ইমাম বুখারী (রঃ) ‘ফাযায়িলুল কুরআন’ অধ্যায়ে উপরোক্ত শিরোনামে একটি পরিচ্ছেদ রচনা করিয়াছেন। তিনি উক্ত শিরোনামের সহিত নিম্নোক্ত শিরোনাম যুক্ত করিয়াছেনঃ
قاقر أوا مَاتَيْسَرَ مثه (অতঃপর উহা হইতে যতটুকু পার তিলাওয়াত কর।)
আয়াতের তাৎপর্যঃ সুফিয়ান হইতে ধারাবাহিকভাবে আলী ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেন যে, সুফিয়ান বলেনঃ
‘একদা ইব্ন শুবরুমা আমাকে বলিলেন- নামাযে কুরআন মজীদের কতটুকু তিলাওয়াত করা একটি লোকের জন্যে যথেষ্ট তদ্বিষয়ে আমি চিন্তা করিয়াছি। তিন আয়াত হইতে কম আয়াত বিশিষ্ট কোন সূরা আমি পাই নাই। আমি (সুফিয়ান) বলিলাম- নামাযে তিন আয়াতের কম তিলাওয়াত করা কাহারও জন্যে ঠিক নহে।
হযরত আবূ মাসউদ বদরী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আলকামা (ইব্ন কয়স), আবদুর রহমান ইব্ন ইয়াযীদ, ইবরাহীম, মানসূর, সুফিয়ান, আলী ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘যে ব্যক্তি রাত্রিতে সূরা বাকারার শেষ দুইটি আয়াত তিলাওয়াত করিবে, তাহার জন্যে উহা যথেষ্ট হইবে।’ রাবী আবদুর রহমান ইব্ন ইয়াযীদ বলেন- একদা হযরত আবূ মাসউদ (রাঃ) বায়তুল্লাহ্ শরীফ তাওয়াফ করিতেছিলেন। সে সময়ে তিনি সরাসরি আমার নিকটও উপরোক্ত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
ইতিপূর্বে উল্লেখিত হইয়াছে যে, উক্ত হাদীস ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে। সনদের অন্যতম রাবী আলী হইতেছেন আলী ইব্ন মাদীনী। তাঁহার উস্তাদ হইতেছেন সুফিয়ান ইব্ন উয়াইনা। সুফিয়ান ইব্ন উয়াইনার আরেক নাম আবদুল্লাহ্ ! তিনি কূফা নগরীর অধিবাসী ছিলেন। তিনি একজন বিশিষ্ট ফকীহ ছিলেন। তাঁহার উপরোল্লেখিত অভিমত সুচিন্তিত অভিমত বটে।
‘সুনান’ সংকলনে বর্ণিত হইয়াছে যে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘ফাতিহা শরীফ এবং অন্য তিনটি আয়াত তিলাওয়াত করা ব্যতীত নামায হয় না। কিন্তু হযরত আবূ মাসউদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত পূর্বোক্ত হাদীসই অধিকতর সহীহ ও বিখ্যাত। তবে বক্ষ্যমান পরিচ্ছেদের শিরোনামের সহিত উহার সম্পর্ক খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। বরং উহার সহিত সুফিয়ান ইব্ন উয়াইনার অভিমতের সম্পর্ক সুস্পষ্ট ও সুপরিজ্ঞেয়।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে মুজাহিদ, মুগীরাহ, আবূ উয়াইনা, মূসা ইব্ন ইসমাঈল ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রাঃ) বলেনঃ
‘আমার পিতা আমাকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের একটি মহিলার সহিত বিবাহ করাইয়া দিলেন। তিনি স্বীয় পুত্রবধুর খোঁজ-খবর লইতেন। তিনি তাহার নিকট আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেন। আমার স্ত্রী আমার সম্বন্ধে বলিত- লোকটি বড়ই ভালো; তবে কথা এই যে, সে তাহার নিকট আমার আগমনের পর হইতে এই পর্যন্ত কোন দিন না আমার শয্যাসঙ্গী হইয়াছে আর না আমার সহিত নির্জনে একটু সময় কাটাইল। আমার পিতা দীর্ঘদিন ধরিয়া পুত্রবধূর নিকট হইতে আমার বিরুদ্ধে উপরোক্তরূপ অনুযোগ শুনিবার পর একদা তৎসম্বন্ধে নবী করীম (সাঃ)-কে অবহিত করিলেন। