(৩)
রাতভর কি তুমি অন্ধকার অপবিত্র অপরাধ করেছে, হাসান? নিজেকে সে জিজ্ঞেস করে। তোমার কি মনে হচ্ছে অপরাধ করেছাে তুমি? অপবিত্ৰ দূষিত পাপী তুমি? না, আমার তা মনে হয় না; হাসান, তুমি যা করেছে, তা পবিত্ৰ শুদ্ধ, সন্তরা ওই শুদ্ধতার ছোঁয়া পাবে না কখনো। তুমি কি ক্লান্তি বোধ করছো? না। ক্লান্তি আর কিছু নয়, অন্ধকার অপরাধবোধ; যদি তুমি ক্লান্তি বোধ করতে, এই আশ্চর্য নদী নৌকো পাল নোঙর শ্রাবণের রাতটি যদি ভোরবেলা চেপে ধরতো তোমাকে, তাহলে বুঝতে হবে তুমি সারারাত পবিত্ৰ শুদ্ধতায় ছিলে না, ছিলে অপবিত্র অপরাধবোধের মধ্যে; মাংস তাহলে হতো তোমার কাছে পুরোনো গ্রন্থের পাপ, রক্ত হতো তোমার কাছে আদিম অপরাধ; মানুষের মাংস রক্ত কখনো অশুদ্ধ হয় না অপবিত্র হয় না। মাংস রক্ত নিয়ত পবিত্র নিয়ত বিশুদ্ধ।
কয়েক দিন সে আর আড্ডায় যায় না, মনে হয় বাচালতায় আবর্জনায় গিয়ে সে। ডুবে যাবে, মাথা আর বুকে পঙ্ক জমবে; সে ঘর থেকে বেরোয় শুধুই বিকেলে, একা একা পথে পথে হাঁটে, মানুষের মুখের দিকে তাকায়, পথে-পথে একটি-দুটি কবিতার পংক্তি পায়, ঘরে ফিরে আসে, এবং পংক্তিগুলোকে কবিতায় পরিণত ক’রে ক’রে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়।
কবিতাগুলো তার কাছে বিস্ময়কর আসতে থাকে।
একটি পংক্তি হয়তো সে পেয়েছে গুলিস্থানের মোড়ে দাঁড়িয়ে, পংক্তিটি মাথায় নিয়ে হাঁটছে, আর কোনো পংক্তি আসছে না, আটকে গেছে মাথায়।
ঘরে ফিরে এসে পংক্তিটিকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েও সে কবিতায় পরিণত করতে পারছে না; কিন্তু তখন অন্য একটি পংক্তি আসছে, অবলীলায় কবিতা হয়ে উঠছে, খাতার পাতাটির দিকে তাকিয়ে থাকছে সে অনেকক্ষণ’।
কবিতা কি এলোমেলো পাগল পংক্তির সমষ্টি, নিরর্থ প্ৰলাপ? হঠাৎ গুনগুনিয়ে উঠলো। যে-পংক্তিটি, যেটি মুগ্ধ করলে আমাকে, সেটির সাথে আরো কয়েকটি ময়লা। পংক্তি জুড়ে দেবো আমি?
না। কবিতা এলোমেলো পাগল পংক্তির সমষ্টি নয়। কবি পাগল হ’তে পারে, বদ্ধ পাগল, কিনতি কবিতা পাগল হবে না, কবিতা ধাঁধা নয়।
কবিতা হবে সম্পূর্ণ কবিতা, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কবিতা, আমি সম্পূর্ণ কবিতা চাই, সম্পূর্ণ কবিতা লিখতে চাই।
কবিতা হবে অভাবিত প্রগাঢ় চিত্রকল্পমালা, চিত্রকল্পের অগ্লোৎসব।
একটি একটি ক’রে অবলীলায় ও সংশোধন ও সংশোধন ক’রে এবং অবলীলায় কয়েক দিনের মধ্যে সে একগুচ্ছ সম্পূর্ণ কবিতা লিখে ফেলে।
তোমাদের কোনাে মূল্য নেই, তোমরা সাবান টুথপেস্ট নও চটি জুতো আন্ডারওয়ার নও কয়লার টুকরো পাউরুটি নও ধানের গুচ্ছ নও, তোমাদের কোনাে দাম নেই, তবে আমার কাছে তোমরা মূল্যবান। হাসান মনে মনে বলে।
কয়েক দিনে ধরেই হাসানের মনে পড়ছে আলাউদ্দিন রেহমানকে, যে তাকে প্রথম অনুপ্রাণিত করেছিলো নিজেকে ভাঙতে, সে মােহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার থেকে হয়ে উঠেছিল হাসান রসিদ। আলাউদ্দিন রেহমান, যে ঝকঝকে কথা বলতো সিগারেট টানতে টানতে চায়ের কাপ ঠোঁটে লাগাতে লাগাতে, দু-একটি ঝকঝকে কবিতাও– কবিতার পংক্তিও লিখেছিলো, অধ্যাপক আহমদ আলির সাথে গোলমালের ফলে যে তৃতীয় শ্রেণী পেয়েছিলো, তাকে আর কবিতার আড্ডায় পাওয়া যায় না, মাঝেমাঝে শুধু তার নাম ওঠে ঝ’রে পড়া পাতার মতো; সে এখন অ্যাড গার্মেন্টস ইন্ডেন্টিং, সে আর কবিতা লেখে না। তার ঝকঝকে কালো রঙ আর থলথলে স্বাস্থ্য ঝিলিক দেয় হাসানের চোখে। তার টেলিফোন নম্বরটিও জোগাড় করেছে হাসান, কিন্তু টেলিফোন করা হয় নি; টেলিফোন করার কথা মনে হ’লেই কষ্ট লাগে, আলাউদ্দিন শক্তি আর কবিতা লেখে না, কবিতার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই, তাকে আর টেলিফোন করা হয় না।
একদিন হাসান তাকে টেলিফোন করে।
আলাউদ্দিনকে পেতে বেশ কষ্ট হয়–প্রথম একটি মেয়ে টেলিফোন ধরে, তাকে নিজের নাম বলতে হয়;–টেলিফোনে কেউ তার নাম জিজ্ঞেস করলেই সে অস্বস্তি বােধ করে, নিজের নামটা বলার সময় তার মনে হয় সে যেনাে সকলের পায়ের নিচে প’ড়ে গেছে, হঠাৎ তুচ্ছতম হয়ে গেছে, তার কোনাে নামপরিচয় নেই, অনেকক্ষণ ঠিক করতে পারে না সে কী বলবে–সে কি বলবে ‘আমি হাসান রশিদ’, নাকি বলবে ‘আমার নাম হাসান রশিদ’, ঠিক করতে পারে না সে; এক সময় সে বলে, ;আমার নাম হাসান রশিদ’, তারপর তাকে পাঁচ মিনিট ধরে শুনতে হয় গানবাদ্য, তারপর জানতে হয় স্যার আরেকটি টেলিফোনে কথা বলছেন, এবং শেষে সে আলাউদ্দিনকে পায়। এভাবে পেয়ে হাসান বুঝতে পারে আলাউদ্দিন রেহমান কেনো কবিতার থেকে দূরে আছে।
কিন্তু না, আলাউদ্দিন আগের মতোই আছে; তার কণ্ঠস্বর তাই বলে। তার থেকে আলাউদ্দিন পাঁচ-ছ বছরের বড়ো হবে, কিন্তু সে যেভাবে ‘দোস্ত’ বলে তাতে মনে হয় তাদের একই বয়স।
টেলিফোনেই আলাউদ্দিন হৈ হৈ ক’রে ওঠে, আরো দোস্ত, এতকাল পর, কই থিকা কইতে আছো, তাড়াতাড়ি আইসা পড়ো।
হাসান আধঘণ্টার মধ্যেই গিয়ে উপস্থিত হয় আলাউদ্দিন রেহমানের অফিসে। আলাউদ্দিন তাকে জড়িয়ে ধ’রে পাগল হয়ে ওঠে। হাসানের মনে হয় তার অচেনা হয়ে যাওয়া স্যান্ডলের শব্দ যেনো চিনতে শুরু করছে শহর।
আলাউদ্দিন বলে, আমি আগেই বুঝছিলাম, কবিতাটবিতা আমার হইব না, অইসব চালাকি কবিতা না; সেইজন্য অ্যাড গার্মেন্টস ইন্ডেন্টিং হইয়া গেলাম। বাপেরও পয়সা আছিলো, আর দেখলাম কবিতায় না লাগলেও ব্যবসায় আমার চালাকি কামে লাগে: আর ট্যাকাপয়সাও একধরনের কবিতাই, মহাকাইব্যও কইতে পারে।
হাসান বলে, না, কবিতা-লেখা ছেড়ে তুমি ভালো করোনি।
চিতা আলাউদ্দিন বলে, কবিতা লেখন ছাইর্যা দিছি, কিন্তু পড়ন ছাড়ি নাই। তোমাগো কবিতা মন দিয়া পড়ি, সুধীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ বুদ্ধদেবের কবিতা আইজও আবৃত্তি করি, আমি বিংশশতাব্দীর সমান বয়সী, মজ্জমান বঙ্গোপসাগরে, বীর নেই, যুদ্ধে যুদ্ধে। তোমার কয়টা কবিতা পড়লাম কাগজে, পইড়া মন ভইরা উঠলো। জানোই ত, তোমার লগেরগুলির মইধ্যে তোমারেই আমি খাঁটি কবি মনে করি, তোমারেই খাঁটি আধুনিক মনে করি।
হাসান বলে, আমিও অনেকদিন কবিতা লিখি নি, তবে এখন লিখছি, আরো লিখবো, কবিতা আবার ফিরে আসছে।
আলাউদ্দিন বলে, তোমার মইধ্যে খাঁটি কবি আছে, তোমারে কবিতা লেখতেই হইবো, তুমি কবিতা না লেখলে বড় লস হইবো। কবিয়ালে পাগলা কানাইয়ে দ্যাশ ভইর্যা যাইতেছে।
সে কবিতা না লিখলে ক্ষতি হবে? কার ক্ষতি হবে? কী ক্ষতি হতো জীবনানন্দ জন্ম না নিলে? তাহলে কি অ্যাড গার্মেন্টস্ ইন্ডেন্টিং বাঙলাদেশ দারোগা পুলিশ মন্ত্রী জজ সাবিজজ হতো না? কী লাভ হয়েছে জীবনানন্দ কবিতা লিখেছে বলে? কী ক্ষতি হয়েছে কেরামত আলি চাকলাদার কবিতা লেখে নি ব’লে?
হাসান বলে, তুমি কবিতা লিখছো না কেনো? তুমি ভালো লিখতে, তোমার ঝকঝকে পংক্তি আমার ভালো লাগতো। বাঙলায় কিছু ঝকঝকে কবিতাও দরকার, পানসে ম্যাদা পান্তা পদ্যে বাঙলা কবিতা, ভ’রে আছে।
হৈহৈ ক’রে চারপাশ কাঁপিয়ে তোলে আলাউদ্দিন; চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে এসে একবার হাসানকে জড়িয়ে ধরে। আলাউদ্দিন আরো মাংসল হয়েছে।
আলাউদ্দিন বলে, আরো দোস্ত, আমি যে কবিতা লেখা ছাইর্যা দিছি, এইতেই বোঝতে হইবো আমি কবিতাটিবিতা বুঝি, যার হইবো না তার ঠিক সময়ে ছাইর্যা দেওনাই প্রতিভার লক্ষণ। বাজে কবিতা লেখনের থিকা অ্যাড গার্মেন্টস ইন্ডেন্টিং করন অনেক ভাল, বাঙলার কবিগুলি এইকথা বোঝে না। সুধীন্দ্রনাথ ছাইর্যা দেয় নাই? সমর সেন ছাইর্যা দেয় নাই? তারা বোঝাছে আর কবিতা হইবো না, তাই ছাইর্যা দেওনই ভাল; কিন্তু এইকথা বিষ্ণু দে থিকা জসীমদিন বোঝে নাই। আর দ্যাখো না দ্যাশে যাইট সত্তরটা মূর্খ চিকনচাকিন লাইন লেইখ্যাই চলছে, বােঝতে পারছে না। অইগুলি ড্রেনের ময়লার থেইক্যা বেশি ময়লা।
হাসান বলে, তুমি তো ভালো ক’রে শুরুই করো নি।
আলাউদ্দিন বলে, এইখানেই তা আমার উইজডম ধরা পড়ে, শুরুতেই বুজছি হইবো না। তুমি আড্ডায় গিয়া দ্যাখো, পোলাপানগুলিন দাড়ি রাখতেছে, ময়লা কাপড় পরতেছে, গাজা টানতেছে, বেশ্যাবাড়ি যাইতেছে, বইপড়া ছাইর্যা দিছে, ভুল বাঙলায় লম্বাচিকন লাইন লেখতেছে, মাইয়ালোকের দুই চাইরটা উচানিচা জায়গার নাম লাইতেছে, ছাপাইতেছে, ভাবতেছে কবি হইতাছে। কিন্তু আইগুলির একশোটার মইধ্যে দুইটাও কবি হইবো না। এইকথা বোঝতে পারতেছে না।
হাসান বলে, একশোটির মধ্যে একটি বা দুটি কবি হবে, তার জন্যে ওই আটানব্বই নিরানব্বইটাও দরকার; অনেকে নষ্ট না হ’লে একটি দুটি কবি হ’তে পারে না। এটা মাছের ডিমের মতোই, পশুর বাচ্চার মতোই।
আলাউদ্দিন ঘণ্টা বাজাতেই একটি মেয়ে হাঁসের বাচ্চার মতো ঘরে ঢোকে। আলাউদ্দিন বলে, ম্যাডাম মরিয়ম, আইজ আমার আনন্দের দিন বাৰ্থ ডের মতন, অনেক বছর পর আমার পয়েট ফ্রন্ড আসছে, তারে একটু মালটাল ঢাইল্যা দিয়া খুশি করো। চাইয়া দেখো এই কবির দিকে, দ্যাশের বড়ো পয়েট হইবো বিশ বচ্ছর পর, তখন বলতে পারবা তার গেলাশে তুমি মাল ঢাইল্যা দিছিলা।
মরিয়ম বেশ ঝলমলে, তার সব কিছু দোলে; হাসানকে সালাম দেয়ার সময় তার বাহু আর বিভিন্ন অঙ্গ ঢেউয়ের মতো দুলে ওঠে, সব কিছু দুলিয়ে সে আলমারি থেকে ব্ল্যাক লেবেলের বোতল বের করে: ধবধবে শাদা গেলাশে সোনালি পানীয় ঢেলে তাদের সামনে রাখে। কেরুর থেকে এটা কতোই ভিন্ন কতোই উজ্জ্বল। হাসানের চোখে একবার দুলে ওঠে কংকাবতী আফ্রোদিতি।
আলাউদ্দিন মরিয়মকে বলে, ম্যাডাম অইদিকে জানাই দেও আমি বিজি আছি, এখন কোনো লোক না কোনো ফোন না।
মরিয়ম ফোনে সংবাদটি ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে দাঁড়িয়ে দুলতে থাকে। আলাউদ্দিন বলে, ম্যাডাম, চাইলে তুমিও একটু খাও।
তারা দুজন পান শুরু করে, হাসান পানীয়র সাথে একটি ব্যাপক দোলনও পান করতে থাকে।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, তুমি বলছিলা মাছের আন্ডার মতন কুত্তার বাচ্চার মতন অনেকগুলি নষ্ট হইয়া একটা দুইটা কবি হইয়া বাইর হয়, ঠিক কথাই কইছো, কিন্তু আমি অই পাঁচটা কুত্তার বাচ্চার চাইরটার মইধ্যে পড়তে চাই নাই। তাতে কি হইতো? কবিও হাইতাম না, এইদিকে না খাইয়া মারতাম, ব্ল্যাক লেবেলের বতলের কাছেও যাইতে পারতাম না।
না খেয়ে মরার কথায় নিজের দিকে তাকায় হাসান। সেও কি মরবে না খেয়ে? আলাউদ্দিন খুবই চমৎকার আছে, এমন চমৎকার থাকলে কবিতার কোনো দরকার পড়ে না হয়তো; বা কবিতা থেকে খুবই দূরে থাকলে মানুষ এমন চমৎকার থাকে। ঝকঝকে পংক্তি লিখতে থাকলে আলাউদ্দিনের সব কিছু আজ এমন ঝকঝকি করতো না, কোনো মরিয়ম দোলা ছড়াতো না; সে হয়তো কোনো দোস্তের অফিসে গিয়ে নিজের ভেতরের ময়লা খুঁটিতে খুঁটিতে পানটান করতো।
কবি, হায়, কুঁড়েঘরে বাস ক’রে শিল্পের বড়াই!
