(৪)

পরদিন ভোরে কয়েকটি বাঙলা দৈনিক দেখে শিউরে ওঠে হাসান। তার কথা দিয়েই সংবাদের শিরোনাম করা হয়েছে, আর তার বক্তৃতারই রয়েছে বিশদ বিবরণ; সভাপতি, প্রধান অতিথির শুধু নাম রয়েছে। হায়, সভাপতি, হায়, প্রধান অতিথি। একটিতে তার ছবিও ছাপা হয়েছে, কিন্তু ছবিটা হাসানের পছন্দ হচ্ছে না, পাশ থেকে ছবিটা না তুলে কি মুখোমুখি তোলা যেতো না? হাসান পত্রিকাগুলোর সংবাদ বারবার পড়ে। এই কথাগুলোই কি সে বলেছে? মনে পড়ে সে বলেছে, তবে অনেক বাক্য ঠিক তার নয়, সাংবাদিকেরা নিজেদের মতো ক’রে লিখেছে। সে কি এমন বাসি বাক্য বলে?

তাহলে আমিও শিরোনামযোগ্য? সংবাদযোগ্য? হো হো ক’রে মনে মনে হাসে সে। আমিও তাহলে হয়ে উঠছি?

কিন্তু হয়ে ওঠা কাকে বলে, হাসান? নিজের সাথে কথা বলতে থাকে সে।

জমিরালি তো অনেক আগেই হয়ে উঠেছে, আরো হয়ে উঠবে; তুমি কি জমিরালি হ’তে চাও? হতে চাও ওই সভাপতি, প্রধান অতিথি? এক পাতিল বাসি পচা পুঁটি মাছের সিদলের মতো মঞ্চে মঞ্চে পচা বাসি কথা বলতে চাও তুমি? চাও না? তাহলে তোমার কিছু হবে না। কবিতা লিখে তুমি স্বীকৃতি পাবে? তোমার কবিতা ওরা বুঝবে? তুমি ওদের পেছনে পেছনে না হাঁটলে কখনো ওরা তোমার নাম নেবে? কখনো নেবে না।

আলাউদ্দিন রেহমান ফোন করে, দোস্ত, তোমার অনুষ্ঠানে যাইতে পারি নাই, কিন্তু কাগজে যা পড়লাম তাতে মনে হইতেছে তুমি তুলকালাম কাণ্ড বাধাই দিছো। মনে হইল সুকান্তজয়ন্তী না হইয়া হাসান জয়ন্তী হইয়া গেছে।

হাসান বলে, না, না, হাসানজয়ন্তী নয়, তুমি একটু ভুল করেছে, এর নাম হওয়া উচিত হাসানক্ষয়ন্তী; আমার আর ভবিষ্যৎ নেই।

আলাউদ্দিন রেহমান বলে, কবির আর ভবিষ্যৎ কি, মরার পর অমর হওয়া ছারা। হাসান বলে, তাহলে ওই ঘটনাটি শিগগির ঘটা দরকার।

আলাউদ্দিন রেহমান বলে, দোস্ত, একটা ভাল খবর আছে, তোমার জন্যে, ম্যাডাম মরিয়ম মাঝেমইন্দ্যেই তোমার নাম লয়, বলে তুমি আর আসলা না।

হাসান বলে, কার কথা বলছো, বুঝতে পারছি না তো। আলাউদ্দিন রেহমান বলে, আরো দোস্ত, অই যে একদিন আসছিলা আর তোমারে হুইস্কি ঢাইল্যা খাওয়াইছিলো, সেই ম্যাডাম মরিয়াম; মাঝেমইন্দ্যেই তোমার কথা কয়। মনে হয় দিলে দাগ কাইট্যা গেছো।

হাসান বলে, খুবই চমৎকার মেয়ে ম্যাডাম মরিয়ম, তুমি বেশ ভালোই আছো।

আলাউদ্দিন রেহমান বলে, দোস্ত, ভাল থাকা কি অতই সহজ, মাইয়ালোক লইয়া?এই এরিয়ায় গার্মেন্টস আর প্রিন্সেসে তফাৎ নাই; মাইয়ালোক শুরুতে গোলাপের পাপড়ির মতন পাতলা আর শ্যাষে পাথরের মতন ভারি। দোস্ত, আমি ভাল থাকতে চাই না, মাঝেমইধ্যে আনন্দে থাকতে চাই। আইজ সন্ধ্যায় আমার বাইড়তে আইসো, দোস্ত, একটু খাঅনদাঅনগিলন যাইবো, আনন্দ করন যাইবো।

হাসান বলে, আচ্ছা, অবশ্যই আসবো।

আলাউদ্দিন বলে, আরও দুই চাইরটা কবিরেও বলতেছি, অই দোস্তারা গিলার বেশি চান্স পায় না, কিন্তু গিলতে চায়, অগো গিলাইতে ভালই লাগে, ইম্মরটালগো লগে খাইতে আমার ভালই লাগে, অগো যতই গাইল্লাই অরা কমবেশি ইম্মরটাল এইটা আমি বুঝি। অগো নাম থাকবো, আমার নাম থাকবো না।

হাসান বলে, তুমি গার্মেন্টস, নও তুমি অ্যাড নও, তোমার ভেতর সেই কবিটি এখনো আছে, তুমি আবার কবিতা লেখো। তোমার কবিতা আমি পছন্দ করতাম। তোমার ভেতরেও অমর হওয়ার রোগ আছে, আলাউদ্দিন।

আলাউদ্দিন রহমান বলে, আরো দোস্ত, গার্মেন্টস্, আর পয়েট্রি একলগে যায় না, ট্যাকা বানাইতে চাইলে আর ইম্মরটাল হ’অন যায় না। ইম্মরটাল হইতে হইলে সেক্রিফাইস করতে হয়, পাগল হইতে হয়, আয়নায় নিজেরে দেইখ্যা গুডমৰ্নিং বলার প্রতিভা থাকতে হয়, খানকি ট্যাকারে গুডবাই জানাইতে হয়, আমি পয়েট্রিরে গুডবাই জানাইছি, অই বিউটি আমার লগে শুইবো না, তোমাগো লগেই রাইত কাটাইবো। তয় ট্যাকার শরিলটাও শোঅনের মতন।

অনেক দিন পানটান হয় নি, হাসান একটু তৃষ্ণা বোধ করে, আজ সন্ধ্যায় বেশ পান করা যাবে, রক্তনালি ভ’রে নিতে হবে ব্ল্যাক লেবেলে। সন্ধ্যার বেশ পরে, কখন যাবে কখন যাবে ভাবতে ভাবতে একটু দেরি ক’রে, সে উপস্থিত হয় আলাউদ্দিন রেহমানের লালমাটিয়ার বিশাল বাড়ির তেতলার ফ্ল্যাটে।

হাসানকে দেখে হৈ হৈ ক’রে ওঠে আলাউদ্দিন, শ্যাষম্যাষ কবি হাসান রশিদ আসছেন, বেশি দেরি করেন নাই, ঘণ্টা দুই দেরি করছেন, বইস্যা যাও, দোস্ত, খাও, গিলো।

ঢুকেই হাসান দেখে পাঁচ অমর পান ক’রে চলছেন।

আলাউদিনের কাব্যরুচি গার্মেন্টস ইন্ডেন্টিং অ্যাডে নষ্ট হয় নি–এজনোই ওকে আজো কবি মনে হয়, আলাউদ্দিন বেছে বেছেই গিলতে ডেকেছে হাসানের ভালোই লাগে। মাঝখানের দুটি সোফায় বসে আছেন কবি কামর আবদিন ও কথাশিল্পী করিম আহমেদ; এ-পাশের বড়ো সোফাটিতে বসেছে কবি শাহেদ আলতাফ ও কবি রাকিব সুলতান, ওপাশের আরেকটি বড়ো সোফায় একলা বসে আছে কবি সালেহ ফরিদউদ্দিন।

কথাশিল্পী করিম আহমেদটি সবার বড়ো, দু-খানা বই লিখে সাতখানা পুরস্কার পেয়ে তিনি সব সময় গাল ফুলিয়ে এবং সব কিছুর ওপর নিরন্তর বিরক্ত হয়ে থাকেন, সহজে কাউকে দেখতে পান না, তার চোখ দুটি যে-কাউকে দেখার জন্যে নয়; হাসানের মতো সামান্যতাকে তিনি দেখতে পেয়েছেন বলে মনে হলো না। তিনি পান ক’রে চলছেন, পানিপাত্রে হয়তো তার নায়িকাদের নগ্ন সাঁতার কাটতে দেখছেন, চমৎকারভাবে কাঁপছেন, কারো দিকে তাকাচ্ছেন না, মনে মনে তিনি দস্তয়োভস্কির বা হেমিংওয়ের সাথে হয়তো কথা বলে চলছেন।

কবিদের মাঝে এই গদ্য কেনো? হাসান নিজেকে জিজ্ঞেস করে।

ওহ! কবি কামর আবদিন আবার এঁকে ছাড়া কোথাও যান না, তাঁরা দুজন দুজনকে প্রশংসা ক’রে ক’রে পুরস্কার পাচ্ছেন ও বুড়ো হচ্ছেন।

তাঁরা দেশকে একদিন দুটি অতুলনীয় বুড়ো উপহার দেবেন।

হাসান মনে মনে অনেকক্ষণ ধ’রে হাসে।

কবি কামর আবদিন এখন খুব সাড়া জাগাচ্ছেন, এবং তিনি আপাদমস্তক অকবিসুলভ ভদ্রজন, বুড়ো হ’লে লোকটি হয়তো এতো ভদ্র হবেন যে সব কিছু ঘিনঘিনে ক’রে তুলবেন; তার চুল ঢেউ খেলানো, মুখখানি সুন্দর–এটা তার বড়ো সম্পদ, এটা ভেঙে তিনি খেয়ে যাবেন আরো তিরিশ বছর, এবং তিনি কথা বলার সময় মৃদুমধুর তোতলান, সব সময়ই মধুর কথা বলেন।

কবি কামর আবদিন পান করতে করতে বলেন, আআআসুসুসুন হাসান রশিদ সাহেব, আআআপপপনার ককককথাই হহহচ্ছিলো।

আদিম অভদ্র কবিদের মধ্যে এমন দু-একটি ভদ্র উদাহরণ থাকা দরকার।

হাসান হাত নেড়ে সবাইকে সালাম দেয়, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।

কবি শাহেদ আলতাফের মুখটি বিশাল, ঠোঁট ঝুলন্ত, চুল এলোমেলো, চোখ ঘোলাটে লাল; এর মাঝেই প্রচুর পান ক’রে ফেলেছে বলে মনে হয়, সে ঝিমোচ্ছে একটু পরই হয়তো সিঁড়ির নিচে গড়িয়ে পড়বে, হাসানের দিকে একবার তাকিয়ে বলে, পিয়ো, ইয়াং পোয়েট অ্যান্ড রেবেল, হ্যাঁভ এ গ্লাস।