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘তাহাকে লইয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিও।’ আমি নবী করীম (সাঃ)-এর খেদমতে নীত হইলাম। তিনি আমার নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘তুমি কিভাবে রোযা রাখিয়া থাকো?” আমি আরয করিলাম- আমি প্রতিদিন রোযা রাখি। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘তুমি কুরআন মজীদ কিভাবে খতম করিয়া থাকো?’ আমি আরয করিলাম- আমি প্রতি রাত্রিতে একবার সমগ্র কুরআন মজীদ খতম করিয়া থাকি। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘প্রতিমাসে তিন দিন করিয়া রোযা রাখিও এবং প্রতিমাসে একবার করিয়া কুরআন মজীদ খতম করিও।’ আমি বলিলাম- আমি উহা অপেক্ষা অধিকতর সংখ্যায় রোযা রাখিতে পারি এবং অধিকতর পরিমাণে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে পারি। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘তুমি প্রতি মাসে দিনে তিনটি করিয়া রোযা রাখিও।’ আমি আরয করিলাম- আমি উহা অপেক্ষা অধিকতর পরিমাণে ইবাদত করিতে পারি। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- প্রতি তিন দিনের তৃতীয় দিনে রোযা রাখিও। আমি আরয করিলাম- আমি উহা অপেক্ষা অধিকতর ইবাদত করিতে পারি। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘রোযা রাখিও; তবে রোযা রাখিবার সর্বোত্তম পন্থা হইতেছে হযরত দাউদ (আঃ)-এর অনুসৃত রোযা রাখিবার পন্থা। উহা হইল একদিন পর একদিন রোযা রাখা। তাহা ছাড়া প্রতি সপ্তাহে একবার করিয়া কুরআন মজীদ খতম করিও।’
হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রাঃ) বলেন- ‘আহা ! যদি আমি নবী করীম (সাঃ) কর্তৃক সর্বপ্রথম প্রদত্ত অনমুতিকে বরণ করিয়া লইতাম, তবে কতো ভালো হইত ! কারণ, আমি এখন বৃদ্ধ ও দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি।’ বৃদ্ধ অবস্থায় তিনি স্বীয় পরিবারের জনৈক সদস্যকে দিনের বেলায় কুরআন মজীদের এক সপ্তমাংশ তিলাওয়াত করিয়া শুনাইতেন। প্রথম জীবনে রাত্রিতে কুরআন মজীদ যতটুকু তিনি তিলাওয়াত করিতেন, বৃদ্ধাবস্থায় দিনের বেলায় ততটুকু তিলাওয়াত করিয়া শুনাইতেন, যাহাতে রাত্রিতে তিনি কম ক্লান্ত হন। আর যখন তিনি বেশী দুর্বল হইয়া পড়িতেন, তখন তিনি শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে হিসাব রাখিয়া কয়েক দিন রোযা রাখা বন্ধ করিতেন। অতঃপর শক্তি সঞ্চয় হইলে নির্ধারিত সংখ্যক দিনগুলিতে রোযা রাখিতেন, যাহাতে নবী করীম (সাঃ) কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ লঙ্ঘিত না হয়।
কেহ কেহ বলেন- প্রতি তিন দিনে একবার করিয়া সমগ্র কুরআন মজীদের তিলাওয়াত সম্পন্ন করা সমীচীন। কেহ কেহ বলেন- প্রতি পাঁচ দিনে একবার করিয়া কুরআন মজীদের তিলাওয়াত সম্পন্ন করা সমীচীন। তবে অধিকাংশ ফিকাহবিদ বলেন- প্রতি সাত দিনে একবার করিয়া কুরআন মজীদ খতম করা সমীচীন।
ইমাম বুখারী উপরোক্ত হাদীস ‘সিয়াম অধ্যায়ে’ও বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম নাসায়ী উহা উপরোক্ত রাবী মুগীরা (রাঃ) হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং মুগীরা হইতে ধারাবাহিকভাবে শু’বা, গুনদুর ও বিনদারের ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন ৷ আবার তিনি উহা উপরোক্ত রাবী মুজাহিদ হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং মুজাহিদ হইতে হিসীন প্রমুখ রাবীর ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন।