হাসান বলে, আমাকেও না খেয়ে থাকতে হবে, আলাউদ্দিন।
আলাউদ্দিন জিজ্ঞেস করে, তুমি কি করছে আইজাকাইল, দোস্ত?
হাসান বলে, কিছুই করি না, একটা কলেজে ছিলাম, ছেড়ে দিয়েছি।
আলাউদ্দিন বলে, আরো দোস্ত, তুমি দেখি লাইফেও পয়েট হইয়া ওঠতেছে, এইটা কবিতার জইন্যে ভাল না। এইটা অনাহারী কবিগো টাইম না, ছিঁড়া পাঞ্জাবি পরা কবিগো এইজ এইটা না; টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরির এই ডিকেডের কবি হইবো মডার্ন, তার লাইফস্টাইলও হইবো মডার্ন। তার গাড়ি থাকতে হইবো, তাকে ব্ল্যাক লেবেল খাইতে হইবো, রাইতে বাড়ি ফিরার সময় তাকে দেখতে হইবো শোনতে হইবো এভরি স্ট্রিটল্যাম্প দ্যাট আই পাস বিটুস লাইক এ ফ্যাটালিস্টিক ড্রাম। বোঝােলা ল্যাম্পপোস্টের বাইদ্য শোনাতে হইবো, ট্রাকরে ফুলের মালার মতন দেখতে হইবো, সন্ধাটারে ইথারে অজ্ঞান রোগীর মতন আকাশে ছারাইন্যা দেখতে হইবো। দাড়িমুখে সারিগান লাশরিকাল্লা, পাল তুলে দাও ঝাণ্ডা উড়াও, এই গাঁয়েতে একটি মেয়ে চুলগুলি তার কাল কালর যুগ আর নাই দোস্ত।
হাসান বলে, গ্রামের কলেজে আমি ম’রে যাচ্ছিলাম, তিন বছর আমি কবিতা লিখি নি, একটি পংক্তিও মাথায় আসে নি। ঢাকা থেকে দূরে ছিলাম, তাই কবিতা থেকেও দূরে ছিলাম।
আলাউদ্দিন বলে, তুমি ত পল্লীকবি হইতে যাইতেছ না যে অই গাছপালা সোনাই রুপাইর মধ্যে কবিতা পাইবা। ঢাকার বাইরে আইজ কবিতা নাই।
হাসান বলে, তুমি তো জানোই আমার ওসব হবে না, আমি ওই মহান অক্সফোর্ডের উপযুক্ত নই।
আলাউদ্দিন বলে, তোমার লগে যেইটা সেকেন্ড হইলো সেইটা ত অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর হইয়া ফাল ফারতেছে, মওলবি নজিবর রহমান আর কায়কোবাদরে লইয়া একাডেমিতে পরবন্ধ পরতেছে, বলতেছে তাগো মতন মহৎ ঐপন্যাসিক আর মহাকবি নাকি নাই। অইটারে তুমি অক্সফোর্ড বলতেছ? ফোর্ড আর নাই, খালি অক্সগুলি আণ্ডা দুলাইয়া শিং উচাইয়া গুতাগুতি করতেছে।
হাসান বলে, ইউনিভার্সিটি ওই নজিবর রহমান কায়কোবাদঅলাদের জন্যেই, আমার জন্যে নয়। কবি, ঔপন্যাসিকের জন্যে ওই দুর্গ নয়, ওটা সংঘবদ্ধদের জন্যে।
আলাউদ্দিন বলে, তোমার হইবো ক্যান? তুমি তা জমিরালি পরাগালির বাসায় বাজার কইর্যা দেও নাই, তাগো পোলামাইয়ারে চুয়িংগাম কিন্না খাওয়াও নাই, তাগো পায়ের ধুলা মাথায় মাখো নাই, তাগো লইয়া তিনখানা ভাঙচুরা পরবন্ধ লেখো নাই। তুমি কবি হইছো, তুমি বলি হইয়া গেছো।
হাসান বলে, কিন্তু আমি হয়তো কবি হবো না, কুকুরবাচ্চার মতোই নষ্ট হবো, আমি হয়তো কিছুই হবো না।
আলাউদ্দিন বলে, চলো দোস্ত, তোমারে একটু ভালমন্দ খাওয়াই আনি। লাঞ্চটা আমি অই চাইরতারাই করি। কবিতা ছাইর্যা ট্যাকা করতেছি ত চাইরতারা পাঁচতারায় যাওনের লিগাই, এইতে কবিতা ছারনের কষ্টটা একটু কমে–কি বুঝিতে চাই। আর জানি না কি আহা, সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের।
আলাউদ্দিন রেহমানের শীততাপমেঘবৃষ্টিকুয়াশাশিশিরকবিতাচিত্রকল্পনিয়ন্ত্রিত পাজেরোতে ওঠার সাথে সাথে একটা অদ্ভুত অপরিচিত অনামা আরাম ধাক্কা দেয় হাসানকে; যে-ট্রাকটি তার রিকশার পেছনে এসে গো গো ক’রে থেমেছিলো, তার মতো নয়, সেই দয়াময় ট্রাক একটি পংক্তি তাকে উপহার দিয়ে কবিতা লিখতে বলেছিলো, আর এই স্বপ্রকল্পনা আবেগসৌন্দর্যনিয়ন্ত্রিত পাজেরো তার ভেতর থেকে সব পংক্তি টেনে বের ক’রে নিয়ে নর্দমায় ফেলে দিতে চায়, বলে কবিতাঠবিতা ভুইল্যা যাও ভালো থাকবা। হাসান অনভ্যাসবশত একটু কান্ত হয়ে বসেছিলো, কান্ত হওয়ার সাথে সাথে অভাবিত আরামটা একগুচ্ছ ছুরির মতো গেথে যায়, তার মাংসে পাছার ভেতরে; সে পিঠটা টেনে নেয়। তার মনে হয়। পিঠ পেছনে ঠেকিয়ে বসলেই গুচ্ছ গুচ্ছ ছুরিকার আক্রমণে কবিতার কথা তার মনে থাকবে না, ছন্দ আর চিত্রকল্প সে ভুলে যাবে, সে অপরূপ অ্যাড গার্মেন্টস ইন্ডেন্টিং হয়ে উঠবে। সে শক্ত হয়ে ইস্কুলের বেঞ্চে ক্লাশ ফোরের ছাত্রের মতো বসে।
হাসান বাইরে তাকিয়ে একটি ভাঙাচোরা রিকশা দেখতে পায়, রিকশাটাকে তার বদলেয়ার র্যাঁবো মালার্মে রবীন্দ্রনাথের মতো মহানুভব মনে হয়, রিকশাকে সে গোপনে বলে, বিষন্ন রিকশা, করুণ রিকশা, অনির্বাচনীয় রিকশা, ডানাভাঙা রিকশা আমাকে একটি চিত্রকল্প দাও, অন্তত একটা ছেঁড়াফাড়া কবিতা দাও। আমার মানসসুন্দরী নেই, ধর্ষিত বিপন্ন ব্যথিত রিকশা, তুমি হও আমার ক্ষণিক মানসসুন্দরী।
পাজেরো শাই শাই ক’রে চলতে থাকে, আটকে যেতে থাকে, বলতে থাকে, অ্যাড গার্মেন্টস্ ইন্ডেন্টিং চারতারা পাঁচতারা ব্ল্যাক লেবেল অ্যাড গার্মেন্টস্ ইন্ডেন্টিং চারতারা পাঁচতারা ব্ল্যাক লেবেল মরিয়ম মরিয়ম মরিয়ম।
রিকশা বলে, আমি শিক আর টায়ার আর প্যাডেল, আমি বদলেয়ার র্যাঁবো মালার্মে রবীন্দ্রনাথ নই, এমনকি আমি যতীন্দ্রমোহন বাগচী মানকুমারী বসুও নই, মানসসুন্দরী নই, আমার ভেতরে কোনো কবিতা নেই, আমি তোমাকে কবিতা দিতে পারবো না।
বাঁ পাশের সিনেমা হলটি নাভি খুলে মাজা বাঁকিয়ে হাসানের কানে কানে বলে, আমি তোমাকে কবিতা দিতে পারবো না, আমি ব্যানার, জোড়া জোড়া নগ্ন স্তন, স্থল উরু, স্তনবাঁক, চিজ বড়ি হায় মস্ত্ মস্ত্।
ডান পাশের ভিডিওর দোকানটি ন্যাংটাে হয়ে যায়, ঝনক ঝনক ক’রে বুক দাপাতে থাকে, অট্টরোলে বলে, হা হা হা হা, কবিতা কারে বলে মিয়া? অইটা আবার কি জিনিশ, কি মাল? পিরথিমিতে অইটার কি দরকার? অইটায় কয় কেজি সেক্স? তু চিজ বড়ি হায় মস্ত্ মস্ত্।
মুক্তি ক্লিনিকটি দুই পা ফাঁক ক’রে দু-দিকে ছড়িয়ে দিয়ে গোঙাতে থাকে, এমআর এমআর এমআর, এমআর দিতে পারি, তোমারে কবিতা দিতে পারি না। তুমি কি এমআর করাইবা? আসো, চিৎ হইয়া শোও, তিন মিনিটে ভিতরের কবিতার সব ফিটাস ফালাইয়া দিমু, আধঘণ্টায় বাড়িতে হাইট্যা চইল্যা যাইবা।
হাসান দেখতে পায় ঝাঁকে ঝাঁকে দলবেঁধে সবাই এসে বলছে, তারা তাকে কবিতা দিতে পারবে না।
নৌকো ছেঁড়া পাল উড়িয়ে এসে তার সামনে থামে, বলে, তুমি কোথায় যাচ্ছো, হাসান? তোমাকে আমি কবিতা দিতে পারবো না। যাও, তুমি অপরূপ অ্যাড গার্মেন্টস ইন্ডেন্টিং হইয়া যাও, সেইখানে চাইর তারা পাঁচতারা ব্ল্যাক লেবেল মরিয়ম মরিয়ম মরিয়ম।
একঝাঁক কাক উড়ে যেতে যেতে বলে, তোমাকে আমরা কবিতা দিতে পারবো না, হাসান, তুমি যেখানে যাচ্ছে সেখানে অনেক মাল আছে, কবিতা নেই, সেইখানে আমাগো মতো কাউয়ারাই আছে।
নদী বয়ে যাচ্ছে, তার ঢেউ বলছে, তোমাকে কবিতা দিতে পারবো না; তোমার ভেতর থেকে আমি কবিতা টেনে বের ক’রে আনবো, তোমার ভেতরে আমি চর পড়াবো, ধুধু বালুচর।
হাসান কি চিৎকার ক’রে উঠবে? সে চিৎকার ক’রে উঠতে যাচ্ছিলো, একটা চিৎকার তার গলায় এসে গামগম শুরু করতে যাচ্ছে, এমন সময় পাজেরো গিয়ে ঝলমলে চার তারার সামনে মসৃণভাবে থামে।
হাসান পাজেরো থেকে নেমে সালাম স্যালুট লাল কার্পেটে অদ্ভুতভাবে অসুস্থ বোধ করে, ভেতরে গেলে রোগটা নোংরা ঢালের মতো তার শরীর উপচে বইতে থাকবে ব’লে মনে হয়; সে ফিরে দাঁড়ায়, বাইরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায়।
আলাউদ্দিন বলে, আরো দোস্ত, কোন দিকে যাইতাছো, অইটা ত রাস্তার দিক।
হাসান একটু লজ্জা পেয়ে ঘুরে আলাউদ্দিনের পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে।
আলাউদ্দিনের অ্যান্ড ২০০০-এ হাসানের একটি কাজ হয়ে যায়।
হাসান এ-কাজের এবং কোনো কাজের কথাই ভাবে নি; কবিতা ছাড়া কিছুই ভাবছিলো না সে, কিন্তু ভেতরে কী একটা যেনো খচখচ করছিলো, হয়তো সেটা কাজ, তবে কীভাবে সেটা পেতে হয় তার মাথায় আসছিলো না।
আলাউদ্দিনই প্রস্তাব করে, দোস্ত, থাকন থাওন কবিতা লেখনের লিগা তোমার একটা কাম দরকার; আমার অ্যান্ড ২০০০-এ একটা কাম খালি আছে, তুমি সেইখানে লাইগ্যা যাও।
হাসান বলে, আমি তো অ্যাডের কিছু জানি না।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, আইজাকাইল কোনো কামই আগে থিকা জানতে হয় না; কাম শুরু করলেই জানা হইয়া যায়, তখন তার থিকা আর কেউ বেশি জানে না। আমিই কি আগে থিকা এইসব, এই অ্যাড ইন্ডেন্টিং গার্মেন্টস্ জানতাম? আইজ দ্যাখো আমার থিকা আর কে বেশি জানে?