শাহেদ আলতাফ হাত বাড়িয়ে দেয় হাসানের দিকে; কয়েক সেরা ওজন হবে শাহেদ আলতাফের হাতটি, হাসানের হাতটি ভেঙে যেতে চায়।

শাহেদ বলে, ইয়াং পোয়েট অ্যান্ড রেবেল, হাতটা তো রমণীদের মতো নরম।

হাসান বিব্রত হয়ে হাসে, বলে, কবির হাত।

শাহেদ আলতাফ বলে, পোয়েট, নাই-এ-ডেইজ পোয়েটদের হাত ডাকাতদের হাতের মতো শক্ত হওয়া দরকার, লিরিকেল রোম্যান্টিসিজমের কাল কবে শেষ হয়ে গেছে, এখন কবির হাত দিয়ে নর্দমা ঘাটতে হবে, চৌরাস্তায় গুণ্ডামি করতে হবে, রাবীন্দ্ৰিক চম্পক আঙুলে আর চলবে না; এ পয়েট নাউ-এ-ডেইজ ইজ অ্যান অ্যাকজিকিউশনার।

কবি রাকিব সুলতান এরই মাঝে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে।

রাকিব সুলতান বলে, গিলতে আসতে দেরি করলে আর কবি হওনা হইবো না ভাই, মদের গন্ধ পাইলেই কবিগো কুত্তার মতন ছুইট্টা আসতে হইবো শুয়োরের মতোন ঘোৎঘোৎ করতে করতে আসতে হইবো, মদই হইল কবি গো পানি কবিগো নিশ্বাস, হায়, তাও অই গরিবরা পায় না, গার্মেন্টস্‌রা পায় খানকির পুতরা পায়, কবিরা পায় না। বইল্যা দিলাম। আপনে ভাই কবি হইতে পারবেন না, যান, গ্যারামে গিয়া চেয়ারম্যানের মোটাগাটা একটা মাইয়ারে বিয়া কইর‍্যা সুখে ঘরসংসার করেন, পোলাপান পয়দা করেন।

কবি সালেহ ফরিদউদ্দিন একপাশে তার প্রুফগুচ্ছ বিছিয়ে বসেছে, কাবাব আর নান খেয়ে চলছে, ও সব সময়ই ক্ষুধার্তা থাকে, এবং নিজের কবিতাও আবৃত্তি ক’রে চলছে, আর পান ক’রে চলছে।

সে বলে, আসো, দোস্ত, বসো আমার পাশে; তোমারে একটা কবিতা শুনাই।

সালেহ প্রুফগুচ্ছ থেকে একটি কবিতা পড়তে শুরু করে, ওর দেখে পড়তে হয়। না, চােখ বুজেই সে আবৃত্তি করতে থাকে।

ম্যাডাম মরিয়ম ঢোকার সময়ই হাসানকে সালাম ও হাসি জানিয়েছিলো, এবং আরো দুটি তরুণীও তাকে সালাম ও হাসি জানিয়েছিলো; তারা পরিবেশকে খুবই সেনাসুয়্যাল শৈল্পিক ক’রে রেখেছে, পাত্রে পাত্রে ব্ল্যাক লেবেল ঢেলে দিচ্ছে, এগিয়ে দিচ্ছে কাবাব আর নান।

হাসান কবি সালেহ ফরিদউদিনের পাশে বসে।

ম্যাডাম মরিয়ম একটি প্লেটে কাবাব আর নানা নিয়ে তার সামনে হেসে দাঁড়ায়, সে প্লেটটি নেয় ম্যাডাম মরিয়মের হাত থেকে। মরিয়মের একগুচ্ছ আঙুল তার আঙুলের ওপর একপশলা বৃষ্টিধারার মতো ঝরে পড়ে।

অনেক দিন পর তার আঙুলের ফাটা মাটির ওপর শ্রাবণ নামলো।

ম্যাডাম মরিয়ম তার গেলাশে হুইস্কি এবং চােখে বৃষ্টি ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করে, পানি না বরফ, কবি?

বিস্মিত হয়ে হাসান তাকায় তার দিকে, এবং হেসে বলে, পানিও নয় বরফও নয়, একটু সবুজ মেঘ একটু সোনালি কুয়াশা এক টুকরো নীল চাঁদ যদি থাকে।

মরিয়ম মধুরভাবে তাকায় হাসানের দিকে।

হাসান বলে, প্রিয়, এখানে আমি একা কবি নাই, একা আমাকে কবি বললে অন্যরা আপনাকে খুন ক’রে ফেলবে। সেনাপতিরাও অবহেলা সহ্য করে, কিন্তু কবিরা করে না, কবিরা নিজেকে ছাড়া আর কাউকে কবি মনে করে না।

মরিয়ম তার গ্লাশে পানি ঢালতে ঢালতে বলে, খুন করুক, আপনারে এই একটু

সবুজ ম্যাঘ দিলাম, কবি।

হাসান মরিয়মের মুখের দিকে তাকিয়ে গেলাশে একবার চুমুক দেয়।

বরফ নেই। সে কাপতে কাঁপতে এক চুমুকে অর্ধেকটাই শেষ করে ফেলে, তার ঝকঝকে গায়ের রঙ ঝিলিক দিয়ে ওঠে, এবং বলে, ইম্মরটালগো লগে পান করতে পাইর‍্যা আমি নিজেরে ধইন্য বোধ করতেছি।

আলাউদ্দিন সম্ভবত এর আগেই দু-এক গ্লাশ গিয়েছে।

কবি কামর আবদিন খুবই সামাজিক ভদ্র, তিনি জিজ্ঞেস করেন, আলাউদ্দিন সাহেব, ভাভাভাবীকে তো আআআজ দেখছি না।

তাঁর ভদ্রতায় মুগ্ধ হয় হাসান, নিজেকে অভদ্র মনে হয়; আলাউদিনের বাসায় এসে প্রথমেই তো তার উচিত ছিলো ভাবীর সংবাদ নেয়া।

তবে কামর আবদিনের ভদ্রতা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

আলাউদ্দিন আরেক চুমুকে গোলাশটি শেষ ক’রে ম্যাডাম মরিয়মের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, তারে কি দ্যাখনের সাধ এত তারাত্যারিই হইয়া গেলো আপনের আবদিন ভাই? এখনও তা রাইত বেশি হয় নাই, এক গোলাশও শ্যাষ করেন নাই, আরও কয়েক গেলাশ গিলেন, তারপর তারে দেখনের কথা ভাইবেন। রাইত ফুরাই যায় নাই।

খুবই বিব্রত হন ভদ্র কবি কামর আবদিন, তাঁর হাত থেকে গোলাশটি পড়ে যেতে চায়; গোলাশটি ধরতে ধরতে তিনি লাজুকভাবে বলেন, না, না, কিকিকিকিছু মমমনে কককরবেন না, আমি কিছু খারাপ মিন করি নি, আআআমি এএইভাবেই জিজিজিজ্ঞেস কককরেছিলাম। ভাবী খুব সন্ত্রান্ত মহিলা।

আলাউদ্দিন বলে, ওই সব সম্ভ্রান্তফম্ভ্রান্ত মহিলার কথা ভুইল্যা যান, আইজ ম্যাডাম মরিয়ম আছে, লগে আরও দুইজন প্রিন্সেস আছে।

কবি রাকিব সুলতান বলে, অই হারামজাদা আলাউদ্দিন, তুই তা আমার আগেই মাতাল হইয়া যাইতেছছ, আগে আমারে মাতাল হইতে দে, এইটা আমার অধিকার, তারপর তুই মাতলামি করিছ। আসল কথাটা কইয়া দে যে ভাবী দ্যাশে নাই, দিল্লি দাৰ্জিলিং গ্যাছে।

আলাউদ্দিন বলে, আর ফিইররা না আসলে বাচি, ওয়াইফ আর হুইস্কি আর কবিতা একলগে চলে না। এই দ্যাখেন না, ওয়াইফাগো ডরে আপনেরা নিজেগো বাড়িতে গিলেন না, বাড়িতে ঢোকনের আগে পানজর্দা খাইয়া লন।

শাহেদ আলতাফ বলে, আরো ছালা, বউটউ লইয়া ডিস্কাশন ছারো, পান করো আর কবতে লইয়া কথা বলো, কবতেই আমাদের ফিয়াঁসে, কবতেই আমাদের ওয়াইফ। অ্যান্ড মিস্ট্রেস, কবতেই আমাদের ইটারন্যাল গডেজ। ওয়াইফ থাকবে হারামজাদাদের, আমাদের কোনো মেয়েলোক ওয়াইফ থাকবে না। হিজড়েদেরই ওয়াইফ লাগে, কবিদের ওয়াইফ লাগে না; দি পয়েটস ডোন্ট নিড ওয়াইভস্‌।

রাকিব সুলতান বলে, ওস্তাদ, কইতে থাকো, কবতের স্তব গাইতে থাকো, কবতের জইন্যে আমি হাজেরার লগে ঘুমাইতে অস্বীকার করছি, কবিতের জাইন্যে আমি পশ্চিম পাড়ার সুনীল্যার মতন অম্‌রতা অস্বীকার করছি।

আলাউদ্দিন বলে, শালা, অইটা কোনো কবি না, অইটা একটা সেন্টিমেন্টাল স্টেরিটেলার, অইটার নাম মুখে আনিছ না। অই শালা কবি না।

রাকিব সুলতান বেশ খেয়েছে, সে ঢকঢক ক’রে খায়, সে গড়িয়ে পড়ে, উঠতে উঠতে বলে, তাইলে কি আমি এই পোস্ট-এডিটরিয়াল রাইটার কামর আবদিনের কথা বলুম? ও আইজ পর্যন্ত একটা মেমোরেবল লাইন লিখছে? ও তা একটা ঈশ্বরগুপ্ত। এই পাড়ার মুসলমানরা অরে লইয়া মাতামাতি করন শুরু করছে, আগে জসিমুদ্দিন আছিল, এখন অরে লইয়া ফালাফালি করছে, ও আমার এইটার কবি।

রাকিব সুলতান দাঁড়িয়ে ট্রাউজারের জিপ টানতে টানতে বলতে থাকে, ও আমার এইটার কবি, ও হইল পোস্ট-এডিটরিয়াল রাইটার, ও হইল রিপোর্টার, রিপোটিং আর কবতে এক জিনিশ না। কবিরা মহাকালের জাইন্যে লেখে, ও লেখে একদিনের জইন্যে; ওর কবিতা পাঁঠার পদ্য, তপসে মাছের পদ্য।

