পঞ্চম অধ্যায়
কর্মসন্ন্যাস-যোগ
শ্লোকঃ ১
অর্জুন উবাচ
সন্ন্যাসং কর্মণাং কৃষ্ণ পুনর্যোগং চ শংসসি ।
যচ্ছ্রেয় এতয়োরেকং তন্মে ব্রুহি সুনিশ্চিতম্ ॥ ১ ॥
অর্জুনঃ উবাচ—-অর্জুন বললেন; সন্ন্যাসম্—ত্যাগ, কর্মণাম্—সমস্ত কর্মের, কৃষ্ণ- হে শ্রীকৃষ্ণ, পুনঃ পুনরায়, যোগম্—যোগ; চ–ও; শংসসি – প্রশংসা করছ; যৎ-যা: শ্রেয়ঃ- শ্রেয়স্কর; এতয়োঃ—এই দুটির মধ্যে; একম্—একটি; তৎ–তা, যে-আমাকে; ক্রহি-দয়া করে বল, সুনিশ্চিতম্ নিশ্চিতভাবে।
গীতার গান
অর্জুন কহিলেনঃ
হে কৃষ্ণ বারেক কর্ম ত্যাগ যে কথন ।
পুনরায় কর্মযোগ কহ বিবরণ ।।
তার মধ্যে যেবা নিশ্চিত জানিবা ৷
সংশয়বিহীন করি আমারে কহিবা ।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে শ্রীকৃষ্ণ! প্রথমে তুমি আমাকে কর্ম ত্যাগ করতে বললে এবং তারপর কর্মযোগের অনুষ্ঠান করতে বললে। এই দুটির মধ্যে কোন্টি অধিক কল্যাণকর, তা সুনিশ্চিতভাবে আমাকে বল।
তাৎপর্যঃ ভগবদ্গীতার এই পঞ্চম অধ্যায়ে ভগবান বলছেন যে, শুষ্ক জ্ঞানের মানসিক জল্পনার চেয়ে কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিভাবমূলক কর্ম শ্রেয়। ভক্তিভাবমূলক সেবা শুল্ক জল্পনা-কল্পনার চেয়ে সহজতর, কারণ এই ধরনের কর্ম অপ্রাকৃত এবং তা সাধন করার ফলে মানুষ কর্মফলের প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত হয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আত্মার প্রাথমিক জ্ঞান এবং জড় জগতে তার বন্ধনের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে এবং বুদ্ধিযোগ বা ভক্তিযোগের অনুশীলনের ফলে কিভাবে সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়, তার ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, যিনি শুধু জ্ঞানের স্তরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তাঁর আর কোন কর্তব্য নেই। চতুর্থ অধ্যায়ে ভগবান অর্জুনকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, সব রকমের যজ্ঞই জ্ঞানে পরিসমাপ্তি হয়। তবে, এই চতুর্থ অধ্যায়ের শেষে ভগবান অর্জুনকে উপদেশ দিলেন, পূর্ণ জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়ে মোহমুক্ত হয়ে যুদ্ধ করতে। সুতরাং, এভাবে একই সঙ্গে ভক্তিভাবমূলক কর্মে নিয়োজিত হতে এবং জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়ে কর্ম পরিহার করতে পরামর্শ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিভ্রান্ত করেছিলেন আর তাঁকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিচলিত করে তোলেন। অর্জুন বুঝতে পেরেছিলেন যে, জ্ঞানের প্রভাবে কর্ম ত্যাগের অর্থ হচ্ছে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য যে সমস্ত কর্ম, তা থেকে বিরত থাকা। কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভক্তিযোগ সাধন করার জন্য যদি কর্ম করা হয়, তা হলে কর্ম ত্যাগ করা হল কি করে? তিনি মনে করেছিলেন, জ্ঞানের প্রভাবে কর্মত্যাগ অর্থাৎ সন্ন্যাস হচ্ছে সব রকমের কর্ম থেকে বিরত হওয়া, কারণ কর্ম ও ত্যাগ তাঁর কাছে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছিল। সাধারণ মানুষের মতো তিনিও বুঝতে পারেননি যে, পূর্ণ জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়ে যে কর্ম করা হয়, তা কর্মফল থেকে মুক্ত এবং তাই তা ‘অকর্ম’। সুতরাং, তিনি ভগবানকে প্রশ্ন করেছেন, পরমার্থ সাধনের জন্য তিনি কি সর্বতোভাবে কর্ম পরিত্যাগ করবেন, না, পূর্ণ জ্ঞানে কর্ম করবেন।
শ্লোকঃ ২
শ্রীভগবানুবাচ
সন্ন্যাসঃ কর্মযোগশ্চ নিঃশ্রেয়সকরাবুভৌ ।
তয়োস্ত কর্মসন্ন্যাসাৎ কর্মযোগো বিশিষ্যতে ॥ ২॥
শ্রীভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন; সন্ন্যাসঃ কর্মত্যাগ; কর্মযোগঃ- কর্মযোগ; চ–ও; নিঃশ্রেয়সকরৌ – মুক্তিদায়ক, উভৌ—উভয়; তয়োঃ– সেই দুটির মধ্যে; তু– কিন্তু; কর্মসন্ন্যাসাৎ- কর্মসন্ন্যাস থেকে; কর্মযোগঃ—কর্মযোগ; বিশিষ্যতে—শ্রেয়।