আবূ সালামা হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ)-এর মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম মুহাম্মদ ইব্ন আবদুর রহমান, ইয়াহিয়া ইব্ন আবূ কাছীর প্রমুখ রাবীর সনদে ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম ও ইমাম আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেন যে, রাবী মুহাম্মদ ইব্ন আবদুর রহমান বলেন- আমার মনে পড়ে আবূ সালামা আমার নিকট হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রাঃ) হইতে নিম্নরূপ বর্ণনা প্রদান করেনঃ
‘হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রাঃ) বলেন যে, একদা নবী করীম (সাঃ) আমাকে বলিলেন- তুমি প্রতি মাসে একবার করিয়া সমগ্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত সম্পন্ন করিও । আমি আরয করিলাম- আমি উহার অধিক তিলাওয়াতের জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তির অধিকারী। নবী করীম (সা) বলিলেন- ‘তবে তুমি প্রতি সপ্তাহে একবার করিয়া কুরআন মজীদ খতম করিও। তদপেক্ষা অতিরিক্ত তিলাওয়াত করিও না।’
উক্ত হাদীস দ্বারা বাহ্যত প্রমাণিত হয় যে, এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে কুরআন মজীদ খতম করা নিষিদ্ধ। ইমাম আবূ উবায়দ কর্তৃক বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারাও উহাই প্রমাণিত হয় ৷
হয়রত কয়স ইব্ন সা’সাআ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ওয়াসে, হাব্বান ইব্ন ওয়াসে, ইব্ন লাহীআ, হাজ্জাজ, উমর ইব্ন তারিক, ইয়াহিয়া ইব্ন বুকায়র ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
একদা হযরত কয়স (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর খেদমতে আরয করিলেন- হে আল্লাহ্ রাসূল ! আমি কতদিনে সমগ্র কুরআন মজীদ একবার খতম করিব? নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘প্রতি পনের দিনে একবার।’ হযরত কয়স (রাঃ) আরয করিলেন- আমি উহা অপেক্ষা অধিক পরিমাণে তিলাওয়াত করিতে সমর্থ। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘তবে প্রতি সপ্তাহে একবার।’
হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর পুত্র আবদুর রহমান হইতে ধারাবাহিকভাবে মুহাম্মদ ইব্ন যাকওয়ান, শু’বা, হাজ্জাজ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ রমযান মাস ভিন্ন অন্য সময়ে প্রতি সপ্তাহে একবার করিয়া কুরআন মজীদ খতম করিতেন।
আবূ মাহলাব হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ কুলাবাহ, আইয়ুব, শু’বা, হাজ্জাজ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত উবাই ইব্ন কা’ব (রাঃ) প্রতি আট দিনে একবার করিয়া এবং হযরত তামীম দারী (রাঃ) প্রতি সাত দিনে একবার করিয়া কুরআন মজীদ খতম করিতেন।’
ইবরাহীম হইতে ধারাবাহিকভাবে আ’মাশ, হাশীম ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ “হযরত আসওয়াদ প্রতি ছয় দিনে একবার করিয়া এবং হযরত আলকামা প্রতি পাঁচ দিনে একবার করিয়া কুরআন মজীদ খতম করিতেন।’
