(১)
আমি সম্ভবত দণ্ডিত মানুষ, আমি কবি।
ভোরের কাজগুলোকে অসহ্য একঘেয়ে বিরক্তিকর লাগে হাসানের; কেনো যে ভোর হয়, গোলগাল লাল সূর্য ওঠে পুব দিকে, এর থেকে চমৎকার হতো এক অন্ধকারে এক দীর্ঘ আলোতে সব কিছু কেটে গেলে;–দিনের পর দিন ঘুম থেকে ওঠে, শক্ত বস্তুটাকে চেপে একটু দ্রুত বাথরুমে যাও, ঝরঝর ঝরঝর করো, ফিরে আসো, তলপেটটাকে মুক্ত করার জন্যে লাল ঝলমলে চা খাও এক কাপ, দু-কাপ হ’লেই জমজমাট হয়, সঙ্গে পর পর দু-তিনটি সিগারেট-এ-দুটো কাজই শুধু বিরক্তি থেকে মুক্তি দেয় তাকে, তারপর গিয়ে প্যানের ওপর নতুন খালের কিনারের সেই মাথায় লাল গামছা চাষীটার মতো বসো, গলগল করো চেপে চেপে মুক্ত হও, বুনো ঘাস আগাছার মতো গজিয়ে ওঠা দাড়ি কাটাে, ফ্লাশ টানো, পানি না বেরোলে আবার টানো, বদনা লাগাও, ব্ৰাশ করো, ওপর থেকে নিচে নিচ থেকে ওপরে, জিভ শানাও খশখশ ক’রে, ভেতর থেকে ইতরের পালের মতো ছুটে আসা বমিটাকে রোধ করো, জিভটার বর্ণ গন্ধ স্বাদ বদলে যাচ্ছে দিন দিন, এক বালতি পানিতে গোশলটা তাড়াতাড়ি সেরে নাও, অত্যন্ত জঘন্য এই সাত শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি শুকুরে ভরা জীবন নামের ঢলঢলে কাজের মেয়েটি, বিশেষ ক’রে তার ভোরবেলাটি। সবচেয়ে বিশ্ৰী লাগে দাড়ি কামাতে, গালটা টনটন করে, কোনো কোনো দিন ব্লেডটাকে মনে হয় জংধরা ছুরি, অশীল অশ্লীল আগাছার মতো লোমগুলো রেখে দিতেই ইচ্ছে হয়, কিন্তু লোমগুলোকে ঘেন্না লাগে ব’লে কামানো ছাড়া উপায় নেই। প্যানের ওপর বসলে ঝলমল ক’রে মনে পড়ে ইস্কুলে যাওয়ার পথের ধারের নতুন খালটিকে, সেই চাষীটাকে মনে পড়ে, লুঙ্গি উঠিয়ে যে ‘ঙ্গ’র মতো অদ্ভুতভাবে ব’সে ছিলো চোখ বন্ধ করে, খুব কষ্ট খুব সুখ হচ্ছিলো মনে হয় লোকটির, নিজেকে ওই চাষী মনে হয়, হাসি পায় হাসানের, ভালো লাগে। বেশ হতো চাষী হ’লে; আহা, খালের পাড়ে ব’সে প্রসন্ন পর্যাপ্ত প্রকৃতি। প্যানের ওপর বসে সে দাড়ি কামানোর কাজটিও করে, এক সঙ্গে দু-কাজ- এ-অভ্যাসের জন্যে সে ধন্যবাদ দেয় নিজেকে, এটা সে কখন যে শুরু করেছিলো আজ আর মনে নেই, এটাকে তার একটা উৎকৃষ্ট পদ্যের পংক্তি মনে হয়; খুব ভালো লাগে তার যে আয়নাটায়না তার লাগে না, চোখ বুজেই সে নিজের মুখটি দেখতে পায়, চোখের ভেতরেই তার একটি আয়না আছে, আর আঙুলগুলোই কাজ করে চোখের, দশটি চোখ দু-হাতে, তার কোনো ক্রিমট্রিম মাখতে হয় না, ধবধবে ফেনা তুলতে হয় না, যদিও শোভিং ক্রিমের দুটি বিজ্ঞাপন সে নিজ হাতে লিখেছে, পানি লাগিয়েই সে রেজর চালাতে পারে–মসৃণ বিরক্তিকর।
আজ প্যানের ওপর বসে গালটাকে ভিজিয়ে রেজার টান দিতেই ব্লেডের একটা দুরন্ত কোনা গালের ডান পাশে গেথে যায়, একটু কোপে ওঠে হাসান, এবং গালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়া সরু লাল রক্তধারার মতোই গড়িয়ে গড়িয়ে তার মনে আসে ভাবনাটি- আমি সম্ভবত দণ্ডিত মানুষ, আমি কবি।