হাসান বলে, আমাকে কী করতে হবে?
আলাউদ্দিন বলে, তোমারে দোস্ত স্ক্রিপ্টট ল্যাখতে হইবো, নানা রকম অ্যাডের স্ক্রিপ্ট। তুমি পারবা, তোমার আঙুলে কবিতার লাইনও আসবো, আর গদ্যটাও তুমি ভালই ল্যাখো। ভাল ব্যাতন পাইবা, লগে আরও নানান মজাও আছে।
হাসান বলে, অ্যাডের কাজ তো জিনিশপত্রের বিক্রি বাড়ানো, কিন্তু জিনিশপত্র দেখলেই যে আমার ঘেন্না লাগে বমি আসে। ফ্রিজ টেলিভিশন ব্রা টুথপেস্ট এসি টয়োটা দেখলেই যে, ওগুলোতে আমার আগুন ধরিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়, কমলাপুরের ভাগাড়ে নিয়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হয়।
হা হা হা ক’রে উল্লাসে ফেটে পড়ে আলাউদ্দিন, যেনো সে এমন আনন্দ অনেক বছর পায় নি; যেনো হাসানের সাথে সেও আগুন ধরাবে, ভাগাড়ে গিয়ে সম্পূর্ণ স্টেডিয়াম বায়তুল মোকাররম গাউছিয়া মৌচাক ও আর যা আছে, সব কিছুকে কমলাপুরে ফেলে দিয়ে আসবে এক্ষুনি।
আলাউদ্দিন বলে, ঠিক কথা বলছে দোস্ত। ফ্রিজ দেখলেই অইটার ভিতর ভড়ভড় কইর্যা হাগতে ইচ্ছা করে, মনে মনে আমি ফ্রিজ ডিপফ্রিজে রেগুলার হাগি, কমোড হিসাবে অইগুলি খুবই ভাল, টেলিভিশন, দেখলে মনে মনে দিনরাত মুতি; কিন্তু কথা হইছে ব্যাচাকিনাই হইছে লাইফ, লাইফে ব্যাচাকিনাই আসল কথা।
আলাউদ্দিন আরো কিছুক্ষণ হা হা হাসে; এবং বলে, এই দুনিয়ায় অনলি দি সেলার সারভাইভস্, আইজ দি সেলার ইজ দি ফিটেস্ট পার্সন, ডারউইন সাবের রুলে আইজ বাচবো খালি দোকানদার, প্রোডিউসার, যার মাল মাইনষে কিনে সেই বাইচ্যা থাকে, যারটা কিনে না সে মরে। পয়েটের মাল কোনো হারামজাদা কিনে না, কিন্তু গার্মেন্টসের মাল আমরিকা জারমানি কিনে; মাইনষে টুথপেস্ট কিনে জুতা কিনে রাজা কিনে মায়া কিনে ব্ল্যাক লেবেল কিনে, কবিতা কিনে না। এইর লিগা জীবনানন্দরা ট্রামের নিচে পরে।
হাসান হেসে বলে, আলাউদ্দিন, আমি ট্রাম রেলগাড়ি বাস ট্রাকের নিচে পড়তে চাই না, উটের গ্ৰীবার ডাকে সাড়া দিতে চাই না, ভূত দেখতে চাই না, দু-একটা ইঁদুর ধরেই বেঁচে থাকতে চাই।
আলাউদ্দিন বলে, তাইলে তোমারে অ্যাড ল্যাখতেই হইবো, অ্যাডে অ্যাডে আশমানজামিন ঢাইক্যা দিতে হইবো, দোস্ত; আইজকাল ভগবান ঈশ্বর জিহোভা গডরাও অ্যাড ছাড়া টিকতে পারে না, গডরাও আমাগো দিয়া আইজাকাইল সেক্সি অ্যাড ছারে। আইজ অ্যান্ড ইজ গড, মীের পাওয়ারফুল দ্যান অল দি ইস্টার্ন অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন গড্স্। দোস্ত, লোকে বিজ্ঞান বিজ্ঞান করে, তয় এইটা বিজ্ঞানের যুগ না, এইটা হইল বিজ্ঞাপনের যুগ মনে রাখবা।
হাসান বলে, আমার মনে হয়। আমি কোনো কাজেরই উপযুক্ত নই, অ্যাড পারবো কি না আমি জানি না। আমাকে ভাবতে হবে।
পাত্রটি শেষ ক’রে নিজের ও হাসানের জন্যে আরো দুটি ফরাশি ওয়াইনের আদেশ দেন আলাউদ্দিন।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, তুমি পারবা, তোমার কবিতায় দুইটা কোয়ালিটি আছে, একটা হইছে গোপনে বালির ভিতর দিয়া বিসুভিয়াসের লাভার মতন বইয়াচলা ভাইওলেন্ট সেক্স, মনে হয় সাওতালগো মতন আকাশ ফাটাইয়া নাচতেছে, আর শরিলের রগ ছিররা ফেলনের মতন ফ্যান্টাসি; গদ্যও তুমি ল্যাখতে পারো, আমাগো মডার্নিজমের টিচার ব্লু ব-র থিকাও অ্যাট্রাক্টিভ। দোস্ত, বাঙালি মুসলমান আইজও গদ্য ল্যাখতে শিখে নাই।
হাসানের খুব সুখ লাগে আলাউদিনের কথা শুনে; তাহলে তার কবিতা, তার গদ্য, এবং তাকেও কেউ কেউ বুঝতে পারছে।
হাসান বলে, সেক্স হচ্ছে প্রতিভার রক্তধারা, নদীর স্রোতের সাথেও এটা বয়ে চলে মেঘেও বয়ে চলে, গীতাঞ্জলি আর নভোযান সেক্স থেকেই জন্মেছে; বাঙালি মুসলমান শোয়া বোঝে, সেক্স বোঝে না কাম বোঝে না; তাই ওরা এখনো হাম্দ্ নাত চায়, ওরা কখনো ‘শাশ্বতী’ আর ‘অবসরের গান’ লিখতে পারবে না।
আলাউদ্দিন বলে, আমরা অ্যাডআলারা এইটা বুজছি; অ্যাডে কোনো হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইহুদি ক্যাথলিক প্রোসেস্ট্যান্ট নাই, অ্যাডের একটাই ধর্ম–ব্যাচো ব্যাচো ব্যাচো, সব ব্যাইচা দেও, গাড়ি ব্যাচো শাড়ি ব্যাচো লাভারের পাছা ব্যাচো আকাশ ব্যাচো বাতাস ব্যাচো। তয় মানুষ আইজকাল জিনিশ কিনতে চায় না, চায় সেক্স কিনতে; সেইজন্য আমরা জামাকাপড় গাড়িবাড়ি ফ্রিজ টেলিভিশন কম্পিউটার টুথপেস্ট সেন্ট পাউডার আলকাতরা বেচি না, বেচি সেক্স; সেক্স ছাড়া আর কিছুর দাম নাই। সেক্স ইজ অলপাওয়ারফুল, অমনিপোটেন্ট; সেক্সে ফুল ফোটে, সেক্সে পাজেরো ঘণ্টায় একশো মাইল দৌরায়; সেক্সে ভোটের বাক্সে ভোট পরে। তোমার কবিতা যে আমি লাইক করি, তার একটা কারণ অই দুর্দান্ত সেক্স।
হাসান বলে, আমার ভালো লাগছে যে তুমি আমার কবিতার ভেতরটা বুঝতে পেরেছে; তবে আমি কিন্তু অন্যদের মতো নারীর কয়েকটি বাঁক নিয়ে মাতামাতি করি না, কথায় কথায় স্তন যোনি উরু, সঙ্গম উচ্চারণ করি না।
আলাউদ্দিন বলে, এইখানেই ত তোমার প্রতিভা; তুমি অইসব উচানিচা জায়গাগুলি নিয়া ডলাড্লি চাপাচাপি খোদাখুদি কর না, কিন্তু সব কিছুর ভিতর ভিতর কাম ঢুকাইয়া দেও গোপন রাঙা লাভার মতন, তাতে আসমান ফাইট্যা পরতে চায় জমিন ফাক হইয়া যায়। অ্যাডেও তোমার তাই করতে হইবো। হুন্ডার ভিতরে তোমার কাম ঢুকাই দিতে হইবো, সাবানের মইধ্যে সেক্স ঢুকাই দিতে হইবো, ব্যাটারির মইধ্যে সেক্স ভইরা দিতে হইবো। আইজাকাইল ত্যালে হুন্ডা পাজেরো টয়োটা চলে না, চলে সেক্সে; সাবানে কাপড় সাফ হয় না, সাফ হয় সেক্সে; ইলেকট্রসিটিতে লাইট জ্বলে না, জ্বলে সেক্সে। সেক্সই হইল আইজাকাইলাকার অ্যাটমিক এনার্জি। দোস্ত, লাভার মতন সেক্সি অ্যাড লেখতে হইবো তোমারে; তুমি পারবা, আমি বইল্যা দিলাম কবিতায় তুমি শাইন করবা, অ্যাডেও শাইন করবা।
হাসান বলে, আমি তো শাইন করতে চাই না, নিজেকে আমি ধ্বংস করতে চাই কবিতার জন্যে।
আলাউদ্দিন বলে, তুমি দোস্ত অ্যান্ডের লিগাও নিজেরে কিছুটা ধ্বংস কর, তোমার কাছে যা ধ্বংস আমাগো কাছে তা ক্রিয়েশন মনে হইবো, কবিরা ডেস্ট্রাকশনের মইধ্যেও ক্রিয়েটিভ।
দু-দিন পর হাসান অ্যাড-২০০০–এ যোগ দেয়।
নিয়োগপত্রে একটি জিনিশই দর্শনীয় মনে হয় হাসানের কাছে, সেটি বেতন। একটা মোটা অংশ দেখে সে বিস্মিত হয়। সে মুঠোয় একগুচ্ছ চকচকে টাকা দেখতে পায়, খুব ভারি লাগে, পরমুহূর্তেই এক আকাশ নক্ষত্রের মতো ঝলমল ক’রে ওঠে কাগজগুলো, সে শিউরে ওঠে, এবং তীব্র একটা কাম বোধ করে। এতো টাকার কথা সে ভাবে নি, এতো টাকা দিয়ে কী করবে। সে বুঝতে পারে না, একটু পরেই মনে হয় টাকা বোঝার বস্তু নয়, ভোগের বস্তু, যেমন ফুল বোঝার বস্তু নয়, রঙধনু বোঝার বস্তু নয়। টাকা সে বোঝে না, কোনো দিন বুঝবে না; এটা এক রহস্যময় বস্তু, রহস্য হয়েই থাক।
আলাউদ্দিন তাকে অফিসে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় সবার সাথে ,বুঝিয়ে দেয় তার কাজও; এবং হাসান সুখ পায় অ্যাড ২০০০-এর কেউ কেউ তার নাম আগে থেকেই জানে–শুধু এটুকুর জন্যেই সে নিজেকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অন্যরা কেউ কেউ তার নাম জানবে, শুধু এটুকুর জন্যে?–দু-একজন তার কবিতারও অনুরাগী। অফিসটি তাকে বিব্রত ও সুখী করে একই সাথে;–সব কিছুই ঝলমলে ঝকঝকে; যে-কয়েকটি তরুণীকে সে দেখতে পায়, তাদের মতোই অত্যন্ত নিবিড় সুন্দর ঢলঢলে আবেদনময়ী অফিস।
হাসান কাচ দিয়ে ঘেরা একটি ডেস্ক পায়, চেয়ারটি খুবই রূপসী আরামদায়ক, একটি মডেলের মতোই ক্যামেরার সামনে স্থির পোজ দিয়ে আছে–ব’সেই মনে মনে সে বলে, কবিতা, প্রিয় কবিতা; তারপর মনে পড়ে–অ্যাড, আবেদনময়ী রঙিন সেক্সি অ্যাড, সমকালের ঈশ্বর না ঈশ্বরী; সাথে সাথে চেয়ারটি এদিকে সেদিকে যেনো ঘুরতে থাকে। হাসানকে তার অ্যাঙ্গেল দেখায়।
সামনের দিকে তাকিয়ে একটি থরোথরো তরুণীর রঙিন দিগন্তজোড়া ছবি দেখতে পায় হাসান। এ কি তরুণী, না বাঁক? এ কি তরুণী, না ওষ্ঠ? এ কি তরুণী, না যুগল বক্ষ? ছবিটির দিকে সে তাকিয়ে থাকে।
সে কি এমন সেক্সি কবিতা লিখতে পেরেছে আজো? ছবির এই তরুণীটিকে কি কবিতায় রূপান্তরিত করা সম্ভব?
আমি অ্যাড হয়ে গেলাম, কবিতা আমাকে ক্ষমা কোরো। সে মনে মনে বলে।
কিন্তু তোমার আমার মধ্যে কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। সে মনে মনে বলে।
আমি অ্যাডকে কবিতা ক’রে তুলবো, কিন্তু কবিতা, তোমাকে অ্যাড করবো না। তুমি অ্যাড নও, সেক্স নও, তুমি লোকোত্তর শিল্পকলা। সে মনে মনে বলে।
সামনের দিকে তাকিয়ে আবার সে তরুণীকে দেখে।
তুমি সুন্দর, কিন্তু তুমি কবিতা নও, তুমি আশ্চর্য শরীর, তুমি বিস্ময়কর টাকা। সে মনে মনে বলে। তুমি শাশ্বত পণ্য, তুমি এই সময়ের উর্বশী।
উর্বশী হাসানকে জিজ্ঞেস করছে, আমাকে কি তুমি ঘৃণা করছাে?
একটা অপরাধবোধ তার রক্তের ভেতর ঢুকে যায়, সে ক্ষমা চায়।
না, তোমাকে ঘৃণা করছি না, তুমি সুন্দর, তোমাকে ঘৃণা করি না; ঘৃণা করার আমার অধিকার নেই, তুমি সুন্দর।
আমি কি বেশ্যা? আমাকে কি বেশ্য মনে করছে তুমি?
বেশ্যা কাকে বলে? কেউ বেশ্যা নয়, বা সবাই বেশ্যা। আসলে বেশ্যা কাকে বলে আমি জানি না।
অ্যাড কী, তুমি কি জানো হাসান?
অ্যাড হচ্ছে নিরন্তর বেচা বেচা বেচা, অবিনাশী টাকা টাকা টাকা।
অ্যাড আর কী হাসান?
