—ওগো ও কর্ণফুলী,

উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি।

যে লোনা জলের সিন্ধু-সিকতে নিতি তব আনাগোনা,

আমার অশ্রু লাগিবে না সখি তার চেয়ে বেশি লোনা !

তুমি শুধু জল কর টলমল ; নাই তব প্রয়োজন

আমার দু’ফোঁটা অশ্রুজলের এ গোপন আবেদন ।

যুগ যুগ ধরি’ বাড়াইয়া বাহু তব দু’ধারের তীর

ধরিতে চাহিয়া পারেনি ধরিতে, তব জল-মঞ্জীর

বাজাইয়া তুমি ওগো গর্বিতা চলিয়াছ নিজ পথে !

কূলের মানুষ ভেসে গেল কত তব এ অকূল স্রোতে !

তব কূলে যারা নিতি রচে নীড় তা’রাই পেল না কূল,

দিশা কি তাহার পাবে এ অতিথি দু’দিনের বুলবুল !

                —বুঝি প্রিয় সব বুঝি,

তবু তব চরে চখা কেঁদে মরে চখীরে তাহার খুঁজি’ !

***              ***               ***

তুমি কি পদ্মা, হারানো গোমতী, ভুলে-যাওয়া ভাগীরথী—

তুমি কি আমার বুকের তলার প্রেয়সী অশ্রুমতী?

দেশ দেশ ঘুরে পেয়েছি কি দেখা মিলনের মোহনায়,

স্থলের অশ্রু নিশেষ হইয়া যথায় ফুরায়ে যায়?

ওরে পার্বতী উদাসিনী, বল্ এ গৃহ-হারারে বল,

এই স্রোত তোর কোন্ পাহাড়ের হাড়-গলা আঁখি-জল?

বজ্র যাহারে বিঁধিতে পারেনি, উড়াতে পারেনি ঝড়,

ভূমিকম্পে যে টলেনি, করেনি মহাকালেরে যে ডর,

সেই পাহাড়ের পাষাণের তলে ছিল এত অভিমান?

এত কাঁদে তবু শুকায় না তার চোখের জলের বান?

তুই নারী, তুই বুঝিবি না নদী পাষাণ নরের ক্লেশ,

নারী কাঁদে—তার সে আঁখিজলের আছে একদিন শেষ।

পাষাণ ফাটিয়া যদি কোনোদিন জলের উৎস বহে,

সে জলের ধারা শাশ্বত হয়ে রহে রে চির-বিরহে !

নারীর অশ্রু নয়নের শুধু ; পুরুষের আঁখি-জল

বাহিরায় গ’লে অন্তর হতে অন্তরতম তল !

আকাশের মত তোমাদের চোখে সহসা বাদল নেমে’

রৌদ্রের তাত ফুটে ওঠে সখি নিমেষে সে মেঘ থেমে !

***               ***               ***

               —ওগো ও কর্ণফুলী !

তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কান-ফুল খুলি?

তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন্ তরুণী কে জানে,

“সাম্পান”-নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে?

আমনা তার খুলে গেল খোঁপা, কান-ফুল গেল খুলি’,

সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কি কর্ণফুলী?

 

যে গিরি গলিয়া তুমি বও নদী, সেথা কি আজিও রহি’

কাঁদিছে বন্দী চিত্রকূটের যক্ষে চির-বিরহী?

তব এত জল একি তারি সেই মেঘদূত-গলা বাণী?

তুমি কি গো তার প্রিয়-বিরহের বিধুর স্মরণখানি ?

ঐ পাহাড়ে কি শিরীরে স্মরিয়া ফারেসের ফরহাদ,

আজিও পাথর কাটিয়া করিছে জিন্দেগী বর্বাদ?

সারা গিরি হ’ল শিরী-মুখ হায়, পাহাড় গলিল প্রেমে,

গলিল না শিরী! সেই বেদনা কি নদী হয়ে এলে নেমে?

ঐ গিরি-শিরে মজ্‌ন্ কি গো আজিও দিওয়ানা হয়ে

লায়লির লাগি’ নিশিদিন জাগি’ ফিরিতেছে রোয়ে রোয়ে?

পাহাড়ের বুক বেয়ে সেই জল বহিতেছ তুমি কি গো? —

দুষ্মন্তের খোঁজে-আসা তুমি শকুন্তলার মৃগ?

