
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের নারীরা শুধু সেবা, মমতা আর প্রেরণাই যোগান নি। যে হাতে স্নেহ মায়া মমতা দিয়েছেন সে হাতে গর্জে উঠেছে আগ্নেয়াস্ত্র, ছিদ্র করেছে শত্রুবক্ষ। নারীদের এই বীরত্বগাথা ইতিহাস আজ অবহেলায়, অনাদরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি গ্রাম-গ্রামান্তরে, আনাচে-কানাচে। বরিশাল জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে খুঁজে পেয়েছি এমন একজন বীর নারী যার নাম করুণা বেগম।
করুণা বেগমের সন্ধান পাই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল থেকে প্রকাশিত মুক্তিবার্তা পত্রিকা থেকে। মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত ঠিকানা অনুযায়ী বরিশাল জেলার মূলাদি থানার কাজির চর গ্রামে যাই করুণা বেগমের খোঁজে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কাজির চর গ্রামে করুণা বেগমের সন্ধান পাই নি। এ প্রজন্মের অনেকেই জানে না করুণার কথা। পরে এক মুক্তিযোদ্ধার সহযোগিতায় খুঁজে পেলাম তাঁর ভাইয়ের ঠিকানা। তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পাই করুণা বেগমের বর্তমান ঠিকানা।
ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে দোয়ারিকা-শিকারপুর ফেরি ঘাটের মাঝে অবস্থিত রাকুদিয়া গ্রাম। এখানেই থাকেন আমাদের বীরযোদ্ধা করুণা বেগম। স্নেহের পরশ বোলানো নারিকেল, সুপারিসহ নানান জাতের বৃক্ষে শোভিত রাকুদিয়া গ্রামটি। গ্রামের দুপাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। দক্ষিণাঞ্চলের সাথে রাজধানীর নদীপথে যোগাযোগের জন্য নদী দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পড়ন্ত বেলায় গাছের ছায়ায় নদীর বুকে সবুজের আল্পনা। নয়নাভিরাম এ দৃশ্য দেখতে দেখতে বিকেল তিনটার দিকে রাকুদিয়া গ্রামে পৌঁছাই। ঐ গ্রামের একটা ছেলের সহযোগিতায় বাড়ি খুঁজে পাই। কথা হয় করুণা বেগমের সাথে। সহজ-সরল, হাসি-খুশি এক কূলবধূ করুণা বেগম। কে বলবে একাত্তরে তাঁর হাতে গর্জে উঠেছিল আগ্নেয়াস্ত্র, তাঁর বুলেটে বিদ্ধ হয়েছিল শত্ৰু বক্ষ।
করুণা বেগম ১৯৫৩ সালের ১০ জানুয়ারি মূলাদী থানার কাজিরচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা খন্দকার শাহ আলী এবং মা জোবেদা বেগম। মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বৎসর আগে তাঁর বিয়ে হয় মূলাদী থানার কাজির চর গ্রামের শহীদুল হাসান চুন্নুর সাথে। চুন্নু ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের চাকুরি ছেড়ে ১৯৭১ সালে গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি শহীদুল হাসান রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে কাজির চর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে করুণার স্বামী চুন্নু দেশপ্রেমিক যুবকদের সাংগঠনিকভাবে একত্রিত করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠাতে থাকেন এবং নিজে স্থানীয়ভাবে দল গঠন করেন এবং বিভিন্ন শত্রু ছাউনিতে আঘাত হানার প্রস্তুতি নেন। সে সময়ে পাকিস্তানি মিলিটারির সাথে এদেশীয় কতিপয় রাজাকার করুণার স্বামী শহীদুল হাসান এবং এলাকার আরো কয়েকজন যুবককে ধরে নিয়ে জয়ন্তী নদীর তীরে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং নদীতে ফেলে দেয়।
স্বামীর মৃত্যুর পরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন করুণা। একমাত্র পুত্র মান্নানকে নিয়ে দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকেন তিনি। কিছুদিন পরে স্বামীর মৃত্যুশোক দুর্দমনীয় শক্তিতে পরিণত হয়। স্বামীর আদর্শ, হত্যার প্রতিশোধ এবং দেশের মুক্তির জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেন তিনি।