উল্লেখিত রিওয়ায়েত দ্বারা যাহা প্রমাণিত হয়, তাহা সুস্পষ্ট। কিন্তু অন্যান্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, উল্লেখিত রিওয়ায়েতে বর্ণিত সময় অপেক্ষা স্বল্পতর সময়েও সমগ্র কুরআন মজীদ খতম করা যায়। হযরত সা’দ ইব্ন মুনযির আনসারী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ওয়াসে’, হাব্বান ইব্ন ওয়াসে’, ইব্ন লাহীআ, হাসান ও ইমাম আহমদ স্বীয় মুসনাদ সংকলনে বর্ণনা করিয়াছেনঃ
একদা হযরত সা’দ ইব্ন মুনযির আনসারী (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর খেদমতে আরয করিলেন- হে আল্লাহর রাসূল ! আমি কি তিন দিনে একবার করিয়া সমগ্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত সম্পন্ন করিব? নবী করীম (সা) বলিলেন- ‘হ্যাঁ।’ রাবী বলেন যে, হযরত সা’দ (রাঃ) আমৃত্যু উপরোক্ত নিয়মে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিয়াছেন। উক্ত হাদীসের সনদ অত্যন্ত শক্তিশালী। উহার অন্যতম রাবী হাসান ইব্ন মূসা আশিয়াব একজন বিশ্বস্ত রাবী। তাঁহার মর্যাদা সর্বজন স্বীকৃত। সিহাহ সিত্তার সংকলকগণ তাঁহার মাধ্যমে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।’ অপর এক রাবী ইব্ন লাহীআর মধ্যে অবশ্য দুইটি ত্রুটি ছিলঃ (১) তাদলীস (التدليس) অর্থাৎ হাদীস বর্ণনায় বর্ণনকারীর স্বীয় উস্তাদের নাম উহ্য রাখা ও তদস্থলে উস্তাদের পূর্ববর্তী রাবীর নাম উল্লেখ করা এবং বর্ণনাকারী সরাসরি তাহার নিকট সংশ্লিষ্ট হাদীসটি শুনিয়াছেন বলিয়া ধারণা দেওয়া। (২) স্মৃতি শক্তির দুর্বলতা। তবে উপরোক্ত হাদীসের বর্ণনায় তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করিয়াছেন যে, তিনি হাব্বান ইব্ন ওয়াসে’র নিকট উহা শ্রবণ করিয়াছেন। ইব্ন লাহীআ মিশরের তৎকালীন একজন শীর্ষস্থানীয় আলিম ছিলেন। তাঁহার উস্তাদ হাব্বান এবং হাব্বানের পিতা ওয়াসে’ ইব্ন হাব্বান উভয়েই নেককার মুসলমান ছিলেন। হযরত সা’দ ইব্ন মুনযির (রাঃ) হইতে সিহাহ সিত্তার কোন সংকলক হাদীস বর্ণনা না করিলেও আলোচ্য হাদীসের সনদ সিহাহ সিত্তার অনেক সংকলকের নিজস্ব শর্তাবলীর নিরীখে টিকে। আলোচ্য হাদীসের সনদ তাহাদের নিকট প্রত্যাখ্যেয় নহে। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।
হযরত সা’দ ইব্ন মুনযির আনসারী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ওয়াসে’, হাব্বান ইব্ন ওয়াসে’, লাহীআ ইব্ন বুকায়র ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ একদা হযরত সা’দ (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর খেদমতে আরয করিলেন- হে আল্লাহর রাসূল ! আমি প্রতি তিন দিনে একবার করিয়া সমগ্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত সম্পন্ন করিব? নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- “হ্যাঁ, যদি তোমার শক্তিতে কুলায়।’ রাবী বলেন- হযরত সা’দ (রাঃ) আমরণ উপরোক্ত নিয়মে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিয়াছেন।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ইয়াযীদ ইব্ন আবদুল্লাহ্ ইব্ন খুমায়ের, কাতাদাহ, হুমাম, ইয়াযীদ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘তিন দিনের কম সময়ের মধ্যে সমগ্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত সম্পন্ন করিলে তুমি কুরআন মজীদের মর্ম উপলব্ধি করিতে সমর্থ হইবে না।’ ইমাম আহমদ এবং অন্য চারিজন ‘সুনান’ সংকলকও উক্ত হাদীস উপরোক্ত রাবী কাতাদাহ হইতে উক্ত অভিন্ন উর্ধ্বতন সনদাংশে এবং বিভিন্ন অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম তিরমিযী উহাকে সহীহ ও গ্রহণযোগ্য হাদীস বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আম্মারাহ বিনতে আবদুর রহমান, তাইয়েব ইব্ন সুলায়মান, ইউসুফ ইব্ন উরফ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ “নবী করীম (সা) তিন দিন অপেক্ষা অল্প সময়ে কুরআন মজীদ খতম করিতেন না।’ উক্ত হাদীস অন্য কোন মাধ্যমে বর্ণিত হয় নাই। উহার সনদ দুর্বল। কারণ ইমাম দারা কুতনী উহার অন্যতম রাবী তাইয়েব ইব্ন সুলায়মানকে দুর্বল রাবী বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। তাহা ছাড়া সে মুহাদ্দিসগণের নিকট তেমন পরিচিতও নহে। আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।
পূর্বসূরী বহু ফকীহ তিন দিনের কম সময়ে কুরআন মজীদ খতম করা মাকরূহ বলিয়াছেন। ইমাম আবূ উবায়দ, ইসহাক ইব্ন রাহবিয়াহ প্রমুখ পরবর্তী যুগের ফকীহগণও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন।
আবুল আলীয়া হইতে ধারাবাহিকভাবে হাফস, হিশাম ইব্ন হাস্সান, ইয়াযীদ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ আবুল আলীয়া বলেন- ‘হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রাঃ) তিন দিন অপেক্ষা কম সময়ে কুরআন মজীদ খতম করা অপছন্দ করিতেন।’ উক্ত রিওয়ায়েত সহীহ।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ উবায়দা, আলী ইব্ন বুযায়মাহ, সুফিয়ান, ইয়াযীদ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত আবদুল্লাহ্ (রাঃ) বলেন- ‘তিন দিনের কম সময়ে সমগ্র কুরআন মজীদ খতম করা গুনাহর কাজ।’ হযরত আবদুল্লাহ্ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ উবায়দা, আলী ইব্ন বুযায়মাহ, শু’বা, হাজ্জাজ ও ইমাম আবূ উবায়দ উপরোক্তরূপ রিওয়ায়েত বর্ণনা করিয়াছেন।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে তৎপুত্র আবদুর রহমান, মুহাম্মদ ইব্ন যাকওয়ান, শু’বা, হাজ্জাজ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ ‘হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) রমযান মাসে প্রতি তিন দিনে একবার করিয়া কুরআন মজীদ খতম করিতেন।’ উক্ত রিওয়ায়েতের সনদ সহীহ।
উপরোক্ত রিওয়ায়েতসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ‘পূর্বসূরী ও উত্তরসূরী বিপুল সংখ্যক ফকীহ ও বিজ্ঞ ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন মজীদ খতম করা অপছন্দ করিতেন। পক্ষান্তরে ইহাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পূর্ববর্তী বিপুল সংখ্যক ফকীহ ও বিজ্ঞ ব্যক্তি তিন দিন অপেক্ষা কম সময়ে সমগ্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত সম্পন্ন করিতে অনুমতি প্ৰদান করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে আমীরুল মু’মিনীন হযরত উসমান (রাঃ)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সায়েব