গাল টিপতে টিপতে একবার সে মনে মনে হেসে ওঠে হো হো করে; কোনো শব্দ হয় না, তবে তার মনে হয়। সে হো হো ক’রে হাসছে; এবং তার সাথে হাসছে শহরের সবাই। খালের পাড়ের সেই মাথায় লাল গামছা চাষীটাও।
বেশ লাগছে হাসানের, আজ ভোরবেলা গালে লাল সরু রক্তধারার মতো চুইয়ে চুইয়ে একটির পর একটি ভাবনা আসছে, ভাবনাগুলো তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। ভাবনার সঙ্গী ও রক্ত মাংসময়।
আমি মানুষ? তাহলে আমি এমন কেনো? আমি কেমন?
ওই ঠেলাগাড়িঅলার মতো নাই কেনো? আমি কি নই? করিমউদ্দিন ব্যাপারীর মতো নাই কেনো? আমি কি নই? নাই কেনো ভেড়ামারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাগল ছাগল ভিসিটার মতো? আমি কি নাই? গাভী গাভী পাটখেতের চাকর চাকর গাধা গাধা। মাননীয়টার মতো নাই কেনো? আমি কি নই? নিচের তলার ওই ভদ্র আর অভদ্রলোকটির মতো নাই কেনো, যে আরো নিচের তলার কাজের মেয়েটিকে সিঁড়িতে দেখলেই একটা সিগারেট ধরিয়ে দাঁড়ায়, হাসে, পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের ক’রে মেয়েটার ব্লাউজের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে হাতটা কিছুক্ষণ চেপে রাখে, যার লিকলিকে বউটি বিয়োয় বছর বছর?
আবার হেসে ওঠে হাসান নিঃশব্দে হো হো ক’রে।
তাহলে আমি মানুষ নই? আমার কি মনে হয় আমি মানুষ নই? স্বাভাবিক মানুষ নাই আমি? নিজেকে জিজ্ঞেস করে হাসান।
তুমি কি মানুষ নও? তুমি কি স্বাভাবিক মানুষ নও? তুমি কি সকালে উঠে ঝরঝর করার জন্যে বাথরুমে ঢোকো না? প্যানের ওপর বসো না সেই চাষীটার মতো, শুধু তোমার অভাব তোমার কোনো নতুন কাটা খাল নেই? পেয়ালা ভ’রে চা খাও না? দু-তিনটি সিগারেট খাও না? একটু কাশো না? ব্রাশ করো না? শোভ করো না? চুল আঁচড়াও না? ভাত খাও না? কাম বোধ করো না? ওই কাজের মেয়েটার দিকে তাকাও না? ধনে পাতার গন্ধে তুমি এলোমেলো হও না? বিলে গিয়ে আজো কি জ্যৈষ্ঠের বৃষ্টিতে তোমার বােয়াল মাছ ধরতে ইচ্ছে করে না? লিফটে আটকে যাওয়ার ভয়ে তোমার কি দম বন্ধ হয়ে আসে না? ইচ্ছে করে না লাফিয়ে। পড়তে? মুহূর্তের জন্যে কি পৃথিবীটাকে তোমার একটা বদ্ধ ঘর মনে হয় না, এবং আধামিনিট ধ’রে তুমি কি ভোগো না ক্লস্ট্রফোবিয়ায়? বেবিঅলার কথায় মাঝেমাঝে রেগে ওঠে না তুমি? তুমি তো সবই করো।
কিন্তু তুমি কবি? ভীষণ হাসি পাচ্ছে তার নিজেকে কবি ভেবে, খুব বিব্রত বোধ করছে, দাড়িঅলা জোব্বাপরা একটি বুড়ো হয়তো মিটিমিটি কিটিকিট হাসছে সব দেয়ালে; হাসান তাড়াতাড়ি ভাবনাটি খুব গভীর গর্তে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে, যাতে কেউ দেখতে না পায়, শুনতে না পায়, গন্ধও না পায়।