অ্যাড হচ্ছে আধামিনিটের জন্যে অমরতা দান, বিশ্ববিখ্যাত করা।
এখন কি সবাই বিশ্ববিখ্যাত?
এই অসামান্য সময়ে প্রত্যেকের নিয়তি অন্তত আধামিনিটের জন্যে বিশ্ববিখ্যাত হওয়া। বিখ্যাত না হয়ে আর উপায় নেই, বিখ্যাত না হয়ে আমাদের মৃত্যু নেই।
আাধামিনিট বিখ্যাত হওয়ার জন্যে দণ্ডিত আমরা।
আমি তোমার থেকে বিখ্যাত, রাস্তায় তোমাকে কেউ চেনে না, তোমাকে দেখে কেউ রিকশা থেকে লাফিয়ে নামার উত্তেজনা বোধ করে না, আমাকে দেখে করে; আমি সাবানের অ্যাড ছিলাম, এখন আমি রাস্তায় বেরোতে পারি না।
সবাই তোমার পায়ে পড়তে চায়?
না, সবাই আমাকে রেস্টহাউজে মোটেলে নিতে চায়, অন্তত একরাতের জন্যে পুলক অনুভব করতে চায়, এক রাত এক রাত।
তুমি একরাতের বিলোল হিল্লোল উর্বশী?
আমরা এখন সবাই একরাতের উর্বশী, সবাই আধামিনিটের সেলিব্রেটি।
তুমি কি বাস্তব, তুমি কি বাস্তবতা, হে তরুণী?
না, আমি বাস্তব নাই, আমি ফ্যান্টাসি। এটা বাস্তবতার কাল নয়, এখন কেউ বাস্তবতা সহ্য করে না, এখন সব কিছু ভেঙেচুরে ফ্যান্টাসি তৈরি করতে হয়, এটা ফ্যান্টাসির যুগ। আমি ফ্যান্টাসির কন্যা।
হাসান তরুণীটির সাথে কথা বন্ধ ক’রে একটি সিগারেট ধরায়।
আমি যতো দিন এখানে আছি তুমি আমার সামনে থাকবে, হাসান মনে মনে বলে, তাহলে আমি পারবো।
দেয়ালে আমরা কেউ বেশি দিন থাকি না, আমাকে সরিয়ে অন্য কেউ আসবে। প্রতিদিন আমার জন্ম হচ্ছে, প্রতিদিন আমি নতুন তরুণী হয়ে দেয়ালে আসি।
একটি পংক্তি জলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে। হাসানের মাথায়। সে কি এখনই ওটাকে কবিতা বানাতে বসবে, কাটতে ছিড়তে থাকবে? সে কি রামপ্রসাদা? হিশেবের খাতায় লিখবে শ্যামা কালির স্তব? না, এখন আর কেউ কালি নেই, সবাই রঙিনা; সে পংক্তিটিকে মাথার ভেতর রেখে দেয়, তুমি আমার মাথার ভেতর থাকো, পংক্তি, এটা অ্যাডের টেবিল, এখানে আমি তোমাকে নিয়ে খেলতে পারি না। এখানে আমার অন্য দেবীর স্তব লিখতে হবে, যার নাম স্ক্রিপ্ট, কবিতা নয়।
দুটি অ্যাডের স্ক্রিপ্ট লেখার দায়িত্ব পরের দিনই লাফিয়ে পড়ে হাসানের ওপর।
অ্যাড ১ : মাতৃদুগ্ধের গুণকীর্তন ক’রে অ্যাড লিখতে হবে, চােখে খোঁচা দিয়ে দেখাতে হবে মাতৃদুগ্ধের কোনাে বিকল্প নেই।
অ্যাড ২: ‘রাধিকা’ নামের একটি অস্ট্রেলীয় গুঁড়োদুধের অ্যাড লিখতে হবে, চোখে মায়াজাল ছড়িয়ে দেখাতে হবে এটা মাতৃদুগ্ধের থেকেও পুষ্টিকর, আর মায়ের দুধ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু রাধিকার ধারা অফুরন্ত।
অ্যাড দুটির বৈপরীত্যে মুগ্ধ হয়। হাসান, সুখীও বোধ করে; এটা তার কবিতার মতোই, সে তো কবিতায় ভয়াবহ বৈপরীত্যকেই বিন্যস্ত ক’রে দিতে পছন্দ করে। সে কি অগ্নিগিরি। আর অশ্রুবিন্দুকে পাশাপাশি বসায় না? তার ওপর এই বৈপরীত্য এসে কি পড়লো সে-জন্যেই?
প্রথম অ্যাডটা সরকারি, জাতিসংঘফংঘ হয়তো বিশ্বমায়েদের ঝোলা স্তনের দিকে তাকিয়েছে। দয়া ক’রে, ফোলা স্তন দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, এবং বিশ্বের কোনো সম্পদকেই নষ্ট হ’তে দেবে না ব’লে মায়ের দুধের গুণকীর্তনের শ্লোগান তৈরি ক’রে ফেলেছে।
হাসানকে তার অ্যাড লিখতে হবে। বেশ, সে লিখবে।
দ্বিতীয়টা প্রাইভেট; ‘রাধিকা’র পিতৃপুরুষেরা মায়ের স্তনকে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পুষ্টিকর খাদ্য মনে করে, শিশুর নয়, শিশুকালের স্তন নিয়ে টানাটানি ইত্যাদিতে কোমলমতি শিশুদের চরিত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে, দুধ খাওয়া ছেড়ে চোষাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়তে পারে, যা জাতির জন্যে শুভ নয়; তাছাড়া মায়ের দুধ বিনে পয়সায় পাওয়া যায়, কিন্তু বিনে পয়সার জিনিশে বিশ্ব চললে বিশ্ব চলতো না। ব্যবসা থেমে যেতো, ধস নামতো বাজারে। অন্য দিকে মাতৃদুগ্ধ উৎপাদন ব্যয়বহুল, আধলিটার মাতৃদুগ্ধের পেছনে খরচ হয়, একশো টাকা, সেখানে এক লিটার রাধিকা পাওয়া যায় পাঁচ টাকায়।
হাসানকে তার অ্যাড লিখতে হবে। বেশ, সে লিখবে।
প্রথম অ্যাডটি নিয়েই প্রথম বসে হাসান, সে মাতৃদুগ্ধ পান করাবে সবাইকে। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি মহাপতি উপপতি অতিপতি যুগপতি বিচারপতি আমলা মামলা অধ্যাপক পুলিশক এনজিওক গার্মেন্টস্ক ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টক ধর্ষক ধৰ্মক কৰ্মক চর্মক সবাইকে। মাতৃদুগ্ধ পান ক’রে তারা সুস্থ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠবে, তাদের অকল বিকল মাথাগুলো ঠিকভাবে কাজ করবে, রাস্তাঘাট ধানক্ষেত পাটক্ষেতে তার বিকাশ দেখা যাবে। ওহ, তারা এখন আর মাতৃদুগ্ধ পান করে না? ওই দুধের গন্ধে তাদের বমি আসে? তারা স্তন্য পান করতে পছন্দ করে না? তারা পছন্দ করে শুধু স্তন পান করতে? মায়ের না, অন্য কারো?
তাহলে শুধু শিশুদেরই পান করাতে হবে মাতৃদুগ্ধ?
কিন্তু কেনাে শুধু শিশুদেরই পান করাতে হবে মাতৃদুগ্ধ?
হাসান একবার চোখ বুজে দেশ জুড়ে গোয়ালঘর দেখতে পায়, তাতে রাশিরাশি দুগ্ধবতী গাভী দেখতে পায়, তাদের বাঁট ফেটে পড়তে চাচ্ছে। পরমুহূর্তে সে রাশিরাশি দুগ্ধবতী মাতাদের দেখতে পায়, তাদের বাঁট ফেটে পড়তে চাচ্ছে। মাতাদের জন্যে অমন গোয়ালঘর দরকার।
মাতৃদুগ্ধ বিশ্বের সম্পদ, তার এক ফোঁটাও নষ্ট করা চলবে না, এর প্রতি ফোঁটা সম্মিলিতভাবে চুষে খেতে হবে; ফুরিয়ে আসছে গরিব বিশ্বের সম্পদ, নিশ্চিত করতে হবে তার সম্পদের চূড়ান্ত ব্যবহার।
সে মাতৃদুগ্ধ পান করাবে সবাইকে, দারোগা থেকে জেনারেল সবাইকে।
মাতৃদুগ্ধের কোনাে বিকল্প নেই, এর পুষ্টিকরতার সীমা নেই।
এটা বিনিয়োগের শতাব্দী, মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানাে হচ্ছে শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ।
এটা এক আশ্চর্য ঔষধ। এতে সারাক্ষণ লাফালাফি দৌড়োদৌড়ি কুচকাওয়াজ গোলাগুলি করছে এমন এক জীবন্ত কোষ, যা দেশরক্ষী বাহিনীর মতোই অতন্দ্র–এটা কোনো বিদেশি বাহিনীকে ঢুকতে দেয় না ত্রিসীমার মধ্যে; এটা খেলে ঘনঘন হাণ্ড হয় না, বাতাসের নালি জ্বালাপোড়া ক’রে না, দাঁতগণ আর মাঢ়ি হিমালয়ের পাথরের মতো শক্ত থাকে, মাথাটা মগজটা থাকে ঝকঝকে, যে খাবে সে নিউটন আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথ না হয়ে যাবে না।
বেশি ক’রে মাতৃদুগ্ধ খাও, জাতিসংঘ ব’লে দিয়েছে খাও, মাতৃদুগ্ধ খাও, এমন বিনিয়োগ আর হয় না।
হাসান দেশের প্রধান নারীবাদীটির সাথে একটু কথা বলতে চায়। ইচ্ছে করে এখনি তাকে ফোন করে; তবে ফোন না ক’রে মনে মনে ফোনে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে থাকে। এর নাম সে দেয় মানসিক সাক্ষাৎকার।
হাসান জিজ্ঞেস করে, একটু বলুন তো মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা কী?
এভাবে প্রশ্ন করা কি ঠিক হলো বিখ্যাত নারীবাদীকে?
সে ভাষা বদলে আবার জিজ্ঞেস করে, দয়া ক’রে মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা কী সে-সম্পর্কে আপনার মতামত জানালে খুশি হবো।
নারীবাদী হা হা হা হা হা হা ক’রে হেসে উঠে বলেন, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলটির প্রতিদিন এক লিটার মাতৃদুগ্ধ খাওয়া উচিত, তাহলে তার মাথা সুস্থ থাকবে, পাগলামো করবে না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আপনি কি তাহলে মাতৃদুগ্ধ খাওয়া বা খাওয়ানাে পছন্দ করেন না?
নারীবাদী হা হা হা ক’রে বলেন, ওরা মনে করে নারীরা দুগ্ধবতী গাভী, নারীদের ওলানের দিকে এবার ওদের চোখ পড়েছে, আগামী বছর হয়তো ওরা উন্নত জাতের দুগ্ধবতী নারী উৎপাদনের জন্যে উন্নত মানের গোয়ালঘর বানানোর পরিকল্পনা নেবে, নারীদের উন্নত মানের ফিড দেবে, যাতে দেশে বেশি পরিমাণে নারীদুগ্ধ মাতৃদুগ্ধ উৎপাদিত হয়।
হাসান জিজ্ঞেস করে, মাতৃদুগ্ধ থেকে কি আমরা আমাদের অতি প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবো?
নারীবাদী বলেন, হ্যাঁ, তা খুবই পারা যাবে। বছরে যদি আমরা কয়েক কোটি লিটার মাতৃদুগ্ধ উৎপাদনা করি, তাহলে তা পলিথিনের ব্যাগে ভ’রে বেচা যাবে, ওই দুগ্ধ থেকে বাটার চিজ ঘি কন্ডেন্স্ড্ মিল্ক আইস ক্রিম উৎপাদন করা যাবে, হা হা হা, হা, বিদেশে রপ্তানি করা যাবে, তখন নিজেরা অবশ্য খেতে পাবো না।
হাসান বলে, আপনার কথা বেশ নেগেটিভ ব’লে মনে হচ্ছে।
নারীবাদী বলেন, কোথায় নেগেটিভ? আমি তো খুবই পজিটিভ কথা বলছি। ব্যাপারটি হচ্ছে ওরা নারীদের ঘরে আটকে রাখার নতুন নতুন ফর্মুলা বের করছে। ওরা নারীর মগজ চায় না ওলান চায়, মেধা চায় না দুগ্ধ চায়, আর নারীর ঐতিহাসিক দেহখানা তো আছেই। মাতৃদুগ্ধ পান করানো হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে নতুন সুন্দর ফর্মুলা নতুন নতুন চক্রান্ত।
হাসান জিজ্ঞেস করে, মাতৃদুগ্ধ পানে কি কোনােই উপকার হয় না?
নারীবাদী বলেন, দেশে কোটি কোটি বাচ্চা মায়ের দুধ খাচ্ছে, তাতে কি তাদের স্বাস্থ্য মেধা অতুলনীয় হচ্ছে? আর মায়ের দুধে প্রতিভা? মায়ের দুধে নৈতিকতা? রবীন্দ্রনাথ তো মায়ের দুধ না খেয়েই প্রতিভাবান হয়েছেন, আর বস্তির বাচ্চাগুলো মায়ের দুধ খেতে খেতে ম’রে যাচ্ছে। ওই দারোগা পুলিশ মাস্তানগুলো তো মায়ের দুধ খেয়েছে, ওই জেনারেলগুলোও মায়ের দুধ খেয়েছিলো। তাতে কি তারা নৈতিক হয়েছে? হা হা হা হা।
হাসান জিজ্ঞেস করে, বুড়োদের মাতৃদুগ্ধ খাওয়ালে উপকার হ’তে পারে?