গীতার গান
ভগবান কহিলেনঃ
সন্ন্যাস আর কর্মযোগ দুই শ্রেয় হয় ৷
সকল বেদাদি শাস্ত্রে তাই সে কহয় ৷।
তার মধ্যে কর্মযোগ সন্ন্যাস অপেক্ষা ৷
ক্রিয়াত্মক জনমধ্যে না কর উপেক্ষা ।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন—কর্মত্যাগ কর্মযোগ উভয়ই মুক্তিদায়ক। কিন্তু, এই দুটির মধ্যে কর্মযোগ কর্মসন্ন্যাস থেকে শ্রেয়।
তাৎপর্যঃ ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য যে সকাম কর্ম করা হয়, তা মানুষকে জড় বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। জীব যখন তার শারীরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করার আশায় নানাবিধ কর্ম করে চলে, তখন সে নিশ্চিতভাবে তার কর্মের ফলস্বরূপ একটির পর একটি বিভিন্ন ধরনের দেহ ধারণ করে এই জড় জগতে ঘুরে বেড়ায় এবং তার ফলে জড় বন্ধন অনন্তকাল ধরেই চলতে থাকে। সেই সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতে (৫/৫/৪-৬) প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে
নূনং প্রমত্তঃ কুরুতে বিকর্ম
যদিন্দ্রিয়প্রীতয় আপুণোতি ।
ন সাধু মন্যে যত আত্মনোহয়-
মসন্নপি ক্লেশদ আস দেহঃ ॥
পরাভবক্তাবদবোধজাতো
যাবন্ন জিজ্ঞাসত আত্মতত্ত্বম্ ।
যাবৎ ক্রিয়াভাবদিদং মনো বৈ
কর্মাত্মকং যেন শরীরবন্ধঃ ॥
এবং মনঃ কর্মবশং প্রযুক্তে
অবিদ্যয়াত্মন্যুপধীয়মানে।
প্রীতির্ন যাবন্ময়ি বাসুদেবে
ন মুচ্যতে দেহযোগেন তাবৎ ॥
“ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করবার জন্য মানুষ উন্মাদ এবং সে জানে না যে, তার ক্লেশদায়ক দেহটি হচ্ছে তার পূর্বকৃত সকাম কর্মের ফল। এই দেহটি অস্থায়ী, অথচ এর জন্যই মানুষকে দুঃখকষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। তাই, জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করবার আশায় কর্ম করা ভাল নয়। নিজের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে যে মানুষ কোনও অনুসন্ধান করে না, তার জীবন ব্যর্থ বলেই মনে করতে হবে। যতদিন মানুষ তার প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে না পারে, ততদিন তাকে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য কর্মফলের আশায় কর্ম করতে হয় এবং যতদিন বিষয়সুখ ভোগ করবার বাসনায় তার চেতনা আচ্ছন্ন থাকে, ততদিন তাকে এক দেহ থেকে আর এক দেহে দেহান্তরিত হতে হয়। অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন মন সকাম কর্মে নিবিষ্ট হতে পারে, কিন্তু মানুষের কর্তব্য হচ্ছে মনের এই বাসনাকে দমন করে বাসুদেবের চরণে প্রপত্তি করা। কেবল তখনই সে এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হবার সুযোগ পেতে পারে।”
তাই, যে জ্ঞান মানুষকে শিক্ষা দেয় যে, সে তার জড় দেহ নয়, তার প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে তার আত্মা, সেই জ্ঞানও জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরে আত্মার শাশ্বত ধর্ম পালন করতে হয়, নচেৎ জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় নেই। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভগবানের সেবা করার জন্য যে কর্ম করা হয়, সেই কর্ম সকাম কর্ম নয়। জ্ঞানময় কর্ম মানুষের প্রকৃত জ্ঞানের প্রগতিকে শক্তিশালী করে। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত না হয়ে, কেবল সকাম কর্ম ত্যাগ করলেই বদ্ধ জীবের হৃদয় কলুষমুক্ত হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত হৃদয় সম্পূর্ণভাবে কলুষমুক্ত না হচ্ছে, ততক্ষণ সকাম কর্মের স্তরে কর্ম করতে হয়। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম সাধিত হলে তা আপনা থেকেই কর্মফলের বন্ধন থেকে মানুষকে মুক্ত করতে সাহায্য করে এবং তখন তাকে আর এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম সর্বদাই কর্মত্যাগের চেয়ে শ্রেয়, কেন না কর্মত্যাগ থেকে পতনের সম্ভাবনা থাকে। কৃষ্ণভক্তিবিহীন বৈরাগ্য অপূর্ণ, সেই কথা শ্রীল রূপ গোস্বামী তাঁর ভক্তিরসামৃতসিন্ধুতে (পূর্ব 2/2৫৬) বলেছেন-