কামর আবদিন বিব্রত হয়ে তোতলাতে শুরু করেন, তাঁর চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে, এবং বলেন, আআআমি যা লিলিলিখেছি আআআগে তা লিলিলিখুন, ওই সব নাগরিক ইমেজারি তৈরি করুন, পরে এএএইসব বববলবেন।

রাকিব সুলতান গিয়ে দাঁড়ায় কামর আবদিনের সামনে, সে জিপ খুলতে থাকে, কামার আবদিন ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

রাকিব সুলতান বলে, তুমি আমার এইটা ল্যাখছো, আই ল্যাওরা আমি লিখুম না, কবিতা লিখতে গিয়া আমি জার্নালিজম করুম না। কবিতা হইল পিউরেস্ট ডায়মন্ড, আর তুমি কবিতার নামে কয়লা চালাইতেছ।

সালেহ ফরিদউদ্দিন নিজের কবিতা আবৃত্তি ও পান করা থেকে জেগে উঠে বলে, মহাকবি জীবনানন্দের আগে আর পরে বাঙলায় কোনো শালা কবিতা ল্যাখে নাই, আমি দুই একটা ল্যাখতেছি। আবদিন ভাই ত আঠার মাত্রার গদ্য লেখে।

কামর আবদিনকে বাঁচাতে কাঁপতে কাঁপতে গোলাশ উল্টে ফেলতে ফেলতে ধরতে ধরতে এগিয়ে আসেন কথাশিল্পী করিম আহমেদ।

তিনি খশখ’শে পুরস্কারপ্রাপ্ত গলায় বলেন, কবি কামর আবদিন বাঙলা কবিতায় যুগান্তর এনেছেন, তিনি নকশিকাঁথা সোজানবাদিয়ার কবিতাকে খালেঝিলে ফেলে দিয়ে কবিতাকে নাগরিক কবিতা ক’রে তুলেছেন, তিনি আমাদের টি এস এলিয়ট, তাঁর কবিতা বোঝার শক্তি আপনাদের নেই।

রাকিব সুলতান এবার করিম আহমেদের দিকে তার জিপ টানাটানি নিয়ে এগিয়ে যায়, বলে, আমার চুলমার্কা দুইখানা পিরিতির গল্প লেইখ্যা আপনে সাতখানা পুরস্কার পাইছেন, আপনে অইগুলি লইয়াই থাকেন, কবিগো মইধ্যে কথা কইতে আইসেন না। নাগরিকতা আর এলিয়টের এইটা বোঝেন আপনে, হইছেন ত মুসলমানের নীহাররঞ্জন গুপ্ত, সেইটা হইয়াই থাকেন।

কামর আহমেদ চিৎকার ক’রে ওঠেন, আমাকে একটা সিগারেট দিন, আমাকে একটা সিগারেট দিন।

তিনি আসন থেকে মেঝের ওপর প’ড়ে যেতে যেতে আসন জড়িয়ে ধরেন।

কামর আবদিন তাঁকে বলেন, করিম ভাই, আপনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো, আপনার সিগারেট খাওয়া ঠিক হবে না।

করিম আহমেদ বলেন, রাখুন। হার্ট অ্যাটাক, আমাকে একটা সিগারেট দিন, আমাকে একটা সিগারেট দিন।

হাসান উঠে গিয়ে তাকে একটি সিগারেট দেয়।

করিম আহমেদ সিগারেটটি ঠোঁটে রাখতে রাখতে একবার সিগারেটটি নিচে প’ড়ে যায়, তিনি সেটি খুঁজতে থাকেন।

হাসান সিগারেটটি তুলে তার হাতে দেয়।

তিনি বলেন, আগুন দিন, আগুন দিন।

হাসান আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে দেখে করিম আহমেদের কোলে একটা ছােটাে অদ্ভুত বোতল, বোতলটা পিছলে পড়ে যাচ্ছে।

হাসান বোতলাটা তুলে বলে, এটা কী?

করিম আহমেদ চিৎকার করে বলে, এটা সিভাস রিগাল, এটা সিভাস রিগাল, এটা আমার জন্যে, আমি এটা ছাড়া খেতে পারি না।

রাকিব সুলতান এসে বোতলটি ছিনিয়ে নেয়। হাসানের হাত থেকে, চিৎকার ক’রে বলে, কবিরা খাইবো ব্ল্যাক লেবেল, আর সিভাস রিগাল খাইবো একটা থার্ড ক্লাস নভেলিস্ট, এইটা হইতে পারে না।

করিম আহমেদ হাহাকার ক’রে ওঠেন, আমার সিভাস রিগাল, আমার সিভাস রিগােল; সিভাস রিগাল ছাড়া আমি খেতে পারি না।

আলাউদ্দিন ঢুলতে ঢুলতে বলে, দ্যাখো শালা নভেলিস্টরা কিৎনা ছােটােলোক, ঘরে ঢুইকাই সিভাস রিগালের বোতলটা নিজের প্যাটের ভিতর ঢুকাইয়া রাখছে। কবিরা যদি ব্ল্যাক লেবেল টানে তাইলে নভেলিস্টগো টাননের কথা মেথরপট্টির কেরু, ব্যাটারি ভিজাইন্যা অ্যাসিড।

রাকিব সুলতান ঢকঢক ক’রে বোতল থেকেই গলায় ঢালতে থাকে সিভাস রিগাল, এবং টলতে টলতে মেঝের ওপর বসে পড়ে।

করিম আহমেদ কেঁপে কেঁপে বলেন, হাসান সাহেব, আরেকটা সিগারেট দিন।

হাসান বলে, আপনার আর সিগারেট খাওয়া ঠিক হবে না।

করিম আহমেদ রেগে ওঠেন, ধমক দিয়ে বলেন, আরে হাসান সাহেব, আপনি তো খুবই কৃপণ লোক, একটা সিগারেট, তাও দিতে চাচ্ছেন না।

শাহেদ আলতাফ অনেকক্ষণ চুপচাপ পান করছিলো, অল্প অল্প ঢুলে পড়ছিলো, এক সময় সব কিছু তার অসহ্য মনে হয়; সে ব’লে ওঠে, শালা এই গাইয়া কবিয়ালগো সাথে পান করতে আসার থিকা মেথরপট্টিই ফার বেটার, শালারা কবিতাও ল্যাখতে জানে না পান ও করতে জানে না। আমি এখনই বেরিয়ে বাদামতলি চ’লে যাবো, সেইখানে গোলাপির সাথে মদ খাবো।

শাহেদ আলতাফ একবার উঠতে গিয়ে ব’সে পড়ে; বিড়বিড় করতে থাকে, গোলাপি গোলাপি, পেতে দে তোর পবিত্ৰ দেহখানা।

পান করতে বেশ লাগছে হাসানের, বেশ লাগছে তার এই পরিবেশ। কবি, এখানে পান করছে কবিরা, যারা এই শহরের রাষ্ট্রের কেউ নয়, যারা নির্বাসিত এই শহর রাষ্ট্র বন্দুক কামান থেকে,–হাসানের মনে হ’তে থাকে–, কিন্তু তারাই এই সময়। আজ সন্ধ্যার আজ রাতের এই অসামান্য সময়টুকুই শুধু স্মরণীয় শুধু উল্লেখযোগ্য সারা শহরের আজকের ইতিহাসে, আর কিছু স্মরণীয় নয় উল্লেখযোগ্য নয়। কয়েক দিন আগে সে একটা ঝকঝকে উচ্চ আমলার চকচকে বাসায় পান করতে গিয়েছিলো, চারজনকে বসতে হয়েছিলো পৃথিবীর চার প্রান্তে, এবং তারা কেউ কথা বলছিলো না, যে যার পাত্র নিয়ে অল্প অল্প খাচ্ছিলো, হয়তো তারা ফাইল ঘাটছিলো, উন্নতি মাপছিলো, টাকা হিশেবে করছিলো, সভ্যতা বজায় রাখছিলো, আর হাসানের মনে হচ্ছিলো সে একটা গোয়ালঘরে বসে সাত দিনের বাসি পান্তাভাত লবণ ছাড়া খাচ্ছে। বারবার সে নিজেকে বলছিলো, হাসান, দ্যাখো, প্রতিভাহীনতা কাকে বলে, ভালো ক’রে দেখে নাও, সাফল্য হচ্ছে এই রকম, চুপচাপ, অতিশয় সভ্য, চারপ্রান্তে, নীরবে নিঃশব্দে পান্তাভাত। একটু পরেই সে বেরিয়ে এসেছিলো, ঠিক করেছিলো ওই সাফল্যের পান্তাভাতে সে আর যাবে না।

পান করতে তার বেশ লাগছে, সব কিছু সুন্দর মনে হচ্ছে, কয়েক দিন আগে যেরঙিন ট্রাকটি তাকে চাপা দিতে দিতে স’রে গিয়েছিলো, সেটির মুখ সে দেখতে পাচ্ছে–সুন্দর বিষন্ন পবিত্র মুখ, সেটির গলা জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, এবং তার ভেতর থেকে দু-তিনটি কবিতা না পাখি না কী যেনো গড়িয়ে গড়িয়ে বেরোতে চাচ্ছে, কয়েকটি চিত্রকল্প কোপে কেঁপে বারবার হানা দিচ্ছে, কয়েকটি শব্দ প্রজাপতির মতো উড়ছে ঘুরছে উড়ছে বসছে কাঁপছে নাচছে; একটু একটু ঘোলাটে বোধ করছে সে নিজেকে, এক অসম্ভব সরলতা তার ভেতরটাকে কোনোদিন না-দেখা দিঘির জলের মতো দোলাচ্ছে। সে বিষগ্ন হয়ে উঠছে তাদের পুকুরের পাড়ের নিঃসঙ্গ হিজল গাছটির ছায়ার মতো। হিজল, তুমি আমার থেকে পাঁচ বছর দূরে আছাে আমি আছি তোমার থেকে, কেমন আছো, তুমি? কী রকম ব্যথিত সুদূর নক্ষত্রের মতো মনে হচ্ছে সবাইকে, কী যেনো তারা জয় করতে চাচ্ছে যা তারা কখনো জয় করতে পারবে না, তারা চিরপরাভূত থেকে যাবে। আমি এই চিরপরাজিতদের একজন, আমি এই চিরপরাজিতদের একজন হ’তে চাই, যেমন পরাজিত রবীন্দ্রনাথ, যেমন পরাভূত সুধীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ বুদ্ধদেব, যেমন পরাভূত বদলেয়ার র‍্যাঁবো মালার্মে ইয়েট্‌স্‌, এবং আরো অজস্র মত্ত উন্মত্ত উদ্ধাস্তু।