নিজেকে কবি ভাবা খুব হাস্যকর, না? হাসান জিজ্ঞেস করে নিজেকে। হাস্যকর, খুবই হাস্যকর, এবং খুবই ভয়ঙ্কর। নিজেকে সে বোঝায়। অন্য সব কিছু স্বাভাবিক-ঠিকাদার হও, কালোবাজারি, আমলা, বেশ্যার দালাল, জোব্বা জজ মেজিস্ট্রেট ব্যারিস্টার হাবিলদার দফাদার চাটনাদার হও, ইস্কুল মাস্টার হও, দারোগী হও, ইন্ডেন্ট গার্মেন্টস ব্যাংক এনজিও দালাল হও; কিন্তু না, কবি না। সমাজ (চমৎকার নর্দমা, মলের স্তূপ, সতী বেশ্যা, অসতী সাধ্বী) কবি চায় না, কবির কোনো দরকার নেই সমাজে।
হাসান সমাজের চুনকামকরা মুখে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিতে চায়; তারপর থুতু আটকে রাখে, এমন নর্দমার ওপর সে খুতু ফেলতে পারবে না।
কবি? কী ক’রে কবি হ’তে পারি। আমি? কবি কাকে বলে? গালে পাঁচটি আঙুল বোলাতে বোলাতে হাসানের মনে হয়।
বেশ কয়েকবার ডান হাতের আঙুলগুলো নরমভাবে সে বোলায় তার গালে, একটু একটু রক্ত এখনাে বেরিয়ে আসছে বাল্যস্মৃতির মতো, বেরোেক। রক্ত, তুমিই হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, বেরোও; তুমি শরীরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছন্দ, নাচো; তুমি হাহাকার, ধ্বনিত হও।
কারো পক্ষেই কবি হওয়া সম্ভব নয়, মানুষের পক্ষে কবি হওয়া সম্ভব নয়। যার লিঙ্গ অণ্ড পাকস্থলি তলপেট আছে, তার পক্ষে কবি হওয়া অসম্ভব। রেজার চালাতে চালাতে আবার মনে হয় হাসানের।
কবি হতে পারি আমি, শুধু যদি আমি মানুষ না হই।
হাসানের আবার মনে হয়, মানুষের পক্ষে কবি হওয়া অসম্ভব।
কটি পদ্য লিখেছি? কটি কবিতা? একশো আশিটি হবে?
ঠিক মনে পড়ছে না তার, আবার মনের ভেতরে হো হে ক’রে হাসে হাসান। কোনো শব্দ হয় না, কিন্তু তার মনে হয় সে খুব উচ্চকণ্ঠে হাসছে, তার হাসি শুনতে পাচ্ছে সবাই।
কবি হ’তে হ’লে এই গরিব দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার কবিতা লিখতে হয় না? ঈদে আর কোরবানিতে কবিতা লিখতে হয় না?
ওর খালাশ হওয়ার দিনে তার ইন্তেকালের দিনে কবিতা লিখতে হয় না?
এই মাসের দশ তারিখে সেই মাসের চোদ্দো তারিখে কবিতা লিখতে হয় না?
হা হা ক’রে হাসে হাসান।
একাশিটা কাইব্য থাকতে হয় না?
হাসান নিজেকে বলে, তোমার তা কখনো হবে না।
এখন তোমার চারটি, সারাজীবনে হয়তো দশটি, যদি বেঁচে থাকো। তুমি কি বেঁচে থাকবে? বেঁচে থাকা কি খুবই দরকার?
প্যানের কাজ সেরে হাসান সিংকের সামনে দাডিয়ে ব্ৰাশে পেস্ট লাগায়, সবুজ রঙের পেস্টটাকে তার ঘেন্না লাগে, আসলেই ঘেন্না লাগে? না, হয়তো তার ভালোই লাগছে পেস্টটাকে; বেশ টিপতে হয় টিউবটাকে, নইলে বেরোয় না। তার মনে হয়। সে টিউবটাকে ভাঙছে, সে মনে মনে বলে, ভাঙতে হয় ভাঙতে হয়, কবিতার জন্যে শুধু অনবরত ভাঙতে হয়।
আমি কি নিজেকে যথেষ্ট ভেঙেছি, নইলে কবি হবো কীভাবে?