ইব্ন ইয়াযীদ হইতে ধারাবাহিকভাবে ইব্ন খাসীফ, জুরায়জ, হাজ্জাজ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ ‘সায়েব ইব্ন ইয়াযীদ বলেন- একদা জনৈক ব্যক্তি আবদুর রহমান ইবন উসমান তায়মীর নিকট হযরত তালহা ইব্ন উবায়দুল্লাহর নামায সম্বন্ধে প্ৰশ্ন করিলে তিনি লোকটিকে বলিলেন- তুমি চাহিলে আমি তোমাকে হযরত উসমান (রাঃ)-এর নামায সম্বন্ধে তথ্য প্রদান করিতে পারি। লোকটি বলিল- তাহাই করুন। তিনি (আবদুর রহমান) বলিলেন- ‘একদা আমি সিদ্ধান্ত করিলাম, আজ সারা রাত জাগিয়া থাকিব। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাত্রিতে নামাযে দাঁড়াইলাম। আমার পার্শ্বেই একটি লোক স্বীয় মস্তক বস্ত্রাবৃত করিয়া নামায আদায় করিতেছিল। লোকটির কারণে আমার নামাযের স্থান সংকুচিত হইয়া গিয়াছিল। লক্ষ্য করিয়া দেখি— তিনি হযরত উসমান (রাঃ)। আমি পিছনে সরিয়া গেলাম। তিনি নামায আদায় করিতে লাগিলেন। তিনি যতটুকু সময় ধরিয়া কিরাআত পড়িতেন, ততটুকু সময় ধরিয়া সিজদা করিতেন। এক সময়ে আমি বলিলাম- পূর্বদিকে ফজরের পূর্ববর্তী চিহ্ন পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। ইহা শুনিয়া তিনি মাত্র এক রাকআত বেজোড় নামায আদায় করিলেন। তিনি উহা ব্যতীত অন্য কোন নামায আদায় করিলেন না।’ উক্ত রিওয়ায়েতের সনদ সহীহ।
ইবন সীরীন হইতে ধারাবাহিকভাবে মানসূর, হাশীম ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেন যে, ইব্ন সীরীন বলেনঃ বিদ্রোহীগণ হযরত উসমান (রাঃ)-কে হত্যা করিবার উদ্দেশ্যে তাঁহার গৃহে প্রবেশ করিলে তাঁহার স্ত্রী নায়েলা বিনতে কুরাফসাহ কালবিয়া তাহাদিকে বলিয়াছিলেন— ‘তোমরা তাঁহাকে হত্যাই কর অথবা উহা হইতে বিরত থাক; (জানিয়া রাখ তিনি সারারাত জাগিয়া নামায আদায় করেন এবং এক রাকআত নামাযে সমগ্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করেন।’ উক্ত রিওয়ায়েতের সনদ গ্রহণযোগ্য ।
ইব্ন সীরীন হইতে ধারাবাহিকভাবে ইব্ন সুলায়মান, আবূ মুআবিয়া, আসিম ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেন যে, ইব্ন সীরীন বলেনঃ ‘হযরত তামীম দারী (রাঃ) এক রাকআত নামাযে সমগ্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতেন।’
সাঈদ ইব্ন জুবায়র হইতে ধারাবাহিকভাবে হাম্মাদ শু‘বা, হাজ্জাজ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেন যে, সাঈদ ইব্ন জুবায়র বলেন- ‘আমি বায়তুল্লাহ্ শরীফে দাঁড়াইয়া এক রাকআত নামাযে সমগ্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিয়াছি।’
আলকামা হইতে ধারাবাহিকভাবে ইবরাহীম, মানসূর, জারীর ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেন- ‘আলকামা এক রাত্রিতে সমগ্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিয়াছেন। তিনি সাতবার বায়তুল্লাহ্ শরীফ তাওয়াফ করিয়াছেন। অতঃপর মাকামে ইবরাহীমে আসিয়া নামায আদায় করিয়াছেন। উক্ত নামাযে কুরআন মজীদের শত আয়াত বিশিষ্ট দীর্ঘ সূরা সমষ্টি তিলাওয়াত করিয়াছেন। আবার সাতবার বায়তুল্লাহ্ শরীফ তাওয়াফ করিয়াছেন। অতঃপর মাকামে ইবরাহীমে আসিয়া নামায আদায় করিয়াছেন। উক্ত নামাযে কুরআন মজীদের নাতিদীর্ঘ সূরা সমষ্টি তিলাওয়াত করিয়াছেন। পুনরায় সাতবার বায়তুল্লাহ্ শরীফ তাওয়াফ করিয়াছেন। অতঃপর মাকামে ইব্রাহীমে আসিয়া তথায় নামায আদায় করিয়াছেন। উক্ত নামাযে কুরআন মজীদের অবশিষ্টাংশ তিলাওয়াত করিয়াছেন।’ উপরোক্ত সমুদয় রিওয়ায়েতের সনদই সহীহ।