করুণা বরিশাল জেলার মূলাদী থানার কুতুবউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ নেন এবং কুতুব বাহিনীতে যোগ দেন। গেরিলা বাহিনীর অন্যতম সক্রিয় সদস্য ছিলেন করুণা। এই বাহিনীর সাথে তিনি ছাড়া আরো ৫০জন নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। রাইফেল, স্টেনগান, গ্রেনেড ছোড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন করুণা। এছাড়া তিনি যে-কোনো ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার সম্পর্কেও বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেন। গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে কখনো ভিক্ষুক, কখনো বা গ্রামের কুলবধূ বেশে শত্রু-শিবির চিহ্নিত করা এবং সুযোগ বুঝে গ্রেনেড ছোড়া বা সময়মতো অপারেশন করা-ই ছিল তাঁর প্রধান কাজ।
করুণা সরাসরি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন বরিশাল জেলার কাশিমাবাদ, বাটাজোর, কসবা, টরকি, নন্দিবাজার, মাহিলারা ও শিকারপুরে।
সশস্ত্রযুদ্ধের একটি স্মরণীয় ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে গর্জে ওঠেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিশর্মা রূপধারণ করেন করুণা। তিনি ফিরে যান একাত্তরের স্মৃতিতে । কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘নভেম্বর মাসের শেষের দিকে, গৌরনদী থানার মহিলারা গ্রামে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তঘাঁটি। পাকিস্তানি সেনারা নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে। আমরা একদিন ঐ ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা করি ৷ আমরা ৫জন নারী মুক্তিযোদ্ধা এবং ১০জন পুরুষ যোদ্ধার একটি চৌকশ দল ঐ ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা নেই যার নেতৃত্ব দেই আমি নিজেই। পর পর ৪/৫টি গ্রেনেড ছুড়ে আক্রমণের সূচনা করি। চার ঘণ্টা স্থায়ী এই যুদ্ধে ১০জন শত্রুসেনা হতাহত হয় এবং মুক্তিসেনাদের মধ্যে আমি নিজে আহত হই। আমার পায়ে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমি সাধারণ কুলবধূর বেশে মূলাদী থানা হাসপাতালে ভর্তি হই। তখনো দেশ স্বাধীন হয় নি। ওই হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসার সুবিধাদি না থাকায় আমি সাধারণভাবে চলাচল শক্তি হারাই। স্বাধীনতার পরে আমি বরিশাল হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করি।’
দেশ স্বাধীন হলেও আর্থিক মুক্তি আসে নি করুণার। জীবন ও জীবিকার জন্য তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে একমাত্র ছেলে আব্দুল মান্নানকে বাঁচানোর জন্য। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দুইটি রাষ্ট্রীয় ভাতা (শহীদ স্বামীর ও নিজে আহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে) পেলেও তা ছিল চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
দারিদ্র্যের কষাঘাত এবং পারিপার্শ্বিকতার কারণে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হন তিনি। দ্বিতীয় বিয়ে করেন বাবুগঞ্জ থানায় দেহেরগতি ইউনিয়নের রাকুদিয়া গ্রামের গোলাম মোস্তফাকে। গোলাম মোস্তফার সংসারে তাঁর তিন মেয়ে এবং দুই ছেলে। অগ্নিঝরা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি যুদ্ধে গিয়েও আমার স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারলাম না। দেশবাসী যেন তাদের ক্ষমা না করে। আল্লাহ যেন বিচার করে।’
কারা আপনার স্বামীকে হত্যা করেছে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি নাম বলে নিরাপত্তা হারাতে চাই না। আমি যুদ্ধে গিয়েও প্রতিশোধ নিতে পারলাম না। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ। এ দুঃখ আমাকে আজীবন কুরে কুরে খাচ্ছে।’