নারীবাদী বলে, হ্যাঁ ওই বদমাশ বুড়োগুলোকে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানাে দরকার; তাহলে হয়তো বদমাশি কিছুটা কমবে।
হাসান নারীবাদীটির সাথে কথা বন্ধ ক’রে তার সামনের একগুচ্ছ দৈনিক পত্রিকার একটির পাতা উল্টোতে শুরু করে; দ্বিতীয় পাতায় একটি সংবাদ তাকে যারপরনাই স্বস্তি দেয়। বাক্স ক’রে সংবাদটি ছাপা হয়েছে, যার শিরোনাম ‘স্ত্রীর স্তন্য পান ক’রে বেঁচে আছেন মোহাম্মদ ফজর আলি’। সংবাদে বলা হয়েছে মোহাম্মদ ফজর আলি বছর বছর বিয়ে ক’রে চলছেন, তার ঘরে সব সময়ই কমপক্ষে একটি ক’রে গর্ভবতী স্ত্রী থাকে, এবং থাকে একটি নতুন সন্তানবতী স্ত্রী। মোহাম্মদ ফজর আলি তাঁর শিশু সন্তানকে মায়ের স্তন্য পান করতে দেন না, তিনি নিজেই স্ত্রীকে চেপে ধ’রে সকাল দুপুর বিকেলে রাতে চারবেলা স্ত্রীর দুগ্ধ পান করেন। স্ত্রীর পুষ্টিকর দুগ্ধ পান না করলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তার গর্দান সরু হয়ে যায়; তাই এই কাজ তিনি ক’রে আসছেন তিরিশ বছর ধ’রে। এবার তিনি গোলমালে পড়েছেন, তিনি নতুন বিউটির স্তন্য পান করতে গেলে বউটি তাকে বাধা দেয়, তিনি জোর ক’রে তিন মাস ধরে স্ত্রীর স্তন্য পান করেন, শিশু কন্যাটিকে স্তন্য পান করতে দেন না। মোহাম্মদ ফজর আলি হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠলেও শিশুটি দিন দিন রোগাপটকা হয়ে পড়তে থাকে। স্বামীর স্তন্যপাননেশা বন্ধ করতে না পেরে অবশেষে বউটি গিয়ে থানায় মামলা দায়ের করে; এবং নীতিপরায়ণ পুলিশ ফজর আলিকে গ্রেফতার করে।
হাসান সংবাদটি পড়ে অভিবাদন জানায় মোহাম্মদ ফজর আলিকে।
হাসান এবার আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করে যে নারীদের স্তন্য জাতীয় সম্পদ, তা নষ্ট হ’তে দেয়া যায় না। গরিব দেশে প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি লিটার মাতৃদুগ্ধ; কিন্তু ওই মূল্যবান জাতীয় সম্পদ নষ্ট হ’তে দেয়া যায় না। মােহাম্মদ ফজর আলিকে হাসানের পথপ্রদর্শক ব’লে মনে হয়–আবার অভিনন্দন জানায় সে মোহাম্মদ ফজর আলিকে। জাতিসংঘ কি তাঁকে নেবে?
আহমেদ মাওলা, বিজ্ঞাপন নির্বাহী, তাকে ডেকে পাঠায় অ্যাড দুটির মেসেজ বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে।
আহমেদ মাওলা বলে, বোঝাতেই পারছেন অ্যাড দুইটা ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড এইট্টি ডিগ্রি অপজিট, একটায় আমাগো নীতিকথা শুনাইতে হইবো, কোনো মাল ব্যাচতে হইবো না, মেসেজ ব্যাচতে হইবো ফিলসফি ব্যাচতে হইবো এথিক্স ব্যাচতে হইবো মরালিটি ব্যাচতে হইবো; আরেকটায় মাল ব্যাচতে হইবো, খাঁটি মাল যা গরুর বান থিকা বাইর হয়, তা গুড়া কইর্যা ব্যাচতে হইবো, ফিলসফি মরালিটি এথিক্স কয়েক মাসেই ফুরাই যাইবো, কিন্তু মাল থাকবো। এই কথা মনে রাইখ্যা স্ক্রিপ্ট ল্যাখবেন।
হাসান বলে, দুটিকেই আমার শয়তানদের কাজ মনে হচ্ছে।
আহমেদ মাওলা বলে, আরো পয়েট ভাই, শয়তানরাই দুনিয়া চালাইতেছে, আমাগো কাম হইতেছে শয়তানগো গ্রেট গড বাগান। আইচ্ছা কইর্যা স্ক্রিপ্ট লেইখেন। কবিতা ত আইচ্ছা কইর্যাই লেখেন, দেখি এইবার স্ক্রিপ্ট লেখনের ট্যালেন্ট আছে কেমন। দুই এক দিনের মইধ্যেই লেখন শ্যাষ করতে হইবো।
হাসান দুটি অ্যাডের স্ক্রিপ্টই বিস্তৃতভাবে লিখে ফেলে। মাতৃদুগ্ধ অ্যাডের জন্যে সে দুটি ক’রে স্ক্রিপ্ট তৈরি করে–প্রিন্ট মিডিয়ার জন্যে দুটি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার জন্যে দুটি, তার বেশ মজা লাগে; আর ‘রাধিকা’র জন্যে তৈরি করে তিনটি ক’রে স্ক্রিপ্টপ্রিন্ট মিডিয়ার জন্যে তিনটি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার জন্যে তিনটি, অসাধারণ মজা লাগে তার। হাসানের মনে হয় সে নতুন ধরনের পদ্য লিখছে, শয়তানের পদ্য, মহান শয়তান ক্ষমা কোরো মোর সীমাহীন দুঃখে, যে-পদ্য সক্রিয়, সে-পদ্য কাজ করবে, যে-পদ্য বস্তু বিক্রি করবে, যে-পদ্য অর্জন করবে মহাজগতের শ্রেষ্ঠ সাফল্য–টাকা-আমর উজ্জ্বল মেধাবী প্রতিভাবান।
বেশ ভেবেচিন্তে কেটে ছিঁড়ে পাতার পর পাতা নিউজপ্রিন্ট ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে সে শিরোনাম, উপশিরোনাম, পাঠ, অডিও, ভিডিও, উপসংহার তৈরি করে। এই প্রথম সে নিউজপ্রিন্টের প্যাডে লিখছে, অদ্ভুত বস্তু মনে হয় এটাকে তার, বলপয়েন্ট আর নিউজপ্রিন্ট কাছাকাছি এলেই একটা বিস্ফোরণ একটা দুর্ঘটনা ঘটে—শুধু লিখতে আর কাটতে আর ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়, মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত বাস্কেট, সারা পৃথিবী, ডাঁই ডাঁই ছেঁড়া নিউজপ্রিন্টে ভরে ফেলি। কিন্তু তাকে পারতে হবে; কবিদের পারতে হবে, নিজেকে সে বলে, কবি না পারলে আর কে থাকে যে পারে? তাই তাকে পারতে হবে। মাতৃদুগ্ধ অ্যাডটিতে তার ভাষার কণ্ঠ চিরসত্যের, জিহোভা ঈশ্বর হোলি ঘোস্ট উজ্জা প্রকাশ করছে। ওই পরম সত্য, ওই ধ্রুব সত্য থেকে স’রে গেলে ধ্বংস হয়ে যাবে। সব কিছু, মরুভূমিতে পরিণত হবে মহাসমুদ্র, চানসুরুজ আর দশ আসমান মাটিতে নেমে আসবে, আর ‘রাধিকা’য় তার ভাষার স্বর উদ্দীপক উষ্ণ সুস্বাদু পুষ্টিকর, শিশুরা রাধিকার বাঁট ধ’রে ঝুলে থাকবে বছরের পর বছর।
তার স্ক্রিপ্ট প’ড়ে আহমেদ মাওলা ছুটে আসে তার ডেস্কে। চমৎকার, যাকে বলে মাইডিয়ার, মানুষ আহমেদ মাওলা।
আহমেদ মাওলা খুশিতে ফেটে পড়ে বলে, আরো পয়েট ভাই, দারুণ স্ক্রিপ্ট ল্যাখছেন আপনে, দুইটাই হিট হইবো, সুপারহিট; এখন আমার মাথা ঘোরছে স্ক্রিপ্ট বাছাই করতে গিয়া, কোনটা থুইয়া কোনটা রাখি। মনে করছিলাম পয়েট দিয়া ব্যাচাকেনা হইবো না, এখন দেখছি পয়েট ছাড়া কাম হইবো না।
হাসান বিব্রত হয়ে বলে, আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম, এখনো আমার মনে হচ্ছে হয়তো কিছুই হয় নি। এগুলো কবিতা হ’লে আমি ছিঁড়ে ফেলে দিতাম।
আহমেদ মাওলা বলে, স্ক্রিপ্ট পাওয়ার পর আমার সাতদিন ঘষাঘষি করতে হয়, আর এই স্ক্রিপ্ট লইয়া কাইলই কামে নামতে পারি। স্পন্সরগো লগে কথা বইল্যা ঠিক করতে হইবো কোন স্ক্রিপ্টটারে রাখুম কোনটারে ছারুম।
হাসান বলে, আমাকেও ডাকবেন, কীভাবে আপনারা কাজ করেন দেখবো।
আহমেদ মাওলা জিজ্ঞেস করে, ভিডিওর সময় থাকতে চান নি?
হাসান বলে, হ্যাঁ, ওটা এখনো আমার কাছে বিস্ময়।
আহমেদ মাওলা বলেন, বোঝতে পারছি মাইয়া দ্যাখতে চান, তা মাঝেমইধ্যে দাখন ভাল; তাতে স্ক্রিপ্টও ভাল হইবো, মডেলগুলিরেও একটু লাড়াচাড়া করা যাইবাে। দুইটা খুব ডগমইগ্যা সেক্সি মডেল লাগবাে। মাতৃদুগ্ধের মাটারে হইতে হইবাে মধুবালার মতন সেক্সি, মা সেক্সি না হইলে পোলাপান মার দুধ খাইতে চাইবো ক্যান? বুকের দুধ খাওয়াতে হইলে মাগুলিরে সেক্সি হইতেই হইবো। আর হইবো বুক ভরা মধু বঙ্গের বধু। এমুনভাবে ক্যামেরা চালাইতে হইবো যে পোলাপান ক্যান বাপোরাও দুধ খাইতে চাইবো।
হাসান বলে, তাহলে আমি পুরোপুরি ব্যর্থ হই নি? কবিরাও পারে?
আহমেদ মাওলা বলেন, যা স্ক্রিপ্টট ল্যাখছেন তার জাইন্যে আপনেরে প্রাইজ দিমু, একটা মিল্কি মডেলের গে এক সন্ধ্যা ছাইর্যা দিমু। অইটা ঠিক রাধিকার অস্ট্রেলিয়ান গাভীটার মতন, যত ইচ্ছা ওলানা থিকা দুধ খাইবেন।
হাসানের মনে হচ্ছে সে দুটি বিপরীত দেবী না উর্বশী না পরিহাসের সাধনা ক’রে চলছে; একটা অ্যাডের আরেকটি কবিতার; একটি তাকে বেতন দিচ্ছে ডেস্ক দিচ্ছে মাইক্রোবাসে নিচ্ছে আনছে টেলিফোন দিচ্ছে দামি সিগারেট খাওয়াচ্ছে হুইস্কি বিয়ারের সুযোগ দিচ্ছে তরুণীদের সঙ্গ দিচ্ছে, আরেকটি তাকে কিছুই দিচ্ছে না বা হতাশা দিচ্ছে ব্যর্থতা দিচ্ছে শূন্যতা দিচ্ছে, কিন্তু সেটির পুজোতেই (পুজো? সে কি পুজো ক’রে তার?) সে সুখ পায় বেশি, সেটিকেই সে পুজো করে অন্যটির সাথে বিছানায় যায়। অ্যাডের দেবী তাকে বদলে দিচ্ছে, মুখোমুখি ক’রে দিচ্ছে অজস্র অজানা বাস্তবেরও ও অবাস্তবের, তাকে খুলে দিচ্ছে, অনেক কুত্তার আর বাঘের আর বরাহের বাচ্চার সঙ্গে বসাচ্ছে, আর কবিতার দেবীও যেনো হারিতে চায় না, প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তাকে ছেড়ে দিতে চাচ্ছে না–দু-চারদিন পরপরই দিচ্ছে একটি-দুটি পংক্তি, দু-একটি চিত্রকল্প, হঠাৎ ধ্বনিগুঞ্জন, দুটি-একটি যন্ত্রণা, এবং সে ওগুলোকে কবিতায় পরিণত করছে।
দুটি সাময়িকীতে তার দু-গুচ্ছ কবিতা ছাপা হওয়ার পর সে নিজেই চঞ্চল বোধ করে, দুটি সম্পূর্ণ রাত কাটিয়ে দেয় বারবার নিজের কবিতা পড়ে, এবং নিজেকে প্রশ্ন ক’রে- কবিতাগুলো কি ঠিক এভাবেই লেখা অবধারিত ছিলো, সে কি এভাবেই লিখতে চেয়েছিলো, না কি এগুলো বাস্তবায়িত হ’তে পারতো অন্য রূপেও, এবং এগুলো আদৌ লেখার কোনো দরকার ছিলো কি না? স্ক্রিপ্টের জন্যে সে প্রশংসা পাচ্ছে, কিন্তু ওই প্রশংসাকে সে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে স্যান্ডল দিয়ে ডলছে; ব্যাকুল হয়ে থাকছে তার কবিতার জন্যে একটুকু প্রশংসার জন্যে, একটু প্ৰশংসা পেলে তা সে রক্তে গুচ্ছগুচ্ছ ফুলের মতো সাজিয়ে রাখছে। আধটুকু একটুকু প্রশংসার জন্যে সে এক সপ্তাহে দুটি আড্ডায় যায়, সিগারেট খাওয়ায় অন্যমনস্কভাবে, তবে অনেকে কেড়েই নেয় সিগারেট, তবু কারো মুখ থেকে প্রশংসা বেরোয় না; তবে সে বুঝতে পারে তার কবিতাগুলো পড়েছে। এরা, এই সম্ভাব্য মহাকবিরা, যারা নিজেদের ছাড়া অন্যদের কখনো প্রশংসা করে না।
হাসান, তুমি কেনো একটুকু প্রশংসার জন্যে কাতর? নিজেকে প্রশ্ন করে সে। ওই প্রশংসায় তো তুমি মহাকবি হয়ে উঠবে না, শহরে তোমার একটা চারতলা বাড়ি উঠবে। না, তবু তুমি কেনো সামান্য তুচ্ছ প্রশংসা চাও মনে মনে? কেনো এই এই লাল ক্ষুধা, কেনো এই সোনালি পিপাসা?