হাসান নিজের পাত্রটিকে ভ’রে নেয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ায়, একটুকু কাঁপে, মধুর কম্পনটুকু সে উপভোগ করে, সে নির্ভার হচ্ছে, মধ্যরাতে হয়তো কোনো খ’সে পড়া গাছের পাশ দিয়ে গড়িয়ে যাবে ছোট্ট কোনো পুকুরের দিকে।

 

সে দেখে আলাউদ্দিন নদীর পাড়ে একটি বিশাল নৌকোর মতো কাৎ হয়ে আছে, মেঝের ওপর শাশ্বত বিকলাঙ্গ ভিখিরির মতো প’ড়ে আছে রাকিব সুলতান, চুপচাপ পান করছে কামর আবদিন, করিম আহমেদ, শাহেদ আলতাফ, হয়তো তারা অন্য কোনো নক্ষত্রে আছে যার নাম তারা জানে না; সালেহ ফরিদউদ্দিন তার প্রুফগুচ্ছ জড়িয়ে ধ’রে কাঁদছে।

মরিয়ম এসে তার পাত্রটি ভ’রে দেয়, একগুচ্ছ মেঘ তার আঙুলে লাগে।

মরিয়মকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, ওর চুলের ভেতর একরাশ আঙুল প্রবাহিত ক’রে দিতে ইচ্ছে করছে, ওর শাড়ির ভেতর দিয়ে একটা কোমল নরম সাপের মতো এঁকেবেঁকে ওপরের দিকে উঠে বিড়া পাঁকিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে, ওর বুকে একটা ছোটো পাখি হয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

মরিয়ম বলে, কবিদের মদ খাওয়া খুব সুন্দর, দেখতে আমার ভাল লাগে।

ঝলক দিয়ে উঠছে মরিয়ম।

মরিয়মের পায়ের তালু দুটি কেমন? সেখানে ওষ্ঠ ছোঁয়াতে ইচ্ছে করছে; ও কি শোয় আলাউদিনের সাথে, তা শোক, ওর ঠোঁটে হুইস্কি হয়ে লেগে থাকতে ইচ্ছে করছে, ওর গ্ৰীবায় একটা লাল তিল হয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে; ওকে একটি কবিতার পংক্তি ক’রে চিরকালের জন্যে অমরতা দিতে ইচ্ছে করছে।

হাসান বলে, কবিরা ব্যর্থ, ব্যর্থতা সব সময়ই সুন্দর।

মরিয়ম বলে, আমার কাছে আপনে সুন্দর।

হাসান মরিয়মের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে, ওর মুখে একটা উজ্জ্বল শহর দেখতে পায়, যেখানে জুলছে অজস্র নিদ্ৰাতুর বাতি।

হাসান সালেহ ফরিদউদ্দিনের দিকে এগিয়ে যায়, একটু কাঁপছে সে, সালেহের কান্না আরো বেড়ে গেছে।

হাসান জিজ্ঞেস করে, কাঁদছো কেনো সালেহ?

সালেহ বলে, আমার এই কবিতাগুলো অমর হবে না, এগুলো জীবনানন্দের কবিতার মতো হবে না।

সালেহ কাঁদতে থাকে; আজ রাতে অনন্তের কানে সে তার কান্না পৌঁছে দিতে চায়, হাসানের মনে হয় সে নতুন কবিতার কান্না শুনছে।

তার ভেতরেও কেঁদে চলছে তার কবিতাগুলো।

রাকিব সুলতান মেঝে থেকে হুহু ক’রে কাদতে কাঁদতে উঠে বসে, হাসানকে দেখতে পেয়ে সে উচ্চকণ্ঠে কাঁদতে কাঁদতে হাসানের পা জড়িয়ে ধরে।

রাকিব সুলতানের কান্নার শব্দে সবাই যেনো অবলুপ্ত অতলতা থেকে এক অপরিচিত অস্বস্তিকর বাস্তবতায় জেগে ওঠে।

হাসানের পা জোরে জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেতে থাকে রাকিব, এবং কাঁদতে থাকে যেনো এইমাত্র তার সবচেয়ে প্রিয়জনের মৃত্যু হয়েছে, আর বলতে থাকে, আমারে মাফ কইর‍্যা দেও, দোস্ত, মাফ কইর‍্যা দেও, বাঙলা কবিতা, মাফ কইর‍্যা দেও, চণ্ডীদাস, মাফ কইর‍্যা দেও, মুকুন্দরাম, আমি বড়ো পাপী, আমি নদীর কাছে পাপ করছি, নারীর কাছে পাপ করছি, ম্যাঘের কাছে পাপ করছি, অক্ষরবৃত্তের কাছে পাপ করছি, পাখির কাছে পাপ করছি, আমারে মাফ কইর‍্যা দেও।

হাসান তাকে টেনে তুলতে তুলতে বলে, তুমি কী করছো, কী করছো রাকিব, ওঠো, তুমি কোনো পাপ করো নি, পাপ আমরা সবাই করেছি, তুমি কোনো পাপ করো নি, কবিরা সবাই পাপী।

রাকিব সুলতান পাপের ভারি বোঝা মাথায় নিয়ে পা থেকে পায়ে ছুটতে থাকে। পাপের ভারে সে হাঁটতে পারছে না, কাঁপছে, প’ড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে ছুটছে; সব মানুষের পাপ থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র হয়ে উঠতে হবে তাকে।

সে ঢুলতে ঢুলতে গিয়ে জড়িয়ে ধ’রে কামর আবদিনের পা।

কামর আবদিন ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠেন, এমন বর্বর তিনি আগে দেখেন নি, তার হাতের পাত্রটি দূরে ছিটকে পরে হাহাকার করতে থাকে, পারলে তিনি দৌড়ে বেরিয়ে যেতেন। পৃথিবী থেকে। বেরোতে না পেরে তিনি কাঁপতে থাকেন।

রাকিব সুলতান কামর আবদিনের পা জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেতে খেতে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, আমারে মাফ কইর‍্যা দেও, ভাই, তুমি আমার অগ্রজ, তুমি আমার বাবা, তুমি আমার পিতামহ, তোমার কাছে আমার পাপের শ্যাষ নাই, তুমি হইলা আমাগো রবীন্দ্রনাথ, আমাগো জীবনানন্দ, আমাগো এলিঅট; তোমার কবিতা ছাড়া আর কোনো কবিতা নাই, আমারে মাফ কইর‍্যা দেও, তুমি ছাড়া আর কোনো মুসলমান কবিতা ল্যাখতে জানে না, তুমিই শুধু থাকবা, আমরা থাকুম না, আমারে মাফ কইর‍্যা দেও।

কামর আবদিন বুঝতে পারেন না। কী করবেন। তিনি রাকিব সুলতানকে জড়িয়ে ধ’রে বলতে থাকেন, এ আআআপনি কী কাককরছেন, এ আপনি কি বলছেন, আপনি আআমাদের বড়ো কবি হহবেন, আমার কবিতা কিছু না কিছু না, আপনার কবিতা পিউউর ককবিতা, আমি আজো শুদ্ধ কবিতা লিলিলিখতে পারি নি।

রাকিব সুলতান কামর আবদিনের পা ছেড়ে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে করিম আহমেদের।

করিম আহমেদ বলেন, এ কি অসভ্যতা, এ কি গ্ৰাম্যতা, এ কি ভালগারিটি।

রাকিব কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমারে মাফ কইর‍্যা দেও, ভাই, তোমার কাছে আমি অনেক পাপ করছি, তুমি হইলা আমাগো হেমিংওয়ে, আমাগো টমাস মান, আমাগো জেমস জয়েস, আমাগো লরেন্স; আমারে তুমি মাফ কইর‍্যা দেও। কবতে কিছু না, বেশ্যার দালালও কবতে ল্যাখতে পারে, নভেল ল্যাখ্যার জিইন্যে দরকার জিনিয়াস। তুমি আমাগো জিনিয়াস।

রাকিব সুলতান তাঁর পা ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে পথ খুঁজতে থাকে, পথ খুঁজে পায় না; সে কাঁদতে থাকে, হাজেরারে, তার কাছে আমি পাপ করছি, তর বুকের কাছে আমি পাপ করছি, তার ঠোঁটের কাছে আমি পাপ করছি, তার শাড়ির কাছে আমি পাপ করছি, আমারে তুই মাফ কইর‍্যা দে।

হুহু ক’রে কাঁদতে থাকে রাকিব সুলতান।

কয়েক দিন ধ’রেই হাসান ভাবছে একবার বাংলাবাজারের চৌধুরী ব্ৰাদার্সে যাবে, কথা ব’লে দেখবে তারা তার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি বের করবেন কি না? একেকবার সে খুবই অনুপ্রাণিত বোধ করে, পরেই মনে হয় যদি তারা রাজি না হন? প্রথম কাব্যগ্রন্থ কি তাকে দুঃখ দেবে, লজ্জা দেবে, বুকে একটা ঘা জাগিয়ে দেবে? একদিন দুপুরে সে সুদূর বাংলাবাজারের পথে গিয়ে পৌঁছে; রিকশা থেকে নেমে খুঁজতে থাকে চৌধুরী ব্রাদার্স, তার লজ্জা লাগে, ভয় লাগে, মনে হয় ফিরে যাই, আবার সে একটি একটি ক’রে নম্বর আর নােম পড়তে পড়তে এগোতে থাকে। সে এক সময় চৌধুরী ব্রাদার্সের ছোটো দোকানটি দেখতে পায়। কলেজের ছাত্র যেমন প্রথম একলা পতিতাপল্লীর গলির সামনে এসে ভয়ে লজ্জায় হঠাৎ অন্য দিকে চ’লে যায়, তাকিয়ে দেখে কেউ তাকে দেখলো কি না, হাসানও দ্রুত হেঁটে পেরিয়ে যায় কয়েকটি দোকান, দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট কিনে ধরায়, আবার অন্য দিকে হাঁটতে থাকে, সিগারেটটি শেষ করে।

সে কি ফিরে যাবে? সে কি চৌধুরী ব্ৰাদার্সে ঢুকবে?

নিজের কী পরিচয় দেবে সে?

নিজেকে কবি বলা কি ঠিক হবে? না, না, না।

না, আর ঘোরাঘুরি নয়। আর সিগারেট নয়; সে এবার ঢুকে পড়ে চৌধুরী ব্রাদার্সে, দু-দিকে বসে আছেন দুই সুদৰ্শন তরুণ, মাঝে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণ বৃদ্ধ।

হাসান নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, আমার নাম হাসান রশিদ।

দুই তরুণ উৎসাহিত হয়ে বলে, আপনার কথাই সেদিন হচ্ছিলো, আপনার বই আমরা ছাপবো ঠিক করেছি।

বৃদ্ধ বলেন, আপনে কবি? আপনারে ত কবির মতন দেখাইতেছে না।

হাসান জিজ্ঞেস করে, কবিরা দেখতে কেমন?