মহাশ্বেতা কি বসিয়াছে সেথা পুণ্ডরীকের ধ্যানে ? –

তুমি কি চলেছ তাহারি সে প্রেম নিরুদ্দেশের পানে? –

 

যুগে যুগে আমি হারায়ে প্রিয়ারে ধরণীর কূলে কূলে

কাঁদিয়াছি যত, সে অশ্রু কি গো তোমাতে উঠেছে দুলে?

***               ***               ***

               —ওগো চির উদাসিনী !

তুমি শোনো শুধু তোমারি নিজের বক্ষের রিণি রিণি ।

তব টানে ভেসে আসিল যে ল’য়ে ভাঙা “সাম্পান”-তরী,

চাহনি তাহার মুখ-পানে তুমি কখনো করুণা করি ।

জোয়ারে সিন্ধু ঠেলে দেয় ফেলে তবু নিতি ভাটি-টানে

ফিরে ফিরে যাও মলিন বয়ানে সেই সিন্ধুরই পানে !

বন্ধু, হৃদয় এমনি অবুঝ কারো সে অধীন নয় !

যারে চায় শুধু তাহারেই চায়—নাহি মানে লাজ ভয় ।

বারে বারে যায় তারি দরজায়, বারে বারে ফিরে আসে !

যে আগুনে পু’ড়ে মরে পতঙ্গ—ঘোরে সে তাহারি পাশে!

 

তব জলে আমি ডুবে মরি যদি, নহে তব অপরাধ,

তোমার সলিলে মরিব ডুবিয়া, আমারি সে চির-সাধ !

আপনার জ্বালা মিটাতে এসেছি তোমার শীতল তলে,

তোমারে বেদনা হানিতে আসিনি আমার চোখের জলে !

অপরাধ শুধু হৃদয়ের সখি, অপরাধ কারো নয় !

ডুবিতে যে আসে ডোবে সে একাই, তটিনী তেমনি বয় !

***               ***               ***

সারিয়া এসেছি আমার জীবনে কূলে ছিল যত কাজ,

এসেছি তোমার শীতল নিতলে জুড়াইতে তাই আজ !

ডাকনি ক’ তুমি, আপনার ডাকে আপনি এসেছি আমি

যে বুকের ডাক শুনেছি শয়নে স্বপনে দিবস-যামী ।

হয়ত আমারে লয়ে অন্যের আজও প্রয়োজন আছে,

মোর প্রয়োজন ফুরাইয়া গেছে চিরতরে মোর কাছে !

               —সে কবে বাঁচিতে চায়,

জীবনের সব প্রয়োজন যার জীবনে ফুরায়ে যায় !

 

জীবন ভরিয়া মিটায়েছি শুধু অপরের প্রয়োজন,

সবার খোরাক জোগায়ে নেহারি উপবাসী মোরই মন !

আপনার পানে ফিরে দেখি আজ—চলিয়া গেছে সময়,

যা’ হারাবার তা’ হারাইয়া গেছে, তাহা ফিরিবার নয় !

হারায়েছি সব, বাকি আছি আমি, শুধু সেইটুকু লয়ে

বাঁচিতে পারি না, যত চলি পথে তত উঠি বোঝা হয়ে !

 

বহিতে পারি না আর এই বোঝা, নামানু সে ভার হেথা ;

তোমার জলের লিখনে লিখিনু আমার গোপন ব্যথা !

ভয় নাই প্রিয়, নিমেষে মুছিয়া যাইবে এ জল-লেখা,

তুমি জল—হেথা দাগ কেটে কভু থাকে না কিছুরি রেখা !

আমার ব্যথায় শুকায়ে যাবে না তব জল কা’ল হ’তে,

ঘূর্ণাবর্ত জাগিবে না তব অগাধ গভীর স্রোতে।

হয়ত ঈষৎ উঠিবে দুলিয়া, তারপর উদাসিনী,

বহিয়া চলিবে তব পথে তুমি বাজাইয়া কিঙ্কিণী !

শুধু লীলাভরে তেমনি হয়ত ভাঙিয়া চলিবে কূল,

তুমি র’বে, শুধু র’বে না ক’ আর এ গানের বুলবুল !

 

তুষার-হৃদয় অকরুণা ওগো, বুঝিয়াছি আমি আজি—

দেওলিয়া হয়ে কেন তব তীরে কাঁদে “সাম্পান”-মাঝি !

error: Content is protected !!