ব্ৰাশ করতে করতে নিজের নামটা মনে পড়ে হাসানের।
মোহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার। নিঃশব্দে হো হো ক’রে হাসে হাসান, বেশ নাম রেখেছিলেন শ্ৰদ্ধেয় আব্বাজান, দারোগার ছেলের জন্যে ফাসক্যালাস নাম। এই নামটাই আছে নোংরা সাটিফিকেটে, যদিও সাটিফিকেটগুলো কোথায় আছে তার মনে নেই; মোহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার, পিতা মোহাম্মদ রশিদ আলি তালুকদার। দারোগার পোলার নাম হিশেবে অনবদ্য। সে যদি দারোগা হতো, আর তার নাম যদি হতো মোহাম্মদ রশিদ আলি তালুকদার, তাহলে সে নিজের পুত্রের এই নামই রাখতো।
কিন্তু এই নামে কি কেউ কবি হ’তে পারে? কবি মোহাম্মদ আবুল হোসেন তালুকদার? আবার হেসে ওঠে হাসান।
নিজের নামটিকেই সে প্রথম ভেঙেছে, প্রথম ভাঙতে হয়েছে; এবং দিন দিন নিজেকে ভাঙছে, আরো যে কতো ভাঙতে হবে–আর কিছু নয়, শুধু কবি হওয়ার জন্যে, দণ্ডিত মানুষ হওয়ার জন্যে ভেঙে ভেঙে চলা। নিজেকে ভাঙো, শব্দ ভাঙে, বাক্য ভাঙো, বাঙলা ভাষাকে ভাঙো, এবং নিরস্তর ভেঙে ভেঙে চলো। ভেঙে ভেঙে সৃষ্টি করো না, ভাঙলে কী সৃষ্টি করবে তুমি, হাসান রশিদ?
কিন্তু কবি আমি হ’তে পারবো না? হাসানের মনে হয়।
তখন সে এক গাছে ঢাকা পানিঘেরা গর্দভ মফস্বল শহর থেকে পাশ ক’রে ঢাকা এসেছে, খুব ভীরু পায়ে হাঁটছে সিংহ শহরে, শহর বুঝতে পারছে এক আগন্তুক এসেছে। দারোগা মোহাম্মদ রশিদ আলি তালুকদার চেয়েছিলেন তার স্টার পাওয়া মেধাবী ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, দশ হাতে টাকা বানাবে, দালানের পর দালান তুলবে, কিন্তু সে ঢাকা এসে কাপতে কাঁপতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলায় ভর্তি হয়ে যায়। প্রথম দু-তিন মাস বাড়ির কাউকেই জানায় নি কোথায় সে ভর্তি হয়েছে। সে জানতো বাঙলা কে পছন্দ করে? দারোগারাও বাঙলা পছন্দ করে না, বেশ্যারাও করে না, রাজনীতিবিদেরাও পছন্দ করে না, বাঙলা হচ্ছে শ্লোগান। বাঙলায় ভর্তি–এটা এক ভাঙা ভাঙি, তালুকদার সাহেব বছর তিনেক তার মুখও দেখেন নি, ইঞ্জিনিয়ার ছেলের বাপ হ’তে না পারার দুঃখে পিতা দারোগা সাহেব মালপানি খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, পনেরো বছরের কাজের মেয়েটিকে, যে-মেয়েটির বুকে সে নিজেও একবার হাত দিয়েছিলো যে-মেয়েটির বুক খুবই নরম ছিলো যে-মেয়েটি তার কাছে একবার কবিতা শুনতে চেয়েছিলো, সেই মেয়েটিকে বিবাহেরও উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
হাসানের মনে হয়, আমরা কেউ একা নিজেকে ভাঙতে পারি না, নিজেকে ভাঙার সময় প্রিয়দেরও ভাঙি। সেই ভাঙা চলছে, চলবে চিরকাল, চলবে।
“কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ” প্রবন্ধ বা উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