বৃদ্ধ বলেন, রাস্তায় পাগল আসতে দেখলেই আমার মনে হয় কোনো কবি আসতেছে, বই ছাপাইতে বলবো। আপনের ত লম্বা চুল নাই, পরনে ছিরা জামা নাই, আপনে আবার দারিও কাটছেন।

পিতার কথা শুনে দুই তরুণ বেশ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু ক’রে থাকে।

হাসান বলে, আমি অতো বড়ো কবি নই।

বৃদ্ধ বলেন, আপনে দেখি আবার শুদ্ধ ভাষা কন, কবিরা শুদ্ধ ভাষা জানে না।

হাসান বলে, আপনি কবিদের সম্পর্কে চমৎকার ধারণা রাখেন, আমার বেশ ভালো লাগছে।

বৃদ্ধ বলেন, কবিতা ছাইরা আমারে ক্যালাস নাইনের কয়টা নোট বই লেইখ্যা দেন, অইগুলি চলে, হাতে দুই চাইর পয়সা আসে, আপনেও ভাল পয়সা পাইবেন, কবিতায় পয়সা নাই, পাগল ছারা কেও কবিতা পড়ে না।

বৃদ্ধের কথা শুনে তাঁর লাজুক পুত্র দুটি লজ্জা পায়, হাসান হাসে, এবং বলে, নোটবই লিখতে পারলে খুব খুশি হতাম, তবে নোট বই লিখতে হ’লে পণ্ডিত হতে হয়, এক্সপেরিয়েন্স্‌ড্‌ হেডমাস্টার হতে হয়, আমি তাদের মতো পণ্ডিত নই; আপনি তো জানেন ফেলকরারা আর মূর্খরাই কবিতা লেখে; আর পয়সা? পয়সা খুবই সুন্দর, খুবই পবিত্র, পয়সা দেখতে আমার ফুলের থেকেও ভালো লাগে, আমি যদি বিশ্বাসী হতাম। তাহলে শুধু পয়সায়ই বিশ্বাস করতাম।

বৃদ্ধ বলেন, হ, বােঝছি, পয়সাই যদি চাইবেন তাইলে আর ক্যান কবিতা ল্যাখবেন, তাইলে ত ব্যবসাবাণিজ্যই করতেন।

হাসান হাসে, আপনি ঠিক বুঝেছেন, তবে আমি স্বপ্নে কিন্তু শুধু পয়সাই দেখি।

বৃদ্ধ বলেন, আপনারে আমার ভাল লাগতেছে, আপনে অন্য কবিগুলির মতন না। তারা আইসাই বিড়ি ধরায়, চা খাইতে চায়, দোকানো ছাপ ফালায়, আর বলে তাগো মতন কবি আর নাই। তয় আমার কাছে কবি হইতেছে মহাকবি কায়কোবাদ, আর কবি নাই, তার মতন ল্যাখেন ত ‘কে মোরে শোনাইল আজানের ধ্বনি, মর্মে মৰ্মে সেই সোর বাজিল কি সোমধুর, আকোল করিল প্ৰাণ নাচিল ধমনী’। ল্যাখেন ত এমন কবিতা, দেখুম কেমুন কবি আপনেরা।

প্রথম কবিতার বই ছাপার জন্যে গৃহীত হয়ে গেছে, চৌধুরী ব্রাদার্স গ্রহণ করেছে তার পাণ্ডুলিপি, হাসান কাঁপছে থরোথরো, দিনরাতগুলো তার স্বপ্নে ভরে গেছে। যন্ত্রণায় ভ’রে গেছে মধুরতায় ভ’রে গেছে। অ্যান্ড ২০০০-এর ডেস্কে বসে স্ক্রিপ্ট লিখতে লিখতে মনে হয় তাকে যেতে হবে নবাবপুরে আলেকজান্ড্রা প্রেসে, পবিত্রতম গন্তব্যে, তীর্থে, যেখানে অলৌকিক লাইনোতে ছাপা হচ্ছে তার কবিতার বই, লাইনো হচ্ছে কবিতা আর কবিতা হচ্ছে লাইনো, তাকে প্রুফ দেখতে হবে, প্রুফ দেখাটা তাকে শিখে নিতে হবে, আঙুল থেকে বের করতে হবে ওই চমৎকার ঐন্দ্রজালিক চিহ্নগুলো। সে গন্ধ পেতে থাকে নিউজপ্রিন্টের, তার বুক ভরে যায়, গোলাপের- যদিও সে ঠিক জানে না গোলাপের গন্ধ কেমন, কখনো ঘ্রাণ নেয় নি ওই প্রখ্যাত ফুলের— থেকেও অনেক অনেক সুগন্ধি ওই নিউজপ্রিন্ট, তা চোখের সামনে নক্ষত্রগুচ্ছের মতো জ্বলে ওঠে লাইনো পংক্তিমালা, ওই অপূর্ব অক্ষরে মুদ্রিত হয়ে তার তুচ্ছ গরিব বিষন্ন পংক্তিগুলো হয়ে উঠবে কবিতা, এই ভাবনা তাকে শিউরে দিতে থাকে।

একদিন গিয়ে দেখে কম্পোজ হচ্ছে তার কবিতা; চার পাতা কম্পোজ হয়েছে।

কম্পোজিটর তার হাতে চারটি পাতা দিয়ে কম্পোজ করতে থাকে, ঝনাৎ ঝনাৎ ক’রে ঝরতে পড়তে থাকে একেকটি পংক্তি, শব্দটাকে তার সিম্ফনির থেকে মধুর মনে হয়, ইচ্ছে হয় তাড়াতাড়ি পংক্তিগুলো তুলে দেখতে, কিন্তু সে কোনো কথা বলে না, সে দেখে তার লেখা কবিতা হচ্ছে, অমরতা পাচ্ছে।

একটি লোক এসে বলে, আপনে কি প্রুফ দ্যাখতে জানেন?

হাসান বলে, না।

লোকটি বলে, শিখ্‌খা লইয়েন, আবার সাত দিন পর আইয়েন।

বিকেলােভর কাঁপতে কাপতে কবিতাগুলো পড়তে পড়তে ওগুলোর রূপ বদলে গেছে দেখতে দেখতে সন্ধ্যার পর হাসান চার পাতার প্রুফ নিয়ে উপস্থিত হয় শেখ সাহেব বাজার রোডের রিকশাঅলা রেস্তোরাঁঁর আড্ডায়; দেখে জমজমাট আড্ডা চলছে, আর প্রুফ দেখে চলছে সালেহ ফরিদউদ্দিন ও আহমেদ মোস্তফা হায়দার।

সালেহ বলে, দোস্ত, তোমার বই না কি কম্পোজ শুরু হইয়া গ্যাছে?

হাসান বলে, হ্যাঁ, চার পাতা প্রুফ দিয়েছে।

মোস্তফা হায়দার জিজ্ঞেস করে, কয়টা কবিতা দিলা, কি কি কবিতা দিলা, দোস্ত? পলিটিকেল কবিতা কয়টা দিলা? পলিটিকেল কবিতা ছাড়া আইজকাইল কবি হঅন যায় না, দ্যাখছো না রাস্কেল বিভূতিভূষণটা থার্ড ক্লাস পলিটিকেল কবিতা লেইখ্যা পপোলার কবি হইয়া গ্যালো। ওই শালা কোনো কবি না, কিন্তু আইজাকাইল ওইটাই হইছে এক নম্বর কবি।

হাসান বলে, আশিটির মতো কবিতা দিয়েছি, কোনো পলিটিকেল কবিতা নেই, আমি তো অমন কবিতা লিখতে পারি না।

একটু থেমে হাসান বলে, বিভূতিভূষণ পপোলার হয়েই থাকবে, কোনো দিন কবি হবে না, সে আমাদের কবিয়াল।

মোস্তফা হায়দার বলে, তাইলে তুমি হইবা বালের কবি, যাও, দুই চাইরটা স্বাধীনতা, ফাদার অফ দি ন্যাশন, ড্যামোক্রেসি আর সোসিয়ালিজমের শ্লোগান ঢুকাই দেও, তাইলেই কবি হইবা।

হাসান বলে, আমি তা পারবো না তা তুমি জানো।

সালেহ জিজ্ঞেস করে, বই শুরু করলা কি কবিতা দিয়া আর শ্যাষ করলা কি কবিতা দিয়া? শুরু আর শ্যাষের কবিতা খুব ইস্পরটেন্ট, দোস্ত।

হাসান কয়েকটি কবিতার নাম বলে, এবং বলে, আমার শেষ কবিতাটির নাম ’হাসান রশিদ’।

গোলমালে তার কথা কেউ ভালোভাবে শুনতে পায় না ব’লেই মনে হয়; কিন্তু সালেহ ফরিদউদ্দিন তার দিকে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে, বিচলিত হয়, কথা বলে না, ঢকঢক ক’রে চা শেষ করে, সে হয়তো এখনই তার প্রুফগুচ্ছ বুকে নিয়ে কেঁদে উঠব; এবং একটু পরেই রেস্তোরাঁঁ থেকে বেরিয়ে যায়।

কয়েক দিন পর আবার হাসান যায় শেখ সাহেব বাজার রোডের রিকশাঅলা রেস্তোরাঁয়, যেটি তাকে এখন ডাকে, টানে, যার ধোঁয়া আর চিৎকার সুখকর মনে হয়। তার কাছে। আড্ডা চলছে, ধোঁয়া আর প্রচণ্ড শব্দ উঠছে, প্রুফ দেখে চলছে সালেহ ফরিদউদ্দিন ও আহমেদ মোস্তফা হায়দার।

সালেহ ফরিদউদ্দিন বলে, আসো, আসো, দোস্ত, আমার কবিতা শোনো; যা ল্যাখছি জবাব নাই, নতুন বড়ো কবি আসতে আছে দ্যাশে, জীবনানন্দের পর দোস্ত আমিই একলা কবি, তোমরা কবি হইতে পার নাই।

হাসান হাসে, এবং বলে, তুমি আবার ছােটােখাটাে জীবনানন্দ হয়ে উঠো না, সালেহ, বড়ো জীবনানন্দের পর ছোটাে জীবনানন্দকে খুব করুণ দেখাবে।

সালেহ বলে, আরো দোস্ত, অইটারেও আমি ছারাই যামু, দেইখ্যো।

হাসান বলে, আচ্ছা, শুনি তোমার কবিতা।

সালেহ বলে, আমার বহর প্রথম কবিতাটা বদল করছি, এখন প্রথম কবিতাটার নাম ‘সালেহ ফরিদ’, সেইটাই তোমারে শুনাই।