প্রাপঞ্চিকতয়া বুদ্ধ্যা হরিসম্বন্ধিবস্তনঃ ।
মুমুক্ষুভিঃ পরিত্যাগো বৈরাগ্যং ফল্গু কথ্যতে ॥
“মুমুক্ষুরা ভগবান সম্বন্ধীয় বস্তুকেও প্রাকৃত জ্ঞানে পরিত্যাগ করে এবং সেই ত্যাগ সম্পূর্ণ হয় না। এই ধরনের বৈরাগ্যকে ‘ফল্গুবৈরাগ্য’ বলা হয়।” আমরা যখন বুঝতে পারি যে, সব কিছুই ভগবানের, আমাদের কিছুই নয়, তাই ‘আমার’ বলে কোন কিছুর উপর আমাদের অধিকার বিস্তার করা উচিত নয়; তখন ত্যাগের সম্পূর্ণতা আসে। মানুষের বোঝা উচিত, বাস্তবিকই কোন কিছুই তার নিজের নয়। তা হলে ত্যাগের প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? যে জানে, সব কিছুই হচ্ছে ভগবানের সম্পত্তি, সে নিত্য বৈরাগ্যযুক্ত। যেহেতু সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণের, তাই সবই শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োগ করতে হয়। এই শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত কর্ম মায়াবাদী সন্ন্যাসীদের কৃত্রিম বৈরাগ্যের চেয়ে অনেক ভাল।
শ্লোকঃ ৩
জ্ঞেয়ঃ স নিত্যসন্ন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষতি ৷
নির্দ্বন্দো হি মহাবাহো সুখং বন্ধাৎ প্রমুচ্যতে ॥৩॥
জ্ঞেয়ঃ—জ্ঞাতবা; সঃ – তিনি; নিত্য – সর্বদা; সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসী; যঃ যিনি; ন– না; দ্বেষ্টি— দ্বেষ করেন; ন–না; কাঙ্ক্ষতি – আকাঙ্ক্ষা করেন; নির্দ্বন্দঃ দ্বন্দুরহিত; হি— অবশ্যই; মহাবাহো – হে মহাবীর; সুখম্ — সুখে; বন্ধাৎ—বন্ধন থেকে প্রমুচ্যতে—মুক্ত হন।
গীতার গান
রাগদ্বেষ বিবর্জিত যেবা কর্মযোগী ।
অনাসক্ত বিষয়েতে নহেত সে ভোগী ॥
নির্দ্বন্দু সে মহাবাহো দুঃখ বন্ধ নাই ৷
তোমারে কহিনু আমি করিয়া নিশ্চয় ৷।
অনুবাদঃ হে মহাবাহো ! যিনি তাঁর কর্মফলের প্রতি দ্বেষ বা আকাঙ্ক্ষা করেন না, তাঁকেই নিত্য সন্ন্যাসী বলে জানবে। এই প্রকার ব্যক্তি দ্বন্দুরহিত এবং পরম সুখে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ যিনি পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময়, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত ত্যাগী, কারণ তিনি কর্মফলের প্রতি বীতরাগ বা অনুরাগ যে কোন দিক থেকেই সম্পূর্ণভাবে নিরাসক্ত। এভাবেই যিনি সব কিছু ত্যাগ করে অনন্য ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করেন, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত জ্ঞানী। কারণ, ভগবানের সঙ্গে তাঁর নিত্য সম্পর্কের কথা তিনি জানেন। তিনি খুব ভালভাবেই জানেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সম্যকভাবেই পূর্ণ এবং তিনি হচ্ছেন তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ মাত্র। এই জ্ঞানই পরম জ্ঞান, তা গুণবৈশিষ্ট্য এবং পরিমাণ-তত্ত্ব বিচারেও পরম সত্য। নির্বিশেষবাদীরা যে ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে ভগবান হওয়ার বাসনা পোষণ করে তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, কারণ অংশ কখনও পূর্ণের সমান হতে পারে না। গুণগত বৈশিষ্ট্যে মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবে পরিমাণ- তত্ত্ব বিচারে ভিন্নতা-বিশিষ্ট, এই অচিন্তা-ভেদাভেদ তত্ত্বজ্ঞানই হচ্ছে প্রকৃত পারমার্থিক তত্ত্বজ্ঞান। তখন মানুষের আকাঙ্ক্ষা বা শোক করবার কিছুই থাকে না। তাই তাঁর মনে আর কোনও দ্বন্দুভাব থাকে না, কারণ তিনি যা করেন তা সবই শ্রীকৃষ্ণের জন্য করেন। এভাবেই দ্বন্দ্বভাবের স্তর থেকে মুক্ত হবার ফলে তিনি জড় বন্ধনমুক্ত হন। এমন কি এই জড় জগতে অবস্থানকালেও তিনি বন্ধনমুক্ত থাকেন।