সামান্য একটু প্রশংসা হঠাৎ আলোর ঝিলিকের মতো, তাতে ভেতরের অন্ধকার কেটে যায়, শরীর জুড়ে অপার্থিব কােপন লাগে; চারতলা বাড়ি তোমাকে সে সুখ দিতে পারে না। সে নিজেকে বলে, মনে মনে বলে, কবি একটুকু প্রশংসার জন্যে নিরবধি কাল অপেক্ষা ক’রে থাকে, আমিও তো সেই কবি, অপেক্ষা ক’রে থাকবো, যদি একটু প্রশংসা পাই।
তাহলে তুমি যাও, হাঁটাে, বিব্রতভাবে গিয়ে আড়ায় বসো, প্রত্যাশা ক’রে থাকো অপেক্ষা ক’রে থাকো অসম্ভবের; তোমার ওই সঙ্গী কবিদেরই মনে করো মহাকাল, তারা প্ৰসন্ন হ’লে মহাকাল প্রসন্ন হবে। মহাকাল কী? মহাকাল তো এই তুচ্ছরাই; তারাই তো মহাকালের প্রতিনিধি।
কবিতাগুলো বেরোনোর দু-এক দিনের মধ্যেই আলাউদ্দিন রেহমান ফোন ক’রে তার কাতর রক্তে কাঁপন ধরিয়ে দেয়, অতিশয়োক্তিতে তাকে পুলকিত ক’রে তোলে; এবং দুপুরে বিয়ার খাওয়াতে নিয়ে যায়।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত তোমার স্ক্রিপ্ট ফাসক্যালাস হইছে, কিন্তু তোমার কবিতা অসাধারণ, প্রত্যেকটা লাইন আমারে কাঁপাই দিছে। স্ক্রিপ্ট তোমারে ভাত দিবো বিয়ার দিবো, আর কবিতা তোমারে বাঁচাই রাখবো।
হাসান বলে, তুমি আমার অনুরাগী বন্ধ ব’লে এতোটা প্রশংসা করছে। কিন্তু আড্ডায় গেলে শোনা যাবে ওইগুলো কবিতাই হয় নি।
হা হা হা ক’রে আলাউদ্দিন বলে, কবিরা কবে আবার অন্য কবির প্রশংসা করে? আমরা গার্মেন্টস্রা অন্য গার্মেন্টসের যেমুন প্রশংসা করি না, কবিতার ব্যবসায়েও একই ব্যাপার, অগো প্রশংসা তুমি পাইবা না। তাছাড়া অরা পড়েও না, অরা পড়ে না খালি ল্যাখে মাথায় যা পাগলামি আসে।
আলাউদ্দিন রেহমানের প্রশংসা তাকে সম্পূর্ণ ভরাতে পারে না, ভেতরে একটা বড়ো শূন্যতা থেকে যায়, তার কবিতার যদি প্রশংসা করতো রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী তাহলেও ওই শূন্যতা ভরতো না; তার সাধ হয় ওই যারা শস্তা রেস্তোরাঁয় স্টার টানছে ময়লা চা খাচ্ছে খিস্তি করছে বুকের ভেতর থেকে একটি-দুটি পংক্তি উচ্চারণ করছে, তাদের কথা শুনতে।
একদিন হেঁটে হেঁটে শেখ সাহেব বাজার রোডের এক রিকশা’আলা রেস্তোরাঁঁর আড্ডায় গিয়ে উপস্থিত হয় হাসান। রেস্তোরাঁঁর টেবিলে টেবিলে রিকশাআলারা পিরিচে ঢেলে চা খাচ্ছে দু-হাতে টেনে রুটি খাচ্ছে উচ্চস্বরে রেডিও বাজছে, তাদের লুঙ্গিগামছার গন্ধে চারদিক ভ’রে আছে; আর একপাশে সমকালীন কবিরা মহাকাল তৈরি করছে। হাসান দেখে অতিশয় উত্তেজিত অনুপ্রাণিত শিহরিত তুরীয় গলিত হয়ে আছে কবি সালেহ ফরিদউদ্দিন আর কবি আহমেদ মোস্তফা হায়দার। তাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরোতে যাচ্ছে, নবাবপুরের আলেকজান্ড্রা প্রেসে লাইনোতে কম্পোজ শুরু হয়ে গেছে, তারা কবিতার প্রুফ দেখছে আর স্টার ফুঁকছে, চায়ের পেয়ালায় ছাই বাড়ছে, নীল বলপয়েন্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম প্রেমের মতোই উজ্জ্বল অমর শাশ্বত ব্যৰ্থ।
সালেহ ফরিদউদ্দিন বলে, আসো আসো দোস্ত আমাগো কবিতার বই বাইর হইতে যাইতেছে, প্রুফ দ্যাখতাছি।
হাসানের ভেতরটা কেঁপে ওঠে; সে জিজ্ঞেস করে, কারা বের করছে? আহমেদ মোস্তফা হায়দার বলে, বাংলাবাজারের চৌধুরী ব্রাদার্স, তারা তরুণ কবিগো কাব্যগ্রন্থ বের করবে ব’লে ঠিক করছে, আমাগো দুইজন দিয়াই শুরু করছে, পরে অন্যগো কাব্যও বের করবো।
হাসানের ভেতরটা আবার কেঁপে ওঠে, একটা ঝিলিক ও একগুচ্ছ অন্ধকার তার ভেতর দিয়ে বয়ে যায়।
সালেহ ফরিদউদ্দিন কবিতার জন্যে পাগল, হয়তো পাগলের থেকেও বেশি, হয়তো সে মরবেও কবিতার জন্যে; ইংরেজিতে অনার্স ভর্তি হয়েছিলো, কবিতার জন্যে পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগে; ও যে কীভাবে বেঁচে আছে হাসান জানে না। সালেহ হাসানের থেকে বছরখানেকের ছােটাে, কিন্তু এর মাঝে অনেক বেশি কবিতা লিখে ফেলেছে হাসানের থেকে। তার সাথে হাসানের প্রথম দেখা হয়েছিলো ব্রিটিশ কাউন্সিলে। হাসানের তখন বেশ কিছু কবিতা বেরিয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়, তরুণ কবি হিশেবে একটা পরিচিতি তার গ’ড়ে উঠছে, এবং সে তা উপভোগও করছে। সে একটি টেবিলে বসে পাউন্ডের ‘একগুচ্ছ নিষেধ’ প’ড়ে বেশ মজা পাচ্ছিলো, তখন একটি বিনম্র বিব্রত লাজুক তরুণ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। গায়ে আগের দিনের দুই জেবের শার্ট, পাজামা পরা, চুল উস্কো খুস্কো, মুখে দু-এক দিনের না-কাটা দাড়ি, চোখ মান উজ্জ্বল, শরীরটা অসহায়।
তরুণটি জিজ্ঞেস করে, আপনি তো হাসান রশিদ?
হাসান একটু গোপন গৌরব বোধ করে, তাহলে তাকে এখন অনেকে চেনে।
হাসান হেসে বলে, হুঁ, আর আপনি?
তরুণটি বলে, আমার নাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন, এবার ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছি। আমিও কবিতা লিখি।
হাসান বলে, আপনার কোনো কবিতা আমি এখনো পড়ি নি। তরুণটি তখনই খাতা খুলে নিজের কবিতা সুর ক’রে পড়তে শুরু করে। হাসান বলে, ব্রিটিশ কাউন্সিলে এভাবে কবিতা পড়লে সবাই বিরক্ত হবে, চলুন বাইরে যাই।
বাইরে গিয়ে হাসানের মনে পড়ে আলাউদ্দিন রেহমানকে, যে তার নাম বদলে দিয়েছিলো; হাসানের মনে হয় মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন নামেও চলবে না; একেও ভাঙতে হবে, নাম দিয়েই শুরু হবে তার ভাঙাভাঙি।
হাসান বলে, আপনার নামটি ঠিক আধুনিক কবির নামের মতো নয়, নামটি সম্ভবত বদলাতে হবে।
মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন বলে, আমি শুনেছি আপনিও নাম বদল করেছেন, আমিও আমার নাম বদলাবো।
কিছু দিন পর মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন নিজেকে ভেঙে হয় সালেহ ফরিদউদ্দিন, এবং কবিতার জন্যে উৎসর্গ ক’রে দেয় নিজেকে, অনবরত ভাঙতে থাকে নিজেকে। প্রথম দিকে সে চলতি বাঙলা বলতো, বেশ চমৎকারভাবে বলতো, পরে অন্যদের মতো সেও মিশ্র বলতে থাকে। হাসান কখনো মিশ্রতে যেতে পারে নি, সম্ভবত সে বেশি আড্ডায় যায় না আর বেশি মেশে না ব’লে।
সালেহর কবিতায় একটা এলোমেলো সুন্দর পাগলামো আছে, শব্দ নিয়ে পাগল কিশোরের মতো খেলা আছে, মাঝেমাঝে চমৎকার কাতর পংক্তি আছে, ছবি আছে, ভেতরে জীবনানন্দ আছে, এবং ওর মুখে একটা করুণ অসহায়তার আভা আছে। সালেহকে এজন্যে ভালো লাগে হাসানের।
সালেহর প্রিয় অভ্যাস নিজের কবিতা প’ড়ে শোনানো; শুধু প’ড়ে নয় নিজের কবিতা সে অনর্গল আবৃত্তি করতে ভালোবাসে।
ওর আরো একটি প্রিয় অভ্যাস অন্যের কোনো পংক্তি ভালো লাগলে সেটাকে নিজের কবিতার ভেতর সে অনায়াসে ঢুকিয়ে দেয়। তাই ছাপানোর আগে সালেহকে কবিতা শোনাতে ভয় হয়, হয়তো কোনো পংক্তি সে হরণ ক’রে নেবে, ছাপিয়ে ফেলবে, তখন পুরো কবিতাটিই বাতিল হয়ে যাবে।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকার সময় কোনো কোনো দিন হঠাৎ ছিন্নভিন্ন ওয়ার্ডস্ওয়ার্থি মেঘের মতো তার ঘরে আসতো সালেহ, বলতো দোস, তোমার হলে খাইতে আসলাম তোমার হলের চ্যাপ্টা রান আর টেবিলগুলি আমার খুব ভালো লাগে, তোমার লগে খাইলে প্যাট ভরে।
সে নিজের কবিতা আবৃত্তি করতে থাকতো, এমন কি খাওয়ার সময়ও। হাসান সব সময়ই লজ্জা পায় নিজের কবিতা আবৃত্তি করতে, অন্যকে পড়ে শোনাতে; কিন্তু সালেহর এটা বড়ো আনন্দ। খাওয়ার পর নিজের কবিতা আবৃত্তি করতে করতে তার ক্যাপস্টেনের প্যাকেট থেকে একটার পর একটা সিগারেট ধরাতো, তারপর বলতো, দোস, পাঁচটা ট্যাকা দেও, সিনেমা দেখুম।
হাসান অবাক হতো, ও কী ক’রে ওই পচা দুৰ্গন্ধপূর্ণ আবর্জনা দেখে, আবার সিনেমার থেকে বহুদূরবর্তী কবিতা লেখে!
কবিতার জন্যে সে সব ছেড়েছে, এমন কি ছেড়েছে নিজের শরীরটিকেও, ওর শরীরটি নানাভাবে ভাঙছে বলে মনে হচ্ছে হাসানের।
হাসান জিজ্ঞেস করতো, শুধুই কি সিনেমা দেখবে, না কি অন্য কিছুও?
সালেহ লজ্জা পেয়ে বলতো, হল থিকা একবার ব্ৰোথোলেও যামু, দোস।
আহমেদ মোস্তফা হায়দার একটু অন্যমনস্ক ধরনের, আল্পতেই ভেঙে পড়তে চায়, কিন্তু ভেঙে পড়বে না ব’লেই মনে হয়; একটি দৈনিকে কাজ করে। পাশের বাড়ির একটি ইস্কুলে-পড়া মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিলো আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, এবং কয়েক দিন পর ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলো। পালানোর জন্যে তারা নদী সাঁতরে গিয়েছিলো, কিন্তু মেয়েটিকে সে ধ’রে রাখতে পারে নি। ওই মেয়েটির জন্যে শোক চিরকালের জন্যে লেগে আছে আহমেদের চোখে মুখে চুলে কণ্ঠস্বরে। আহমেদ কাতর সেন্টিমেন্টাল প্রেমের কবিতা লিখে চলছে, প্রতিটি বাক্যের শেষে অশ্রুর মতো একটি ক’রে বিস্ময়চিহ্ন বসাচ্ছে, হয়তো সারাজীবনই বসাবে। হয়তো এজন্যেই আহমেদ মোস্তফা হায়দারকে ভালো লাগে হাসানের।
দুটি টেবিল ঘিরে চলছে। জমজমাট আড্ডা, সিগারেটের ছাই জমছে পিরিচে কাপে; পাশাপাশি ব’সে প্রুফ দেখছে আহমেদ ও সালেহ। তাদের মুখোমুখি একটি নড়োবড়ো চেয়ারে বসে হাসান।
তাদের প্রুফের গুচ্ছগুচ্ছ নিউজপ্রিন্ট থেকে একটা ভেজা ভারি অদ্ভুত সুগন্ধ এসে ঢুকে যাচ্ছে হাসানের বুকের ভেতর, হয়তো কবিতার গন্ধ; আর নিউজপ্রিণ্টের প্রুফে লাইনো অক্ষরগুলোকে নক্ষত্রের থেকেও জ্বলজ্বলে দেখাচ্ছে।
হাসান বলে, লাইনের অক্ষরগুলো দেখতে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে, এগুলোর সম্ভবত সুগন্ধ পাচ্ছি।
সালেহ ফরিদউদ্দিন বলে, আরে দোস, লাইনো আর কবিতা একই কথা, লাইনােতে না ছাপলে কোনাে কিছুই কবিতা মনে হয় না।
আহমেদ মোস্তফা হায়দার বলে, লাইনো মিন্স্ পোয়েট্রি, এই জন্যেই তা হাইট্টা হাইট্টা নবাবপুর যাই, যখন ঝনাৎ ঝনাৎ কইর্যা লাইনগুলি পড়ে মনে হয় আমার ভিতর থিকা ঝনাৎ ঝনাৎ কইর্যা কবিতার লাইন বাইর হইতেছে।
হাসান বলে, তোমার কবিতার লাইন তো ঝনাৎ ঝনাৎ ক’রে বেরোনোর কথা নয়, ওগুলো তো অশ্রদ্ধর মতো গড়িয়ে বেরোনোর কথা।
হৈ হৈ ক’রে ওঠে আহমেদ, দোস, অশ্রু জইম্যা সীসা হইয়া গ্যাছে, আইজ লাইনো অক্ষর হইয়া ঝানাৎ ঝনাৎ কইর্যা পড়ে।
খুব সুখী মনে হচ্ছে আহমেদ মোস্তফা হায়দার ও সালেহাকে। ওরা প্রুফ দেখছে, কিন্তু শুধু বানান দেখছে না, পাণ্ডুলিপির সাথে মিলিয়ে দেখছে না, নতুন নতুন পংক্তিও যোগ করছে প্রুফে। আর প্রুফের চিহ্নগুলো দিচ্ছে পরম আদরে, ক্লাশের খাতায় ওরা কখনো এতো আদরে কিছু লেখে নি। প্রুফের চিহ্নগুলোকে রহস্যময় মনে হচ্ছে হাসানের; সে কখনো প্রুফ দেখে নি, তাই ওই চিহ্নগুলোর অর্থ সে বুঝতে পারছে না, তাকিয়ে থাকছে ওদের আঙুলের দিকে, কবিতার থেকেও রহস্যময় চিহ্ন রাশি নিৰ্গত হচ্ছে ওদের আঙুল থেকে।
সালেহর থেকে প্রচ্ছদের কয়েকটি পাতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে হাসান। একদিন কি এমন প্রুফ সেও দেখবে, বর্ণের ওপর দাগ দেবে, শব্দ ফাঁক করবে, যুক্ত করবে, পাতার পাশে এই বিস্ময়কর চিহ্নগুলো বসাবে? বেশ কয়েকটি বানান ভুল রয়ে গেছে সালেহর প্রুফে, কিছু বাক্যও অশুদ্ধ।
হাসান একটি শব্দ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, সালেহ এই শব্দটি কী?