হাসান সালেহর কথা শুনে নিথর হয়ে যায়, এক অসীম ভারি কর্কশ স্তব্ধতা ভর করে তার ওপর। সে কোনো কথা বলতে পারে না; বলতে পারে না যে এ-নামে তোমার কোনো কবিতা ছিলো না, সালেহ, তুমি সেদিন আমার শেষ কবিতাটির নাম শুনে এ-কবিতা লিখেছে; সালেহ, তুমি এ-অভ্যাস ছাড়ো।

সালেহ করুণ কাতর স্বরে তার কবিতা পড়তে থাকে, হাসানের দিকে তাকাতে পারে না, হাসান তার বিব্রত স্বরে অপরাধবোধের কণ্ঠ শুনতে পায়। সালেহ একটি বিষন্ন অহমিকাপূর্ণ নার্সিসীয় কবিতা লিখেছে নিজেকে নিয়ে, তার স্বভাব অনুসারে বসিয়েছে নানা এলোমেলো বাক্য আর ছবি, সতেরো বছরের কুয়াশাচ্ছন্নরা পছন্দ করবে। এই কবিতা। সালেহর বই তো তার বইয়ের অনেক আগেই বেরিয়ে যাবে, সে কি তার শেষ কবিতাটি রাখবে বইয়ে? সবাই ভাববে না সে সালেহরা দেখাদেখি নিজেকে নিয়ে নিজের নামে লিখেছে কবিতাটি? আর তার কবিতাটি তো সহজে পাঠকের ভেতরেও ঢুকবে না; সে কোনো কাতর হাহাকার করে নি, বিষগ্ন অহমিকা দেখায় নি, সে লিখেছে একটি সময়ের আন্তর ইতিহাস।

আড্ডাটি তার চোখে ময়লা ঘোলাটে হয়ে ওঠে।

হাসান উঠে পড়ে আড্ডা থেকে, সে বাদ দেবে তার কবিতাটি বই থেকে।

হাসান একটি সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে থাকে, রাস্তার মানুষ আর যানবাহনকে তার ধূসর অপরিচিত মনে হয়,–সে বাদ দেবে তার কবিতাটি বই থেকে?

বাদ দেয়াই উচিত, বাদ তাকে দিতেই হবে, ওই কবিতাটিকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে হবে, যেনো ওটি কখনো লেখা হয় নি।

কেনো বাদ দেবে তার কবিতাটি? কেনো মুছে ফেলবে? অনেক খেটে সে লিখেছে কবিতাটি।

কবিতাটি আমার প্রিয় ছিলো, আজ থেকে আমি আর ওটি পড়তে পারবো না। সে হাঁটতে হাঁটতে নিজের সাথে কথা বলতে থাকে। কোনো আমি আমার কবিতার নাম ওদের বলতে গেলাম?

না, কবিতাটি থাকবে, যদিও ওটি আমার প্রিয় থাকবে না।

আমার জন্যে আর আড্ডা নয়, আমার জন্যে নিঃসঙ্গতা, আমার জন্যে একলা জীবন, আমার জন্যে শুধু কবিতা, আমার জন্যে ব্যর্থতা, আমার জন্যে দণ্ড।

হাসানের কবিতাগুলো কম্পোজ হতে থাকে, ধীরে ধীরে, মাসের পর মাস কেটে যেতে থাকে, সে প্রুফ দেখতে থাকে, আলেকজান্ড্রা প্রেসে যেতে থাকে, ফিরে আসতে থাকে, নিউজপ্রিন্টের গন্ধে তার বুক ভরে যেতে থাকে।

এর মাঝে আরেকটি আলোচনা অনুষ্ঠানে, আকস্মিকভাবেই, অংশ নিতে হয় তাকে। পঞ্চাশের এক কবির কাব্যসংগ্ৰহ বেরিয়েছে, তার প্রকাশনা উৎসব হবে, আয়োজকদের একজন তাকে অনুরোধ করে ওই উৎসবে সংগ্রহটি আলোচনা করার জন্যে। সে কি সম্মত হবে? হাসান প্রথম সম্মত হয় না, ওই কবিকে সে ঠিক কবি মনে করে না,–এই দেশে এমদাদ আলিও কবি বেগম রোকেয়াও কবি কাদের নওয়াজও কবি–,তাঁর কবিতার বিশেষ মূল্য নেই ব’লেই তার মনে হয়, সে প্রকাশনা উৎসবে তার কবিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে পারবে না, তাই তার তাতে না থাকাই ভালো। প্রকাশনা উৎসবের জন্যে দেশে খান জামান চৌধুরী মোল্লারা উল্লারা আছেন, তারা সব কিছুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করার বিনম্র উদার প্রতিভা নিয়েই জন্ম নিয়েছেন, কোনো কিছুই মূল্যহীন নয় তাদের কাছে, ছাইয়ের ভেতরে তাঁরা সব সময় অমূল্য রতন পেয়ে ধন্য হন, সব ছোটাে বড়ো পংক্তিই তাঁদের কাছে মহৎ কবিতা, প্ৰতিগণ্ডা পংক্তিই উদ্ধৃতিযোগ্য তাদের কাছে, ওই মহৎ মৌলভিদের দিয়েই প্রকাশনা উৎসবের মতো বিবাহানুষ্ঠান সম্পন্ন করা ভালো। বিবাহোৎসবে বর যতোই অযোগ্য কুৎসিত হোক সে-ই নরোত্তম, প্রকাশনা উৎসবে কবিমাত্রই বড়ো কবি। সে কি থাকবে ওই উৎসবে? উচ্ছ্বসিত স্তব করবে ওই কবির? তাঁর নিকৃষ্ট পদ্যের? তার থাকা ঠিক হবে না, সে আয়োজকদের জানিয়ে দেয়; কিন্তু তাকে থাকতেই হয়, কবি নিজে তার বক্তব্য শুনতে চান।

কবি নিজে তার বক্তব্য শুনতে চান? এটা আরো বিব্রতকর তার কাছে। ওই কবির সাথে তার দু-একবার দেখা হয়েছে, তিনি লোক ভালো, তার কবিতার প্রশংসা করেছেন তিনি, নিজের কবিতা সম্পর্কেও জানতে চেয়েছেন; কিন্তু লোক ভালো হ’লেই কবি ভালো হয় না; ভালো লোকেরা সাধারণত জঘন্য খারাপ কবি হয়। ভালো লোকদের কবিতা লেখা অনুচিত, তাদের উচিত বিয়ে সংসার ক’রে বাচ্চার পর বাচ্চা জন্ম দেয়া, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শাশুড়িকে মা ব’লে সালাম করা।

প্রকাশনা উৎসব স্তব আর উচ্ছাসে মুখর হয়ে ওঠে।

এক আলোচক বলেন, এটা এক মহৎ কাব্যসংগ্ৰহ, এই কবির কবিতা চিরকালীনতা লাভ করেছে, তিনি বাঙলা ভাষার এক প্রধান কবি।

আরেক আলোচক বলেন, আধুনিক কবিতার ধারায় তিনি শুধু এক প্রধান কবিই নন, তিনি তিরিশের নষ্ট আধুনিকতা ত্যাগ ক’রে আধুনিক বাঙলা কবিতাকে পাশ্চাত্য থেকে ঘরে ফিরিয়ে এনেছেন; তার কবিতায় দ্যাশের মাটির গন্ধ পাওয়া যায়, তাঁর কবিতায় ঘাসের গন্ধ পাওয়া যায়।

হাসানকে যখন ডাকা হয় সে স্থিরভাবে মাইক্রোফোনের দিকে যায়, কিন্তু ভেতরে একটা তীব্র কম্পন অনুভব করে;–তাকেও বলতে হবে একরাশ মিথ্যে, উচ্চারণ করতে হবে নিরর্থক স্তবস্তুতি? যা কবিতা হয় নি, তা উদ্ধৃত ক’রে বলতে হবে এগুলো আধুনিক ও শাশ্বত?

সে জানে না সে কী ব’লে ফেলবে। ঠিক আছে সে মিথ্যে কথাই বলবে; কবি নিজে বসে আছেন মঞ্চে, তিনি মিথ্যে শুনে সুখী হবেন, মিথ্যে সাধারণত সুখকর; তাতে বাঙলা কবিতার কিছু যাবে আসবে না, হাজার বছর ধ’রেই তো কতো বাজে পদ্যে ভ’রে আছে বাঙলা কবিতার নদী? সরোবর? পুকুর? গোলা? ডোল? ঈশ্বরগুপ্ত রঙ্গলাল কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার কায়কোবাদ এমদাদ আলি বন্দে আলি বাজে পদ্য লিখেছেন ব’লে কার কী ক্ষতি হয়েছে?

কিন্তু সে কথা বলতে গিয়ে দেখে সে মিথ্যে বলতে পারছে না; ওই কবির কবিতা মনোযোগের সাথে প’ড়ে তার যা মনে হয়েছে, তাই বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে তার ভেতর থেকে। ওই কবির তো কবিতাই লেখা ঠিক হয় নি। ভালো পিতা আর শ্বশুর হিশেবে জীবন কাটিয়ে গেলেই ভালো করতেন তিনি।

হাসান বলে, কাব্যসংগ্ৰহ প্রকাশ এক সুখকর আনন্দদায়ক ঘটনা, তার কবিতার সংগ্ৰহ প্রকাশে কবি আনন্দিত, আমরাও সবাই আনন্দিত। তিনি এ-বয়সে যে পাঁচশো কবিতা লিখেছেন, তার জন্যে তাকে আমি অভিনন্দন জানাই।

হাসান বলে, কবিতা লেখা সকলের জন্যে জরুরি নয়, কারো কারো জন্যে জরুরি; কিন্তু পৃথিবীতে তারাই কবিতা লিখতে বেশি উদ্যোগী হয়, যারা অন্য কিছু করলেই ভালো হতো কবিতার জন্যে, এবং তাদের জন্যে।

হাসান বলে, আধুনিকতা বাঙালি মুসলমানের কাছে বড়ো ধাঁধা, মুসলমানের পক্ষে আধুনিক হওয়া প্রায় অসম্ভব, শিল্পকলা বোঝাও কঠিন।

হাসান লক্ষ্য করে চারদিকে একটা অস্বস্তিকর স্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে।

