্মযোগকে; চ–এবং; যঃ যিনি; পশ্যতি—দর্শন করেন; সঃ— তিনি; পশ্যতি — যথার্থ দর্শন করেন।
গীতার গান
সাংখ্যযোগ সাধ্য করি যে পদ সে পায় ।
যোগসিদ্ধ হলে লাভ তাহা উপজয় ॥
অতএব সাংখ্য কিংবা যোগ এক বল
বুদ্ধিমান সেই হয় যে বুঝে এক ফল ॥
অনুবাদঃ যিনি জানেন, সাংখ্য-যোগের দ্বারা যে গতি লাভ হয়, কর্মযোগের দ্বারাও সেই গতি প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং তাই যিনি সাংখ্যযোগ ও কর্ম-যোগকে এক বলে জানেন, তিনিই যথার্থ তত্ত্বদ্রষ্টা।
তাৎপর্যঃ দার্শনিক গবেষণার যথার্থ উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের পরম লক্ষ্য সম্বন্ধে অবগত হওয়া। জীবনের পরম লক্ষ্য হচ্ছে আত্ম-উপলব্ধি, তাই এই দুটি পদ্ধতির মাধ্যমে যেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, তা ভিন্ন নয়। সাংখ্য-দর্শনের মাধ্যমে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, জীব এই জড় জগতের বস্তু নয়, সে হচ্ছে পূর্ণ পরমাত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই, এই জড় জগতে চিন্ময় আত্মার কোনই প্রয়োজন নেই। তার অস্তিত্বের ও কর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবানের সঙ্গে সম্বন্ধ রক্ষা করা। যখন সে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে কর্ম করে, তখন সে যথার্থই তার স্বরূপে অধিষ্ঠিত হয়। প্রথমোক্ত পদ্ধতি সাংখ্য-যোগের মাধ্যমে মানুষকে জড় বিষয়ের প্রতি নিরাসক্ত হতে হয় এবং কর্মযোগ পদ্ধতি অনুসারে মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় কর্মে আসক্ত হতে হয়। প্রকৃতপক্ষে, এই দুটি পন্থা এক ও অভিন্ন, যদিও আপাতদৃষ্টিতে তাদের একটিকে নিরাসক্তি ও অন্যটিকে আসক্তি বলে মনে হয়। কিন্তু জড় বস্তুর প্রতি অনাসক্তি এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্তি একই তত্ত্ব। এই কথা যিনি বুঝতে পেরেছেন, তিনি প্রকৃত তত্ত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
শ্লোকঃ ৬
সন্ন্যাসস্ত মহাবাহো দুঃখমাপ্তমযোগতঃ ।
যোগযুক্তো মুনিব্রহ্ম ন চিরেণাধিগচ্ছতি ॥ ৬ ৷।
সন্ন্যাসঃ—সন্ন্যাস আশ্রম; তু– কিন্তু; মহাবাহো – হে মহাবীর; দুঃখম্ — দুঃখ; আপুম্—প্রাপ্ত হয়; অযোগতঃ – নিষ্কাম কর্মযোগ ব্যতীত; যোগযুক্তঃ – নিষ্কাম কর্ম অনুষ্ঠানকারী; মুনিঃ—জ্ঞানী; ব্রহ্ম — ব্রহ্মকে; ন চিরেণ—অচিরেই; অধিগচ্ছতি লাভ করেন।
গীতার গান
সন্ন্যাস করিয়া যদি নহে কর্মযোগী ।
মহাবাহো কি বলিব বৃথা সেই ত্যাগী ॥
যোগযুক্ত মুনি যেবা ব্ৰহ্মপদ পায় ।
অচিরাৎ সেই কার্য সিদ্ধি যোগে হয় ॥
অনুবাদঃ হে মহাবাহো ! কর্মযোগ ব্যতীত কেবল কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস দুঃখজনক। কিন্তু যোগযুক্ত মুনি অচিরেই ব্রহ্মকে লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ সন্ন্যাসী দুই প্রকারের— মায়াবাদী ও বৈষ্ণব। মায়াবাদী সন্ন্যাসীরা সাংখ্য-দর্শন অধ্যয়ন করেন আর বৈষ্ণব সন্ন্যাসীরা বেদান্ত-সূত্রের যথার্থ ভাষ্য শ্রীমদ্ভাগবত-দর্শন অধ্যয়ন করেন। মায়াবাদী সন্ন্যাসীরাও বেদান্ত-সূত্র অধ্যয়ন করেন, কিন্তু তাঁরা তা অধ্যয়ন করেন শ্রীপাদ শঙ্করাচার্যের শারীরক-ভাষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে। শ্রীমদ্ভাগবত অনুসরণকারী বৈষ্ণবেরা পাঞ্চরাত্রিকী বিধি অনুসারে ভক্তিমার্গে ভগবানের সেবা করেন, তাই বৈষ্ণব সন্ন্যাসীরা চিন্ময় ভগবদ্ভক্তিতে নানাবিধ কর্তব্য পালন করেন। বৈষ্ণব সন্ন্যাসীদের জড়-জাগতিক কর্তব্যকর্ম সাধন করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই, কিন্তু তবুও ভগবানের সেবা করার জন্য তাঁরা নানা রকম কার্যকলাপের অনুষ্ঠান করেন। কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত-দর্শন অধ্যয়নকারী এবং মনোধর্ম-পরায়ণ মায়াবাদী সন্ন্যাসীরা ভগবদ্ভক্তি আস্বাদন করতে পারেন না। যেহেতু তাঁদের অধ্যয়ন অত্যন্ত শ্রমদায়ক, তাই ব্রহ্ম বিষয়ক মনোধর্মের প্রভাবে বিভ্রান্ত ও ক্লান্ত হয়ে তাঁরা কখনও কখনও শ্রীমদ্ভাগবতের শরণাপন্ন হন। কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবতের যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করতে না পারার ফলে তাও ক্লেশদায়ক হয়ে ওঠে। কৃত্রিম উপায়ে মায়াবাদীদের শুষ্ক জ্ঞানালোচনা এবং জল্পনা-কল্পনা-প্রসূত অনুমান সবই নিরর্থক। ভগবদ্ভক্তি- পরায়ণ বৈষ্ণব সন্ন্যাসীরা তাঁদের দিব্য কর্তব্য সম্পাদন করে অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন এবং এই জগতের কাজ সমাপ্ত হলে অন্তিমে তাঁরা যে চিন্ময় ভগবৎ-ধামে ফিরে যাবেন, সেই সম্বন্ধে তাঁরা নিশ্চিত। মায়াবাদী সন্ন্যাসীরা কখনও কখনও আত্ম-উপলব্ধির মার্গ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে সমাজসেবা, পরোপকার আদি প্রাকৃত কার্যকলাপে পুনরায় প্রবৃত্ত হন। এগুলি সবই জড়-জাগতিক কর্মবন্ধন। এভাবেই আমরা দেখতে পাই, যাঁরা ভক্তি সহকারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করে চলেছেন, তাঁরা ব্রহ্মজ্ঞান অনুসন্ধানী সন্ন্যাসীদের থেকে অনেক উচ্চ মার্গে রয়েছেন। এই সমস্ত ব্রহ্মবাদী জ্ঞানীরাও বহু জন্মের পরে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করেন।