সালেহ বলে, আরো দোস, শব্দটা হইল ‘মুমুর্ষ’, মানে মরা মরা।
সে কি শব্দটি ঠিক ক’রে দেবে?
হাসান বলে, সালেহ, শব্দটির বানান। কিন্তু ‘মুমূর্ষ’। সালেহ বলে, আরো দোস, বানানে কি হয়, কবিতা হইলেই হইল, কবিগো বানান লাগে না, তুমি ত আবার আমাগো থিকা বানান বেশি জানো, দেও দেও দোস বানানটা শুদ্ধ ক’রে লই।
সালেহ বানানটি শুদ্ধ ক’রে নেয় প্রুফে।
সালেহ বলে, দোস, তোমারও একটা বই বাইর হওন দরকার। বিয়ার বয়সের মতন প্রথম কাব্যগ্রন্থ বাইর করনেরও একটা বয়স আছে।
তার হৃৎপিণ্ডটি বিপজ্জনকভাবে লাফিয়ে ওঠে, থামতে চায় না।
হাসান বলে, না, না, এখনো সময় আসে নি; আমি বেশি কবিতা লিখি নি।
আহমেদ মোস্তফা বলে, আরে দোস, বিনয় কইরো না, ছয় ফর্ম পদ্য তুমিও ল্যাখছো, অই যে দুইটা গুচ্ছ ছাড়লা তাতেই তা তিন ফর্ম হইয়া যাইবো। যাও, কবিতার বইর নাম ঠিক কইর্যা ফালাও।
হাসান বিব্রতভাবে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কি আমার কবিতাগুলো পড়েছে?
সালেহ বলে, পরুম না ক্যান, ভালই ল্যাখছো দোস, যাও, কপি বানাই ফালাও, আমাগো বইর পর তোমার বইও চৌধুরী ব্রাদার্স বাইর করবো।
ওদের এই সামান্য কথা, ওরা তার কবিতা পড়েছে, এটাকেই হাসানের মনে হয় শ্ৰেষ্ঠ প্ৰশংসা; যেনো মহাকাল বলছে, কপি বানাই ফালাও, কবিতার বইর নাম ঠিক কইর্যা ফালাও।
কিন্তু চৌধুরী ব্রাদার্স কি তার নাম জানে? কী ক’রে জানবে? সে তো কখনো কোনো প্রকাশকের কাছে যায় নি, আর সে শুনছে প্রকাশকরা কবিতা পড়ে না, বই পড়ে না, বই ছাপে। তারা কি ছাপিবে তার কবিতার বই? প্রথম কাব্যগ্রন্থ?
বাসায় ফেরার সময় রিকশা নিতে ইচ্ছে হয় না তার, সে হেঁটে হেঁটে একটির পর একটি ক্যাপস্টেন টানতে টানতে মহাকালের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, মহাকালের গ্ৰীবা দেখতে পায়, যেনো তাকে কে যেনো ডাকছে সে তার পেছন পেছন হাঁটছে, এই হাঁটা ফুরোবে না কোনোদিন। তার হাঁটা অনন্ত হোক, গন্তব্যহীন হোক, অশেষ হোক; সে শুধু হাঁটবে, কোনোদিন পৌছোবে না, হাঁটাই গন্তব্য। সে কি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রেসকপি বানাবে, তৈরি ক’রে ফেলবে পাণ্ডুলিপি, ঠিক ক’রে ফেলবে বইয়ের একটা নাম? চিরকালের জন্যে ওটিই হয়ে যাবে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম? শিউরে ওঠে হাসান, তার মনে হয় সে এমন কিছু সম্পর্কে ভাবছে যা সম্পর্কে বাস্তবে বাস ক’রে ভাবা উচিত নয়, ভাবা উচিত স্বপ্নে, বা একলা পানশালায় বসে প্রচুর বিয়ার পান করতে করতে। অনেকগুলো কবিতার পংক্তি অনেকগুলো চিত্রকল্প তার মাথায় বাকব্যাক ভোরের টিয়ের মতো উড়ছে, এদিকে যাচ্ছে সেদিকে যাচ্ছে, সেগুলোকে সে খাতার খাঁচায় ধরতে পারছে না, ধরতে গেলেই ওড়া বন্ধ ক’রে দিচ্ছে ডাক বন্ধ ক’রে দিচ্ছে ওই বিস্ময়কর সবুজ স্বপ্নগুলো, সেগুলোকে কি সে ধরবে না? কী নাম রাখবে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের? একটি একটি ক’রে নাম ভেসে আসতে থাকে, উড়ে যেতে থাকে;
ইচ্ছে করে বুকের ভেতরে।
হাঁটতে হাঁটতে নিজের কবিতার নাম ও পংক্তি একটি একটি ক’রে মনে আসতে থাকে হাসানের; এবং এক সময় সব কিছু এলোমেলো হয়ে তার মগজে খেলা করতে থাকে। পূর্বপুরুষদের বিস্ময়কর পংক্তির পর পংক্তি।
পাতার আড়াল হতে বিকালের আলোটুকু এসে আরো কিছুখন ধ’রে ঝালুক তোমার কালো কেশে।
কবিতা, মানসী, তুই প্রাসাদের উপাসক, জানি। কিন্তু বল, যখন প্রদোষকালে, হিমেল বাতাসে, নির্বোদে, নীহারপুঞ্জে জানুয়ারি কালো হয়ে আসে–নীলাভ চরণে তোর তাপ দিবি, আছে তো জ্বালানি?
আনরিয়েল সিটি, আন্ডার দি ব্ৰাউন ফগ অফ এ উইন্টার ডন, এ ক্রাউড ফ্লোউড ওভার লন্ডন ব্রিজ, সো মেনি, আই হ্যাড নট থট ডেথ হ্যাড অন ডান সো মেনি।
সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভোরের জন্যে অপেক্ষা করছিল।
থিংজ ফল অ্যাপার্ট; দি সেন্টার ক্যানট হৌল্ড; মেয়ার অ্যানার্কি ইজ লুজ্ড্ আপন দি ওয়ার্ল্ড’ দি বেস্ট ল্যাক অল কনভিকশন, হোয়াইল দি ওয়স্ট আর ফুল অফ প্যাশোনেট ইন্টেনসিটি।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী; একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে, থামিল কালের চিরাচঞ্চল গতি।
আই হ্যাভ সাং উইমেন ইন থ্রি সিটিজ ৷ বাট ইট ইজ অল ওয়ান। আই উইল সিং অফ দি সান।
অ্যামং টুয়েন্টি স্নোয়ি মাউন্টেন্স দি অনলি মুভিং থিং ওয়াজ দি আই অফ দি ব্ল্যাকবার্ড।
তুমি ভ’রে তুলবে, তাই শূন্যতা। তুমি আসবে উষ্ণতা, তাই শীত।
আই হ্যাভ মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।
এই সব অবিস্মরণীয় জলের মতো ঘুরে ঘুরে বুকের ভেতর কথা বলা পংক্তির ভেতর থেকে আবার জেগে ওঠে নিজের পংক্তিমালা, এগুলোর পাশে তারগুলোকে কি খুব করুণ গরিব দেখাচ্ছে? নিজের পংক্তিমালার উদ্দেশে সে বলতে থাকে :
আমার করুণ গরিব বিপন্ন রুগ্ন পংক্তিমালা
তোমরা জেগেছো তোমরা জন্মেছো আমার ভেতর থেকে
আমি সামান্য, তোমাদের আমি অমরত্ব দিতে পারি নি
ক’রে তুলতে পারি নি অবিস্মরণীয়
তোমরা হয়তো কবিতাও হয়ে ওঠে নি
তোমরা হয়তো কারো হৃদয়েই ঢুকতে পারবে না
ঢুকতে পারবে না। কারো রক্তে
কিন্তু তোমরা নতুন তোমরা এই ভয়ঙ্কর সময়ের
তাই তোমরা হতে পারো কাব্যগ্রন্থ।
তোমরা সূচনা, একদিন দেখা দেবে তারা
যারা বেঁচে থাকবে, হবে অবিস্মরণীয়।
কয়েক দিনের মধ্যে দুটি ঘটনা ঘটে যায়; হাসান দেখে তার ভেতর একটি অন্য হাসান জ্বলছিলো। সে-আগুন হঠাৎ বের হয়ে ঝলসে দেয় প্রথাগত ভাবনার মুখমণ্ডল। নিজের এ-রূপ দেখে সে বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়, আর অন্যরা তাকে ভয় পেতে থাকে, যদিও সে মনে করে সে ভীতিকর নয় একটুও।
গাড়লদের একটি ভাঙাচোরা দুর্গ আছে, ওই পদ্মলোচনের নাম অ্যাকাডেমি; কিন্তু ওটা একটা গোশালা একটা ছাগশালা।
সেখানে পালিত হবে সুকান্তজয়ন্তী;–দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর গরু গাধা মোষ খচ্চর সিংহ সবাই সমাজতান্ত্রিক হয়ে উঠছে; ওই দুর্গের একজনের সাথে একদিন দেখা হয়ে যায় হাসানের, যে পছন্দ করে হাসানকে। হাসান ওই অনুষ্ঠানে স্থান পায় আলোচক হিশেবে। একরাশ বাজেকথা, ভজভজে বাজেকথা, হবে বটগাছের নিচে, হাসান জানে, যেমন হয়ে আসছে। বছরের পর বছর; কোনো পদস্থ মুর্খ সুকান্তের কবিতা থেকে একশো চল্লিশটা উদ্ধৃতি দিয়ে একটা চল্লিশ মিনিটের প্রবন্ধ পড়বে, তারপর আলোচকেরা প্রবন্ধের কথা ভুলে বিশ্বজগত ভুলে অনর্গল আবোলতাবোল বকবে প্যাচাল পাড়বে। বড়ো গৌরবের কথা, সে আলোচক হয়ে উঠছে। এবার একটি বিশেষ আকর্ষণও আছে, কলকাতা থেকে প্রধান অতিথি হয়ে আসছেন সুকান্তের ভাই। ভেতরে একটা কাঁপনও লাগে, সে মঞ্চে কথা বলতে পারবে তো, পা কেঁপে উঠবে না তো, গলা শুকিয়ে যাবে না তো, চোখে অন্ধকার দেখবে না তো? সে যখন জানতে পারে প্রবন্ধ পড়বে অধ্যাপক জমিরালি পিউবিক হ্যায়ার ড্রেসার, সে হো হো ক’রে ভেতরে ভেতরে হাসে, সুকান্তের সমস্ত কবিতাই হয়তো জমিরালি সাহেব উদ্ধৃত করবে প্রবন্ধে। সে আলোচনা করবে জমিরালির প্রবন্ধ? একবার ইচ্ছে হয় গিয়ে ব’লে আসে সে আলোচনায় অংশ নিতে পারবে না, জমিরালির প্রবন্ধে আলোচনার যোগ্য কিছু থাকবে। না। জমিরালির মুখোমুখি হ’তে হবে তাকে? বিশ্ববিদ্যালয়ে জমিরালি তার শিক্ষক ছিলো, কিন্তু জমিরালির কাছে থেকে সে কিছু শেখে নি, যেমন কিছুই শেখে নি কদম আলি মনু মিয়া তোরাব উদ্দিন সোরাব চাকলাদারের কাছে; এবং সে তো জমিরালি ও অনেককেই ঘৃণা করে। জীবনে কখনাে তাদের মুখ যে সে দেখতে চায় না। জমিরালি যে তার শিক্ষক ছিলো এটাও সে আর স্বীকার করতে চায় না বা স্বীকার করলে সব কিছু নিরর্থক হয়ে ওঠে। শিক্ষক শিক্ষক শিক্ষক, কাকে বলে শিক্ষক? সে নিজেকে বলে, এটা এক আকস্মিক দুর্ঘটনা কে কখন কোথায় কোন অবস্থায় থাকে, ক্লাশকক্ষে কে শিক্ষক হিশেবে ঢোকে কে ঢোকে ছাত্র হিশেবে।
অনুষ্ঠানের বিকেলে হাসান গিয়ে দেখে লোকজন আসতে শুরু করেছে।
বটগাছের সামনে সারিসারি চেয়ার পাতা, সে একজন আলোচক ব’লে বেশ বিনয়ের সাথে এক কর্মকর্তা তাকে সামনের সারির একটি চেয়ারে বসান। খুবই বিব্রত বোধ করে হাসান। সে আলোচক? তার কাছে হাস্যকর মনে হয় এটা। ইচ্ছে করে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু সে চুপচাপ বসে থাকে, এমন সময় অধ্যাপক জমিরালি বেশ হাসিখুশি মুখে তাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়। জমিরালি মনে করেছিলো হাসান উঠে তাকে সালাম দেবে, কিন্তু হাসান সে-সব কিছুই করে না। জমিরালির হাসিটা কালো হয়ে ওঠে। তার কালো হাসিটা দেখে বেশ সুখ পায় হাসান।
কিন্তু জমিরালি দমার পাত্র নয়, সে তার মর্যাদা রক্ষা ক’রে ছাড়বে।
সে আবার হেসে বলে, তুমি হাসান রশিদ না?
হাসান কোনো উত্তর না দিয়ে একটি পায়ের ওপর আরেক পা দিয়ে বসে, এবং পকেট থেকে বের ক’রে একটি সিগারেট ধরায়।
জমিরালি আবার হেসে হেসে বলে, আমার কি ভুল হচ্ছে, আমার কি ভুল হচ্ছে, তুমি হাসান রশিদ না?
হাসান ধুঁয়ো ছাড়তে ছাড়তে বলে, হু, আমি হাসান রশিদ, আর আপনি?