হাসান বলে, বাঙালি মুসলমান পঞ্চাশের দশকে আধুনিক হয়ে উঠতে পারে নি, কবিরাও প্রকৃত আধুনিক হয়ে উঠতে পারেন নি। আজ যার কবিতা আমরা আলোচনা করছি, তার কবিতায় আধুনিক চেতনার থেকে অনাধুনিক ইসলামি ও লৌকিক চেতনাই বেশি পাই। আমার মনে হয় তাঁর লেখা কবিতাও হয়ে উঠেছে খুবই কম। তাঁর কৃতিত্ব উৎকৃষ্ট কবিতা সৃষ্টির নয়, তাঁর কৃতিত্ব তিনি বাঙালি মুসলমানের কবিতার ধারাটিকে শুকিয়ে যেতে দেন নি, নিজেকে উৎসর্গ ক’রে তিনি পরবর্তীদের জন্যে কবিতার স্রোতকে অবারিত রেখেছেন।

আরো খোলাখুলিভাবে একথাগুলো তার বলতে ইচ্ছে করছিলো; কিন্তু কবির কথা মনে রেখে একটু রেখেঢেকেই বলার চেষ্টা করছিলো হাসান।

মঞ্চে তখন চিৎকার শুরু হয়ে যায়, কবি নিজে চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম করেন, আর আয়োজনকারীদের একদল হৈচৈ ক’রে হাসানের সামনে থেকে মাইক্রোফোন টেনে নেয়, তার হাত থেকে কাব্যসংগ্রহটি কেড়ে নেয়। হাসান আস্তে আস্তে মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসে।

এক আয়োজনকারী তাকে আটকে বলে, এইসব বলার জাইন্যে আপনেরে আমরা ডাকছি নি? আপনে কবিতার এইটা বোঝেন।

হাসান বলে, আমি যা বুঝি তাই বলতে চেয়েছি।

আরেক আয়োজনকারী বলে, আপনের মোখ ভাইঙ্গা দেঅন দরকার।

হাসান সভাকক্ষ থেকে ধীরেধীরে বেরিয়ে আসে, এবং দেখতে পায় তার পেছনে পেছনে বেরিয়ে আসছে শ্রোতাদের অনেকে।

এক তরুণ দৌড়ে এসে একটি খাতা খুলে বলে, একটি অটােগ্রাফ দিন। হাসান এক নতুন চাঞ্চল্য বোধ করে; এবং বলে, না, না, আমি এখনো অটােগ্রাফ দেয়ার উপযুক্ত হই নি।

তরুণটি তার খাতা বাড়িয়ে ধ’রে থাকে।

হাসান তার খাতাটি নিয়ে স্বাক্ষর দেয়, এবং নিচে একটি ধারালো দাগ দিয়ে দুটি ফোঁটা দেয়।

 

নতুন কাল এই প্রথম তার স্বাক্ষর চায়, নতুন সময়কে সে এই প্রথম স্বাক্ষর দেয়। এই শুরু; নতুন কাল তার দিকে শূন্যপৃষ্ঠা তুলে ধরতে শুরু করেছে।

তরুণটি জিজ্ঞেস করে, এই রেখা ও ফোটা দুটির কী অৰ্থ?

হাসান তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কোনো অর্থ নেই।

তরুণটি বলে, না, নিশ্চয়ই অর্থ আছে, আমাকে বলুন।

হাসান হেসে বলে, এটি তরবারি, যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি।

রাতে ঘরে ফিরে গিয়ে ওই কবির জন্যে তার খুব কষ্ট হয়, ভারি একটা যন্ত্রণা তাকে চেপে ধরে, ইচ্ছে হয় মাইল মাইল মাইল হেঁটে হেঁটে হেঁটে পা ক্ষতবিক্ষত ক’রে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে নদী পেরিয়ে তাঁর সামনে গিয়ে মাটিতে মাথা নিচু ক’রে বসে থাকে সারারাত। তার মুখে কোনো কথা আসবে না, মাটিতে বসে থেকেই সে কবিকে জানাবে তার অশেষ বেদনা। ওই কবি ব্যর্থ, তার কোনো কবিতাই সম্পূর্ণ কবিতা হয়ে ওঠে নি, কিন্তু তিনি তো কবিতার জন্যে ব্যয় করেছেন সারাটি জীবন। কবির কী আছে হৃদয়ের একগুচ্ছ খড়কুটাে ছাড়া? ওই খড়ে আগুন? লাগলে ছাই হয়ে যায় মহাজগত, আবার শিশির জমলে মহাজগত জুড়ে ফোটে শিউলি কামিনী রক্তজবা। অন্য কিছুর জন্যে এভাবে জীবন ব্যয় করলে পার্থিব সোনায় তাঁর সব কিছু ভ’রে উঠতো, কখনো এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না। তিনিও তো দণ্ডিত, প্রতিটি মুহূর্ত তিনি দণ্ড ভোগ করেছেন, জেগে থেকেছেন অজস্র রাত্রি, শুধু স্বপ্ন দেখছেন, ব্যর্থতার আগুনে পুড়েছেন, যেমন সে জেগে থাকছে রাতের পর রাত, স্বপ্ন দেখছে, স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছে। তারাও তো বেরোতে যাচ্ছে প্রথম কাব্যগ্রন্থ, তার বই নিয়ে যে উল্লাসে মেতে উঠবে না। শহর, এটা সে জানে; অনেক আক্রমণ আসবে, তার কবিতাকে হয়তো ছিঁড়ে ফেড়ে ফেলবে অনেকে, হয়তো তার উৎকৃষ্টতম চিত্রকল্পটি দেখিয়ে বলবে এটা কিছুই হয় নি, এটা কষ্টকল্পনা। কবিতা তো মেপে দেখানো যায় না, কবিতাকে তো নম্বর দেয়ার কোনো উপায় নেই। সময়ই বিচার করবে। কবিতা, এসব যদিও বলা হয়, তবু মানুষই বিচারক, এবং সব সময়ই মনস্বী বিচারকের খুবই অভাব, তুচ্ছদের বিচারই মেনে নিতে হয় যুগ যুগ। হাসান যন্ত্রণা বোধ করতে থাকে, ওই কবির জন্যে যন্ত্রণাটি রাতের গভীরতার সাথে সাথে পরিণত হয় নিজের জন্যে গভীর যন্ত্রণায়।

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি বেরোতে আরো সময় লাগে, প্রুফে প্রচ্ছদে বাঁধাইয়ে আরো আট মাস কেটে যায়। কিন্তু সে কখনো উত্তেজিত হয় নি;— হবে, বেরোবে, সে মনে করেছে; এই যে দেরি হচ্ছে এটাকে সে উপভোগ করেছে প্রতিটি মুহূর্ত। একদিন চৌধুরী ব্ৰাদার্সে গিয়ে দেখে তার বই বাঁধাই হয়ে এসেছে, শেল্‌ফে জায়গা ক’রে নিয়েছে, বইটি বিব্রত বোধ করছে না; সে চঞ্চলতা বোধ করে, তার বইয়ের দিকে হাত বাড়াতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু সাহস হয় না। লাইনোতে ছাপা হয়ে যা বাঁধাই হয়ে এলো, শেল্‌ফে যা স্থান ক’রে নিলো, যার প্রচ্ছদে তার নাম মুদ্রিত, সেগুলো কী? কবিতা? গুরুত্বপূর্ণ? উল্লেখযোগ্য? নতুন?

শাজাহান চৌধুরী একটি বই তার হাতে দিয়ে বলে, দেখুন, খুব সুন্দর হয়েছে।

বইটি হাতে নিতে গিয়ে সে শিউরে ওঠে, তার রক্ত নিঃশব্দে বলতে থাকে, একাব্য আমার, এর পংক্তি আর স্তবকগুলো আমার সৃষ্টি, আমার ভেতর থেকে এগুলো উৎসারিত হয়েছে, হয়তো এগুলো ব্যর্থ হয়তো সফল; এ-বই সাড়া জাগিয়ে চারদিকে আলোড়ন তুলে দেখা দেবে না, কিন্তু নিঃশব্দে ঢুকবে সময়ের বুকের ভেতরে।

হাসান হেসে বলে, বইটি ছুঁয়ে সুখ পাচ্ছি, আমিও হয়তো কবি হ’তে যাচ্ছি। শাজাহান চৌধুরী বলে, আমি কবিতা ছাপি কিন্তু আমি কবিতা বুঝি না, তবে আমি বুঝি আপনি কবি, অন্যদের থেকে অনেক ভিন্ন।

হাসান জিজ্ঞেস করে, এজন্যে আমাকে খারাপ লাগে আপনার?

শাজাহান চৌধুরী বলে, কী যে বলেন কী যে বলেন, আব্বাও আপনাকে পছন্দ করে, সবচেয়ে পছন্দ করে।

চা খেতে হলো, অনেকক্ষণ বসতে হলো, ব’সে ব’সে সুখ পেতে হলো। হাসান বলে, আমাকে কয়েকটি বই দেবেন?

শাজাহান বলে, এজ পাঁচটি নিন, পরে আরো বিশটি পাবেন।

বইগুলো একটি মোড়কে ঢুকিয়ে, যেনো কেউ দেখতে না পায়, হাসান বেরিয়ে পড়ে। তার মনে হয়। এ-মোড়কের ভেতরে এমন সোনা আছে, যা দেখানো যাবে না কাউকে; কিন্তু রিকশায় উঠে একবার মনে হয় একটি বই খুলে দেখি, টেনে বের করে একটি বই, পরমুহূর্তেই বইটি ঢুকিয়ে রাখে মোড়কে। যদি কেউ দেখে ফেলে তার বই বেরিয়েছে, তাহলে সে খুব বিব্রত বোধ করবে। অ্যান্ড ২০০০–এ পৌঁছে সে বইগুলো যত্ন ক’রে রেখে দেয় ড্রয়ারে, যেনো কেউ দেখতে না পায়। সে প্রকাশিত হয়েছে, সে প্রকাশিত কাব্যের কবি, এটা তাকে শিউরে দিতে থাকে, এটা তাকে হঠাৎ চুমো খাওয়া তরুণীর মতো সুখী বিব্রত স্বপ্নগ্ৰস্ত ক’রে তোলে।

সে নিজের সাথে, একটি সিগারেট ধরিয়ে, কথা বলতে থাকে।

হাসান, তুমি কেনো বিব্রত বোধ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ নিয়ে? তুমি এর জন্যে মাসের পর মাস ব্যাকুল হয়ে ছিলে না, যেমন প্রেমিক থাকে প্রেমিকার জন্যে? তোমার তো এখন উচিত উল্লাসে ফেটে পড়া, চারদিক মাতিয়ে তোলা, যেমন প্রেমিকাকে পেলে মত্ত হয়ে ওঠে প্রেমিকের রক্তমাংস।

তোমার তো উচিত এখন সুখে আনন্দে খানখান হয়ে ডেস্ক থেকে ডেস্কে যাওয়া, সবাইকে বই দেখানো, কিন্তু তুমি যাচ্ছো না কেনো?