ইব্ন আবূ দাউদ মুজাহিদ সম্পর্কে বর্ণনা করিয়াছেন যে, তিনি (মুজাহিদ) মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে কুরআন মজীদ খতম করিতেন। মানসূর হইতে ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ আলী ইযদী রমযান মাসের প্রতি রাত্রিতে মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে কুরআন মজীদ খতম করিতেন। ইবরাহীম ইবন সা’দ বর্ণনা করিয়াছেন যে, মানসূর ইব্ন সা’দ বলেন- ‘আমার পিতা স্বীয় পৃষ্ঠ ও হাঁটুকে একত্রে বাঁধিয়া রাখিতেন। যতক্ষণ সমগ্র কুরআন মজীদের তিলাওয়াত খতম না করিতেন, ততক্ষণ বাঁধন খুলিতেন না।
আমি (ইব্ন কাছীর) বলিতেছি- ‘মানসূর ইব্ন যাযান সম্বন্ধেও বর্ণিত রহিয়াছে, তিনি জোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে একবার এবং মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে একবার কুরআন মজীদ খতম করিতেন। তবে তাহারা ইশার নামায বিলম্বে আদায় করিতেন। ইমাম শাফেঈ সম্বন্ধে বর্ণিত রহিয়াছে, তিনি রমযান মাসে প্রতি দিবা-রাত্রিতে দুইবার করিয়া এবং রমযান মাস ভিন্ন অন্য সময়ে প্রতি দিবা-রাত্রিতে একবার করিয়া কুরআন মজীদ খতম করিতেন।’
এতদসম্পর্কিত সর্বাধিক বিস্ময়কর ঘটনা হইতেছে শায়খ আবূ আবদুর রহমান সালমী সূফী কর্তৃক বর্ণিত ঘটনা। তিনি বলেন- আমি শায়খ আবূ উসমান মাগরেবীর নিকট শুনিয়াছি যে, ইব্ন কাতিব দিনে চারিবার এবং রাত্রিতে চারিবার করিয়া কুরআন মজীদ খতম করিতেন।(১)
ইহা অতিশয় বিস্ময়কর ঘটনা বটে। উক্ত ঘটনা এবং উহার অনুরূপ অন্যান্য ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা এই যে, এই সকল ব্যক্তির নিকট পূর্ব বর্ণিত হাদীস পৌঁছে নাই বলিয়া তাঁহারা এত দ্রুতগতিতে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতেন ও তদবস্থায়ই উহা সম্বন্ধে চিন্তা করিতে এবং উহার মর্ম উপলব্ধি করিতে পারিতেন। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।
শায়খ আবূ যাকারিয়া নববী স্বীয় ‘বয়ান’ গ্রন্থে উপরোক্ত বর্ণনাসমূহের কিয়দংশ উদ্ধৃত করিবার পর মন্তব্য করিয়াছেনঃ একটি লোকের পক্ষে প্রতিদিন কুরআন মজীদের কতটুকু অংশ তিলাওয়াত করা সমীচীন এই বিষয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিধান দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত। যাহাকে আল্লাহ্ তা’আলা গভীর সূক্ষ্ম জ্ঞান ও চিন্তা-ভাবনার অধিকারী করিয়াছেন, তাহার জন্যে ইহাই সমীচীন যে, তিনি গভীর সূক্ষ্ম জ্ঞান দ্বারা কুরআন মজীদের যতটুকু অংশের মর্ম ও তাৎপর্য সম্যকরূপে গ্রহণ করিতে পারেন, ততটুকু অংশই তিলাওয়াত করিবেন। যাহারা দীনী ইলম প্রচার অথবা অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ দীনী কার্যে রত রহিয়াছেন, তাহারা উক্ত কার্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করিয়া যতটুকু অংশ তিলাওয়াত করা সম্ভবপর, ততটুকু অংশ তিলাওয়াত করিবেন। আর অন্যান্য মানুষ যতক্ষণ তিলাওয়াতে অনীহা ও অনিচ্ছা না আসে, ততক্ষণ তিলাওয়াত করিবে।