কেঁপে ওঠে জমিরালি, তুমি আমাকে চিনতে পারলে না, তুমি আমাকে চিনতে পারলে না? আমি তোমার শিক্ষক।
হাসান বলে, না, চিনতে পারলাম না। শিক্ষক? ইস্কুলের পর আমার আর কোনো শিক্ষক নেই।
জমিরালি টলতে টলতে অন্য দিকে পা বাড়ায়, মাটিতে প’ড়ে যাবে মনে হয়, তবে দু-তিনটি সালাম পেয়ে আবার সুস্থ বোধ ক’রে ঠিক মতো দাঁড়ায়।
মঞ্চে ছটি চেয়ার; এক সময় অনুরোধ করা হয় সভাপতি, প্রধান অতিথি, প্রাবন্ধিক, ও তিনজন আলোচককে মঞ্চে উঠতে। হাসান, সবচেয়ে তরুণ, সবার শেষে মঞ্চে উঠে। উত্তরতম চেয়ারটিতে বসে। জমিরালি সভাপতি আর প্রধান অতিথির সাথে প্রচুর কথা বলতে চেষ্টা করছে; সে সম্ভবত পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে নি, প্ৰবন্ধ পড়ার আগে সুস্থ হয়ে উঠতে চাচ্ছে, কিন্তু সুস্থ হয়ে উঠতে পারছে না। হয়তো সারাজীবনেও সে আর সুস্থ হবে না, অসুস্থতাটা থেকে যাবে, অন্তত হাসানের কথা মনে পড়লে; কিন্তু হাসান কয়েক বছর পর আজই চমৎকার সুস্থ বোধ করছে, তার মাংস প্রসন্নতা বোধ করছে।
হ্যাঁ, জমিরালি জমিরালির মতোই প্ৰবন্ধ লিখেছে, জমিরালির মতোই পড়ছে।
সময় কাটানোর জন্যে হাসান গুণে দেখতে চেষ্টা করছিলো জমিরালির প্রবন্ধে কটি উদ্ধৃতি আছে, পঁচিশটা গোণার পর ক্লান্ত হয়ে সে দূরের আমগাছের ডালে কয়েকটি ব্যস্ত কাকের কয়েকটি চঞ্চল শালিখের সৌন্দর্য দেখতে থাকে–দেখে মুগ্ধ হয়, চোখ ফিরিয়ে সামনের সারিতে বসা এক প্রচণ্ড উদ্ভিন্ন উল্লসিত চল্লিশোত্তরার দর্শনীয় সম্মুখভাগের পর্বতমালার উচ্চতা, ভর ও ওজন পরিমাপ করতে থাকে, অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে তার বক্ষবন্ধনির রঙ, বিবর্ণিতা, ও আকার নির্ণয় করতে থাকে। জমিরালির প্রবন্ধের থেকে এগুলো অনেক বেশি মননশীল, অনেক বেশি সৃষ্টিশীল; অনেক বেশি মনোযোগ দাবি করে। জমিরালি প্ৰবন্ধ পড়তে থাকে, প্রাবন্ধিক না হয়ে সে ধারাবর্ণনাকারী ও আবৃত্তিকার হ’লেই ভালো হতো; হাসানের মাথার ভেতর দিয়ে তখন ছুটে চলছে কয়েকটি কাক শালিখ, আর রানার, আঠারো বছরের দুঃসহ বয়স, বিদ্রোহ আজ বিপ্লব চারিদিকে, হিমালয় থেকে সুন্দর বন হঠাৎ বাংলাদেশ, সিগারেট, পূর্ণিমা চাঁদ যেনাে ঝলসানাে রুটি, এবং ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। ঝলসে ওঠে হাসান, আসলেই ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়? একটি গরম তাওয়া থেকে উঠে একটা তাপের প্রবাহ বয়ে যায়। তার চামড়ার নিচ দিয়ে।
জমিরালির শেষ হ’লে প্রথমে আলোচনা করার জন্যে ডাকা হয়। হাসানকে।
সে তরুণতম, সবচেয়ে নির্জ্ঞান, তাই শুরু হয় তাকে দিয়েই, এটাই সূত্র; প্রাজ্ঞ মহাজ্ঞানী মহাজনেরা, যাঁরা পাঁচশো পঁচিশ বছর ধ’রে কবিতা পড়েন না, যাদের কাছে কবিতা হচ্ছে ‘চিরসুখী জন ভ্ৰমে কি কখন’, বড়োজের ‘অন্ন চাই, প্ৰাণ চাই, আলো চাই চাই মুক্ত বায়ু’, তাঁরা পরে আলোচনা করবেন, বাণী দেবেন; বৈদিক শাশ্বত শ্লোক যতো পরে উচ্চারিত হয় ততো বেশি প্রাজ্ঞ শাশ্বত শোনায়।
হাসান কাঁপতে কাঁপতে কোনোদিকে না তাকিয়ে মাইক্রোফোনে গিয়ে সরাসরি আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছিলো, হঠাৎ তার মনে পড়ে যে সভাপতি, প্রধান অতিথি প্রমুখ বা ইত্যাদিকে স্মরণ ক’রে দু-চারটি বিশেষণ ব্যবহার করা বিধেয়, তাই সে তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে একটি দীর্ঘ বাক্য বলে–বাক্যটি ভেঙে পড়তে পড়তে শুদ্ধ হয়ে ওঠে, যদিও প্রত্যেককে তার মনে হচ্ছিলো স্তূপস্তূপ সম্মানিত পেটমােটা শূন্যগর্ভতা, অসার অপার অপদার্থতা; এবং সে আলোচনা শুরু করে।
হাসান বলে, অধ্যাপক জমিরালি সাহেবকে অশেষ ধন্যবাদ তাঁর ৬১টি উদ্ধৃতির জন্যে; তবে প্রবন্ধটি শোনার সময় তার মনে হচ্ছিলো এটা কোনো মেধাবী স্নাতক শিক্ষার্থীর লেখা, এতে সুকান্তের কবিতার বিষয়, ছন্দ, অলঙ্কার সবই উদাহরণসহ আলোচিত হয়েছে, তাঁর প্রবন্ধ শুনে সুকান্তের কবিতার আবৃত্তি শোনার সুখ পাওয়া গেছে, শুধু সুকান্তের কবিতার মর্ম বোঝা যায় নি। তবে জমিরালি সাহেবকে ধন্যবাদ উদ্ধৃতিগুলোর জন্যে, যদিও ভুল রয়েছে কয়েকটি উদ্ধৃতিতে।
হাসান অনুভব করে শ্রোতাদের মধ্যে বিকট অদ্ভুত উল্লাস আর মঞ্চে অতল অশরীরী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে।
ঘোষক এসে তার হাতে এক টুকরো কাগজ দেয়, তাতে লেখা ‘শ্ৰদ্ধা ও বিনয়ের সাথে আলোচনা করুন; আলোচনা সংক্ষিপ্ত করুন।’
হাসান কিছুক্ষণ ধ’রে কাগজটি পড়ে, তার ইচ্ছে হয়। আর আলোচনা না ক’রে মঞ্চ থেকে নেমে বটগাছের ছায়া পেরিয়ে বিক্রমপুর পার্বতীপুর সাগাইয়া কিশোরগঞ্জের ধানক্ষেতে গিয়ে চাষবাস করতে, পুকুরে পলো বা ঝাঁকিজাল দিয়ে মাছ ধরতে, বাড়ৈখালির বাজারে গিয়ে দোকানে ব’সে ঘোলাটে চা খেতে।
শ্রোতাদের মধ্যে একজন চিৎকার করে ওঠে, আপনে বলেন, হাসান রশিদ সাব, আপনে ঠিক কথাই বলতেছেন, আপনে বলেন, আমরা শোনতে চাই।
হাসান বলতে থাকে, সুকান্ত বাঙলা ভাষার একমাত্র বিশুদ্ধ মার্ক্সবাদী কবি, তার কবিতা সাম্যবাদী ইশতেহারের কাব্যরূপ। বাঙলার কবিরা সকলের কবি, তাঁরা সাধনা করেন। সকলের কবি হওয়ার, কিন্তু সুকান্ত সকলের কবি হওয়ার দুর্বলতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন; তিনি সকলের কবি হ’তে চান নি, তিনি হ’তে চেয়েছিলেন একটি শ্রেণীর কবি। সুকান্ত সকলের কবি নন, তিনি একটি শ্রেণীর কবি, তিনি দুর্গত সর্বহারা শ্রেণীর কবি।
হাসান পেছনে উচ্চ ‘না, না, না’ শব্দ শুনতে পায়; তাকিয়ে দেখে সুকান্তের ভাই, প্রধান অতিথি, চিৎকার করছেন, না, না, সুকান্ত ছিলো সকলের কবি। সুকান্ত সকলের কবি, সুকান্ত সকলের কবি।
হাসান বলতে থাকে, সুকান্তের স্পষ্ট পক্ষ ও প্রতিপক্ষ ছিলো; তিনি চাইতেন প্রতিপক্ষকে উৎখাত ক’রে নিজের পক্ষের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে।
হাসান শুনতে পায় পেছনে কে যেনো বলছে, এইটা বলা ঠিক হইতেছে না, সুকান্তকে সকলের কবি বলতেই হবে।
হাসান বলে, সুকান্তের কোনো স্ববিরোধিতা ছিলো না। নজরুলের কথা মনে পড়ছে, নজরুল কয়েক বছর বিদ্রোহী ছিলেন, কিন্তু ছিলেন স্ববিরোধী, কন্ট্রাডিকশনে পরিপূর্ণ, কিন্তু সুকান্তে কোনো কন্ট্রাডিকশন নেই।
পেছনে কে যেনো বলে, নজরুলরে টেনে আনা ঠিক হচ্ছে না, নজরুল সমালোচনার উর্ধ্বে।
হাসান বলে, সুকান্তের একটি পংক্তির সাথেই শুধু আমি দ্বিমত পোষণ করি, আর ওই পংক্তিটি তাঁর দুটি শ্ৰেষ্ঠ পংক্তির একটি; তিনি বলেছিলেন, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়; এটা খুবই স্মরণীয় পংক্তি, কিন্তু কবিতা শাশ্বত, ক্ষুধার রাজ্যেও পৃথিবী কবিতাময়।
সম্মানিত প্রাজ্ঞ আলোচকগণ এর পর আর সুকান্তের কবিতা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেন না, তারা ঝাল ঝাড়া আলোচনা করেন হাসানকে; তাঁরা সবাই অকপটে নিন্দা জানাতে থাকেন হাসানের বক্তব্যের, তাঁরা বলেন সুকান্ত অবশ্যই সকলের কবি, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী অবশ্যই গদ্যময়; আর তরুণ অর্বাচীন আলোচনা হাসান রশিদ উদ্ধত দুর্বিনীত, সে কবিতা আর সাহিত্য বোঝে না, সে এমন এক পবিত্র সভায় স্থান পাওয়ার অযোগ্য।
শ্ৰোতাদের মধ্যে থেকে দু-তিনজন প্রতিবাদ জানালে আলোচকেরা ভয় পান, তাঁরা সংযত হন; এমনকি সভাপতি হাসানের প্রশংসাও করেন।
হাসান চুপ ক’রে বসে থাকে, মাঝেমাঝে তার মনে হয় লাফিয়ে মাইক্রোফোন কেড়ে সে এসবের প্রতিবাদ করে, আবার মনে মনে সে হেসে ওঠে। সভা শেষ হ’লে আস্তে চুপচাপ নেমে আসে মঞ্চ থেকে, একাডেমির কেউ তার সাথে কথা বলে না। সুকান্তের ভাই তার দিক থেকে ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নেন।
কিন্তু মাঠে কয়েকটি তরুণ ও কয়েকটি তরুণ সাংবাদিক তাকে ঘিরে ধরে। এই তাকে প্রথম ঘিরে ধরা, এই প্রথম তার কথা শোনার জন্যে নতুন সময়ের নতুন বিকেলের প্রথম উজ্জ্বল উৎসাহ।
একটি তরুণ বলে, আপনার কথা শুনে আমরা মুগ্ধ হয়েছি, এই নতুন কথা শুনলাম, সুকান্তকে নতুনভাবে বুঝলাম।
আরেক তরুণ বলে, কবিরাও যে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন, এই প্রথম দেখলাম। আগেও কয়েকজন কবির বক্তৃতা শুনেছি, তারা আবোলতাবোল বলেন, কিছু পড়েছেন ব’লে মনে হয় না।
হাসান হেসে বলে, তাহলে আমি হয়তো কবি নাই।
একটি তরুণ সাংবাদিক বলে, আমরা আপনার কথাগুলোই রিপোর্ট করবো, বহু দিন এমন বক্তৃতা শুনি নি। মিছে কথা শুনতে শুনতে আমাদের কান প’চে গেছে।
হাসান চঞ্চল হয়ে ওঠে, তার রক্তে কিসের যেনো সুর বাজে। সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে তাহলে? নতুন কথা বলতে পারে? সত্য কথা? কবি হয়েও পারে কথা বলতে? কিন্তু সে কি কবি? কোথায় তাৱ কবিতার বই?
এক বুড়ো এগিয়ে আসেন তার দিকে।
বুড়ো বলেন, আপনার কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছি, বুড়ো বয়সে সভায় আসি সময় কাটানোর জন্যে, পচা পচা কথা শুনি মিথ্যে কথা শুনি, মনে হয় আমার সময় প্ৰভু কবে কাটাবেন; আজি সুখ পেলাম যে নতুন সত্য কথা বলার লোকও জন্ম নিচ্ছে আমাদের এই মিথ্যেবাদী সমাজে।
হাসান বলে, আপনাকে ধন্যবাদ, কিন্তু দেখলেন তো সবাই আমাকে কেমন বকাবকি করলেন; দেখলেন তো সাহিত্য সমালোচনাও এখানে রাজনীতি।
বুড়ো বলেন, ওরা মিথ্যে বলেন ব’লেই মঞ্চে জায়গা পান। আপনার জন্যে আমার ভয় হচ্ছে, এমন সত্য কথা বলতে থাকলে ভবিষ্যতে আপনি মঞ্চে স্থান পাবেন না, সমাজেও হয়তো স্থান পাবেন না।
আমি শূদ্র হয়েই থাকবো, সমাজের বাইরে নর্দমার পাশের বস্তিতে থাকবো, আমার দিকে তাকাতে সমাজ ঘেন্না বোধ করবে।
সমাজ, হায় রে সমাজ, হায় রে সুন্দর ভাগাড়।
“কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ” প্রবন্ধ বা উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