আজ সন্ধ্যায় আড্ডায় গিয়ে তুমি সবাইকে দেখাবে তোমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ, সালেহ আর মোস্তফা হায়দার যেমন বই নিয়ে ছুটছিলো। তুমিও তেমন ছুটবে।

ছুটিতে হয়, নইলে হয় না; বই গোপন বস্তু নয়, তা সবাইকে জানানোর জন্যে।

কবিতার জন্যেও ফিল্ড ওয়ার্ক দরকার হয়, হাসান, সবাই করে।

না, থাক, কয়েক দিন আমার বই একান্ত আমার হয়ে থাক; তারপর দেখাবো।

দেখাতে গিয়ে তুমি বিব্রত হয়ে না, হাসান।

সন্ধ্যায়, অন্যান্য দিনের থেকে অনেক আগে–আজ কেনো এতো আগে ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হলো, আপাদমস্তক বিশুদ্ধ আমহাজগত একলা হ’তে ইচ্ছে হলো ব’লে?—, ঘরে ফিরে হাসানের মনে হয় সূচনা হলো এক নতুন সময়ের, আর কারো কাছে নয় হয়তো, কিন্তু তার কাছে। ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে, কে পড়তে পারে ভবিষ্যতের শাদা পৃষ্ঠা? বহু দিন পর সে মুগ্ধ হচ্ছে, একটা কিছুর দিকে সে তাকিয়ে থাকতে পারছে— ‘সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সে কখনো তাকিয়ে থাকে প্রচ্ছদের দিকে— সুদূর নক্ষত্রের মতো অচেনা লাগে নিজের নামটি,–নাম, ওরে নাম, তোর জন্যেই কি এই নিরন্তর জাগরণ?–, সূচিপত্রের ওপর চোখ বোলাতে থাকে কখনো, একটি শিশু একটি কিশোর জেগে ওঠে তার ভেতরে, পুকুরে সাঁতার কাটতে থাকে, হিজলের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে, হঠাৎ বর্ষায় খলখল করছে মাঠ, উল্টেপাল্টে বারবার সে পড়ে কবিতাগুলো- এগুলো আমি লিখেছি? আমি লিখেছি? ন্যাংটাে সাঁতার কাটতো যে একদিন, সে লিখেছে? হিজলের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতো যে হাফপ্যান্ট প’রে, সে লিখেছে?–কখনো একটি দুটি মুদ্রণক্রটি তাকে কষ্ট দেয়। একটি কবিতায় ‘অন্ধ’ হয়ে গেছে ‘অন্য’, আরেকটিতে ‘নিশ্বাস’ হয়ে আছে ‘বিশ্বাস’–শব্দ দুটির ওপরই দাঁড়িয়ে ছিলো কবিতা দুটি অনেকটা, ভুল ছাপা হয়ে কবিতা দুটি যেনো কুঁড়েঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। পাঠক কি বুঝবে কী ছিলো এখানে? একটি কবিতা থেকে বাদ প’ড়ে গেছে একটি চাবিশব্দ। হায়!

আমার পংক্তিগুচ্ছ স্তবকমালা আমার কবিতা
জানি না তোমরা কবিতা কি না সত্যিই জানি না
জানি না তোমরা কী শুধু জানি তোমরা আমার সত্তা
তোমরা জন্মেছো আমার রক্ত থেকে মাংস থেকে আমার ক্ষুধা থেকে
স্বপ্ন থেকে আমার ব্যর্থতা থেকে সুখ থেকে দুঃস্বপ্ন থেকে
আমার প্রেম থেকে কাম থেকে আমার নিদ্রা থেকে অনিদ্রা থেকে আমার শৈশব থেকে উঠে এসেছে আমার যৌবন থেকে দল মেলেছো
যখন ঝড়ে ভাঙাচোরা খড়ের ঘরের মতো প’ড়ে থেকেছি
তখন তোমরা জন্মেছো যখন অনন্ত নীলিমায় ঝড়ে বজে বিদ্যুতে উড়েছি
একলা তখন তোমরা বিকশিত হয়েছো
তোমাদের পেয়েছি আমি হঠাৎ রাস্তায় পেয়েছি জনতাদূষিত রাজপথে
যখন নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থেকেছি
তোমাদের পেয়েছি ট্রাকের চাকার নিচে যখন রঙিন প্রজাপতির মতো প’ড়ে থেকেছে কোনো রিকশা
পেয়েছি যখন আমার চোখের সামনে দুলে উঠেছে
যমজ ভগিনীর মতো কোনো তরুণীর উদ্ধত স্তনযুগল
তোমাদের পেয়েছি যখন গাছের সবুজ গ’লে গ’লে ঝরেছে আমার চুলে
সবুজ হয়ে উঠেছে আমার চুল আমার মুখ আমার চোখ
তোমাদের মধ্যে আছি আমিই তোমরা আমিই
তোমরা অামারই শিল্পরূপ
সীমাহীন অতল অন্ধকারে তোমরা অন্য অন্ধকার
এই তো শুরু, এই তো ব্যর্থতার বুলি কাঁধে মহাকালের দিকে যাত্রা।
এই তো শুরু, পিছল মাটির ওপর দিয়ে অচেনা ভুবনের দিকে যাত্রা।
এই তো শুরু, নিষ্ঠুর রক্তপিপাসু শিখরের দিকে অবিরাম আরোহণ।
এই তো শুরু, এই তো শুরু, এই তো শুরু …

আলাউদ্দিনই তো হবে প্রথম অভ্যর্থনাকারী, বই পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে আলাউদ্দিন, দোস্ত, তুমি তা জানো তোমারে লইয়া দ্যাশ পাগল হইয়া ওঠবো না, তুমি তো কোনো লড়কে লেঙ্গে ল্যাখো নাই, কিন্তু এই কবিতা বুঝাই দিছে তুমি বড় কবি হইবা।

হাসান হেসে বলে, তার মানে আমার সামনে ভয়াবহ ভবিষ্যৎ?

আলাউদ্দিন হাসতে হাসতে বলে, আমার সেইটাই মনে হয়, দোস্ত।

হাসান ভয় পায়; সে ভেবেছিলো আলাউদ্দিন প্রতিবাদ করবে, কিন্তু আলাউদ্দিন প্রতিবাদ না ক’রে তাকে সমর্থনা করে।

কেঁপে ওঠে হাসান, সত্যিই আমার সামনে ভয়াবহ ভবিষ্যৎ?

আড্ডায়ও বই নিয়ে যায় সে একদিন; বিব্রতভাবে বই দেখায়, সবাই বই দেখে প্রচ্ছদের আর ছাপার প্রশংসা করে, প্রচুর চা ও সিগারেট সমাপ্ত হয়, কিন্তু কবিতা সম্পর্কে কিছু বলে না।

কয়েকটি পত্রিকায় আলোচনার জন্যে সে বই পৌঁছে দেয়।

প্রত্যেক সম্পাদক বলেন, কাউকে দিয়ে আলোচনা লিখিয়ে আনুন, ভালো আলোচনা।

সে কাকে দিয়ে লিখিয়ে আনবে তার প্রশংসা?

হাসান বলে, লিখিয়ে আনা প্রশংসা আমার ভালো লাগবে না।

পারলে কাউকে দিয়া আলোচনা করাবেন, ভালো লাগবে, অচেনা আলোচনাই আমি চাই।

এক সম্পাদক বলেন, অচেনা কাউকে দিলে গালাগালির সম্ভাবনাই বেশি, আমরা কেউ কারো প্ৰশংসা করি না, ভালো জিনিশের তো করিই না।

হাসান হেসে বলে, গালাগালি প্ৰাপ্য হ’লে তাই চাই।

একজন বলেন, আপনার কোনো শিক্ষককে দিয়ে একটা আলোচনা লিখিয়ে আনুন, শিক্ষকের প্রশংসাপত্র কাজে লাগবে।

হাসান বলে, আমার তো কোনো শিক্ষক নেই।

বেশ কয়েক মাস ধ’রে হাসান উপভোগ করতে থাকে প্রচুর তিরস্কার ও সামান্য প্রশংসা; সে ভরে উঠতে থাকে ওই তিরস্কারে ও প্রশংসায়–তার আরেকটি জীবন শুরু হয়ে গেছে, ক-শতাব্দী ধ’রে এটা চলবে? তার ভেতরের খড়কুটােও পুড়তে শুরু করেছে, শিশিরে ভিজতে শুরু করেছে। নিরন্তর শীতল আগুনে পোড়া আর গনগনে শিশিরে ভেজা, এই তো কবির জীবন। তিরস্কার তার খারাপ লাগে না, ওগুলো প’ড়ে সে মনে মনে হো হো হাসে, রক্তে একটু বিষ ছড়িয়ে পড়ে, বিষ তো ছড়িয়ে পড়বেই, এমন কোন কবি আছে যার রক্তনালিতে হৃৎপিণ্ডে রক্তের থেকে বিষের পরিমাণ বেশি নয়, ফুসফুসে বাতাসের থেকে বিষপ্রবাহ অবিরাম নয়? কাহ্নপাদের রক্ত? মধুসূদনের রক্ত? বিহারীলালের রক্ত? ওতে বিষ বেশি না রক্ত বেশি? রবীন্দ্রনাথের রক্ত? জীবনানন্দের রক্ত? বুদ্ধদেবের রক্ত? সুধীন্দ্রনাথের রক্ত? ওতে বিষ বেশি না রক্ত বেশি? ওদের ফুসফুসে বাতাস বেশি না বিষকণিকা বেশি? আর সে তো সামান্য, তাই বিষকেই সুধায় পরিণত করতে হবে তার। সুধা? কোন কবি কবে তা পেয়েছে? তার সামনে বিষের পেয়ালা, কবিকে অনবরত পান করতে হয় বিষ, মৃত্যুময় গরল।

এই গরল সে পান ক’রে আসছে কতো দিন হলো? এক যুগ? দেড় যুগ?

পাঁচতলা থেকে হাসান তাকায় দক্ষিণের প্রসারিত ব্যাপ্ত আকাশচুম্বী মলস্তূপের দিকে। পৌরসভা নতুন সভ্যতা গড়ার জন্যে জমিয়ে তুলছে বর্তমান আবর্জনার পাহাড়; এই মলস্তূপ থেকে একটি একটি ক’রে উঠে এসেছে তার অনেক কবিতা। আরো আসবে। মলস্তূপের পাশে বস্তির শুয়োরগুলোকে তার মনে পড়ে, কী করুণ বিষগ্ন গরিব শুয়োর। মানুষও ওদেরই মতো, সেও কি ওগুলোরই সহোদর?

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x